Showing posts with label বেতন স্কেল. Show all posts
Showing posts with label বেতন স্কেল. Show all posts

Saturday, October 17, 2015

ভর্তি পরীক্ষা নেবে না শিক্ষক সমিতি

শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো ও অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামো পুনর্নির্ধারণের দাবিতে ভর্তি পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। তবে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার চেষ্টা করা হবে বলে জানিয়েছেন সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মো. খবির উদ্দিন।
এ ছাড়া শিক্ষক লাঞ্ছনার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফয়সাল হোসেন ওরফে দীপুকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিতে উপাচার্যকে ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছে শিক্ষক সমিতি।
আজ শনিবার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত জহির রায়হান মিলনায়তনের সেমিনার কক্ষে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে এই দুটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
সমিতির কার্য নির্বাহী পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগামী ২৫ অক্টোবর থেকে দুই নভেম্বর পর্যন্ত ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু আজ সমিতির সভায় এই পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
অধ্যাপক খবির বলেন, সভায় ভর্তি পরীক্ষা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে—এটা ঠিক। কিন্তু আমরা দ্রুত সমিতির জরুরি সভা ডেকে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার চেষ্টা করব।
এ দিকে শিক্ষকদের বিরোধিতা উপেক্ষা করে ফয়সালকে রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে দেওয়া নিয়োগ, বাতিলের দাবিতে উপাচার্যকে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে নিয়োগ বাতিল করা না হলে ১৯ অক্টোবর থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করা হবে বলে জানিয়েছেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ মাফরুহী সাত্তার।
গত ১৩ জুলাই পবিত্র ঈদুল ফিতরের ছুটির আগে শেষ কর্মদিবসে চার ছাত্রলীগ নেতাসহ ছয়জনকে অ্যাডহক (অস্থায়ী) ভিত্তিতে নিয়োগ দেন উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। ওই দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে ফয়সালকে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে ২০১৩ সালে উপাচার্য বিরোধী আন্দোলন চলাকালে শিক্ষকদের ওপর হামলা চালানোর অভিযোগ রয়েছে। ফলে নিয়োগ পেলেও শিক্ষকদের বিরোধিতার মুখে তিনি কাজে যোগ দিতে পারেননি।
এরপর গত ২৩ আগস্ট তাঁর ওই নিয়োগ বাতিল করে রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ে পুনরায় তাঁকে অ্যাডহক ভিত্তিক নিয়োগ দেন উপাচার্য। এরপর থেকেই শিক্ষকেরা তাঁর নিয়োগ বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছিলেন।

Published in: http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/657562

বেজন্মা আমলাদের পয়দা করল কোন বিশ্ববিদ্যালয় ?

সিদ্দিকুর রহমান খান

স্কুল কলেজের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাড়তি কী শিখলেন তা ভেবে পাচ্ছিলেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র আরিফ নেওয়াজ ফরাজী। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষদিকে ফিন্যান্সের এ ছাত্রটি মনে করতেন বিশেষ কিছু না শিখেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করছেন? অতৃপ্ত ফরাজী তার প্রশ্নের জবাব পেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ক্লাসে। সেদিন স্যার জানতে চাইলেন, পথ চলতে যদি কখনো দেখতে পাও একজন রিক্সাওয়ালাকে কেউ অন্যায়ভাবে পেটাচ্ছে, তখন কী করবে? প্রায় সবার কাছ থেকে জবাব এল প্রতিবাদ করার। স্যার বললেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার এই মন্যুষত্ব ও বিবেকবোধ জাগ্রত করে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। স্যারের শেষ ক্লাসের শেষ বাক্যটিই ফরাজীর কর্মজীবনে বারে বারে মনে আসে। বহুবছর যাবৎ ফরাজী ইংরেজি মাধ্যমে সাংবাদিকতা করেন।

প্রিয় পাঠক, মূল লেখায় যাওয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়নায় সমাজ ও জাতিকে নিয়ে লেখা মনীষী লেখক আহমদ ছফার ‘গাভী বিত্তান্ত’ উপন্যাসের প্রসঙ্গে দুটি কথা বলব। ছফা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাবেক ও প্রয়াত ছাত্র। ছাত্রদের গোলাগুলির মাঝখানে পড়লে “বিশেষ যোগ্যতায়” নিয়োগ পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের গর্ভবতী গাভীটি নিহত হয়। সত্য এ ঘটনাকে উপজীব্য ধরে রচিত ‘গাভী বিত্তান্ত' উপন্যাসের প্রকাশকাল ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ। কারো বুঝতে বাকি নেই, তবুও কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ না করেই এ উপন্যাসে ছফা বলেন : ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টির ছিলো গৌরবময় অতীত। অনেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে গোটা দেশের আত্মার সঙ্গে তুলনা করে গর্ববোধ করতেন। ... অতীতের গরিমার ভার বইবার ক্ষমতা বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই।

সাম্প্রতিককালে নানা রোগব্যাধি বিশ্ববিদ্যালয়টিকে কাবু করে ফেলেছে। মাছের পচন যেমন মস্তক থেকে শুরু হয়, তেমনি যাবতীয় অসুখের জীবাণু শিক্ষকদের চিন্তা-চেতনায় সুন্দরভাবে স্থান করে নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্বরজারি, ধনুষ্টংকার নানা রকমের হিষ্টিরিয়া ইত্যাকার নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাধিগুলো শিক্ষকদের ঘায়েল করেছে সব চাইতে বেশি। এখন শিক্ষক সমাজ বলতে কিছু নেই। ...বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বেশি পেঁচাল পাড়লে মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদের উপাচার্য হওয়ার উপাখ্যানটি অনাবশ্যক লম্বা হয়ে যায়।' বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতি তথা উচ্চশিক্ষার সার্বিক পচন নিয়ে লেখা ওই সময় পর্যন্ত এটিই একমাত্র উপন্যাস। আরবি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রসঙ্গে লেখা অপর এক প্রবন্ধে ছফা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আত্মার’ প্রয়োজনীয়তার উল্লেখ করেছেন। ছফা বলেন, ইট, কাঠ, পাথর আর বড় ভবন হলেই বিশ্ববিদ্যালয় হয় না।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মর্যাদা ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা কেড়ে নিয়েছে বেসামরিক আমলা কর্তৃক প্রস্তুতকৃত নতুন সরকারি বেতন কাঠামো। হারানো সুযোগ-সুবিধা ফেরত পাওয়ার দাবিতে শিক্ষকরা যখন সহনশীল পর্যায়ে আন্দোলন করছিলেন ঠিক সেসময়ে

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক বক্তব্যে গোটা শিক্ষককূল ব্যথিত হয়েছেন। বিদেশফেরত প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ কীভাবে শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া এক কথায় নাকচ করে দিতে পারলেন তা নিয়ে গবেষণায় বের হয় নতুন তথ্য। জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সম্মান কেড়ে নেওয়ার প্রধান নাটের গুরু আমলাকূল শিরোমণি বা প্রজাতন্ত্রের সবচাইতে বেশি বেতন ও সুযোগ-সুবিধাভোগী বেসামরিক আমলাটি! তাকে পয়দা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ। প্রথম শ্রেণির সনদ দিয়ে আমলা হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়! পারিবারিকভাবে জামাতের প্রতি সহানুভুতিশীল হিসেবে সরকারি মহলে পরিচিত এই আমলাকে যখন প্রধান বেসামরিক আমলা পদে নিয়োগ দেওয়া হয় তখন প্রতিবাদ করেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ও আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকরা। বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের কথা না হয় বাদই দিলাম। তখনই প্রতিবাদ জানালে আজ তিনি পদাধিকারবলে সচিব কমিটির প্রধান হিসেবে শিক্ষকদের এত বড় অপমানের কাজটি করার সুযোগ পেতেন না। দ্বিতীয় নাটের গুরু বেসামরিক আমলাকূলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আমলা কাম কবি তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ তাকে পয়দা করেছে। মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকাকালে তিনি নিজের লেখা একটি কবিতা নবম শ্রেণির পাঠ্য বইয়ে ঢুকিয়েছেন গোপনে। বইয়ের কবি পরিচিতিতে তিনি ‘কামাল চৌধুরী’ নাম ব্যবহার করেছেন। তার কবিতা পাঠ্যবইয়ে স্থান দিতে গিয়ে বাদ দেওয়া হয়েছে কবি আবদুল হাকিমের ‘বঙ্গবাণী’ কবিতাটিও। দৈনিকশিক্ষাডটকম-এ খবর প্রকাশ হলে সারাদেশে ছি: ছি: রব ওঠে। আমলার কবিতা বাদ দেওয়ার দাবী জানান কবিরা। 


২০১৩ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি পাঠ্যবইয়ে ‘বঙ্গবাণী’ ও অপর একটি কবিতা পুনর্বহালের সুপারিশ করে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আআমস আরেফিন সিদ্দিক। কবিতা প্রসঙ্গে উপাচার্য কোনো কথা বলেননি।

‘যেসবে বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’ বঙ্গবাণী কবিতার এ লাইন দুটি সবচেয়ে বেশি শোভা পায় আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়ালে দেওয়ালে। অতি জনপ্রিয় এই কবিতাটি যে আমলা নবম শ্রেণির পাঠ্যবই থেকে বাদ দেওয়ার দু:সাহস দেখালেন তার বিরুদ্ধে যদি সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ও আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকরা আন্দোলন গড়ে তুলতেন কিংবা তীব্র প্রতিবাদ ধিক্কার জানাতেন তবে হয়তো আজ এই গোটা শিক্ষককূলের সম্মানহানি ঘটানোর জন্য তিনি সরকারের ওই গুরুত্বপূর্ণ আমলা পদে বসতেই পারতেন না। শিক্ষা সচিবের পদ থেকেই তাকে ওএসডি হতে হতো।

আমলা হয়ে নিজ নিজ শিক্ষকের এমন সম্মানহানি ঘটানোর খলনায়কদের পয়দা করল কোন বিশ্ববিদ্যালয়? দেখলাম দু’জনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। শিক্ষককূলের এ চরম সংকটে যেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা চুপচাপ চাকরি করে চলছেন তাদেরকেও পয়দা করেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ই। ছফার ‌‌'গাভী বিত্তান্ত' উপন্যাসে বর্ণিত ‘বিশেষ যোগ্যতায়’ উপাচার্য নিয়োগপ্রাপ্তরাও এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই পয়দা। আবার এই বিশ্ববিদ্যালয়ই তো বাঙালির সর্বকালের সেরা দুুই অর্জন বায়ান্নো আর একাত্তর-এর জন্মদাতা। এর সফল নায়কদেরও পয়দা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই।

পাঠক, শুরুতে ফিন্যান্সের ছাত্র ফরাজীর প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় ফরাজীকে ‘অন্যায়ের প্রতিবাদ’ করার শিক্ষা দিয়েছিল। আজও তা ধারণ করে পথ চলছেন ফরাজী। কিন্তু তার শিক্ষকরা কী অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন? আহমদ ছফার বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আত্মার’ প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের আত্মা কি কলুষিত হয়নি? এক অসৎ আত্মা থেকে আরেক অসৎ আত্মার পয়দা হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই উক্ত বেজন্মা আমলা পয়দার পুরোটা দায়ভার বিশ্ববিদ্যালয়কে না দিয়ে বরং এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই ফলিত পদার্থ বিজ্ঞানের সাবেক ছাত্র মনজুরুল আহসানের স্মরণাপন্ন হয়ে লেখাটির ইতি টানছি। ইংরেজি সাংবাদিকতায় নিযুক্ত আহসান অদ্য ১৬ই অক্টোবর ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে তার ফেসবুকে নিজস্ব ভঙ্গিতে লিখেছেন এরকম : ‘তুমরা বেবোধ, তুমরা আত্মঘাতি, তুমাদের ঔদ্ধত্য হাস্যকর রুপে ‘‘ছাগলামি’’তে পরিপূর্ণ। তুমরা ভাবিতেছ শিক্ষককূলের ক্ষয়িষ্ণু মেরুদণ্ড গুড়াইয়া দিয়া জাতে উঠিবা! তবে ইহাও সত্য যে, তুমাদিগকে ঐসকল শিক্ষকগণই ’পয়দা’ করিয়াছে। সুতরাং তুমাদিগের মত কুলাঙ্গার ’পয়দা’ করিবার দায় শিক্ষককূলেরই। তবে জানিয়া রাখিও, মেরুদণ্ডবিহীন শিক্ষককূল যাহা পয়দা করিবে উহাদিগেরও মেরুদণ্ড থাকিবে না। যেই কারণে তুমরা অদ্যাবধি বেজন্মা সিএসপি (পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস) বা তাহাদিগের পূর্বসুরি আইসিএস (ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস) দিগের আইকন মনে করিয়া থাকো। অথচ ওইসকল বেজন্মাদের বেতন দেওয়া হইতো তুমাদিগের পূর্ব পুরুষগণের ওপর শোষণ নিপীড়ন পরিচালনার জন্য এবং অবশ্যই ওই বেতন তুমাদিগের পূর্বসুরিদের খাজনার পয়সায় দেওয়া হইতো।’

সিদ্দিকুর রহমান খান : লেখক, সাংবাদিক ও শিক্ষা গবেষক।

Published in: http://dainikshiksha.com/news.php?content_id=10486

রাষ্ট্র, বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষকদের বেতন

জহিরুল হক মজুমদার

১৯০৫ সালে বাংলাকে ভাগ করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে একটি আলাদা ‘প্রভিন্স’ গঠন করেছিলেন ইংরেজ সরকার। কিন্তু বাংলা ফুঁসে উঠেছিল এর বিরুদ্ধে, বিশেষ করে কোলকাতা। নবগঠিত প্রভিন্সের প্রশাসনিক অবকাঠামো হিসেবে ঢাকায় অনেক স্থাপনা তৈরি করা হয়। লাটসাহেবের বাসভবন এবং আমলাদের বাড়ি এর অন্যতম।

১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে গেলে ইংরেজ সরকার লক্ষ্য করেন যে, পূর্ববঙ্গের মুসলিম বাঙালিদের মধ্যে এটি গভীর মনোবেদনার কারণ হয়েছে। এরই ক্ষতিপূরণ হিসেবে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়, যার নাম দেওয়া হয়, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’। কোলকাতার বুদ্ধিজীবীদের বিবিধ উষ্মামূলক মন্তব্য ছিল এ রকম: ওখানে অধিকাংশ মানুষ চাষবাস করে খায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে কে পড়বে? কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক নিয়ন্ত্রণ এলাকা কমে যাওয়ায়ও তাদের ছিল আপত্তি। সে সব নিষ্পত্তি করে ইংরেজ সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে।

লক্ষ্য করার বিষয় হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি প্রদেশ না পাওয়ার ক্ষতিপূরণ হিসেবে। আর এর মাধ্যমেই এর আপতিক গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। নতুন প্রভিন্স পরিচালনার জন্য যত রকম পুরকর্ম করা হয়েছিল– লাট সাহেবের বাসভবন থেকে মন্ত্রী-আমলাদের বাড়ি– সবই দেওয়া হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন দেশ পাওয়ার আগেই এই অঞ্চলের মানুষ এ বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছে। আর এই বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র করেই নিজেদের জীবনমান ও ভাগ্যোন্নয়নের স্বপ্ন দেখেছে পূর্ববঙ্গের মানুষ। এখানে পড়াশুনা করেই পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের মধ্যে একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটে। এই শ্রেণি তাদের অধিকারের চেতনায় শাণিত হয়ে শ্রমিক, কৃষককে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সফল হয়।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তাঁর পূর্ববঙ্গ-কেন্দ্রিক রাজনীতি শুরু হয় এটি কেন্দ্র করেই। এখানকার চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি বহিষ্কৃত হন। অন্য বন্ধুরা মুচলেকা দিয়ে বেরিয়ে এলেও তিনি আসেননি। কিন্তু নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর প্রতি বঙ্গবন্ধুর অটুট শ্রদ্ধা ছিল। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ ১৯৭৩’– যে আইনের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন এবং শিক্ষকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়– তাও তাঁরই সদিচ্ছার প্রতিফলন। অনুরূপ আইন চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রণয়ন করেছেন তিনি।

