মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান
আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে সমালোচনার শেষ নাই। সবচাইতে বড় সমালোচনা হলো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিরাজমান রাজনৈতিক বিভেদ এবং দলাদলি। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিশ্ব-শিক্ষায় অবস্থান দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে সামগ্রিক অর্থে। এই পিছিয়ে পড়ার মানে কি এই যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন পুরোপুরি ব্যর্থ ও সম্ভাবনাহীন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে? রাজনীতির কবলে পড়ে এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো “ওয়াসা” অথবা “আদমজী” হয়ে পড়েছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজ়ার জন্য, আমি মনে করি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এই সঙ্কটকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা খুব জরুরী।
আসলে রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণে জাহাঙ্গীরনগর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ঐতিহ্যগত ভুমিকা একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের জন্ম দিয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যই এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য অন্যতম বিপদ হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রে যারাই ক্ষমতাসীন কিংবা ক্ষমতাচ্যুত হন, তারাই এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করার ব্যপারটিকে অন্য যে কোনো রাজনৈতিক বিষয়ের চাইতে কম গুরুত্ব দেন না। ফলে অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তাই রাষ্ট্রের সাথে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সম্পর্কের ভিত্তি হয়ে ওঠে। আর সেটা কাটাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনরা একদিকে যেমনি তাদের নিজস্ব ছাত্র সংগঠনের দ্বারা বলপ্রয়োগের আশ্রয় নেন, অন্যদিকে একরকমের পোষক-পোষিতের (পেট্রন-কায়েন্ট) কাঠামোর বিকাশ ও লালনকে মূল কাজ বলে মনে করেন। মূলত এই কাঠামোটি সামরিক সরকারগুলোর ধারাবাহিকতায় ‘গণতান্ত্রিক’ রাজনৈতিক দলগুলোও এখন পর্যন্ত ব্যবহার করে আসছে। আর এই সুযোগে ব্যক্তিপর্যায়ে অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা ও রাজনৈতিক ক্ষমতার ভাগ পাওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের একটি অংশ সাদা-নীল-আকাশী-হলুদ বর্ণে বিভক্ত হয়ে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোকে তোষনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর এটার একটা বড় কারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালগুলোর শিক্ষকদের জীবনযাপনে স্বাভাবিক মানের অনিশ্চয়তা আর অভাববোধ। শিক্ষার্থীরাও একই অবস্থার শিকার। তাদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টির প্রাথমিক সূচনা ঘটে হলে আসন পাওয়াকে কেন্দ্র করে।
রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা ও আধিপত্য বিস্তারই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে এবং এর বিকাশের ধারাকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করছে প্রতিনিয়ত। তাই ক্ষমতার পট পরিবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে যারা অধিষ্ঠিত হন, তাদেরকে টিকে থাকার জন্য উচ্চশিক্ষার মানের উন্নয়ন নিশ্চিত করার উপর নির্ভর করতে হয় না। বরং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সাথে সুসম্পর্কটাই মূল নিয়ামক। তারপরও এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষার্থী আকৃষ্ট করার জন্য বাজারকেন্দ্রিক চটকদারি বিজ্ঞাপনের উপর নির্ভর করতে হয়না। কেননা অর্থনৈতিকভাবে সামর্থ্যহীন অথবা কম সামর্থ্যের মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো অন্যতম ভরসা কিংবা আস্থার জায়গা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে একপেশে সমালোচনা দাতাগোষ্ঠীর বেসরকারীকরণের দর্শণ আর প্রক্রিয়াকে আরো অনেক বেশী শক্তিশালী করে। এতে বঞ্ছিত মানুষগুলোর শিক্ষা-বঞ্চনার ক্ষেত্র আরো বেশী প্রসারিত আর শক্তিশালী হয়, অন্য কিছু নয় । স্কুল আর কলেজ পর্যায়ে এটা এখন রূঢ় বাস্তবতা। দরিদ্র, নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তের জন্য সরকারী স্কুল-কলেজে পড়াটা যেন এখন একটা মহাপাপের ভাগীদার হওয়া! যাদের আর্থিক সামর্থ্য আছে, স্ংগতি আছে, তারা আর এই মহাপাপের ভাগীদার হতে চায়না। সব কিছু দেখে শুনে মনে হছে এখন মনে হয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পালা শুরু হয়েছে!
