Thursday, October 15, 2015

মেধা পরিমাপের সূচক এবং একটি হাইপোথেসিস

Sujoy Subroto

ভেবেছিলাম আমলা বনাম শিক্ষক এই ইস্যুতে আর কোন আলোচনায় যাব না কারন এতে করে অনেকের সাথেই এক ধরনের ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হচ্ছে । নিতান্ত বাধ্য হয়েই কিছু জিনিস ক্ল্যারিফাই করার জন্যে আবার লিখতে বসলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়া, পদোন্নতি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে আগে একদিন আলোচনা করেছি আজকে মুলত আলোচনা করব কোন পেশায় এখনও মেধাবীদের সংখ্যা বেশী এই ইস্যুটা নিয়ে । অনেকেই বলছেন আমলা হওয়া অনেক কঠিন এবং উনারাই সবচেয়ে মেধাবী আবার অনেক শিক্ষক দাবী করছেন মেধাবীদের মধ্যে যারা প্রথম সারির শিক্ষার্থী তারাই শিক্ষক হয় । আজকে এই বিষয় টা নিয়ে একটা ফ্যাক্ট বেইসড আলোচনা করব।

আসুন আমরা একটা হাইপোথেসিস চেক করি > 
আমি ধরেই নিলাম বিসিএস ক্যাডার এবং বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষকদের মধ্যে মেধার কোন পার্থক্য নেই এবং দুইটা পেশায়ই মেধাবীদের সংখ্যা সমান সমান > এইটা হচ্ছে আমার নাল হাইপোথেসিস 
আসুন প্রথমেই দেখে নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং বিসিএস ক্যাডার হবার জন্যে নুন্যতম ক্রাইটেরিয়া কি কি 
১। শিক্ষক পদে আবেদনের জন্যে স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর অথবা মাস্টার্স পরীক্ষায় মিনিমাম সিজিপিএ ৩.৫ থাকতে হবে ৪ এর মধ্যে, এস এস সি এবং এইচ এইচ সি পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি অথবা সিজিপিএ ৪ থাকতে হবে , এছাড়া যদি সায়েন্টিফিক পেপার ও রিসার্চ অভিজ্ঞতা থাকে তাইলে অগ্রাধিকার পাবে ।
২। বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহনের জন্যে সেইরকম কোন ক্রাইটেরিয়া নাই , এইখানে ডিগ্রি পাস এর ছাত্র থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারীরাও আবেদন করতে পারে এবং একাডেমিক ফলাফল এইখানে কোন বিবেচ্য বিষয় নয় । সম্ভবত এই একটা জায়গায়ই রাষ্ট্র আক্ষরিক অর্থেই সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে ।