পাকিস্তান আমলে শিক্ষকদের উপর প্রচলিত নানা ধরনের সরকারি চাপের প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বাধীন চিন্তার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যেই এটা করেছিলেন তিনি। পাশাপাশি, শিক্ষকদের যে কোনো বৈধ সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার ও মতপ্রকাশের অধিকারও দেওয়া হয় এর আওতায়। [ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ, ১৯৭৩, ধারা ৫৬ (২); রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট, ১৯৭৩, ধারা ৫৫ (২); চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট, ১৯৭৩, ধারা ৫৫(২); জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট, ১৯৭৩ ধারা ৪৪(২)]

শুরুতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খ্যাতি পায় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে, তার স্থাপত্য সৌন্দর্য ও আবাসিক চরিত্রের জন্য। জ্ঞানের মাত্রায় এটি কখনও অক্সফোর্ডের সমতুল্য ছিল না। সত্যেন বসু নামে কোলকাতার এক উজ্জ্বল তরুণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক তাঁর অসাধারণ তাত্ত্বিক কাজের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তুলে এনেছিলেন বিশ্ব-বিজ্ঞানের আঙিনায়।

১৯২১ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানপীঠ হিসেবে সমাজে অবদান রেখেছে। শিক্ষকদের পাণ্ডিত্যপূর্ণ কাজ, ছাত্রদের নিবেদিতপ্রাণ জ্ঞানচর্চা বিশ্ববিদ্যালয়কে সমাজের চোখে একটি বাতিঘরের জায়গায় অধিষ্ঠিত করে রেখেছিল। সত্যেন বসু, কাজী মোতাহার হোসেন, রমেশ চন্দ্র মজুমদার, মোহিতলাল মজুমদার, হরিদাস ভট্টাচার্য, ড. মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, আবদুর রাজ্জাক, আবদুল্লাহ ফারুক, আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ, মমতাজুর রহমান তরফদার, মোজাফফর আহম্মদ চৌধুরী, আহমদ শরীফ, এ এম হারুন উর রশিদ, কামাল উদ্দিন, রঙ্গলাল সেন, খোন্দকার মোকাররম হোসেন, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, খান সারয়ার মুর্শিদ, আনিসুজ্জামান হয়ে এ এক দীর্ঘ তালিকা।

এছাড়া ষাটের দশকে জাতি পেয়েছে একদল উজ্জ্বল ছাত্র-নেতৃত্ব, যাঁরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণের ভ্যানগার্ড। পূর্ব বাংলার মানুষের বঞ্চিত হওয়ার ‘দুই অর্থনীতি তত্ব’এর নির্মাতাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই প্রসঙ্গে সর্বাগ্রে নাম করতে হয় বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমানের।

এছাড়া ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৯৭০এ প্রতিষ্ঠিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল অবদান রয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণে– সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের ইতিহাস একদিকে রাখলেও। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোশারফ হোসেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আখলাকুর রহমানের তাত্বিক অবদান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ের উপাচার্য আবু সায়ীদ চৌধুরী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ আর মল্লিকের সাংগঠনিক অবদান অসাধারণ। আর শহীদ ছাত্র-শিক্ষকদের অবদান তো ছিলই।

একাত্তরের পর গোটা সত্তর দশক জুড়েই মেধা ও ব্যক্তিত্বে সমুজ্জ্বল উপাচার্য এবং পণ্ডিত শিক্ষকদের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চা অব্যাহত ছিল। কিন্তু আশির দশকে এরশাদের স্বৈরশাসনের সময় অযাচিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে একাডেমিক শৃঙ্খলা নষ্ট করা হয়। যার ফলে তৈরি হয় সেশন জট এবং এর রেশ আজকের দিন পর্যন্ত চলছে।

পাশাপাশি সামরিক এবং বেসামরিক আমলাতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে মেতে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয় ‘ডাকাতদের পাড়া’, ছাত্ররা ‘সন্ত্রাসে লিপ্ত’, শিক্ষকরা ‘রাজনীতি করেন’, বিশ্ববিদ্যালয় ‘রাষ্ট্রের ভিতর আরেকটি রাষ্ট্র’– এ সব সমালোচনা দাঁড় করানো হয়। মূল উদ্দেশ্য, শিক্ষক এবং ছাত্রদের সামরিক শাসনবিরোধী অবস্থান পরিবর্তনের জন্য মানসিক চাপ তৈরি করা। আজকের দিন পর্যন্ত বেসামরিক আমলাতন্ত্র এই প্রচারণা চালাচ্ছে।

আসলে অত্যন্ত সীমিত সম্পদ ও ব্যক্তিগতভাবে চাকরির অনেক কম সুবিধাদি সত্বেও সাধারণ শিক্ষকরা তাদের একাডেমিক কাজ করে যাচ্ছেন। যদি গ্র্যাজুয়েটদের সংখ্যাই বিশ্ববিদ্যালয়ের আউটপুট বলে মনে করা হয়, তাহলে এত কম সম্পদের ব্যবহার করে এত বেশি সংখ্যক গ্র্যাজুয়েট তৈরির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রাষ্ট্রের সবচেয়ে দক্ষ প্রতিষ্ঠান বলতে হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুল সাধারণ শিক্ষক যে বেতন পান তা জীবনধারণের সাধারণ মানের জন্যও যথেষ্ট নয়। একটি চাকরি, যেখানে আর কোনো লজিস্টিক সাপোর্ট নেই, পর্যাপ্ত আবাসন ও পরিবহন সুবিধা নেই, ব্যক্তিগত স্টাফ না থাকার কারণে প্রয়োজনীয় ফটোকপি থেকে শুরু করে একটি চিঠিও নিজ হাতে নিকটবর্তী পোস্ট অফিসে দিয়ে আসতে হয়, সেই চাকরিতে বেতন যদি সাধারণ চাকুরেদের মতো হয় তাহলে জ্ঞানের মতো উচ্চতর সেবা আশা করা বাতুলতা। সেখানে গবেষণা তো সুদূরপরাহত।

যারা মনে করছেন শিক্ষকরা নিজেদের মতো সময়ে অফিসে আসেন, তাদের মনে রাখা উচিত যে, শিক্ষকতা ফাইল-ওয়ার্ক নয়। একজন শিক্ষক নিজেই নির্ধারণ করেন তাঁর লেকচারের মান কী হবে। সে জন্য প্রয়োজনীয় পড়াশুনা এবং ক্লাসের প্রস্তুতি তিনি অন্তত আগের রাত থেকেই করেন। তাহলে সেই সময়টা হিসাবের বাইরে থাকবে?

শিক্ষকতার পেশা আর দশটা পেশার মতো ভাবলে চলবে না। এখানে শিক্ষক নিজেই নিজেকে কাজ দেন, নিজেই সেটি সঠিকভাবে করার জন্য নিজের উপর চাপ অব্যাহত রাখেন। এটি নিজের কাছে দায়বদ্ধ একটি পেশা। যে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁর ছাত্ররা তাঁকে আজীবন মনে রাখে। একজন শিক্ষকের কাজে গোটা জাতি উপকৃত হয়। তাঁর দেওয়া জ্ঞান প্রজন্মের পর প্রজন্ম প্রবাহিত হয়। অনেক সময় জগতজোড়া খ্যাতিপ্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকে গোটা জাতির।

শিক্ষকতা পেশা হিসেবে নেওয়ার জন্য একজন মানুষের বিশেষ ধরনের মনের গড়ন চাই, যা তৈরি হয় সারাজীবন। ‘বিসিএস পছন্দক্রমের শীর্ষে ছিল ফরেন সার্ভিস; পরে নিয়োগ পেলাম আনসারে’– এই রকম চাকরি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা নয়। যারা শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা থাকা সত্বেও অন্য চাকরি করছেন এটা তাদের রুচি ও সমস্যা। শিক্ষককে সমালোচনা করার অধিকার তাদের রয়েছে বলে মনে করি না।

সব শিক্ষক একই রকম মানসম্মত জ্ঞানচর্চা করেন, সবার মেধা এবং জ্ঞান-উদ্যোগ সমান, বিষয়টি তা নয়। যে কোনো প্রতিষ্ঠানের ভেতরেই এ ধরনের অসন্তুষ্টি প্রকাশের মতো ব্যতিক্রমী কর্মী পাওয়া যাবে। কিন্তু উচ্চতর জ্ঞান-কেন্দ্র হিসেবে রাষ্ট্র যদি অবকাঠামো, গবেষণা ও বেতন খাতে প্রয়োজনীয় প্রণোদনা তৈরি না করে, তাহলে উচ্চতর জ্ঞানচর্চা ব্যাহত হবে মারাত্মকভাবে এবং হচ্ছেও।

পাকিস্তান আমলে সঠিক প্রণোদনার অভাবে অনেক মেধাবী লোকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে সিএসপিএর সদস্য হয়ে সরকারি চাকরি করেছেন। এমনকি বেতন বেশি বলে অনেকে সরকারি কলেজের চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। অনেক সাধারণ সরকারি চাকরিও আকর্ষণীয় লেগেছে অনেকের কাছে। এতে জ্ঞানচর্চা ব্যাহত হয়েছে। কবি জসীম উদ্দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের একটি সাধারণ নন-ক্যাডার চাকরি করেছেন সারাজীবন।

বোঝা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি সে যুগেও পরিবার চালানোর জন্য কতটা অসুবিধাজনক ছিল। আর সিএসপিদের তালিকা তো অনেক দীর্ঘ, যারা কিছুদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েই এই চাকরি ত্যাগ করেছিলেন।

এত সব অসুবিধার মধ্যেও যারা নিবেদিতপ্রাণ হয়ে জ্ঞানচর্চা করেছেন, জ্ঞান বিতরণ করেছেন, তাদেরকে সমাজ ও রাষ্ট্রের দিক থেকে যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে বলে মনে করি না। সরকারি হাসপাতালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বিভাগীয় চেয়ারম্যান এবং সিনিয়র অধ্যাপকের জন্য একটি সিট পাওয়া যায়নি তা নিজ চোখে দেখেছি। অথচ সরকারি কর্মচারি পরিচয়ে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের উপ-রেজিস্ট্রারকে আলাদা কেবিনে থাকতে দেখেছি।

সরকারি দপ্তরের একজন সাধারণ কর্মকর্তা যেখানে অফিসিয়াল পাসপোর্ট ব্যবহার করেন, সেখানে বিশেষ প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকারি আমলাতন্ত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদেরকে সাধারণ নাগরিকদের মতো সবুজ পাসপোর্ট ব্যবহারে বাধ্য করেছে। দূতাবাসের লাইনে দাঁড়ানো এবং অন্যান্য কাগজপত্র জমা দিতে গিয়ে বাইরে ওয়ার্কশপ-কনফারেন্সে যাওয়া বিঘ্নিত হয়।

অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের লাশ দীর্ঘদিন জার্মানির মিউনিখে একটি মরচুয়ারিতে পড়ে ছিল। একজন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের মরদেহ ফেরত আনার জন্য সরকারের দিক থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। শিক্ষক সমিতি ও পরিবারের ব্যবস্থাপনায় তাঁর লাশ ফেরত আনা হয়।

এখন বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে সরকারি চাকরিতে যাওয়ার প্রবণতা না থাকলেও, বিদেশে গিয়ে ফিরে না আসার প্রবণতা বেড়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জাতি।

১৯২১ সাল থেকে ১৯৮০ দশক পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা বেতন নিয়ে কোনো আন্দোলন করেননি। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার পি জে হার্টগকে বিশেষ বেতনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য পদে নিয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের বয়ানে পাওয়া যায় যে, কাজী মোতাহার হোসেনের মতো পণ্ডিত ব্যক্তি দুশ টাকা বেতনে পঁচিশ বছর চাকরি করেছিলেন। বেতন বাড়েনি এক টাকাও।

আশির দশকে এরশাদের স্বৈরশাসনের সময় শিক্ষকরা প্রথম বেতন বৃদ্ধির আন্দোলন করেন, যা সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের চাপে সফল হয়নি। বেতন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জাতীয়ভিত্তিক বড় আন্দোলন হয়েছিল ১৯৮৬-৮৭ সালে। শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নেতৃত্বেই এটি হচ্ছিল। তখন ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কে এম সাদউদ্দীন এবং মহাসচিব ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মইনুল ইসলাম। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনু মুহাম্মদ। এই আন্দোলন সম্পর্কে অধ্যাপক মইনুল ইসলাম লিখেছেন:

“ওই আন্দোলনের সময় আমরা ৪২ দিন শিক্ষক ধর্মঘট চালাই এবং তদানীন্তন এরশাদ সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে পাঁচটি সভায় আলাপ-আলোচনা করি। ফেডারেশনের একটি প্রতিনিধিদল খোদ রাষ্ট্রপতি এরশাদের সঙ্গেও বৈঠকে মিলিত হয়েছিল। এরশাদ নীতিগতভাবে আলাদা বেতন স্কেল দিতে তাঁর আপত্তি নেই বলে ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, সিভিল আমলাতন্ত্রের আপত্তি রয়েছে আলাদা স্কেলের ব্যাপারে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আলাদা বেতন স্কেল দেওয়া হলে চাকরির প্রারম্ভিক স্তরে তুলনামূলকভাবে একই শিক্ষাগত যোগ্যতা ও মেধার অধিকারী সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তারা নাকি নিজেদের বঞ্চিত মনে করবেন।..

আমাদের সঙ্গে আলোচনায় সরকারের প্রতিনিধিদলে যে চার জন জাঁদরেল আমলা নেতৃত্ব দিতেন, তাঁরা হলেন তদানীন্তন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুবুজ্জামান, অর্থ সচিব সাইদুজ্জামান, স্বরাষ্ট্র সচিব শামসুল হক চিশতি ও শিক্ষা সচিব আজহার আলী। ওই আলোচনায় প্রতিবেশি দেশগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেল থাকার বিষয়টি নজির হিসেবে আমরা নথিপত্রসহ উপস্থাপন করেছিলাম, যেখানে ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার উদাহরণ আমাদের জন্য প্রযোজ্য হওয়ার ভালো যুক্তি রয়েছে। ভারতে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসরের সর্বোচ্চ বেতন দুই লাখ ভারতীয় রুপিরও বেশি।’’

১৯৮৬-৮৭এর এই আন্দোলন নিয়ে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ লিখেছেন:

“এর আগে বেতন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জাতীয়ভিত্তিক বড় আন্দোলন হয়েছিল ১৯৮৬-৮৭ সালে। সামরিক স্বৈরতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনের পাশাপাশি তখন বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার আন্দোলন বিস্তৃত হচ্ছিল। শিক্ষকদের আন্দোলনও তখন বেশ শক্তিশালী আকার নিয়েছিল। …

সে বছরই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের উদ্যোগে এ বিষয়ে একটি জাতীয় সেমিনার হয়েছিল। সেখানে উপস্থাপনের জন্য প্রবন্ধের কাজ করতে গিয়ে আমি দেখেছিলাম, শিক্ষকদের বেতন ১৯৭২ সালের তুলনায় আর্থিক পরিমাণে বেড়েছে, কিন্তু প্রকৃত আয় হয়ে গেছে তিন ভাগের এক ভাগ। আরও দেখেছি, সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মধ্যে সামাজিক অবস্থান যাঁর যত কম, প্রকৃত আয় হ্রাস তাঁর তত বেশি। …

আলোচনা হয়েছিল বটে, কিন্তু পরিষ্কার বোঝাই যাচ্ছিল সচিবেরা এ বিষয়ে কথা বলতে বা শুনতে খুবই অনিচ্ছুক, এরশাদ সরকারের লোক দেখানো কর্মসূচির অংশ হিসেবে তাঁরা আলোচনা করলেন, তাই তার কোনো অগ্রগতি হয়নি।…

গত প্রায় তিন দশকে বেতন নিয়ে আর সে রকম দাবিদাওয়া সংগঠিত হয়নি। এর মধ্যে নিয়মমাফিক একাধিক বেতন স্কেলে শিক্ষকদেরও বেতন কিছু বেড়েছে। কিন্তু প্রকৃত আয়ের ক্ষেত্রে বারবার অন্য অনেকের মতোই হোঁচট খেয়েছেন শিক্ষকেরাও।

কাঠমান্ডুতে এক সেমিনারে যোগ দিতে গিয়ে পাকিস্তান, ভারত ও নেপালের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাঁরা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না বাংলাদেশের পাবলিক বা সর্বজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন এত নিচে; কোথাও তাঁদের তিন ভাগের এক ভাগ, কোথাও অর্ধেক।’’

শিক্ষকদের কম বেতন দেওয়া বিষয়ে যেসব খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করানো হয় তার একটি হল, আন্তর্জাতিক র‌্যাংকিংএ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম অনেক নিচের দিকে। শিক্ষকদের বেশি বেতনের দাবি মেধাবীদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করার জন্য। তাছাড়া যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষকদের জন্য গাড়ি, পিয়ন ইত্যাকার লজিস্টিক সাপোর্ট নেই, তাই মোট বেতন বাড়িয়ে দিলে শিক্ষক নিজেই এ সব ব্যবস্থা করে নেবেন।

যে সব মানদণ্ডের ভিত্তিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং তালিকায় উঠে আসে এর মধ্যে সর্বাগ্রে রয়েছে গবেষণা। এ জন্য আলাদা অর্থ-বরাদ্দ দিতে হবে। শিক্ষককে যত বেশি বেতনই দেওয়া হোক না কেন, তাতে গবেষণা হবে না। এ যুগে গবেষণার আর্থিক ব্যয় অনেক বেশি, এমনকি সমাজবিদ্যা কিংবা মানববিদ্যার গবেষণাতেও; বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিষয়ে তো অনুমেয়। যারা মনে করেন শুধু কাগজ কলম থাকলেই গবেষণা করা যায়, তাদের এ বিষয়ে ধারণা নেই। তবু, স্বল্প সুবিধার মধ্যেও শিক্ষকরা গবেষণা করে চলেছেন। আন্তর্জাতিক জার্নালে তাদের প্রকাশনা থাকছে।

উন্নত দেশগুলোতে গবেষণা যে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ই করে তা কিন্তু নয়। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত বড় বড় গবেষণাগারেও অনেক ভালো গবেষণা হয়। যেমন, ভারতের CSIR, BARC, পাকিস্তানের AQ Khan Laboratories, PCSIR, অস্ট্রেলিয়ার CSIRO, যুক্তরাজ্যের National Physical Laboratory যুক্তরাষ্ট্রের NASA, Los Alamos National Laboratory ইত্যাদি। বাংলাদেশের একই ধরনের গবেষণাগার BAEC, BCSIR, BARC, BLRI, BRRI, এই সমস্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বাজেট দেখলেই বুঝা যায় সরকার গবেষণার অর্থ-বরাদ্দের বিষয়ে কতটা অনুদার। সেখানে বিজ্ঞানীদের বেতন-কাঠামোও সাধারণ চাকরিজীবীদের মতো।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নেতিবাচক সমালোচনার জোয়ালের নিচে রাখলে নিজেদের শাসন শিক্ষকদের সমালোচনামুক্ত রাখা যায়, এটা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো ও তাদের বশংবদ আমলা-জোটের পুরনো কৌশল। শিক্ষকদের একাংশকে তখন কেনা যায় ধমক ও সামান্য সুবিধা দিয়ে। জনগণের করের পয়সায় আমলাতন্ত্রের উদরপূর্তি আর উন্নয়ন-উন্নয়ন খেলার নামে দলীয় ক্যাডার ও ব্যবসায়ীদের উদরপূর্তির সংস্কৃতি চলছে বহু দিন।

কিছুদিন আগেও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের বেতন ছিল তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারি বা ড্রাইভারের বেতনের সমান। স্বভাবতই একজন আমলা একজন প্রাথমিক শিক্ষককে তাঁর ড্রাইভারের চেয়ে বেশি সম্মান দেবেন না। একটি উন্নত সমাজের দিকে এটি কি একটি ভুল যাত্রা নয়?

যে ছেলেটি মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক হিসেবে খাটলে তাঁর পাঠানো ডলারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্যাপ্ত রিজার্ভের অহংকারে সরকারগুলো ফেটে পড়ে, সেই ছেলেটির গ্রামের স্কুলের শিক্ষককে সরকার বেতন দিতে দ্বিধা করে। যে আমলারা নিজেদের কর্মদক্ষতার বয়ান গেয়ে সরকারের কাছ থেকে অধিক বেতন আদায় করে নিতে চান তাদের সম্পর্কে মূল্যায়ন করেছেন আমাদের আরেক সহকর্মী। তিনি সাবেক আমলা ড. আকবর আলী খানের Gresham’s Law Syndrome and Beyond: An Analysis of the Bangladesh Bureaucracy বইয়ের বরাতে লিখছেন:

“বিশ্ব ব্যাংক পৃথিবীর ২০৯ টি দেশের আমলাতন্ত্রকে তিন ভাগে ভাগ করেছে, যার মধ্যে প্রথমটি হল ‘খুবই কার্যকর আমলাতন্ত্র’ যার মধ্যে পড়েছে ৭০ টি দেশের আমলাতন্ত্র। দ্বিতীয়টি হল ‘মোটামুটি কার্যকর আমলাতন্ত্র’ যার মধ্যে পড়েছে বিশ্বের ৭১ টি দেশের আমলাতন্ত্র এবং শেষটি হল ‘অকার্যকর আমলাতন্ত্র’ যার মধ্যে পড়েছে ৬৮ টি দেশের আমলাতন্ত্র। এখানে বাংলাদেশের অবস্থান ‘অকার্যকর আমলাতন্ত্র’ ক্যাটাগরিতে এবং র‌্যাংকিং হল ১৬৮ (প্রাপ্ত নম্বর ১০০ তে ২০) এবং দক্ষিণ এশিয়ার র‌্যাংকিংএ বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের অবস্থান অন্য সব দেশের নিচে (গভর্নেন্স ম্যাটারস, ২০১২)।’’

ড. আকবর আলী খান লিখেছেন:

‘‘সরকারের কার্যকারিতার সূচক বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে খারাপ। সারা পৃথিবীতে মাত্র ৩৯টি দেশ বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ করেছে এবং বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিস দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল এবং গোটা পৃথিবীর নিকৃষ্টতমগুলোর একটি।’’

মনে রাখা জরুরি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা স্বউদ্যোগে নিজস্ব যোগাযোগের মাধ্যমে বদেশের অর্থ খরচ না করেই পিএইচডি বা উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে আসেন, অল্প কিছু কমনওয়েলথ বৃত্তির কথা বাদ দিলে। এতে উপকৃত হয় জাতি। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ছুটিকালীন পূর্ণবেতন প্রদানের বিধানও নেই। সরকারি আমলারা বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, অস্ট্রেলিয়ান এইড, এসব বৃত্তির মাধ্যমে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে যান পূর্ণ বেতনে। এদের বিরাট অংশেরই উচ্চতর ডিগ্রির জন্য ভর্তির যোগ্যতাও থাকে না।

অষ্টম বেতন স্কেলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদেরকে যেভাবে আগের প্রাপ্য বেতন থেকেও দুধাপ নিচে বেতন প্রস্তাব করা হয়েছে তা কোনোভাবেই তাদের মেধা, যোগ্যতা ও অবদানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এটি চূড়ান্ত অপমানজনক। সিনিয়র সচিব ও কেবিনেট সচিবের পদ বিবেচনা করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের পদের অবনমন ঘটেছে অন্তত চার ধাপ। কোনো পেশার মর্যাদা অবনমন মানে হচ্ছে সমাজে এটি অপ্রয়োজনীয় এমন বার্তা প্রদান। এই বার্তা গোটা সমাজের মূল্যবোধ, চেতনা ও অগ্রগতির দিক থেকে নেতিবাচক একটি বিষয়।

অর্থমন্ত্রী অধিক অধ্যাপকের সংখ্যা বিষয়ে যে অভিযোগ উত্থাপন করে শিক্ষকদের ‘দুর্নীতিবাজ’ বলেছেন তাও তথ্য-উপাত্তে প্রমাণিত হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে ১৯৭০ জন শিক্ষকের মধ্যে অধ্যাপকের সংখ্যা ৬৮৯, অর্থাৎ ৩৫ শতাংশ। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক মাত্র দুজন। বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক মাত্র ১ জন করে। ওদিকে ভারতের দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় ও কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের সংখ্যা মোট শিক্ষকের ৪৮ শতাংশ।

সচিবালয়ে অতিরিক্ত সংখ্যক যুগ্ম সচিব, উপ-সচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে যে পরিস্থিতির তৈরি করা হয়েছে তাতে গোটা আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা সংকটাপন্ন। উপ-সচিবের ৮৩০ টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ১২৯৪ জন। যুগ্ম সচিবের ৩৫০ পদের বিপরীতে ৯১৭ জন, অতিরিক্ত সচিবের ১২০ পদের বিপরীতে ৪২৯ এবং সচিবের ৬০ টি পদের বিপরীতে ৭২ জন রয়েছেন।

শিক্ষকদের সঙ্গে অসম্মানজনক আচরণ গোটা সমাজকেই বিষণ্ণ করবে, তৈরি করবে আস্থাহীনতার পরিবেশ। তাই বিষয়টির আশু মীমাংসা জরুরি।

জহিরুল হক মজুমদার: সহযোগী অধ্যাপক, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Thursday, October 15, 2015

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার খোলনলচের বদল চাই

মির্জা তাসলিমা, নাসরিন খন্দকার, বখতিয়ার আহমেদ, মানস চৌধুরী, কাজী মারুফুল ইসলাম, সামিনা লুৎফা, গীতি আরা নাসরীন, সাঈদ ফেরদৌস, আইনুন নাহার, সেলিম রেজা নিউটন, মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান, মেহের নিগার, মাহমুদুল সুমন, সাদাফ নূর, আ-আল মামুন, ফাহমিদুল হক
----------
দীর্ঘদিন থেকে আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ক্ষুণ্ন হয়ে আছি। একদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিচর্যার ক্ষেত্রে রয়েছে রাষ্ট্রের অমনোযোগিতা, অন্যদিকে রয়েছে সরকারের দলীয়করণ ও অযাচিত হস্তক্ষেপ। তবে এর মধ্যে ঘৃতাহূতি হলো যখন শিক্ষকদের স্পষ্ট নাখোশী অবস্থান ও চলমান আন্দোলন থাকা সত্ত্বেও মন্ত্রীপরিষদ বৈঠকে প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোই হুবহু অনুমোদিত হয়ে গেল। সরকার অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সান্ত্বনা দিতে একটি কমিটির ঘোষণা করেছে। তা সত্ত্বেও অর্থমন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে ঢালাও বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করলেন, শিক্ষকদের ব্যাপক ক্ষোভ ও প্রতিবাদের মুখে সে বক্তব্য প্রত্যাহারও করলেন। সম্প্রতি দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহীও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দাবি প্রসঙ্গে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করেছেন একইরকম বিদ্বেষমূলক ভাষায়, শিক্ষকদের হাস্যস্পদ-তাচ্ছিল্য করে, এবং শাসিয়ে বক্তব্য দিয়ে!তাঁর দেশের প্রজন্ম গড়ার কারিগরদের প্রতি এরকম মনোভাবের প্রকাশ, যেকোনো অর্থেই নিন্দনীয়। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সকল শিক্ষক, শিক্ষার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছেন, ঠিকঠাক দায়িত্ব পালন করছেন না, এরপরও সরকারপ্রধানের কাছ থেকে এরকম মন্তব্য অনভিপ্রেত। রাজনৈতিক বিচক্ষণতার স্বার্থে ও দেশের মঙ্গলের জন্য আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে তিনি শিক্ষকদের দায়িত্বশীল হয়ে ওঠার উদ্বুদ্ধকরণের দায়িত্ব নিতে পারতেন। এই পেশা-গোষ্ঠীকে তীর্যক বাণে জর্জরিত করে, সমাজের সকলের কাছে হেয় করে, তাঁদের কল্পিত কৃতকর্মের (তাঁদের কিছু সংখ্যক সে কাজ করলেও)জন্য শাসিয়ে আর যাই হোক শিক্ষার কোনো মঙ্গল হবে না, শিক্ষকের মঙ্গলের সম্ভাবনা তো নয়ই।

রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিচালকরা এটা জানেন না, এরকম ভেবে নেওয়া হবে নাদানপনা। বরং আমরা দেখতে পাই যে গত দুই দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সংকোচনের নীতিগত যে আয়োজন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে চলছে, তারই ধারাবাহিকতায় আজকের সব ঘটনা ঘটছে। বিশ্ববিদ্যালয় বাধাহীন, মৌলিক জ্ঞান চর্চার জায়গা হওয়ার কথা। যা কিছু বিদ্যমান তা কিছুতে সম্মতি দেওয়া, পুনর্বার জারি রাখার দায়বদ্ধতা বিশ্ববিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠানের তথা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর নেই। বরং বিদ্যমানের দুর্বলতা নিরন্তর উদ্ঘাটন করা, চ্যালেঞ্জ করা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যাচর্চার অন্যতম উদ্দেশ্য। সেই কারণেই এইখানে চর্চিত জ্ঞান নতুন ও মৌলিক, কেবল পূর্বের ধারাবাহিকতা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়কে দলীয়করণ করা, বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের উচ্চশিক্ষা কৌশলপত্র প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজস্ব অর্থায়নের ব্যবস্থা করতে তাগাদা দেয়া (যা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণার সাথে সাযুজ্যহীন, বরং ব্যক্তিমালিকানা ব্যবস্থার সাথে সংগতিপূর্ণ), সার্বিক শিক্ষায় ব্যয় হ্রাস করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়ন বলতে কেবল শিক্ষক-কর্মচারীর বেতনের খরচ দেওয়ার ধারণা ইত্যাদিসহ গবেষণা খাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না রাখার মাধ্যমে বাংলাদেশে অনেক বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে না। অন্যদিকে স্বাধীনতার পর থেকে দেশের অধিকাংশ সরকারপ্রধান বিশ্ববিদ্যলয়ের সারবস্তু, স্বাধীন চিন্তা ও মৌলিক জ্ঞানকে ভয় পেয়ে আসছে, চ্যালেঞ্জড হওয়াকে এড়াতে চেয়েছে। দৃশ্যমান যে, এদেশের রাজনীতিবিদরা এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক হয়ে ওঠেন নি। ফলে বিশ্ববিদ্যায়ের স্বাধীন চিন্তাপ্রক্রিয়া ব্যাহত করে দলীয় অনুগত বাহিনী তৈরি করতে তাঁরা অধিক মনোযোগী ছিলেন। তারই ফল হিসেবে হয়তো রাষ্ট্রের তল্পিবাহক কিছুসংখ্যক ‘জ্বি হুজুর’ শিক্ষক, সর্বোচ্চ নির্বাহীর বক্তব্যে নিহিত থাকা শিক্ষকদের প্রতি স্পষ্ট তাচ্ছিল্য ও শাসানোর সুরকে অন্য কারও ষড়যন্ত্র হিসেবে বুঝতে চান! তবে পাঠক আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, কিছু ব্যতিক্রম বাদে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা স্বাধীন ও মৌলিক চিন্তার সামর্থ্যকে জলাঞ্জলি দিতে রাজি নন। তাঁরা সমাজ ও মানুষের জন্য বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের জ্ঞানচর্চার উৎকর্ষকে চূড়ায় নিয়ে যেতে আগ্রহী। কিন্তু তাঁদের জন্য প্রতিকূলতা সৃষ্টির সকল আয়োজন আজ সম্পন্ন।

