স্কুল কলেজের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাড়তি কী শিখলেন তা ভেবে পাচ্ছিলেন না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র আরিফ নেওয়াজ ফরাজী। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষদিকে ফিন্যান্সের এ ছাত্রটি মনে করতেন বিশেষ কিছু না শিখেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করছেন? অতৃপ্ত ফরাজী তার প্রশ্নের জবাব পেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ক্লাসে। সেদিন স্যার জানতে চাইলেন, পথ চলতে যদি কখনো দেখতে পাও একজন রিক্সাওয়ালাকে কেউ অন্যায়ভাবে পেটাচ্ছে, তখন কী করবে? প্রায় সবার কাছ থেকে জবাব এল প্রতিবাদ করার। স্যার বললেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার এই মন্যুষত্ব ও বিবেকবোধ জাগ্রত করে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। স্যারের শেষ ক্লাসের শেষ বাক্যটিই ফরাজীর কর্মজীবনে বারে বারে মনে আসে। বহুবছর যাবৎ ফরাজী ইংরেজি মাধ্যমে সাংবাদিকতা করেন।
প্রিয় পাঠক, মূল লেখায় যাওয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়নায় সমাজ ও জাতিকে নিয়ে লেখা মনীষী লেখক আহমদ ছফার ‘গাভী বিত্তান্ত’ উপন্যাসের প্রসঙ্গে দুটি কথা বলব। ছফা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাবেক ও প্রয়াত ছাত্র। ছাত্রদের গোলাগুলির মাঝখানে পড়লে “বিশেষ যোগ্যতায়” নিয়োগ পাওয়া বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের গর্ভবতী গাভীটি নিহত হয়। সত্য এ ঘটনাকে উপজীব্য ধরে রচিত ‘গাভী বিত্তান্ত' উপন্যাসের প্রকাশকাল ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ। কারো বুঝতে বাকি নেই, তবুও কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ না করেই এ উপন্যাসে ছফা বলেন : ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টির ছিলো গৌরবময় অতীত। অনেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে গোটা দেশের আত্মার সঙ্গে তুলনা করে গর্ববোধ করতেন। ... অতীতের গরিমার ভার বইবার ক্ষমতা বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই।
সাম্প্রতিককালে নানা রোগব্যাধি বিশ্ববিদ্যালয়টিকে কাবু করে ফেলেছে। মাছের পচন যেমন মস্তক থেকে শুরু হয়, তেমনি যাবতীয় অসুখের জীবাণু শিক্ষকদের চিন্তা-চেতনায় সুন্দরভাবে স্থান করে নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্বরজারি, ধনুষ্টংকার নানা রকমের হিষ্টিরিয়া ইত্যাকার নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাধিগুলো শিক্ষকদের ঘায়েল করেছে সব চাইতে বেশি। এখন শিক্ষক সমাজ বলতে কিছু নেই। ...বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বেশি পেঁচাল পাড়লে মিয়া মুহম্মদ আবু জুনায়েদের উপাচার্য হওয়ার উপাখ্যানটি অনাবশ্যক লম্বা হয়ে যায়।' বিশ্ববিদ্যালয় পরিস্থিতি তথা উচ্চশিক্ষার সার্বিক পচন নিয়ে লেখা ওই সময় পর্যন্ত এটিই একমাত্র উপন্যাস। আরবি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রসঙ্গে লেখা অপর এক প্রবন্ধে ছফা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আত্মার’ প্রয়োজনীয়তার উল্লেখ করেছেন। ছফা বলেন, ইট, কাঠ, পাথর আর বড় ভবন হলেই বিশ্ববিদ্যালয় হয় না।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মর্যাদা ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা কেড়ে নিয়েছে বেসামরিক আমলা কর্তৃক প্রস্তুতকৃত নতুন সরকারি বেতন কাঠামো। হারানো সুযোগ-সুবিধা ফেরত পাওয়ার দাবিতে শিক্ষকরা যখন সহনশীল পর্যায়ে আন্দোলন করছিলেন ঠিক সেসময়ে
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক বক্তব্যে গোটা শিক্ষককূল ব্যথিত হয়েছেন। বিদেশফেরত প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ কীভাবে শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া এক কথায় নাকচ করে দিতে পারলেন তা নিয়ে গবেষণায় বের হয় নতুন তথ্য। জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সম্মান কেড়ে নেওয়ার প্রধান নাটের গুরু আমলাকূল শিরোমণি বা প্রজাতন্ত্রের সবচাইতে বেশি বেতন ও সুযোগ-সুবিধাভোগী বেসামরিক আমলাটি! তাকে পয়দা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ। প্রথম শ্রেণির সনদ দিয়ে আমলা হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়! পারিবারিকভাবে জামাতের প্রতি সহানুভুতিশীল হিসেবে সরকারি মহলে পরিচিত এই আমলাকে যখন প্রধান বেসামরিক আমলা পদে নিয়োগ দেওয়া হয় তখন প্রতিবাদ করেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ও আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকরা। বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের কথা না হয় বাদই দিলাম। তখনই প্রতিবাদ জানালে আজ তিনি পদাধিকারবলে সচিব কমিটির প্রধান হিসেবে শিক্ষকদের এত বড় অপমানের কাজটি করার সুযোগ পেতেন না। দ্বিতীয় নাটের গুরু বেসামরিক আমলাকূলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আমলা কাম কবি তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ তাকে পয়দা করেছে। মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকাকালে তিনি নিজের লেখা একটি কবিতা নবম শ্রেণির পাঠ্য বইয়ে ঢুকিয়েছেন গোপনে। বইয়ের কবি পরিচিতিতে তিনি ‘কামাল চৌধুরী’ নাম ব্যবহার করেছেন। তার কবিতা পাঠ্যবইয়ে স্থান দিতে গিয়ে বাদ দেওয়া হয়েছে কবি আবদুল হাকিমের ‘বঙ্গবাণী’ কবিতাটিও। দৈনিকশিক্ষাডটকম-এ খবর প্রকাশ হলে সারাদেশে ছি: ছি: রব ওঠে। আমলার কবিতা বাদ দেওয়ার দাবী জানান কবিরা।
২০১৩ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি পাঠ্যবইয়ে ‘বঙ্গবাণী’ ও অপর একটি কবিতা পুনর্বহালের সুপারিশ করে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আআমস আরেফিন সিদ্দিক। কবিতা প্রসঙ্গে উপাচার্য কোনো কথা বলেননি।
‘যেসবে বঙ্গেতে জন্মে হিংসে বঙ্গবাণী সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’ বঙ্গবাণী কবিতার এ লাইন দুটি সবচেয়ে বেশি শোভা পায় আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়ালে দেওয়ালে। অতি জনপ্রিয় এই কবিতাটি যে আমলা নবম শ্রেণির পাঠ্যবই থেকে বাদ দেওয়ার দু:সাহস দেখালেন তার বিরুদ্ধে যদি সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ও আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকরা আন্দোলন গড়ে তুলতেন কিংবা তীব্র প্রতিবাদ ধিক্কার জানাতেন তবে হয়তো আজ এই গোটা শিক্ষককূলের সম্মানহানি ঘটানোর জন্য তিনি সরকারের ওই গুরুত্বপূর্ণ আমলা পদে বসতেই পারতেন না। শিক্ষা সচিবের পদ থেকেই তাকে ওএসডি হতে হতো।
আমলা হয়ে নিজ নিজ শিক্ষকের এমন সম্মানহানি ঘটানোর খলনায়কদের পয়দা করল কোন বিশ্ববিদ্যালয়? দেখলাম দু’জনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। শিক্ষককূলের এ চরম সংকটে যেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা চুপচাপ চাকরি করে চলছেন তাদেরকেও পয়দা করেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ই। ছফার 'গাভী বিত্তান্ত' উপন্যাসে বর্ণিত ‘বিশেষ যোগ্যতায়’ উপাচার্য নিয়োগপ্রাপ্তরাও এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই পয়দা। আবার এই বিশ্ববিদ্যালয়ই তো বাঙালির সর্বকালের সেরা দুুই অর্জন বায়ান্নো আর একাত্তর-এর জন্মদাতা। এর সফল নায়কদেরও পয়দা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই।
পাঠক, শুরুতে ফিন্যান্সের ছাত্র ফরাজীর প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় ফরাজীকে ‘অন্যায়ের প্রতিবাদ’ করার শিক্ষা দিয়েছিল। আজও তা ধারণ করে পথ চলছেন ফরাজী। কিন্তু তার শিক্ষকরা কী অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন? আহমদ ছফার বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আত্মার’ প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের আত্মা কি কলুষিত হয়নি? এক অসৎ আত্মা থেকে আরেক অসৎ আত্মার পয়দা হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই উক্ত বেজন্মা আমলা পয়দার পুরোটা দায়ভার বিশ্ববিদ্যালয়কে না দিয়ে বরং এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই ফলিত পদার্থ বিজ্ঞানের সাবেক ছাত্র মনজুরুল আহসানের স্মরণাপন্ন হয়ে লেখাটির ইতি টানছি। ইংরেজি সাংবাদিকতায় নিযুক্ত আহসান অদ্য ১৬ই অক্টোবর ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে তার ফেসবুকে নিজস্ব ভঙ্গিতে লিখেছেন এরকম : ‘তুমরা বেবোধ, তুমরা আত্মঘাতি, তুমাদের ঔদ্ধত্য হাস্যকর রুপে ‘‘ছাগলামি’’তে পরিপূর্ণ। তুমরা ভাবিতেছ শিক্ষককূলের ক্ষয়িষ্ণু মেরুদণ্ড গুড়াইয়া দিয়া জাতে উঠিবা! তবে ইহাও সত্য যে, তুমাদিগকে ঐসকল শিক্ষকগণই ’পয়দা’ করিয়াছে। সুতরাং তুমাদিগের মত কুলাঙ্গার ’পয়দা’ করিবার দায় শিক্ষককূলেরই। তবে জানিয়া রাখিও, মেরুদণ্ডবিহীন শিক্ষককূল যাহা পয়দা করিবে উহাদিগেরও মেরুদণ্ড থাকিবে না। যেই কারণে তুমরা অদ্যাবধি বেজন্মা সিএসপি (পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস) বা তাহাদিগের পূর্বসুরি আইসিএস (ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস) দিগের আইকন মনে করিয়া থাকো। অথচ ওইসকল বেজন্মাদের বেতন দেওয়া হইতো তুমাদিগের পূর্ব পুরুষগণের ওপর শোষণ নিপীড়ন পরিচালনার জন্য এবং অবশ্যই ওই বেতন তুমাদিগের পূর্বসুরিদের খাজনার পয়সায় দেওয়া হইতো।’
সিদ্দিকুর রহমান খান : লেখক, সাংবাদিক ও শিক্ষা গবেষক।
Published in: http://dainikshiksha.com/news.php?content_id=10486
0 comments:
Post a Comment