Thursday, October 1, 2015

শিক্ষকদের জন্য মর্যাদাপূর্ণ স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের প্রত্যাশা আমাদের সকলের

ড. রেবা মন্ডল

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বেশকিছুদিন ধরে ঘোষিত অসম্মানজনক বৈষম্য সৃষ্টিকারী বেতন স্কেলের পরিবর্তে স্বতন্ত্র বেতন স্কেল দাবি ও টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিলের প্রতিবাদে কর্মবিরতি পালন করেছে। একই সাথে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির ডাকে চলছে ঐ একই প্রতিবাদ, আন্দোলন, কর্মবিরতি ও বিভিন্ন কর্মসূচির ঘোষণা। এমনকি ঘোষিত বেতন স্কেল প্রতিবাদী করে তুলছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও।
কর্মসূচি অনুযায়ী দেশের ৩০৫টি সরকারি কলেজের কোথাও ক্লাস পরীক্ষাও গ্রহণ করা হয়নি। ঈদের ছুটির আগে পর্যন্ত দেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সপ্তাহে ২/১ দিন করে কর্মবিরতি চলছিল। আন্দোলনকারী শিক্ষকদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সরকার তাদের দাবি না মানলে ঈদের ছুটির পর কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করবে। পৃথিবীতে বহু আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি আমলাদের বড় করে শিক্ষক সামাজকে হেয় করায় বেতন স্কেল ঘোষণা দেয়ায় শিক্ষকরা নজিরবিহীন আন্দোলনে মাঠে নেমেছে। আমরা মনে করি, বাধ্য হয়েই তারা যৌক্তিক দাবিতে আন্দোলন করলেও এটি একটি মর্যাদাশীল জাতির জন্য অগৌরবের। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর যে কোন সাধারণ মানুষই দ্বিধাহীন চিত্তে বলবে যে শিক্ষক সমাজকে তারা যথাযথ মান মর্যাদা ও উচ্চ আসনে রেখেছে। পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল, শ্রীলঙ্কা এমনকি পাকিস্তানেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদাপূর্ণ স্বতন্ত্র বেতন স্কেল রয়েছে। আমলা হোক, সচিব হোক বা মন্ত্রী যেই হোক না কেন তারা যদি স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে একদিনের জন্য হলেও পড়ালেখা করে থাকেন, তাহলে তারা শিক্ষকদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। যে তার শিক্ষককে সম্মান করতে জানে না সে নিজেকেও সম্মানিত করতে জানে না। বরং সে নিজেকে শুধু নিজেই অপমান করতে পারে। কোন সন্তান যেমন তার পিতা মাতাকে অসম্মান করে অশ্রদ্ধা করে কোন ভাল কিছু অর্জন করতে পারে না তেমনি যে জাতি শিক্ষকদের অশ্রদ্ধা করে সে জাতির সমস্ত অর্জনই ব্যর্থ হয়।শিক্ষকসমাজ যে জাতি গঠনের প্রধান নিয়ামক, কর্ণধার তা যে কোন জ্ঞানী মানুষই বুঝতে পারে, উপলব্ধি করতে পারে। শিক্ষকদের মধ্য থেকেই অধিকাংশ বিজ্ঞানী, কবি, সাহিত্যিক, সমাজকর্মী সৃষ্টি হয়। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সচিব, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী সবার শিক্ষকই তাদের উন্নত জীবন গঠনে মূল চাবিকাঠি। কিছু ব্যতিক্রম সব ক্ষেত্রেই রয়েছে যা কোন নিয়ম নয়। আইনস্টাইনকে একটি রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রস্তাব দেয়ায় আইনস্টাইন সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হওয়ার চেয়ে পদার্থ বিদ্যার একটি সমীকরণ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কলকাতার ঈশ্বর লেনের বাড়িতে সত্যেন বোসকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিজ্ঞানী সত্যেন বোসের গরিব ঘরেও গিয়েছিলেন। মাদামকুরী যিনি ২বার নোবেল পেয়েছিলেন তিনিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। পৃথিবীতে যত গবেষণা হয়েছে তা কি প্রশাসনিক চেয়ারে হয়েছে না কোন উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিষ্ঠানে হয়েছে সেটি সবার ভেবে দেখা দরকার। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন লেকচারার হওয়ার জন্য কমপক্ষে ৩টি প্রথম শ্রেণী অথবা এমফিল কিংবা পিএইচডি ডিগ্রি না থাকলে আবেদন করারই যোগ্যতা থাকে না। প্রাথমিক শিক্ষার স্তর থেকে শিক্ষাজীবনে যারা প্রথম সারির ছাত্র ছিলেন তারাই মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন। যদি কারও সন্দেহ থাকে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রাষ্ট্রের অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের চেয়ে নিম্নমানের, শিক্ষা জীবনে তাদের সাফল্যের ইতিহাস নগন্য ছিল তাহলে ভুল হবে। একজন শিক্ষক তার ক্লাসে যে জ্ঞানের অনুশীলন করেন তা কি অন্য কোন সেক্টরে করা হয়! এ প্রশ্নে উত্তর তারা পেয়ে যাবেন যারা একটু হালকা চিন্তা না করে গভীরভাবে চিন্তা করবেন তারাই। একজন ডাক্তার, একজন ইঞ্জিনিয়ার, একজন বিচারক ছাত্রজীবনে যে বিষয়ে ভালো শিক্ষা পাননি তিনি সারাজীবন সে বিষয়ে অপরিপক্বই থেকে যান। পরবর্তীতে যদি কেউ সে শূন্যতা পূরণ করেও থাকেন, তাকে দ্বিগুণ তিনগুণ কষ্ট করে সেটি অর্জন করতে হয়েছে। যেসব ছাত্ররা বিসিএস পরীক্ষা দেন তারা অনেকেই বলেছেন ইউনিভার্সিটিতে যে সাবজেক্টগুলো শিক্ষকরা ভালোভাবে পড়িয়েছেন, গভীরভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়িয়েছেন সেসব সাবজেক্টে প্রস্তুতি নিতে অতটা কষ্ট হয়নি। আইন, অর্থনীতি, চিকিৎসা শাস্ত্র ও ইঞ্জিনিয়ারিংসহ বেশকিছু বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া যে কি গুরুত্বপূর্ণ তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারে। অর্থ আয় আর লেখাপড়া, জ্ঞান অর্জন, জ্ঞান চর্চা এক বিষয় নয় তা যে কোন মেধা সম্পন্ন মানুষই বুঝতে পারেন, উপলব্ধি করতে পারেন। গায়ের জোরে ও দাম্ভিকতা প্রকাশ করে সত্য কে চাপা দেয়া যায় না। বিভিন্ন অজুহাতে শিক্ষক সমাজের গুরুত্ব কমানো যাবে না কোনদিনও। বর্তমান পে-স্কেলে কেন অধ্যাপকদের টাইম স্কেল, সিলেকশন গ্রেড বাতিল করা হলো- এটি আমাদের বোধগম্য নয়। জাতির যে কোন সংকটকালীন মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই সেস্নাগান, আন্দোলন সংগ্রাম শুরু হয়। আমাদের ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতার আন্দোলন, তৎকালীন স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলন এমনকি বর্তমান সময়কার গণজাগরণ মঞ্চ তাও বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকেই শুরু হয়েছিল। শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তরের শিক্ষকদেরই নিজেদের মানসম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় আন্দোলনে নামতে হলো- এটি বড় বেশি পরিতাপের ও লজ্জার। যারা এ ধরনের বৈষম্য সৃষ্টিকারী ও মর্যাদাহানিকর ৮ম জাতীয় বেতন স্কেল তৈরি ও প্রকাশ করতে পারেন তারা হয়ত ভুলেই গিয়েছিলেন শিক্ষকের মর্যাদা সম্পর্কে কবি কাদের নেওয়াজে লেখা কবিতাটি। বিখ্যাত সেই কবিতায় মোঘল সম্রাট বাদশা আলমগীর কর্তৃক শিক্ষকের মর্যাদা প্রদর্শনের বর্ণনা করা হয়েছে। অনেকে বলে থাকেন এশিয়ার প্রথম সারির ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের তালিকায় বাংলাদেশের ১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ও নাম নেই। স্বীকার করতেই হবে পচন যখন ধরে, তখন সব ক্ষেত্রেই কম বেশি ধরে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রমোশন নিয়ে যত সব নেতিবাচক কথাবার্তা প্রচলিত সেগুলো ভেতরের খবর না জেনে মুখরোচক করে তৈরি করা এক শ্রেণীর জ্ঞানপাপীদের বানানো কল্প কাহিনী। শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি বিষয়গুলো আইন মাফিকই হয়। দেশি, বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ জার্নাল, উচ্চতর ডিগ্রি, আর্টিকেল বই প্রকাশনা নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদোন্নতি হয়। দুর্নীতির কথা বললে বলা যাবে, একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়েই দুর্নীতি কম। বিশ্ববিদ্যালয়েই সব চেয়ে বেশি ক্লাস, টিউটোরিয়াল, অ্যাসাইনমেন্ট, মৌখিক পরীক্ষা বেশি হয়। ইউনিভার্সিটির শিক্ষকরা ইউনিভার্সিটির কর্মঘণ্টার বাইরে রাতের পর রাত জেগে যে গবেষণা, খাতা দেখা, প্রশ্নপত্র তৈরি করা, লেকচার সিট, আর্টিকেল লেখাসহ নানাবিধ একাডেমিক কাজকর্ম চালিয়ে যান_ সেটি সাধারণভাবে বাইরের পরিবেশ থেকে বোঝা যায় না। সাধারণের কাছে বরাবরই এসব অপ্রকাশিত খাকে। অন্যান্য প্রফেশনে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত অফিস করে ঘরে ফিরে আরাম আয়েশের সুযোগ থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এসব অনেকটাই থাকে না।অনিয়ম দুর্নীতি যখন বহু বছর ধরে সমাজ ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বাসা বাঁধে সেখানে শিক্ষা কাঠামো হয়তো একবারে বাদ পড়তে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়েও যে ২/১টি ছোটখাটো অঘটন বা দুর্নীতির ঘটনা ঘটে না এমনও নয়। তবে সরকারি নজরদারি ও কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সেসব অনিয়ম দুর্নীতি নিরসন করা কঠিন কিছু নয়। আমরা বিশ্বাস করি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মর্যাদার কারণেই নিজের অবস্থান যথাযথ স্থানে ধরে রাখার চেষ্টা করে থাকেন। সেই শিক্ষকদের যদি কোনভাবে অবমাননা, অবহেলা ও অসম্মান করা হয় তাহলে শিক্ষার স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হতে পারে। এমনিতেই সমাজে মানবিক মর্যাদা, মূল্যবোধ হ্রাস পেয়েছে, শিক্ষকদের ওপর ছাত্ররা হামলা করছে। এসব ঘটনা খেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সঠিকভাবে বেড়ে উঠবে কিনা সেই আতংক ছড়িয়ে পড়ছে জনমনে। সুতরাং এখনও সময় আছে শিক্ষক সমাজকে বাঁচাতে সরকার ও দেশের আপামর জনসাধারণকে এগিয়ে আসতে হবে। না হলে শিক্ষা জাতির মেরুদ- এ চির সত্য বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদবে, জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদার আসন দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা জীবিত থাকতে তার ব্যত্যয় ঘটতে পারে না। আমরা আশাবাদী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমনভাবে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ পুরস্কার- "চ্যাম্পিয়ন্স অফ দ্য আর্থ" অর্জন করেছেন, তেমনিভাবে নিজের দেশে শিক্ষার পরিবেশ সুষ্ঠু, সুন্দর, উন্নত ও মর্যাদাপূর্ণ রাখার ক্ষেত্রেও শিক্ষক সমাজের দাবি দাওয়া যথাযথভাবে বিবেচনা করবেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে অনবদ্য অবদানের জন্য 'আলোকিত শিক্ষা' পুরস্কারে ভূষিত হবেন। ইতোমধ্যে পে-স্কেল ইসুতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজে শিক্ষকদের মাঝে সৃষ্ট অসন্তোষ যে কোন উপায়ে নিরসনের নির্দশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশ যথাযথভাবে কার্যকর হবে, শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র মর্যাদাপূর্ণ বেতন স্কেল নির্ধারণ করতে অবিলম্বে নতুন একটি পে-কমিশন গঠন করা হবে আমরা সেই প্রত্যাশায় রইলাম।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
rebamandol@gmail.com


Published in: http://thedailysangbad.com/open-discussion/2015/10/01/28320

0 comments:

Post a Comment