বেশি কিছু নয়, কেবল কয়েকটি নীতিগত সিদ্ধান্তই বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়কে সেই জায়গায় নিয়ে যেতে পারে। প্রথমটি হচ্ছ, শিক্ষকের বেতন ভাতা ও গবেষণার জন্য এমন অর্থ বরাদ্দ করা যাতে তাকে নিত্য চাল-ডাল-নুনের হিসেব কষতে না হয়, এবং শিক্ষা ও গবেষণার জন্য তাঁরা সম্পূর্ণ নিবেদিত হতে পারেন। দ্বিতীয়টি হলো, দেশের রাজনীতিবিদরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিল্লায়ই ছেড়ে দিতে পারতেন! একটি কাজ করলেই তার কতক পূর্ণ হয় – যদি উপাচার্য নিয়োগে রাষ্ট্রের, রাজনৈতিক দলের কোনো হস্তক্ষেপ না থাকে। এরপর আসে শিক্ষক নিয়োগে অলিখিত হস্তক্ষেপের চর্চা বন্ধ করা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেই নিজের ব্যবস্থার অভ্যন্তরে শিক্ষকদের সুকর্মের পুরস্কার ও দুষ্কর্মের তিরস্কারের রীতি জারি করবে, সেটা দেশের জনগণ তথা রাজনীতিবিদদের দাবি হতেই পারে।

এইসব নীতিগত পরিবর্তন হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর খোলনলচে বদলে ফেলতে কেবল পরবর্তী দশকই যথেষ্ট। কিন্তু নীতিগত পরিবর্তনের জন্য প্রথমত প্রয়োজন রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও সর্বোপরি সদিচ্ছার। এরপরেও আরও কিছু কাজ রাষ্ট্রের রয়ে যাবে। সর্বজনের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান বাড়ানোর স্বার্থে, তার শ্রেণিকক্ষ, গবেষণাগার, লাইব্রেরি, জাদুঘর ইত্যাদির আধুনিকায়ন করতে হবে, সেইজন্যে অর্থ বরাদ্দ বাড়াতেই হবে। এরপরের কাজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। তার মধ্যে অন্যতম হল, শিক্ষাদান আধুনিকায়ন করতে দেশ, সমাজ অনুযায়ী গবেষণার ভিত্তিতে চাহিদা ও লক্ষ নির্ধারণ। শিক্ষাদান শিক্ষার্থীমুখি করতে, পাঠদান পদ্ধতির উৎকর্ষের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, প্রয়োজনে তার জন্য কাঠামো নির্মাণ আবশ্যকীয়। শিক্ষকদের বাস্তবধর্মী কর্মঘণ্টা অনুমান করা প্রয়োজন এবং শুধু শিক্ষক নয়, শিক্ষা-সহকারীর ধারণা সবক্ষেত্রে চালু করা একান্ত জরুরি। তবেই শিক্ষার্থীদের চিন্তার বিকাশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা অর্থপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে, ভবিষ্যত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের তাতে লাভ বই ক্ষতি হবে না। তবে বলা প্রয়োজন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার আগের ধাপে শিক্ষার সব পর্যায়ে পেডাগজিক্যাল ও কাঠামোগত পরিবর্তন না আনলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষায় রাতারাতি কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে না। ফলে রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য আগে প্রয়োজন ফাঁপা বুলি নয়, বরং শিক্ষার অগ্রাধিকারে সত্যিকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়-ভাবনা এবং বেতন বৈষম্য সংক্রান্ত চলমান আন্দোলনকে বিবেচনায় রেখে আমরা কয়েকটি সুস্পষ্ট দাবি করছি: এক. অষ্টম বেতন কাঠামোতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পেশাগত যে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন তা দূর করতে হবে; দুই. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার উন্নয়নের সম্পূর্ণ দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। জিডিপির অন্তত ৪% শিক্ষার জন্য ব্যয় করতে হবে। বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, সবক্ষেত্রে এই বরাদ্দের সুষ্ঠু বণ্টন করতে হবে। সব পর্যায়ের শিক্ষকদের পৃথক বেতনকাঠামো তারই আওতায় চলে আসবে। এখন পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষায় জিডিপির বরাদ্দ বাংলাদেশে সবচেয়ে কম। শিক্ষায় বিনিয়োগ ছাড়া কোনো দেশই নিম্ন কিংবা মধ্য পর্যায় থেকে উন্নত পর্যায়ে যেতে পারে নি। 

----------
লেখকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের সদস্য। লেখাটি আংশিক পরিবর্তনসহ সমকাল (১৬ অক্টোবর, ২০১৫) প্রকাশ করেছে।

Published in: a. https://goo.gl/e68lml , b. http://www.samakal.net/2015/10/16/167781 (উচ্চশিক্ষা নিয়ে ভাবনা)

পণ্ডিত মশায়ের বেতন সাহেবের কুকুরের কয়টি ঠ্যাঙের সমান


শিশির ভট্টাচার্য্য


ভিক্টোরীয় যুগে সমতট অঞ্চলের এক অসহায় পণ্ডিত মশাই নাকি জানতে চেয়েছিলেন, তাঁর বেতন স্কুল ইন্সপেক্টর সাহেবের কুকুরের কয়টি ঠ্যাঙের সমান। এর বহুদিন পর পণ্ডিতের উত্তরপুরুষরা দুঃসাহসী হয়ে কুকুরের ঠ্যাঙ বাদ দিয়ে সাহেবের দুই ঠ্যাঙের সমান বেতন দাবি করে বসেছিল। তখন মহারানি ভিক্টোরিয়া নাকি ক্ষুব্ধ হয়ে পত্রকারদের জানাতে বলেছিলেন, সাহেবরা আদতেই পণ্ডিতদের চেয়ে বেশি সুবিধা ভোগ করেন কিনা।

সমতটের সাহেবপাড়ায় যত সাহেব তার কমপক্ষে দ্বিগুণ গাড়ি। কত জন অধ্যাপকের গাড়ি আছে? গাড়ি কেনা, গাড়ি রাখা, সারথীর বেতনের জন্যে অধ্যাপককে কি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অর্থ প্রদান করা হয়? অধ্যাপকরা কি সাহেবদের মতো কারণে-অকারণে রাষ্ট্রীয় খরচে ঘন ঘন বিদেশভ্রমণের সুযোগ পান? অবসরে যাবার পর গড়ে কার বেশি সম্পদ থাকে, অধ্যাপকের, নাকি সাহেবের?

অধ্যাপকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়ে উপরি আয় করেন। হ্যাঁ, কিছু অধ্যাপকের এ সুযোগ আছে বটে। কিন্তু সাহেবদের মধ্যেও অনেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারি ইনস্টিটিউটগুলোতে ক্লাস নেন। দুজনের মধ্যে পার্থক্য এই যে, বেসরকারি কর্মস্থলে যাবার জন্যে সাহেব সরকারি গাড়ি হাঁকাতে পারেন। শিক্ষকের গমনাগমনের খরচ তাঁর নিজের।

পদোন্নতি পাওয়ার জন্য একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে শুধু নির্দিষ্ট সময় চাকরি করলেই হয় না। তাঁকে নির্দিষ্ট সংখ্যক গবেষণাপত্র লিখতে হয়, দেশে বা বিদেশে গিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে আসতে হয়। শ্রেণিকক্ষে পড়িয়েই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। বাসায় ফিরেও তাঁকে প্রশ্ন করা, খাতা দেখা, পরের দিনের বক্তৃতার জন্যে প্রস্তুত হওয়া, পদোন্নতি বা আত্মার তাগিদে গবেষণা করা ইত্যাদি হাজারো কাজ করতে হয়।

শিক্ষকের সঙ্গে অন্যসব পেশার পার্থক্য এই যে, শিক্ষকের শিক্ষা পেয়েই একটি অবোধ শিশু তার অসংস্কৃত, অশিক্ষিত পর্যায় অতিক্রম করে কালক্রমে একজন সফল সাহেব-কাজী-সিপাহী-রাজনীতিক এবং সার্থক মানুষ হয়ে ওঠে। সমাজের অন্য কোনো পেশাই শিশুর এই উত্তরণ ঘটাতে পারে না। অন্য কোনো পেশাই ব্যক্তিকে শিক্ষকে রূপান্তরিত করার ক্ষমতা রাখে না।

বিভিন্ন জাতীয় সংকটে সমতটের জনসমাজ তাকিয়ে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মুখের দিকে। তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হয়, জাতিকে দিকনির্দেশনা দিতে হয়। এক-একাদশ নামক সংকটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দুই নেত্রীর পাশে ছিলেন। শিক্ষকরা গ্রেপ্তার হয়েছেন। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কারণেই ‘মাইনাস-টু ফরমুলা’ কার্যকর করা যায়নি। তখন সাহেব-কাজী-সিপাহসালাররা কেউ রাজপথে ছিলেন না, থাকার কথাও নয়; কারণ তাদেরই কেউ কেউ নাকি অন্তরাল থেকে পুতুলনাচের সুতা টানছিলেন। এক-একাদশ প্রতিরোধ করার সুফল এখন কারা ভোগ করছে? মুজতবা আলী কি সাধে লিখেছেন: ‘দই খাবেন রমাকান্ত, বিকারের বেলায় গোবর্ধন!’

বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা নাকি ক্লাস নেন না, গবেষণা করেন না, রঙবেরঙের রাজনীতি করেন, অনেকেই নাকি মধ্যরাতের ‘টকসওয়ার’। যত দোষ অধ্যাপক ঘোষ! শতকরা কত জন শিক্ষক ক্লাস নেন না, কত জন গবেষণা করেন না, কত জন রাজনীতি করেন? গত কয়েক অর্থবছরে শিক্ষাখাতে বাজেট কত কমেছে? গবেষণার জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থ কি বিনিয়োগ করা হয়েছে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে? ক্ষমতাসীনরা কখনও কি শিক্ষকদের রাজনীতি করতে নিরুৎসাহিত করেছেন? ছাত্রসংসদ নির্বাচনহীন নামকাওয়াস্তে ছাত্র (মূলত স্বার্থ) রাজনীতির পেছনে কারা ইন্ধন যোগায়? বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরাও কি কোনো এক সময় বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের জন্যে দিনের পর দিন হরতাল করেননি? যদি কারও বিরুদ্ধে ঠিকমতো কর্তব্য পালন না করার অভিযোগ পাওয়া যায়, তবে সেই শিক্ষককে পদচ্যুত করা হয় না কেন? সমতটের সাহেব-কাজী-সিপাহসালারদের সকলেই কি তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব ঠিকঠাকমতো পালন করছেন? দক্ষতার মাপকাঠিতে এ দেশের সাহেব-কাজী-সিপাহীরা কোন পর্যায়ে আছেন?

বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ৫০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান নেই। আহ্লাদিত হবার মতো খবর নয়, তাতে সন্দেহ কী! কিন্তু বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ৫০০ সাহেব-কাজী-সিপাহীসালারদের মধ্যে সমতটের একজন সাহেব-কাজী-সিপাহীসালারও কি আছেন?

শুনেছি, ৭ম বেতন স্কেলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের টাইম স্কেল ছিল; অর্থাৎ কেউ তার স্কেলের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে গেলে এবং কোনো কারণে তার প্রমোশন না হলে তাকে অটোমেটিক্যালি উচ্চতর একটি স্কেলে উন্নীত করা হত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এই সুবিধা ছিল না। তাদের মধ্যে শুধু অধ্যাপকরা রাষ্ট্রপতির বিশেষ আদেশে একটি উচ্চতর গ্রেডে উন্নীত হতেন যাকে বলা হয় ‘সিলেকশন গ্রেড’। সেটিও সবাই পেতেন না। অধ্যাপক পদে চাকুরির বয়স কমপক্ষে দশ বৎসর হলে একজন অধ্যাপক সিলেকশন গ্রেড পাবার যোগ্যতা অর্জন করতেন এবং সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষক সংখ্যার শতকরা ২৫ ভাগ মাত্র এই গ্রেড পেতেন। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষকদের ছিল সীমিত সিলেকশন গ্রেড, আর বাকি সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারির ছিল অবারিত অটোমেটিক গ্রেড। সুতরাং ৭ম বেতন স্কেল বা তারও অনেক আগে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছেন।

৮ম বেতন স্কেলে শিক্ষকরা নতুন যে বৈষম্যের শিকার হবেন সেটি নাকি এই যে, বেতনের দিক থেকে তাঁরা আর কখনও সাহেবের পর্যায়ে যেতে পারবেন না। ‘যুগ্ম’ সাহেবের সমপর্যায়েই তাদের চিরতরে থেমে থাকতে হবে। একজন সাহেব যখন নতুন চাকুরিতে ঢুকবেন তখন কোনো একদিন সর্বোচ্চ বেতন পাবার আশা তিনি করতে পারবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষকরাও ৭ম বেতন স্কেল পর্যন্ত অনুরূপ আশা করতে পারতেন। ক্ষমতা যখন জেনেশুনে শিক্ষকের মর্যাদাহানি করছে, তখন কেন মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা পেশার প্রতি আগ্রহী হবে? কেন তারা বিদেশের উচ্চ বেতন ছেড়ে দেশে ফিরে আসবে, যদি তাদের পেশার ন্যূনতম সম্মানটুকুও দেওয়া না হয়?

