মোঃ আবু লায়েক
শিক্ষকদের মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনের ব্যাপারে দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহী, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য, ৪ মিনিটের ও কম সময়ের ভিডিও। খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভিডিওটি সবাই ভালোভাবে দেখেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য বলেছেন "সচিবরা কি কি সুবিধা পাচ্ছে আর উনারা (মানে শিক্ষকরা) কি কি সুবিধা ভোগ করছেন তার একটা তুলনামূলক চিত্র আপনারা একটু দয়া করে লেখেন না"। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষকের সাথে সচিবের/ আমলার তুলনা চলে না, আমরা তাতে আগ্রহী ও ছিলাম না কেননা দুজনের কাজের উদ্দেশ্য ও ধরন ভিন্ন। কিন্তু আমাদের উপরে এই তুলনা চলে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বেশীরভাগ বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগে নিম্নতম যোগ্যতা চাওয়া হয় ৪ টি অথবা ৩ টি প্রথম শ্রেনী, যেখানে সবগুলো দ্বিতীয় শ্রেনী নিয়েও এমনকি সাধারন ব্যাচেলর ডিগ্রী নিয়ে আমলা হয়ে ঢুকে সচিব হয়েছেন এ সংখ্যাও নেহাত কম না (শোনা যায় অনেকে তৃতীয় শ্রেনী নিয়ে এসেও পরে প্রাইভেট থেকে সার্টিফিকেট যোগাড় করে নিয়েছে)। অবশ্যই আমলাতন্ত্রেও কিছুসংখ্যক তুখোড় মেধাবী আছেন এবং দেশের স্বার্থে কাজ করে চলেছেন, আমরা তাদের সম্মান করি।
জনগনের ট্যাক্সের টাকার ন্যায়সঙ্গত বন্টন নিশ্চিত করা উচিত। বেশীরভাগ সচিব ই হয়ে থাকেন প্রশাসন ক্যাডার থেকে, যারা ইউএনও থাকাকালীন সময় থেকেই গাড়ী সুবিধা পেয়ে থাকে, এছাড়া গাড়ী/ ফ্লাট কেনার জন্য ঋন-সুবিধা, হাজারো ট্রেনিং/ ট্যুর, সরকারি স্কলারশীপে উচ্চশিক্ষা তাও ডেপুটেশন সুবিধা নিয়ে (যার প্রাথমিক হকদার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা)গাড়ী রক্ষণাবেক্ষনের জন্য মাসিক ৪৫০০০/= টাকা (যুগ্ম সচিব থেকে), অফিসিয়াল পাসপোর্ট, জেলা প্রশাসকদের স্ত্রীরাও জেলা মহিলা ক্রীড়া কমিটির সভাপতি হয়, সচিবেরা ব্যক্তিগত ভৃত্য থেকে শুরু করে পরিবারের ব্যবহারের জন্য গাড়ী সুবিধা আরো কত কি। কেন এত বৈষ্যম্য? মাঝারী মানের মেধা নিয়ে (আমার কথা নয় সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারের কথা) যে ব্যক্তিটি চাকরীতে ঢুকলো তাকে ব্রাহ্মন বানিয়ে সবার উপরে তুলে রাখতে হবে কেন? আর আমলাতন্ত্রের দুর্নীতির ব্যাপারে তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিছুই বললেন না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি যে ৯১ ভাগ বেতন বৃদ্ধির কথা বলেছেন তার জন্য অবশ্যই ধন্যবাদ দিই একইসাথে সবিনয়ে জানতে চাই সেটি কি শুধুমাত্র শিক্ষকদেরই বেড়েছে নাকি সব চাকুরিজীবিরই? বেতন বাড়িয়ে পদমর্যাদার অবনমন কি কেউ প্রত্যাশা করে? যেখানে শিক্ষকেরা এই পেশাতেই এসেছিল মর্যাদার জন্য। সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমরা বর্ধিত বেতন গ্রহন করব না, দয়া করে তার আগে আমাদের বেতন বৃদ্ধি করবেন না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অধিক বয়স পর্যন্ত কাজ করা একটা বৈশ্বিক কালচার কিন্তু আপনি ৬৫ বছর চাকুরীর কথা বলেছেন, প্রয়োজনে কমিয়ে দিন তাও আমাদেরকে মর্যাদার সাথে থাকতে দিন। আর ৬৫ বছরে অবসরগ্রহন করা একজন শিক্ষক এবং ৫৯ বছরে অবসরগ্রহন করা একজন সচিবের সম্পদের তুলনা করলেও আপনি এই কথার যৌক্তিকতা যাচাই করতে পারবেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি শিক্ষকদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়ার কথা বলেছেন।কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে জ্ঞানদান করা কি অপরাধ? আর এই সংখ্যাই বা কত? ঢাকাতে বড়জোর ৮-১০ শতাংশ, ঢাকার বাইরে অনেক কম। সরকার কি একজন শিক্ষককে পরিবার সহ ঢাকায় থেকে সাধারন মানের জীবনযাপনের যোগ্য বেতন দেয়? যোগ্যতাসম্পন্ন কিছু আমলাও তো কন্সালটেন্সি করে অথবা প্রাইভেট ভার্সিটিতে ক্লাস নেয়। আপনার কাছে কি তাদের তালিকাও আছে?