একদম শুরু থেকে শুরি করি । পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হচ্ছে সবচেয়ে কম্পিটিটিভ একটা এক্সাম এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নের কোয়ালিটি নিয়ে কারও দ্বিমত থাকার কথা না । এই লাখ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে ভর্তি পরীক্ষায় যারা মেধাক্রমে উপরের দিকে থাকে তারাই কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায় । তার মানে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় তারা সবাই কমবেশি মেধাবী কারন শুরুতেই তাদের মেধার একটা পরীক্ষা দিতে হয়। সাম্প্রতিক কালে আমরা দেখেছি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অধিকাংশ ছাত্রই পাশ মার্কস পায় না এবং ইংরেজিতে প্রায় শতকরা ৮০- ৯০ ভাগ শিক্ষার্থী ফেল করে । কাজেই এইরকম একটা স্ট্যান্ডার্ড প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যারা বেরিয়ে আসে তাদেরকে কিন্তু মেধাবী বলতেই হবে । এমনও অনেক ছাত্র দেখেছি যাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফরম কেনার মত যোগ্যতা নেই কিন্তু বিসিএস পরীক্ষা তে অলরেডি ২ বার ভাইবা পর্যন্ত দিয়েছে, নিশ্চয়ই এর মধ্যে অনেকে ক্যডারও হয়ে গেছে। এখন যে ছেলেটি একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফর্ম কিনতে পারে না সেই ছেলেটি যদি আমলা হয়ে শিক্ষকদের চেয়ে নিজেকে বেশী মেধাবী মনে করে তাহলে সেইটা কিন্তু একধরনের বাতুলতা। আর একটা পরীক্ষিত সত্য হল যে যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায় না তারাই কিন্তু ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়য়ে ভর্তি হয় এবং এই ক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম অবশ্যই আছে কিন্তু এর সংখ্যা একেবারেই নগণ্য এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েও নিশ্চয়ই অনেক মেধাবী আছেন । অথচ, বিসিএস পরীক্ষায় একটা বিশাল অংশই উত্তীর্ন হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং তারই ফলশ্রুতিতে আমরা দেখি যে ৩৪ তম বিসিএস পরীক্ষায় ঢাকা কলেজের অবস্থান সরকারি কলেজে প্রথম , পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজ মিলে ঢাকা কলেজর অবস্থান সারা দেশে দ্বিতীয় ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা শিক্ষক হয় তারা সবাই কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের এর শিক্ষার্থী । অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া যাবে না এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হতে হলে আপনাকে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েই হতে হবে, এইখানে ভকিচকির কোন সুযোগ নেই । এর মধ্যে সেইসব ছাত্ররাই শিক্ষক হয় যারা এতসব মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে পুরো ব্যাচেলর পরীক্ষায় শীর্ষস্থানে থাকে । এখন যে একাডেমিক কারিকুলামে একজন শিক্ষার্থী সবসময় সর্বোচ্চ গ্রেড পেয়ে শিক্ষক হয় সেই একই কারিকুলামে যারা খারাপ ফলাফল কিংবা টেনেটুনে পাশ করে বিসিএস দিয়ে আমলা হয় এবং নিজেকে শিক্ষকের চেয়ে মেধাবি বলে দাবি করে তাহলে সেইটা কিন্তু হাস্যকর শুনাবে । আমি আগেও বলেছি যে মেধা যাচাইয়ের আসলেই তেমন কোন আদর্শ ক্রাইটেরিয়া নেই এবং একমাত্র সিজিপিএ এর উপর ভিত্তি করে বিশ্বের কোন উন্নত দেশে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয় না, কাজেই রেজাল্ট যেন কোনভাবেই শিক্ষক নিয়োগের একমাত্র ডিটারমিনেণ্ট না হয় এবং অবশ্যই নিয়োগ পক্রিয়ার আধুনিকায়ন করা এবং সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা দরকার । কিন্তু তাই বলে ঢালাওভাবে বললে হবে না যে শিক্ষকদের কোন মেধা নেই এবং সব আমলারাই শিক্ষকদের চেয়ে বেশী মেধাবী এবং এইজন্যে উনাদেরকে শিক্ষকদেরকে উপরে স্থান দিতে হবে ।
এখন আমরা যদি দেখি শতকরা ৯৫ ভাগ শিক্ষক ক্লাসের টপ ৫% শিক্ষার্থী থেকে নিয়োগ হন এবং শতকরা ৩০ % ক্যাডার ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় , শতকরা ৩০- ৪০% ক্যাডার বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝারি মানের শিক্ষার্থী এবং বাকি ২০-৩০ % বিশ্ববিদ্যালয়ের টপ ১০ % শিক্ষার্থী থেকে নিয়োগ হন তাহলেও কিন্তু মানতে হবে যে সংখ্যার দিকে থেকে এখনও শিক্ষকতা পেশায়ই সবচেয়ে বেশী মেধাবিরা আছেন । এবং বিসিএস এর ক্ষেত্রে কিন্তু কোটা একটা বিশাল ফ্যাক্টর কারন ৫৬ % ক্যাডার কোটা থেকে নিয়োগ পান অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় কিন্তু কোটার কোন ব্যাপার স্যাপার নেই যাও আছে তা শুধু আদিবাসী ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এবং এইটাও খুবই নগণ্য, তবে শিক্ষক নিয়োগে দলীয়করন আর আত্মীয়করন যাই বলেন এক্ষেত্রে কিন্তু কোন কোটা নাই । যে পদ্ধতিতে মেধাবীদের চেয়ে মেধাহীনদের কে প্রাধান্য দেওয়া হয় সেই পদ্ধতি নিয়ে আসলেই ঢোল পিটানো কিংবা গর্ব করার তেমন কিছু নেই । তবে এই রকম একটা বৈষম্য মূলক সিস্টেমের মধ্যে দিয়েও মেধা কোটায় যে ৪৪ % ছাত্র বিসিএস ক্যাডার হয় এবং তাদের মধ্যে থেকে যারা আমলা হয় তাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করাটা আসলেই অবান্তর । কাজেই মেধা মাপার জন্যে মুখস্থ বেসড যে সনাতনী পদ্বতি (পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল, ভর্তি পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফল) আমাদের দেশে ব্যাবহার করা হয় সেই হিসেবে দেখলেও কিন্তু স্বীকার করতে হবে যে আমলাদের সবাই সমান মেধাবী না এবং আনুপাতিক হারে এইটা শিক্ষকদের চেয়ে কম। যেহেতু মেধাবীদের সংখ্যা শিক্ষকতা পেশায় তুলনামুলভাবে আমালদের চেয়ে বেশী কাজেই আমাদের নাল হাইপোথেসিস রিজেক্ট করতে হবে এবং অল্টারনেটিভ হাইপোথেসিস এক্সেপ্ট করতে হবে । সেই ক্ষেত্রে আমাদেরকে মেনে নিতে হবে যে সব শিক্ষক এবং সব আমালাদের মেধা সমান না এবং আনুপাতিক হারে শিক্ষকতা পেশায় এখনও মেধাবীদের সংখ্যা অনেক বেশী । সত্যি কথা বলতে কি স্ট্যাটিসটিক্স বেসড বিশ্লেষনের একটা বড় দুর্বলতা হল যে এইটা বাস্তব পরিস্থিতির সাথে অনেক সময় খাপ খায় না কারন একটা সমস্যার সবগুলো দিক একই সাথে অন্তর্ভুক্ত করা প্রায় অসম্ভব । কাজেই বাস্তবে আমরা এমন অসংখ্য শিক্ষক পাব যারা আসলেই এই পেশার জন্যে উপযুক্ত না ঠিক একইভাবে অসংখ্য আমলা পাব যারা প্রচন্ড মেধাবী এবং সৎ। যাই হোক আমি শুধু ফ্যাক্টগুলো নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছি এবং এতে করে যদি কেউ কষ্ট পান তাহলে আমি আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী । পর্যায়ক্রমে বিসিএস পরীক্ষা, কোটা পদ্বতি, আমলাতন্ত্রের দুর্নীতি এবং শিক্ষকদের বেতন বৈষম্য এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করব ।

0 comments:

Post a Comment