যেহেতু ৮ম বেতন স্কেলে প্রজাতন্ত্রের সব কর্মকর্তা-কর্মচারির বেতন প্রতি বৎসর নির্দিষ্ট হারে বৃদ্ধি করা হবে, সেহেতু অটোমেটিক টাইম স্কেল বাতিল করা হয়েছে। কিন্তু অধ্যাপকদের যে বিশেষ সিলেকশন গ্রেড, সেটা কি বাতিল হয়েছে? এর উত্তর ‘হ্যাঁ’ হতে পারে, নাও হতে পারে। যেহেতু রাষ্ট্রপতির বিশেষ আদেশ এখনও বহাল রয়েছে, সেহেতু ধরা নেওয়া যেতে পারে যে, অষ্টম বেতন স্কেলেও সিলেকশন গ্রেড অব্যাহত রয়েছে। আবার সিলেকশন গ্রেড যেহেতু এক ধরনের টাইম স্কেল (অটোমেটিক না হলেও) সেহেতু সেটি বাতিল বিবেচিত হতে পারে।

তালি এক হাতে বাজে না। সমতটের বিশেষ আর্থরাজনৈতিক অবস্থার কারণে পণ্ডিত মশাইদের একটি ক্ষুদ্র অংশ তাদের তুচ্ছ ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে ক্ষমতার আশেপাশে ঘুরঘুর করেন। সঙ্গত কারণেই শিক্ষকদের সম্পর্কে ভুল ধারণা সৃষ্টি হয় ক্ষমতাগর্বী রাজনীতিক এবং গুজবপ্রবণ, অক্ষম আমজনতার মনে। শাসকরা নিজেদের প্রয়োজনে অধ্যাপকের কাছে এসে বিনয়াবত হয়ে উপদেশভিক্ষা করবেন– এটাই উপমহাদেশের শাশ্বত ঐতিহ্য।

পণ্ডিতরা যখন স্বজাতির মতো শাসক বা সাহেবের কাছে গিয়ে অনুগ্রহভিক্ষা করেন, তখনই স্বজাতির সম্মানহানির দায়টাও তাদের উপরই অনেকখানি বর্তায় বৈকি।

শিশির ভট্টাচার্য্য: অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Published in: http://opinion.bdnews24.com/bangla/archives/32061

মেধা পরিমাপের সূচক এবং একটি হাইপোথেসিস

Sujoy Subroto

ভেবেছিলাম আমলা বনাম শিক্ষক এই ইস্যুতে আর কোন আলোচনায় যাব না কারন এতে করে অনেকের সাথেই এক ধরনের ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হচ্ছে । নিতান্ত বাধ্য হয়েই কিছু জিনিস ক্ল্যারিফাই করার জন্যে আবার লিখতে বসলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়া, পদোন্নতি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে আগে একদিন আলোচনা করেছি আজকে মুলত আলোচনা করব কোন পেশায় এখনও মেধাবীদের সংখ্যা বেশী এই ইস্যুটা নিয়ে । অনেকেই বলছেন আমলা হওয়া অনেক কঠিন এবং উনারাই সবচেয়ে মেধাবী আবার অনেক শিক্ষক দাবী করছেন মেধাবীদের মধ্যে যারা প্রথম সারির শিক্ষার্থী তারাই শিক্ষক হয় । আজকে এই বিষয় টা নিয়ে একটা ফ্যাক্ট বেইসড আলোচনা করব।

আসুন আমরা একটা হাইপোথেসিস চেক করি > 
আমি ধরেই নিলাম বিসিএস ক্যাডার এবং বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষকদের মধ্যে মেধার কোন পার্থক্য নেই এবং দুইটা পেশায়ই মেধাবীদের সংখ্যা সমান সমান > এইটা হচ্ছে আমার নাল হাইপোথেসিস 
আসুন প্রথমেই দেখে নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং বিসিএস ক্যাডার হবার জন্যে নুন্যতম ক্রাইটেরিয়া কি কি 
১। শিক্ষক পদে আবেদনের জন্যে স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর অথবা মাস্টার্স পরীক্ষায় মিনিমাম সিজিপিএ ৩.৫ থাকতে হবে ৪ এর মধ্যে, এস এস সি এবং এইচ এইচ সি পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি অথবা সিজিপিএ ৪ থাকতে হবে , এছাড়া যদি সায়েন্টিফিক পেপার ও রিসার্চ অভিজ্ঞতা থাকে তাইলে অগ্রাধিকার পাবে ।
২। বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহনের জন্যে সেইরকম কোন ক্রাইটেরিয়া নাই , এইখানে ডিগ্রি পাস এর ছাত্র থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারীরাও আবেদন করতে পারে এবং একাডেমিক ফলাফল এইখানে কোন বিবেচ্য বিষয় নয় । সম্ভবত এই একটা জায়গায়ই রাষ্ট্র আক্ষরিক অর্থেই সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে ।

একদম শুরু থেকে শুরি করি । পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হচ্ছে সবচেয়ে কম্পিটিটিভ একটা এক্সাম এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নের কোয়ালিটি নিয়ে কারও দ্বিমত থাকার কথা না । এই লাখ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে ভর্তি পরীক্ষায় যারা মেধাক্রমে উপরের দিকে থাকে তারাই কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায় । তার মানে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তারা সবাই কমবেশি মেধাবী কারন শুরুতেই তাদের মেধার একটা পরীক্ষা দিতে হয়। সাম্প্রতিক কালে আমরা দেখেছি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অধিকাংশ ছাত্রই পাশ মার্কস পায় না এবং ইংরেজিতে প্রায় শতকরা ৮০- ৯০ ভাগ শিক্ষার্থী ফেল করে । কাজেই এইরকম একটা স্ট্যান্ডার্ড প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যারা বেরিয়ে আসে তাদেরকে কিন্তু মেধাবী বলতেই হবে । এমনও অনেক ছাত্র দেখেছি যাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফরম কেনার মত যোগ্যতা নেই কিন্তু বিসিএস পরীক্ষা তে অলরেডি ২ বার ভাইবা পর্যন্ত দিয়েছে, নিশ্চয়ই এর মধ্যে অনেকে ক্যডারও হয়ে গেছে। এখন যে ছেলেটি একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফর্ম কিনতে পারে না সেই ছেলেটি যদি আমলা হয়ে শিক্ষকদের চেয়ে নিজেকে বেশী মেধাবী মনে করে তাহলে সেইটা কিন্তু একধরনের বাতুলতা। আর একটা পরীক্ষিত সত্য হল যে যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায় না তারাই কিন্তু ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়য়ে ভর্তি হয় এবং এই ক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম অবশ্যই আছে কিন্তু এর সংখ্যা একেবারেই নগণ্য এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েও নিশ্চয়ই অনেক মেধাবী আছেন । অথচ, বিসিএস পরীক্ষায় একটা বিশাল অংশই উত্তীর্ন হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং তারই ফলশ্রুতিতে আমরা দেখি যে ৩৪ তম বিসিএস পরীক্ষায় ঢাকা কলেজের অবস্থান সরকারি কলেজে প্রথম , পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজ মিলে ঢাকা কলেজর অবস্থান সারা দেশে দ্বিতীয় ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা শিক্ষক হয় তারা সবাই কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের এর শিক্ষার্থী । অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া যাবে না এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হতে হলে আপনাকে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েই হতে হবে, এইখানে ভকিচকির কোন সুযোগ নেই । এর মধ্যে সেইসব ছাত্ররাই শিক্ষক হয় যারা এতসব মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরো ব্যাচেলর পরীক্ষায় শীর্ষস্থানে থাকে । এখন যে একাডেমিক কারিকুলামে একজন শিক্ষার্থী সবসময় সর্বোচ্চ গ্রেড পেয়ে শিক্ষক হয় সেই একই কারিকুলামে যারা খারাপ ফলাফল কিংবা টেনেটুনে পাশ করে বিসিএস দিয়ে আমলা হয় এবং নিজেকে শিক্ষকের চেয়ে মেধাবি বলে দাবি করে তাহলে সেইটা কিন্তু হাস্যকর শুনাবে । আমি আগেও বলেছি যে মেধা যাচাইয়ের আসলেই তেমন কোন আদর্শ ক্রাইটেরিয়া নেই এবং একমাত্র সিজিপিএ এর উপর ভিত্তি করে বিশ্বের কোন উন্নত দেশে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় না, কাজেই রেজাল্ট যেন কোনভাবেই শিক্ষক নিয়োগের একমাত্র ডিটারমিনেণ্ট না হয় এবং অবশ্যই নিয়োগ পক্রিয়ার আধুনিকায়ন করা এবং সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা দরকার । কিন্তু তাই বলে ঢালাওভাবে বললে হবে না যে শিক্ষকদের কোন মেধা নেই এবং সব আমলারাই শিক্ষকদের চেয়ে বেশী মেধাবী এবং এইজন্যে উনাদেরকে শিক্ষকদেরকে উপরে স্থান দিতে হবে ।
এখন আমরা যদি দেখি শতকরা ৯৫ ভাগ শিক্ষক ক্লাসের টপ ৫% শিক্ষার্থী থেকে নিয়োগ হন এবং শতকরা ৩০ % ক্যাডার ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় , শতকরা ৩০- ৪০% ক্যাডার বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝারি মানের শিক্ষার্থী এবং বাকি ২০-৩০ % বিশ্ববিদ্যালয়ের টপ ১০ % শিক্ষার্থী থেকে নিয়োগ হন তাহলেও কিন্তু মানতে হবে যে সংখ্যার দিকে থেকে এখনও শিক্ষকতা পেশায়ই সবচেয়ে বেশী মেধাবিরা আছেন । এবং বিসিএস এর ক্ষেত্রে কিন্তু কোটা একটা বিশাল ফ্যাক্টর কারন ৫৬ % ক্যাডার কোটা থেকে নিয়োগ পান অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় কিন্তু কোটার কোন ব্যাপার স্যাপার নেই যাও আছে তা শুধু আদিবাসী ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এবং এইটাও খুবই নগণ্য, তবে শিক্ষক নিয়োগে দলীয়করন আর আত্মীয়করন যাই বলেন এক্ষেত্রে কিন্তু কোন কোটা নাই । যে পদ্ধতিতে মেধাবীদের চেয়ে মেধাহীনদের কে প্রাধান্য দেওয়া হয় সেই পদ্ধতি নিয়ে আসলেই ঢোল পিটানো কিংবা গর্ব করার তেমন কিছু নেই । তবে এই রকম একটা বৈষম্য মূলক সিস্টেমের মধ্যে দিয়েও মেধা কোটায় যে ৪৪ % ছাত্র বিসিএস ক্যাডার হয় এবং তাদের মধ্যে থেকে যারা আমলা হয় তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করাটা আসলেই অবান্তর । কাজেই মেধা মাপার জন্যে মুখস্থ বেসড যে সনাতনী পদ্বতি (পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল, ভর্তি পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফল) আমাদের দেশে ব্যাবহার করা হয় সেই হিসেবে দেখলেও কিন্তু স্বীকার করতে হবে যে আমলাদের সবাই সমান মেধাবী না এবং আনুপাতিক হারে এইটা শিক্ষকদের চেয়ে কম। যেহেতু মেধাবীদের সংখ্যা শিক্ষকতা পেশায় তুলনামুলভাবে আমালদের চেয়ে বেশী কাজেই আমাদের নাল হাইপোথেসিস রিজেক্ট করতে হবে এবং অল্টারনেটিভ হাইপোথেসিস এক্সেপ্ট করতে হবে । সেই ক্ষেত্রে আমাদেরকে মেনে নিতে হবে যে সব শিক্ষক এবং সব আমালাদের মেধা সমান না এবং আনুপাতিক হারে শিক্ষকতা পেশায় এখনও মেধাবীদের সংখ্যা অনেক বেশী । সত্যি কথা বলতে কি স্ট্যাটিসটিক্স বেসড বিশ্লেষনের একটা বড় দুর্বলতা হল যে এইটা বাস্তব পরিস্থিতির সাথে অনেক সময় খাপ খায় না কারন একটা সমস্যার সবগুলো দিক একই সাথে অন্তর্ভুক্ত করা প্রায় অসম্ভব । কাজেই বাস্তবে আমরা এমন অসংখ্য শিক্ষক পাব যারা আসলেই এই পেশার জন্যে উপযুক্ত না ঠিক একইভাবে অসংখ্য আমলা পাব যারা প্রচন্ড মেধাবী এবং সৎ। যাই হোক আমি শুধু ফ্যাক্টগুলো নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছি এবং এতে করে যদি কেউ কষ্ট পান তাহলে আমি আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী । পর্যায়ক্রমে বিসিএস পরীক্ষা, কোটা পদ্বতি, আমলাতন্ত্রের দুর্নীতি এবং শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করব ।

Wednesday, October 14, 2015

মন্ত্রীদের মন্তব্যের বিপরীতে শিক্ষক জীবনের না বলা কথা

মোঃ তরিকুল ইসলাম

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য এক ধরনের ক্রান্তিকাল চলছে বর্তমানে। এই ক্রান্তিকাল থেকে শিক্ষক সমাজ কিভাবে নিজেদের বের করে আনবেন তার উপর নির্ভর করছে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার গতি প্রকৃতি।

এই ক্রান্তিকাল এমনি এমনি আসেনি। বেশ কিছু মানুষের অবদান আছে এটাতে। এইসব মানুষদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন ও আছেন। শুরুটা অবশ্য মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন ই করেছিলেন। উনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্মানহানি করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজের পায়ে দাড়ানোর সুপারিশ করেছেন। শিক্ষকদের গায়ে লেগেছে উনার অপমানমূলক কথাবার্তা। সেই অপমানের রেশ শেষ হতে না হতেই অর্থমন্ত্রী মহোদয় আসলেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্পর্কে উনার থিয়োরি নিয়ে। এর পর একে একে শিক্ষামন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী নিজেদের থিয়োরি দিলেন শিক্ষকদের নিয়ে। আমি উনাদের মত বড় মানুষদের কাতারের কেউ না, তবে আমার মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আমি উনাদের চেয়ে বেশি দেখেছি, কারন আমি এদের সাথেই দিনের বেশিরভাগ সময় কাটাই গত বেশ কয়েক বছর ধরে। আমার দেখার আলোকে আমি বলতে পারি উনারা যা বলেছেন তা সঠিক নয়। আমার দেখা শিক্ষক জীবনের কিছু চিত্র তুলে ধরছি এখানে, আশা করবো এখান থেকে উনারা নতুন কিছু জানতে পারবেন। 

অর্থমন্ত্রী বলেছেন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জ্ঞানের অভাব এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দুর্নীতি হয়। মন্ত্রী মহোদয় ঠিকই বলেছেন যে আমাদের জ্ঞানের অভাব আছে, আমরা নিজেরাও কোনদিন দাবি করিনা যে আমাদের জ্ঞান পরিপূর্ন হয়েছে। বরং আমরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জ্ঞানের সন্ধান করি, নাহলে নিজেকে অপরিপূর্ন মনে হয়। কিন্তু উনি কি নিজেকে পরিপূর্ন মনে করেন? ঠিক বুঝতে এবং মিলাতে পারছিনা। হলমার্ক কেলেঙ্কারির হলমার্কটা উনার গায়ে সাটানো না? যাকগে, এইরকম আরো অনেক উদাহরন থাকলেও ঐদিকে যাবোনা। আমার মনে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, শিক্ষকদের জ্ঞান, এবং তাদের জীবন সম্পর্কে মন্ত্রী মহোদয়ের জানার পরিধি বেশ ছোট এবং তা দিনের পর দিন এক যায়গায় থেমে আছে, বাড়ছে না। তাই মাননীয় মন্ত্রী শিক্ষকদের সম্পর্কে সঠিক মন্তব্য করতে পারছেন না। একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাজের সাথে সংহতি রেখে আমার নিজের দেখা শিক্ষক জীবন নিয়ে কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করার মাধ্যমে শিক্ষকদের ব্যাপারে উনার জানার পরিধি কিছুটা হলেও বাড়িয়ে দেয়ার জন্য আমার এই লেখা। আশা করবো এরপরে শিক্ষকদের নিয়ে এইরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করা থেকে উনি নিজেকে বিরত রাখতে সক্ষম হবেন।