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমস্যা রাজনৈতিক বোধের লালনে বা রাজনৈতিক ঐতিহ্যে নয়, প্রশাসনিক কাঠামোতে যে অপরাজনীতি ও দুষ্ট রাজনীতি বাসা বেঁধেছে সেটাই মূল সমস্যা। এই সংকটপূর্ণ কাঠামোর সাথে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্ত হয়েছে আরো দু‘টি নতুন বিষয়। তার মধ্যে একটি হলো শিক্ষকদের এনজিও কার্যক্রমে অংশগ্রহন এবং অপরটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়া। অথচ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে যখন সমালোচনা হয় তখন অনেকের মাঝে একটা বড় প্রবণতা দেখা যায় যে, ‘নন্দঘোষ রাজনীতিকে’ সবসময় দোষারোপ করা। অথচ অপরাজনীতি উৎপাদনকারী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনিক কাঠামো নিয়ে কোনো বিশ্লেষণ কিংবা আলোচনা হয়না! বর্তমান সময়ের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন এবং চীনসহ আজকে যদি এ রকম আরও কয়েকটি দেশের উন্নয়নের কথা চিন্তা করা হয়, তাহলে ঐ সব দেশের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম অবধারিতভাবে সামনে চলে আসে। এটা শুধু ‘তথ্য ও জ্ঞাননির্ভর’ রাজনৈতিক বোধ বিবর্জিত মেধাকে কেন্দ্র করে ঘটেনি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছে। এক্ষেত্রে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের উদাহরণই যথেষ্ট। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের লেবার পার্টি কর্তৃক পরিচালিত লেবার-স্টুডেন্ট ক্লাব বৃটেনের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে। লেবার পার্টির এমপি এবং মন্ত্রীসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি এই রাজনৈতিক ক্লাবের সাথে ছাত্রাবস্থায় যুক্ত ছিলেন। তাদের মধ্যে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট রয় জেনকিনস, প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যাক স্ট্র, ডেভিড মিলিব্যান্ডসহ মিডিয়া টাইকুন রুপার্ড মারডকের নাম উল্লেখযোগ্য। বৃটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন ২০০৯ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সফরের সময়, দেশটির প্রগতিশীল রাজনীতিতে এই ক্লাবের অবদানের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন।
শুধু তাই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে টিউশন ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে বৃটেনের বিজনেস সেক্রেটারি ভিনস কেবলের সফরকে বাতিল করতে বাধ্য করেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ১৯৬০ এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রভাগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কথা কে না জানে। সাম্প্রতিক সময়ে অকুপাই ওয়াল ষ্ট্রিট আন্দোলনে নিউ ইয়র্ক সিটি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকাকে খাটো ক’রে দেখার কিছু নাই। রাষ্ট্রের অপকর্মের বিরুদ্ধে তারা দাঁড়াবে এটাই তো স্বাভাবিক। তাদের অর্জিত জ্ঞান, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর বোধশক্তি বাড়াবে, এটাই তো উচ্চ শিক্ষার অনেকগুলো লক্ষের একটা । ভারতবর্ষে বৃটিশবিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের সূচনা কিন্তু, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভূক্ত প্রেসিডেন্সি কলেজের নেতৃত্বেই ঘটেছিল।
তবে বাংলাদেশের সাথে অন্য দেশগুলোর পার্থক্য হলো এই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ঐ রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক সম্পর্ক এখন অনেক সুস্থির এবং দলীয়-রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার ও নিয়ন্ত্রনের নয়। চীন অবশ্য রাজনৈতিক আদর্শিক কারণে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। বরং রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ার সাথে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অ্যাকাডেমিক ও গবেষণা কার্যকক্রমের মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, যা আমরা এখন পর্যন্ত করতে পারিনি। তাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান উন্নয়ন ও তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে একটি প্রধান বিষয় হলো- রাষ্ট্রের সাথে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্কের পুনর্নির্ধারণ এবং পুনর্মূল্যায়ন। আর সেটা করার জন্য আজকে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন জাতীয় পর্যায়ে দূর্বৃত্তের আর দখলের রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনা। আর তার সাথে সাথে রাষ্ট্রের একটা উন্নয়ন দর্শন নির্ধারণ করা। সেটা করতে ব্যর্থ হলে শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কেন অন্য যে কোন ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই শিক্ষাক্ষেত্রে বিশ্বমানে পৌছাতে পারবে না। আর পিছিয়ে পড়ার যে সামগ্রিক আর ঐতিহ্যগত ধারা সেটা থেকেও বাংলাদেশ সামগ্রিক অর্থে মুক্তি পাবে না।
মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান: সহকারী অধ্যাপক (শিক্ষা ছুটিতে), আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার নিউ ইংল্যাণ্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি অধ্যয়নরত।
Source: http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/5219
0 comments:
Post a Comment