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিচ্ছিন্ন কোন দ্বীপ নয় আর শিক্ষকরাও এই সমাজেরই অংশ। সেখানেও মন্দ রাজনীতির চর্চা আছে, যোগ্যতর কে পাশ কাটিয়ে অযোগ্যের উত্থান ও আছে, তারপরও একথা সবাই অকপটে স্বীকার করে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মত এত মেধাবীদের মিলনস্থল আর কোথাও নেই। গবেষণা বাজেটের নিম্নগামীতা, মানসম্মত জীবনধারনের জন্য ন্যুনতম বেতনের অনুপস্থিতি ইত্যাদি কারণে এই মেধাবীদের কাছ থেকে যতটা পাবার কথা ছিল রাস্ট্র তা নিতে ব্যর্থ হয়। তবে আপেক্ষিক বিচারে যা পায় তাও কোন অংশে কম নয়, কেননা এই পাঠ গ্রহন করেই রাস্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মকর্তা হয়ে কাজ করছে,ছাত্র-ছাত্রীরা বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে, বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে কেউবা উদ্যোক্তা হচ্ছে। শিক্ষা এমন একটা মাধ্যম যার কমতি হলে ঐ প্রতিটা ক্ষেত্রেই কম যোগ্যদের আবির্ভাব ঘটবে। তাই দেশের প্রকৃত টেকসই উন্নতি চাইলে এই শিক্ষাক্ষেত্রকেই গুরুত্ব দেয়ার দরকার ছিল, আর তার চালক শিক্ষকদের আরো মর্যাদার আসন দিয়ে আকৃষ্ট করা উচিত ছিল। তাহলে দেশের বাইরে স্থায়ী হয়েছে এমন অনেক যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকও দেশে ফিরে আসতো, কয়েক বছরেই দেশের চেহারা পালটে যেত। কোরিয়া ঠিক এই প্রক্রিয়াতেই উন্নত দেশে রুপান্তরিত হয়েছে, বেশীরভাগ প্রফেসর ই আমেরিকা থেকে ফিরে এসেছে, আসলে তাদেরকে সুযোগ সুবিধা ও সম্মান দিয়ে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু তা না করে আমরা দেখলাম শিক্ষকদের মর্যাদার অবনমনের চেষ্টা করা হচ্ছে। সমস্যার প্রকৃত সমাধানের দিকে না গিয়ে শিক্ষকদের উপরে ক্রোধবর্ষন কি কোন সমাধান নিয়ে আসবে? এতে কি শিক্ষাব্যাবস্থার দূর্গতি আরো বাড়বে না?
শিক্ষকদের কি ছিল তা জানিনা তবে এখন কি আছে কেউ কি বলতে পারবেন? সম্মান, মর্যাদা, অর্থ, ক্ষমতা .................. । এই অথর্ব গোষ্ঠীর সমাজে কি দরকার?
শিক্ষকতা পেশা পছন্দ করে আমরা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করে ফেলেছি, দয়া করে আমাদের শাস্তি দিন।
0 comments:
Post a Comment