ইরাসমুস মুন্ডুস স্কলার হিসেবে পড়ার সময় ফ্রান্সে বসে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পদের জন্য দরখাস্তের ফরম পুরন করার সময় আমার চেয়ে বেশি এবং কম শিক্ষিত অনেকে বলেছিলেন এই ভুলটা যেন না করি। দেশে না ফেরার পরামর্শ দিয়েছিলেন সবাই। কিন্তু ততদিনে তিন বছর বিদেশে থেকে দেশপ্রেমটা মারাত্মকভাবে মনের মধ্যে বসে গিয়েছিলো। বারবার মনে হয়েছিলো আমার দেশকে কিছু দিতে হবে, দেশের জন্য কিছু করতে হবে। সব পরামর্শ উপেক্ষা করে দেশের পথে যাত্রা করি এবং খুব অবাক হয়েছিলাম যখন দেখলাম আমার দরখাস্তখানা মঞ্জুর হয়েছিলো। শুরু হয়েছিলো শিক্ষক হিসেবে পথচলা। মাঝখানে অনেক ভাললাগা অনেক খারাপলাগা বাদ দিলে এখনো চলছি সেই পথে। পরিবর্তন বলতে শুধু খুলনা ছেড়ে জাহাঙ্গীরনগরে চলে আসা। ইতিমধ্যে বিভাগের সভাপতি, অনুষদের ডীন, সিন্ডিকেট সদস্য হয়ে দেখার সুযোগ হয়েছে অনেক কিছুই। অনেক সম্মান পেয়েছি আবার অনেক অসম্মানও জুটেছে কপালে। কিন্তু কোনদিন এতটা অপমানিত বোধ করিনি যতটা এখন করছি প্রধানমন্ত্রীসহ বাকি মন্ত্রীদের বক্তব্যে। 

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়ে যতটা অবাক হয়েছি তারচেয়ে বেশি অবাক হয়েছি চাকরি করতে গিয়ে। দেখেছি রাজনীতি কি করে সব কিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে একের পর এক। প্রথমবার অবাক হয়েছিলাম যখন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন নির্ধারনী কমিটি আমার একটা ইনক্রিমেন্ট বাদ দিয়ে দিয়েছিলো কারন তারা আমার বিদেশী ডিগ্রীর সমতা বিধান করতে পারছেন না। ফলাফল হলো খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা একজন গ্রাজুয়েট এর থেকে আমি একটা ইনক্রিমেন্ট কম পাচ্ছি যদিও আমার দুটো বিদেশী মাস্টার ডিগ্রী আছে পৃথিবীর চারটা বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। খারাপ লেগেছে, কিন্তু রাজনীতির পথে পা দেইনি। দিলে হয়তো আমার সেই ইনক্রিমেন্ট হয়ে যেত। কিন্তু টাকাটাকে বড় করে দেখিনি, পড়াতে গিয়েছিলাম। পড়ানোতেই আনন্দ পাচ্ছিলাম। এই ইনক্রিমেন্ট আমাকে তিনবছর ধরে ভুগিয়েছিলো। তিনবছর ধরে আমি ওই পরিমান টাকাটা পাইনি। যিনি এই কাজটা করেছিলেন তাকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলাম কি মজা পেয়েছেন এইটা করে। আজো জিজ্ঞেস করিনি কারন আমি তো শিক্ষক, আমার এত আক্রমনাত্মক হওয়া সাজেনা। ঐ ভদ্রলোকের চেয়ে অনেক বড় যায়গায় যাবার সুযোগ আমি ইতিমধ্যে পেয়েছি। সেদিন উনার উপড়ে ক্ষেপে গিয়ে রাজনীতি করলে হয়তো সেটা হতনা।

অর্থমন্ত্রীর কথা মেনে নিলে আসলেই আমার জ্ঞানের অভাব আছে। ছয় হাজার টাকা বেতনের চাকরি করতে গিয়ে আমি একটা ইনক্রিমেন্ট না নিয়ে থাকার বিলাসিতা দেখালাম কি করে? আমার উচিৎ ছিলো ক্লাসরুমের বদলে রাজনৈতিক ময়দানে গিয়ে উচ্চবাচ্চ করা যাতে যারা আমার ইনক্রিমেন্ট বাদ দিয়েছে তারা ভয়ে হলেও সেটা দিয়ে দেয়। মজার ব্যাপার হলো অর্থমন্ত্রী কিন্তু এখানে সঠিক আছেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালগুলোতে শক্ত হলে আসলেই পোক্ত থাকা যায়, আমি শক্ত হতে পারলে পোক্ত থাকতে পারতাম। কিন্তু মন্ত্রী মহোদয় হয়তো জানেন না যে এই শক্ত হওয়াটাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকই এক ধরনের অসভ্যতামি মনে করে থাকেন। আমি অসভ্য হতে চাইনি। শিক্ষামন্ত্রীর কথামত আমি কারো বাসায় গিয়ে পড়িয়ে টাকাও কামাতে পারিনি। প্রধানমন্ত্রীর কাছেও কোনদিন গিয়ে বলিনি যে বেতন বাড়িয়ে দেন।

খুলনা ছেড়ে আসলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়েছি। খুলনা ছেড়ে আসার সময় একজন শিক্ষক বলেছিলেন যে তুমি ছোট পুকুর ছেড়ে বড় পুকুরে যাচ্ছ, ওখানে আরো বড় বড় শিয়াল মাছ আছে যাদের কাটায় আরো বেশি বিষ আছে। আসার পরে টের পেয়েছি কথা সত্যি। কিন্তু যেহেতু পড়াতে গিয়েছিলাম, ঐ জায়গায়ই বেশি সময় দিতাম। কে কত বড় মাছ তা নিয়ে মাথা ঘামাতে হতনা। এক সময় মাথায় আঘাত করা শুরু হলে মাথা ঘামানো শুরু করলাম। মাথা ঘামাতে গিয়ে যা দেখলাম তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক হয়েছিলো আমার জন্য। কোনদিন শেয়ার করিনি। আজ করছি যদিও কারো নাম উল্লেখ করবোনা। এক নির্বাচনী প্রচারে সিনিয়র শিক্ষকদের সাথে একদিন একজন সদ্য নিয়োগ পাওয়া প্রভাষকের বাসায় গিয়েছিলাম। শিক্ষক ভদ্রলোক আমাদের দেখে অত্যন্ত লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলেন। কেমন যেন কাচুমাচু করছিলেন। উনি কোন কথাই বলতে পারছিলেন না। আমি একটু অবাক হয়েছিলাম, মনে মনে ভাবছিলাম এই ভোটটা মনে হয় পাবোনা। ভাবতে ভাবতে সাথের সিনিয়র শিক্ষকদের সাথে অন্য বাসার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। ঐ শিক্ষক মহোদয় আমাকে পিছন থেকে ডাকলেন আলাদা করে। আমি কাছে গেলে উনি আমাকে বললেন যে, বিশ্বাস করেন আমি সোফা সেটের অর্ডার দিয়ে এসেছি। দু-চারদিনের মধ্যে এসে যাবে। আপনারা আরেকদিনে আসবেন প্লীজ। আজ আপনাদের বসাতে পারিনি ঠিকমত। আমি জানিনা আপনাদের অনুভুতি কিরকম হবে আমার ভোতা হয়ে গিয়েছিলো। আমি শুধু উনাকে জড়িয়ে ধরে চলে এসেছিলাম। জীবনে কোনদিন ভুলতে পারবোনা একজন শিক্ষকের সেই মুখ। বুজতে পারলাম সদা সদালাপী একজন শিক্ষক বাসায় আসার পরে এতক্ষন কেন এমন করছিলেন। আমাদের মন্ত্রীরা শিক্ষকদের এইরকম মুখ কোনদিন দেখেছেন কি? উনারা কি জানেন যে একজন বিশ্ববিদ্যালয় প্রভাষকের জীবন কি করে চলে? উনারা দুর্নীতি দেখেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। হয়তো আছেও, কিন্তু তা কতটা? বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতি কাদের মাধ্যমে আসে? উনারা নিজেরাই কি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যতটুকু দুর্নীতি হয় তার কারন নন? 

বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষক আছেন যারা নিজ বংশের প্রথম কেউ যে কিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন এবং মেধাবী হওয়াতে ভাগ্যক্রমে শিক্ষক হতে পেরেছেন। ভাগ্যক্রমে বলছি এই কারনে যে মন্ত্রী মহোদয়দের মত মানুষদের রাজনৈতিক মেরুকরনের কারনে আজকাল মেধাবীরাও যে শিক্ষক হতে পারবেন তার কোন নিশ্চয়তা নাই। এইসব শিক্ষকদের বংশ উনাদের দিকে তাকিয়ে থাকে যে একদিন উনারা বংশের মুখ উজ্জল করবেন। কিন্তু বংশের কেউ তো আসলে জানেন না বা বুঝতে পারেন না যে যিনি নিজের বাসায় বসার চেয়ার টেবিল যোগাড় করতে পারেন না, তিনি বংশের মুখ উজ্জ্বল করবেন কি করে। নিয়োগ পাবার পরে একজন শিক্ষক না নিজেকে খুশি করতে পারেন, না পারেন পরিবারকে খুশি করতে। মাথা নিচু হয়ে থাকে সবসময়, তারপরেও ক্লাসে গিয়ে মাথাটা উচু রাখতে হয়। কারন অনেক গুরুদায়িত্ব নিয়ে ক্লাসে যাই আমরা। আমাদেরকে ভাবতে হয় আমার মাথা নিচু দেখে যদি আমার ছাত্রছাত্রীরা মাথা উচু করতে ভুলে যায়। প্রতিনিয়ত নিজের সাথে প্রতারনা করে হলেও আমরা অন্যের জীবন গড়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখি। তার পুরস্কার হিসেবে মুহিত সাহেব আজ আমাদের মূর্খ বানিয়ে দিলেন, শিক্ষামন্ত্রী বাসার টিউটর বানিয়ে দিলেন, এবং প্রধানমন্ত্রী তাচ্ছিল্যের সুরে আমাদের নিয়ে কথা বললেন।

একদিন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক যিনি আমার বিভাগে খন্ডকালীন পড়াতেন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি কত টাকা বেতন পাই। আমি অবাক হয়েছিলাম এই দেখে যে উনি জানেন না। আমি নিজের বেতন বলার পরে উনি যেভাবে অবাক হয়েছিলেন সেটা দেখে আরো বেশি অবাক হয়েছি। উনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে আমি এত কম টাকা বেতন নিয়ে এত খেটে একটা বিভাগ চালাই (তখন বিভাগের সভাপতি ছিলাম)। উনি আমার জুনিয়র পদে থেকে বেতন পেতেন ৭০ হাজারের উপরে। উনি ভাবতেন আমার বেতন উনার চেয়ে বেশি হবে । উনি খুবই বিনয়ের সাথে আমাকে দুটো প্রশ্ন করেছিলেনঃ আমি কি করে ফার্নিচার কিনি এবং আমি কেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করিনা। হেসেছিলাম শুধু, কোন উত্তর দেইনি। মাথাও নিচু হয়নি সেদিন, কারন মাথাও ততদিনে প্রতিবাদ করা শুরু করেছে। আর কত নত হবে সে? আমাদের মন্ত্রীরা আমাদের এইসব মাথা নত হবার খবর কি রাখেন? রাখেন না। আমারাও চাইনা উনারা তা রাখবেন। উনারা দেশের ব্যবস্থাপনায় ব্যস্ত এবং আমরা তাতেই খুশি। কিন্তু না জেনে কথা বললে অন্যের অনুভুতিতে আঘাত লাগতে পারে এই সত্যটা কি মন্ত্রী মহোদয়রা জানেন না?

মন্ত্রী মহোদয়দের কথায় মাথায় আঘাতের পর আঘাত পড়ছে। এই প্রসঙ্গে একটা গল্প বলে লিখাটা শেষ করি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্লাসে গেলে মাঝে মাঝে বিচিত্র প্রতিভা লক্ষ করা যায়। অনেক ছেলেমেয়েই ওইটুকু বয়সে বয়সের চেয়ে বেশি কিছু শিখে ফেলে। আমি প্রশংসা করি এবং স্বীকার করে নেই যে উনারা ভাল জানেন। অনেক ক্ষেত্রে আমার চেয়েও বেশি জানেন। আবার কিছু ছেলেমেয়ে আছে যারা অনেক কিছু জানেনা কিন্তু একটা ভাব নেয় যে অনেক কিছু জানেন। আমি যেহেতু শিক্ষক আমি কাউকে হতাশ করতে পারিনা। আমি সবাইকেই বলি যে আপনারা অনেক জানেন, আমার চেয়েও বেশি জানেন। আমি হলাম কম জানা মানুষ, অন্য কোন চাকরি পাইনি তাই শিক্ষকতায় এসেছি। আমি এইটা এমনি এমনি বলতাম যাতে আমার ছাত্রছাত্রীদের কারো মনোবলে চিড় না ধরে যে উনারা জানেন না বা উনাদের স্বীকৃতি দেয়া হলোনা। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সরকার আমার মশকরাটাকে অনেক সিরিয়াসলি নিয়েছেন। নতুন বেতন স্কেল তার অফিসিয়াল ঘোষনা মাত্র। উনারা আসলেই আমাদের জ্ঞানহীন ভাবেন। নাহলে এইরকম একটা পরিস্থিতি তৈরি হতনা। জেনে অথবা না জেনে আজকাল সবাই শিক্ষকদের নিয়ে আজেবাজে কথা বলছেন। সরকারের অদক্ষ ব্যাবস্থাপনার কারনে আজ শিক্ষক সমাজ আর জনগন মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেছে। এটা কি দেশ বা সরকারের জন্য ভাল কিছু নিয়ে আসবে? ভেবে দেখা উচিত।

[লেখক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং বর্তমানে অস্ট্রেলিয়াতে গবেষণারত]

Tuesday, October 13, 2015

আন্দোলনে যাচ্ছে ২৬টি ক্যাডার - সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল দাবি


নতুন বেতন কাঠামোতে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বহাল রাখার দাবিতে আন্দোলনে যাচ্ছে ২৬টি ক্যাডার সমন্বয়ে গঠিত বিসিএস সমন্বয় কমিটি। কার্যকর আন্দোলন করার জন্য ২০ অক্টোবরের মধ্যে সমন্বয় কমিটির উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় কমিটি পুনর্গঠন করা হবে। গত সোমবার কমিটির জরুরি সভায় এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন। সমন্বয় কমিটির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সর্বস্তরে কর্মচারীদের দাবি উপেক্ষা করে সরকার সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাদ দিয়ে নতুন বেতন কাঠামোর প্রজ্ঞাপন জারি করলে সরকার বিপাকে পড়বে। দেশের সব অফিসে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়বে। বিশেষ একটি ক্যাডার সরকারকে এভাবে বেকায়দায় ফেলতে চাচ্ছে।

সোমবারের সভায় বলা হয়, কর্মকর্তাদের মধ্যে ৯৮ দশমিক ৬৫ ভাগই চতুর্থ থেকে নবম গ্রেডে অবস্থান করেন। এর বেশির ভাগ কর্মকর্তা মাঠপর্যায়ের সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট। বেতন স্কেল, ২০১৫-এর মাধ্যমে এসব কর্মকর্তার মর্যাদাহানি এবং তাঁদের আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে।

গত সোমবার গণপূর্ত অধিদপ্তরের সভাকক্ষে বিসিএস সমন্বয় কমিটির যে জরুরি সভা হয় তাতে সমন্বয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি প্রকৌশলী কবির আহমেদ ভূঁইয়া সভাপতিত্ব করেন। এতে সমন্বয় কমিটির সহসভাপতি ডা. মুশতাক হোসেন, মহাসচিব ফিরোজ খান, সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক মাসুমে রব্বানী, সমাজকল্যাণ সম্পাদক ড. জি এম ফারুক ডন, প্রচার সম্পাদক স ম গোলাম কিবরিয়া, বন ক্যাডারের সভাপতি মো. ইউনুস আলী, কৃষি ক্যাডারের সভাপতি তাসাদ্দেক আহমেদ, মহাসচিব মো. খায়রুল আলম প্রিন্স, সড়ক ও জনপথ ক্যাডারের সাধারণ সম্পাদক মো. আমান উল্লাহ, স্বাস্থ্য ক্যাডারের সভাপতি ড. আ ম সেলিম রেজা, ইকোনমিক ক্যাডারের মহাসচিব আফরোজা মোয়াজ্জেম, সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের সভাপতি অধ্যাপক নাসরিন বেগম, মহাসচিব আই কে সেলিম উল্লাহ খোন্দকার, কর ক্যাডারের ফজলুল হক, তথ্য বেতার ক্যাডারের সায়েদ মোস্তফা কামাল, মৎস্য ক্যাডারের মহাসচিব মজিবুর রহমান, প্রাণিসম্পদ ক্যাডারের সভাপতি মো. মাহবুব আলম ফারুক, গণপূর্ত ক্যাডারের মহাসচিব এ কে এম মনিরুজ্জামানসহ সমন্বয় কমিটি ও বিভিন্ন ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।

সভায় উপজেলা পর্যায়ের সেলফ ড্রয়িং অফিসারদের বেতন-ভাতা বিলে ইউএনওর স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত বাতিলেরও জোর দাবি জানানো হয়। বলা হয়, এ সিদ্ধান্ত গণতন্ত্রের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। ইউএনওসহ উপজেলা কর্মকর্তাদের কার্যক্রম পরিবীক্ষণ ও দায়বদ্ধতা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে ন্যস্ত করার দাবি করেন তাঁরা।

টাইমস্কেল-সিলেকশন গ্রেড বাদ দেয়া ঠিক হয়নি

মিজান চৌধুরী

প্রতি বছর সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পাঁচ শতাংশ হারে বেতন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত সঠিক নয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সরকারি চাকরিজীবীরা। পুরনো পদ্ধতি টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বহাল থাকলেই চাকরিজীবীরা লাভবান হবেন। এ কারণে নতুন বেতন কাঠামোতে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিল করে নতুন যে সুবিধার ঘোষণা দেয়া হয়েছে তা চ্যালেঞ্জ করে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে সচিবালয় সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদ। চলতি সপ্তাহে প্রতিবেদনটি সরকারের গঠিত বেতন বৈষম্য দূরীকরণ কমিটির কাছে জমা দেয়া হয়। ওই প্রতিবেদনে হিসাব করে দেখানো হয়, দীর্ঘমেয়াদে একজন চাকরিজীবী টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডেই লাভবান হবেন।

সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদের প্রতিবেদনে অষ্টম বেতন কাঠামোর ২০টি গ্রেডের সুবিধা আগামী ২০৩০ সাল পর্যন্ত পর্যালোচনা করা হয়। এতে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাদ দিয়ে পাঁচ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধিতে ক্ষতি এবং ওই দুটি সুবিধা বহাল রাখা হলে লাভের বিষয়টি পাশাপাশি হিসাব করে দেখানো হয়।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদের যুগ্ম মহাসচিব জাকারিয়া মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, বেতন বৈষম্য দূরীকরণ কমিটিকে হিসাবসহ প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। আমরা যে হিসাব দিয়েছি অর্থমন্ত্রী সে হিসাব যাচাই করে দেখতে পারেন। অর্থমন্ত্রীর সুবিধার জন্যই আমরা এসব তথ্য প্রদান করেছি। পাশাপাশি এ বিষয়ে কথা বলার জন্য আমরা সাক্ষাতের সময় চেয়েছি মন্ত্রীর কাছে। এখন কমিটি এসব তথ্য পর্যালোচনা করে দেখতে পারবে।

কর্মকর্তা ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, নতুন পে-স্কেলে বছরে পাঁচ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধিতে ২০৩০ সালে গিয়ে সর্বনিু গ্রেডের (২০) একজন কর্মচারীর বেতন ৮২৫০ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ১৭ হাজার ১৫১ টাকা। কিন্তু সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বহাল রাখা হলে কোনো পদোন্নতি ছাড়াই একই সময়ে সর্বনিু গ্রেডের কর্মচারীর বেতন দাঁড়াবে ২৪ হাজার ৭৬৩ টাকা।

একইভাবে নতুন বেতন কাঠামো অনুযায়ী ২০৩০ সালে গ্রেড-২-এর বেতন হবে এক লাখ ১৪ হাজার ৬৪৮ টাকা, গ্রেড-৩-এর বেতন হবে ১ লাখ ১৭৫৩ টাকা, গ্রেড-৪-এর বেতন ৯০ হাজার ৪৭ টাকা, গ্রেড-৫-এর বেতন হবে ৮৩ হাজার ২১৭ টাকা, গ্রেড-৬-এর বেতন হবে ৭৩ হাজার ৮০২ টাকা, গ্রেড-৭-এর বেতন হবে ৬০ হাজার ২৮৯ টাকা, গ্রেড-৮-এর বেতন হবে ৪৭ হাজার ৮১৫ টাকা, গ্রেড-৯-এর বেতন হবে ৪৫ হাজার ৭৩৬ টাকা, গ্রেড-১০-এর বেতন ৩৩ হাজার ২৬৩ টাকা, গ্রেড-১১-এর বেতন ২৫ হাজার ৯৮৭ টাকা, গ্রেড-১২-এর বেতন ২৩ হাজার ৪৯২ টাকা, গ্রেড-১৩-এর বেতন ২২ হাজার ৮৬৮ টাকা, গ্রেড-১৪-এর বেতন ২১ হাজার ২০৫ টাকা, গ্রেড-১৫-এর বেতন ২০ হাজার ১৬৬ টাকা, গ্রেড-১৬-এর বেতন ১৯ হাজার ৩৩৪ টাকা, গ্রেড-১৭-এর বেতন ১৮ হাজার ৭১০ টাকা, গ্রেড-১৮-এর বেতন ১৮ হাজার ২৯৫ টাকা এবং গ্রেড-১৯-এর বেতন হবে ১৭ হাজার ৬৭১ টাকা।

পাশাপাশি টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড সুবিধা বহাল থাকলে এবং ২০৩০ সালে গ্রেড-৯-এর বেতন হবে ৫৯ হাজার ৯৩০ টাকা, গ্রেড-১০-এর বেতন হবে ৪০ হাজার ৮০৬ টাকা, গ্রেড-১৯-এর বেতন হবে ১৯ হাজার ৩৩৪ টাকা।
প্রতিবেদনে আরও একটি হিসাবে দেখানো হয় টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাদ দিয়ে। কিন্তু ভবিষ্যতে নিয়মিত পে-স্কেল প্রদান করা হলে গ্রেড-২-এর বেতন হবে এক লাখ ৯৩ হাজার ৪১৪ টাকা, গ্রেড-৩-এর বেতন হবে এক লাখ ৬৬ হাজার ৩৭৩ টাকা, গ্রেড-৪-এর বেতন এক লাখ ৪৭ হাজার ২৩৩ টাকা, গ্রেড-৫-এর বেতন হবে এক লাখ ২৭ হাজার ৮৪১ টাকা, গ্রেড-৬-এর বেতন এক লাখ ৬৫৫৫ টাকা, গ্রেড-৭-এর বেতন ৮৭ হাজার ৪৫ টাকা, গ্রেড-৮-এর বেতন ৬৯ হাজার ৩৬ টাকা, গ্রেড-৯-এর বেতন ৬৬ হাজার ৩৪ টাকা, গ্রেড-১০-এর বেতন ৪৮ হাজার ২৫ টাকা, গ্রেড-১১-এর বেতন ৩৭ হাজার ৫১৯ টাকা, গ্রেড-১২-এর বেতন ৩৩ হাজার ৯১৮ টাকা, গ্রেড-১৩-এর বেতন ৩৩ হাজার ১৭ টাকা, গ্রেড-১৪-এর বেতন ৩০ হাজার ৬১৬ টাকা, গ্রেড-১৫-এর বেতন ২৯ হাজার ১১৫ টাকা, গ্রেড-১৬-এর বেতন ২৭ হাজার ৯১৪ টাকা, গ্রেড-১৭-এর বেতন ২৭ হাজার ১৪ টাকা, গ্রেড-১৮-এর বেতন ২৬ হাজার ৪১৪ টাকা এবং গ্রেড-১৯-এর বেতন হবে ২৫ হাজার ৫১৩ টাকা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, অষ্টম বেতন কাঠামোতে গড়ে ৯৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেতন বাড়লেও সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাদ দেয়ার কারণে তা অধিকাংশ চাকরিজীবীর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। এতে আরও বলা হয়, বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের সঙ্গে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের কোনো সম্পর্ক নেই। চাকরিতে পদোন্নতি একটি সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু অনেক সময় চাকরির ধরন ও প্রতিষ্ঠানের কাঠামো অনুযায়ী পদোন্নতি প্রদান সম্ভব হয় না। এ কারণেই মূলত টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড প্রবর্তন করা হয়। বিশেষ করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর জনবল, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ, ড্রাইভার, পুলিশ, বিডিআর, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের পদোন্নতি দেয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু বিগত সব পে-স্কেলে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল সুবিধা বহাল থাকলেও বর্তমানে তা বাতিল করা হয়েছে।

Published in: http://www.jugantor.com/last-page/2015/10/14/336670

পরীক্ষা বর্জনের সিদ্ধান্ত স্থগিত জগন্নাথ শিক্ষক সমিতির


Published in: http://bangla.bdnews24.com/bangladesh/article1039877.bdnews

Monday, October 12, 2015

শিক্ষকরা অধ্যক্ষ পদ হারাচ্ছেন

মুসতাক আহমদ 

শিক্ষকরা আর সরকারি অনার্স-মাস্টার্স এবং ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ হতে পারবেন না। অষ্টম পে-স্কেলে নির্দেশিত গ্রেড বিন্যাসের কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ফলে কলেজের অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা বসতে যাচ্ছেন। এছাড়া শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় পদগুলোও শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের হাত থেকে চলে যাচ্ছে। মূলত এসব বন্ধে সরকারি কলেজের শিক্ষকরা আন্দোলন শুরু করেছেন। তারা বৈষ্যম্য নিরসনে পাঁচ স্তরের পদ এবং নয় স্তরের বেতন কাঠামো দাবি করছেন।

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির মহাসচিব আইকে সেলিমউল্লাহ খোন্দকার যুগান্তরকে বলেন, অষ্টম পে-স্কেলে শিক্ষা ক্যাডারের সর্বোচ্চ ধাপ ‘অধ্যাপক’ পদ ৪র্থ গ্রেডে নামিয়ে আনা হয়েছে। অথচ ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষের পদ তৃতীয় গ্রেডের। গ্রেড পার্থক্যের কারণে একজন অধ্যাপক, অধ্যক্ষ পদে যেতে পারবেন না। শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলো প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রেডের অন্তর্ভুক্ত। এসব পদেও শিক্ষকদের যাওয়ার সুযোগ নেই। সরকার সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিল করায় চতুর্থ গ্রেডের অধ্যাপকের পক্ষে তৃতীয় বা তদূর্ধ্ব পদে যাওয়া সম্ভব নয়। শিক্ষা প্রশাসনে সর্বোচ্চ উপ-পরিচালক হতে পারবেন শিক্ষকরা। তিনি আরও বলেন, এসব সমস্যা সমাধানেই আমরা সরকারকে বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছি। সেই সঙ্গে তিন দফা দাবিও জানিয়েছি। প্রস্তাবের মধ্যে আছে, পাঁচ স্তরের পদবিন্যাস করতে হবে। সর্বোচ্চ ধাপ হবে সিনিয়র অধ্যাপক। আর বেতন কাঠামো করতে হবে নয় স্তরের। অনুমোদিত অষ্টম পে-স্কেলে সৃষ্ট বৈষম্য ও ক্ষতি নিরসনে এই ‘রিমেডির’ (সমাধান) বিকল্প নেই।

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আগামীতে কলেজের অধ্যক্ষ ও শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোতে শিক্ষকরা থাকতে পারছেন না’ এ ধরনের সমস্যার কথা তারা আমাকে জানিয়েছেন। আমি শিক্ষকদের কাছ থেকে সমস্যাগুলো ভালোভাবে বুঝে নিয়েছি। এগুলো নিয়ে কমিটির সদস্যরা বসব। আসলে শিক্ষা পরিবারের সদস্য হিসেবে আমি এসব সমস্যা নিয়ে অনানুষ্ঠানিকভাবেও কথা বলতাম। এখন কমিটিতে থাকার কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে বলার সুযোগ পাব। সেখানে এসব তুলে ধরব। আশা করছি, সমস্যা থাকবে না। তিনি আরও বলেন, ‘আসলে কারও সঙ্গে তুলনা করে নয়, মর্যাদা-ইজ্জত-সম্মান আর বেতনভাতার দিক থেকে আমরা শিক্ষকদের উচ্চকিত করতে চাই। সরকার এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরও এ বিষয়ে সহানুভূতি রয়েছে।’

জানা গেছে, বর্তমানে কলেজ শিক্ষকদের চার স্তরের পদবিন্যাস রয়েছে। এগুলো হচ্ছে, প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক এবং অধ্যাপক। সপ্তম পে-স্কেলে তারা আট স্তরে বেতন পেতেন। সম্প্রতি শিক্ষা ক্যাডারের সর্বোচ্চ পদ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই) মহাপরিচালক এক নম্বর গ্রেডে উন্নীত করা হয়েছে। সেই হিসাবে ৯টি গ্রেডেই যাওয়ার সুযোগ ছিল শিক্ষকদের। তবে অষ্টম পে-স্কেলে বেতন কাঠামো ৬টি স্তরে নামিয়ে আনা হয়েছে। অধ্যাপক পদ চতুর্থ গ্রেডে স্থির করায় তাদের মহাপরিচালক তো দূরের কথা, মাউশির পরিচালক, বিভিন্ন বোর্ডের চেয়ারম্যান এমনকি কলেজের অধ্যক্ষ পদে যাওয়ার পথও রুদ্ধ হয়েছে বলে অভিযোগ করেন শিক্ষকরা।

এ প্রসঙ্গে আইকে সেলিমউল্লাহ খোন্দকার বলেন, সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিল করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সপ্তম পে-স্কেলে অধ্যাপকদের প্রারম্ভিক গ্রেড ছিল ৪র্থ। ৫০ ভাগ সিলেকশন গ্রেড পেয়ে ৩য় গ্রেডে উন্নীত হতেন। সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপকরাই বিভিন্ন অনার্স-মাস্টার্স ও ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষ হতেন। এরাই ২য় গ্রেডের বিভিন্ন পদে নিয়োগ পেয়েছেন। দুটি মহাপরিচালকের পদ সম্প্রতি এক নম্বর গ্রেড করা হয়েছে। সেখানেও শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বসার সুযোগ ছিল। কিন্তু অষ্টম পে-স্কেলে শিক্ষকদের চতুর্থের পর অন্য কোনো গ্রেডে যাওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি।

শিক্ষা ক্যাডারে বর্তমানে মোট সদস্য ১৫ হাজারের বেশি। এদের দাবি সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল পুনর্বহাল করা হোক। অন্যথায় পদোন্নতি সংক্রান্ত জটিলতার কারণে তারা যে ক্ষতির শিকার হবেন তা কখনও পূরণ হবে না। গত কয়েকদিন এই ক্যাডারের ব্যাচভিত্তিক বিভিন্ন ফোরামের নেতাদের সঙ্গে যুগান্তরের আলোচনা হয়। ক্ষতির শিকার বিভিন্ন ব্যাচের মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে ২৪তম বিসিএসের শিক্ষক। এই ব্যাচের ফোরামের সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক বলেন, ‘আমরা ২২৪৬ জন বিগত ১০ বছর ধরে প্রভাষক পদে আছি। মাত্র ১২ ঘণ্টার জন্য সিলেকশন গ্রেড বঞ্চিত হয়েছি। কবে নাগাদ পদোন্নতি পাব, তার নিশ্চয়তা নেই। সিলেকশন গ্রেডও বাতিল হয়েছে। সরকার এটা বাতিল করায় এখন আমরা চোখে অন্ধকার দেখছি।’ ১৬তম ব্যাচের কর্মকর্তা ঢাকা বোর্ডের কলেজ উপ-পরিদর্শক মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈ। তিনি এখনও সহকারী অধ্যাপক। এভাবে বিভিন্ন ব্যাচের কর্মকর্তারা বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। বঞ্চিত এসব কর্মকর্তারা বলছেন, যদি সরকার সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল পুনর্বহাল না করে, তাহলে আমাদের দাবি থাকবে, পদবিন্যাস ও বেতন কাঠামো আরও তিনটি বাড়ানো হোক। এক্ষেত্রে ৮ স্তরের পদ চাইব। সেগুলো হচ্ছে- অধ্যাপক, সিনিয়র অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সিনিয়র সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, সিনিয়র সহকারী অধ্যাপক এবং প্রভাষক, সিনিয়র প্রভাষক। এভাবে করা হলে দুটি উপায় হবে। একটি হচ্ছে, শিক্ষা ক্যাডারের উপরের পদগুলো আর অপদখলের আশংকা থাকবে না। অপরটি হচ্ছে, পদোন্নতি বঞ্চনা দূর হবে।

এ বিষয়ে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন, আমাদের দাবি সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহাল করা হোক। তা না হলে সরকার যদি বিকল্প প্রস্তাব চায়, তবে আমরা সমিতির সাধারণ সদস্যদের আবেগ ধারণ করে ৮ স্তরের পদবিন্যাস দাবি করব। তিনি বলেন, এখানেই বিষয়টি শেষ নয়। পরিকল্পনা কমিশনে বর্তমানে একজন অধ্যাপক ডেপুটেশনে কর্মরত আছেন। অধ্যাপকদের ৪র্থ গ্রেডে আটকে দেয়ায় এক নম্বর গ্রেডের এই পদে আর কখনোই শিক্ষকরা যেতে পারবেন না।

গত ৭ অক্টোবর বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির ৩০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় তারা ৩ পৃষ্ঠার প্রস্তাব ও দাবিসংবলিত স্মারকলিপি দেন। তাতে তারা ২৯ ক্যাডারের একটি হিসেবে অন্য ক্যাডারে মতো গাড়ি কেনা বাবদ ৩০ লাখ টাকা বিনা সুদে ঋণ এবং গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ মাসে ৪৫ হাজার টাকা ভাতাও দাবি করেছেন। এ ব্যাপারে সমিতির সভাপতি অধ্যাপক নাসরীন বেগম বলেন, এই একটি ভাতার কারণে শিক্ষকরা অন্য কর্মকর্তাদের থেকে মাসে কমপক্ষে ৬০ হাজার টাকা কম পাচ্ছেন। অথচ সব কর্মকর্তাই পিএসসির (সরকারি কর্ম কমিশন) একই যোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এসেছি। আমরা সব ধরনের বৈষম্যের নিরসন চাই।

Published in: http://www.jugantor.com/first-page/2015/10/13/336197

একাত্তর সংযোগঃ ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ও মোঃ ফরাসউদ্দিন



আরো পড়ুনঃ
মর্যাদার প্রশ্নেই মতভিন্নতা - বেতন কমিশন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আন্দোলন
হুমকির মুখে সুষ্ঠু আলোচনা হতে পারে না - বিশেষ সাক্ষাৎকার : মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

হুমকির মুখে সুষ্ঠু আলোচনা হতে পারে না - বিশেষ সাক্ষাৎকার : মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

প্রথম আলো : অষ্টম বেতন কমিশনের রিপোর্ট প্রশংসিত হলেও শিক্ষকেরা এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছেন, তাঁদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। কমিশনের সভাপতি হিসেবে বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন : নতুন বেতন কমিশন রিপোর্টে সব ক্ষেত্রে বেতন প্রায় দ্বিগুণ বাড়ানো হয়েছে। স্বীকার করতে হবে, এটি দুঃসাহসিক কাজ। এ নিয়ে সর্বস্তরে যে ইতিবাচক প্রবাহ সৃষ্টি হওয়া উচিত ছিল, তা হতে দেওয়া হয়নি। বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে, একটি খারাপ কাজ হয়েছে। এ নিয়ে সত্যিই আমার মনে খেদ আছে।

প্রথম আলো : কিন্তু অনেকেই বেতন কমিশনকে দায়ী করছেন।
ফরাসউদ্দিন : বেতন কমিশনকে দায়ী করার সুযোগ নেই। কমিশনের কাজ হলো সুপারিশ করা, এটি গ্রহণ করা কিংবা বাস্তবায়ন করা সম্পূর্ণ সরকারের এখতিয়ার। ভারত বা অন্যান্য দেশে বেতন কমিশনের আকার খুব ছোট হয়, কিন্তু আমাদের কমিশন ছিল ১৭ সদস্যের। এতে কয়েকজন শিক্ষক প্রতিনিধিও ছিলেন। গত ২১ ডিসেম্বর যেদিন আমরা অর্থমন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট জমা দিই, একজন ছাড়া সবাই উপস্থিত ছিলেন। ব্যক্তিগত কাজ থাকায় তিনি সই দিয়ে আগে আগেই চলে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ এটি ছিল ঐকমত্যের সুপারিশ। এখানে যেটি ব্যত্যয় ঘটেছে তা হলো, অন্যান্য দেশে এসব কমিশনের সুপারিশ মন্ত্রিসভা কমিটিতে বিবেচনা করা হয়। এখানে করেছে সচিব কমিটি। তাঁরাও একটি পক্ষ।
প্রথম আলো : আপনারা যে সুপারিশ করেছেন আর সরকার যেটি চূড়ান্ত করেছে, তার মধ্যে পার্থক্য কতটা?


ফরাসউদ্দিন : পার্থক্য বেশি নয়। কিন্তু কয়েকটি ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য হয়েছে। যেমন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ঔপনিবেশিক আমলের শ্রেণি প্রথা বিলোপ করা হয়েছে। এবং সেখানে এফিসিয়েন্সি বার বা দক্ষতার বাধা বলে  যে দুষ্ট প্রকৃতির জিনিস ছিল, সেটি দূর করা হয়েছে। বেতন বাড়ানোর ক্ষেত্রেও ওপরের দিকে সামান্য কমানো এবং নিচের দিকে কাঙ্ক্ষিতভাবেই বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বেতন কমিশন ১৬টি স্কেল বা স্তর সুপারিশ করলেও সেটিতে স্তর ২০টি করতে গিয়ে নতুন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।

কমিশনের উদ্দেশ্য ছিল ছয়জনের পরিবার যাতে সম্মানজনকভাবে জীবন যাপন করতে পারে এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মীরা সর্বোচ্চ উৎপাদনশীলতা ও গতিশীলতা দিয়ে রাষ্ট্রকে সেবা দিতে পারেন। এরপর রাষ্ট্র তাঁদের দুর্নীতিমুক্ত থাকার ব্যাপারেও অনুশাসন দিতে পারবে। এ কারণেই বেতন বৃদ্ধির হারটা বেশি ছিল। বেতনের বাইরে আমরা একটি সমৃদ্ধি সোপান ব্যাংক, বিমা, শিক্ষা ভাতা, বাড়িভাড়া ভাতার বৃদ্ধি ও যৌক্তিক করার যে সুপারিশ করেছিলাম, সেগুলোও সরকার গ্রহণ করেছে। দু-একটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হওয়ায় বিতর্ক দেখা দিয়েছে। আরেকটি কথা, বেতন কমিশন সুপারিশ করে গত ডিসেম্বরে। আর এ বছরের সেপ্টেম্বরে সরকার তা গ্রহণ করে। এই দীর্ঘ সময়ের কারণে বিভিন্ন স্বার্থের শাখা-উপশাখা ও ষড়যন্ত্র ডালপালা মেলেছে। এটি আরও আগে করা উচিত ছিল বলে মনে করি।
প্রথম আলো : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অভিযোগ, সপ্তম বেতনকাঠামো থেকে এবার তাঁদের পদমর্যাদা কয়েক ধাপ নামিয়ে দেওয়া এবং সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
ফরাসউদ্দিন : আমি শিক্ষকদের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। সপ্তম বেতনকাঠামো থেকে বর্তমান বেতনকাঠামোয় যদি তাঁদের পদমর্যাদার অবনমন ঘটে, সেটি ঘোরতর অন্যায় এবং তার যৌক্তিক মীমাংসা হওয়া দরকার। এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার করা দরকার, কোন গ্রেডে কত বেতন হবে, সেটি ঠিক করেছে কমিশন। কিন্তু কোন গ্রেডে কারা থাকবেন, সেটি ঠিক করার এখতিয়ার সরকারের। আমি যতটা জানি, সপ্তম বেতনকাঠামোয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা দ্বিতীয় গ্রেডে ছিলেন। সে সময় এর বেতন ছিল ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা। আমরা সুপারিশ করেছিলাম ৭০ হাজার টাকা। সরকার ৬৭ হাজার টাকা চূড়ান্ত করেছে। অর্থাৎ, বেতন দ্বিগুণ হয়েছে। এখন অধ্যাপকেরা যদি দ্বিতীয় গ্রেডে ও প্রভাষকেরা নবম গ্রেডে থাকেন, তাহলে তো তাঁদের আপত্তি থাকতে পারে না।
প্রথম আলো : তাঁদের আপত্তি হলো, আগে অধ্যাপকদের শুরু দ্বিতীয় গ্রেড পেলেও  সিলেকশন গ্রেডের মাধ্যমে প্রথম গ্রেডে যেতে পারতেন। সিলেকশন গ্রেড রহিত হওয়ায় তাঁরা সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
ফরাসউদ্দিন : এর সমাধানও আমি বলেছি। নবম গ্রেডে প্রভাষকেরা আছেন। যেমন জনপ্রশাসনে প্রকৌশলী, চিকিৎসক, পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তারাও আছেন। এখন শিক্ষক বন্ধুরা যে প্রভাষকদের জন্য সপ্তম গ্রেড দাবি করছেন, সেটি বোধ হয় ঠিক নয়। তাঁদের নবম থেকে দ্বিতীয় গ্রেডে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি তৈরি করতে হবে। তারপর অধ্যাপকেরা যাতে একটি নির্দিষ্ট সময় ও নির্দিষ্ট অনুপাতে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকের পদ পেতে পারেন, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। আমার জানামতে, সরকার এটি করতে রাজি আছে। সে ক্ষেত্রে সপ্তম বেতন কমিশনের সঙ্গে কোনো পার্থক্য থাকছে না। তাহলে আন্দোলন কেন?
প্রথম আলো : কিন্তু আগে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকেরা সচিবের পদমর্যাদা পেতেন। এখন সচিবদের ওপর আরও দুটি পদ সৃষ্টি করা হয়েছে।
ফরাসউদ্দিন : মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্য সচিব সব সময়ই গ্রেডের বাইরে ছিলেন। আবার সব প্রথম গ্রেড মানেই সচিব নন। সচিবের পদ ৭০টি। আর প্রথম গ্রেড পান কয়েক শ সরকারি কর্মকর্তা। আমি মনে করি, প্রথম গ্রেড পাওয়াটাই মুখ্য। অধ্যাপকদের পদোন্নতি দিয়ে সেখানে নিয়ে গেলে সমস্যা থাকে না। এরপর যে প্রশ্নটি এসেছে, তা হলো পদমর্যাদার। ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স। এ নিয়ে আদালতে মামলা-মোকদ্দমাও হয়েছে। আমরা কমিশনের পক্ষ থেকে কমিশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিশেষ মর্যাদারও সুপারিশ করেছিলাম, যদিও এর সঙ্গে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে যুক্ত করা উচিত ছিল। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকেরা তাঁদের বুয়েটের সঙ্গে তুলনা করায় আপত্তি তুলেছেন।
২০১২ সালে আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে কয়েকটি জ্যেষ্ঠ সচিবের পদ সৃষ্টি করা হয়। এটি না করলে জনপ্রশাসনে অচলাবস্থা দেখা দিত। সেটিকে গ্রেডের মানদণ্ডে দেখাও বোধ হয় ঠিক হবে না।
প্রথম আলো : শিক্ষকেরা আলাদা বেতন কমিশনের দাবি করেছেন।
ফরাসউদ্দিন : বেতন কমিশন বলেছে,  যেসব বিভাগ বা প্রতিষ্ঠানের বেতন সরকারি কোষাগার থেকে দেওয়া হয়, সেগুলো একই বেতনকাঠামোয় হওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা একদিকে সপ্তম বেতনকাঠামোর সমমর্যাদা চাইছেন, আরেক দিকে পৃথক বেতনকাঠামোরও দাবি করছেন। এটি যৌক্তিক নয়। আলাদা বেতন কমিশন হলে তার অর্থের উৎস নিয়েও ভাবতে হবে। ভারত বা শ্রীলঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নের একমাত্র উৎস সরকার নয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা বেতনকাঠামোর প্রশ্ন এলে অর্থায়নের প্রশ্নটিও সামনে আসবে। আর কলেজশিক্ষকদের জন্য আলাদা কর্মকমিশন গঠনের কথা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরেই। এর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কোনো সম্পর্ক নেই।
প্রথম আলো : এখন বেতনকাঠামো নিয়ে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, তার সমাধান আসবে কীভাবে? শিক্ষকেরা আন্দোলনে আছেন।
ফরাসউদ্দিন : দ্রুতই এ সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত। যতটা জানি, এ ব্যাপারে সরকারও অনেক দূর এগিয়েছে। বিষয়টি পুনর্বিবেচনায় জ্যেষ্ঠ মন্ত্রীদের নিয়ে মন্ত্রিসভা কমিটি করা হয়েছে। আলোচনার জন্য মুক্তমন ও সদিচ্ছা থাকা প্রয়োজন। আমার মনে হয়, সরকারের সেটি আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা যেসব মন্তব্য করেছেন, তা ইতিবাচক নয়। দ্বিতীয়ত, তাঁরা বলছেন, দাবি না মানলে ১ নভেম্বর থেকে লাগাতার ধর্মঘট হবে। হুমকির মুখে সুষ্ঠু আলোচনা হতে পারে না। মুক্তমনে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্ব শিক্ষক বন্ধুদেরই।
বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ আন্তর্জাতিক সব সংস্থাই স্বীকার করেছে, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক রূপান্তর হয়েছে, তা দৃষ্টান্তমূলক, অনুসরণীয়। আগামী ২৫ বছরে বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাতারে চলে যাবে। এই সাফল্যের প্রতি যদি শিক্ষকেরা সংবেদনশীল হন, তাহলে তাঁদের উচিত হবে না এমন কিছু করা, যাতে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হয়।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
ফরাসউদ্দিন : আপনাকেও ধন্যবাদ।
  • সরকারি বেতন ও সেবা কমিশনের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
Published in: http://www.prothom-alo.com/opinion/article/652432/