Tuesday, September 29, 2015

বেতনক্রম নিয়ে ছোট আন্দোলন বড় সমস্যা

শ্যামল সরকার

৪ দিনেও গেজেট প্রকাশ না হওয়ায় অসন্তোষ বাড়ছে * লাগাতার কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন প্রাথমিকের শিক্ষকরা * পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কর্মবিরতি চলবে

সরকারের ঘোষিত অষ্টম বেতনক্রম নিয়ে অসন্তোষ দানা বাঁধছে। নতুন বেতনক্রমে বৈষম্য হয়েছে-এই অভিযোগ এনে ঈদের আগে বেশ কয়েকটি ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ আন্দোলন করেছে। ঈদশেষে তারা আবারও আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদিও এসব আন্দোলন এখনও বড় আকার পায়নি। তবুও বিষয়টিকে বেশ জটিল এবং বড় বলেই মানছে সরকারি পক্ষ। আর এ কারণেই সরকার এসব সমস্যা সমাধানের জন্য অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করেছে। অবশ্য এ কমিটিতে অর্থমন্ত্রীকে রাখায় আপত্তি জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট বড় একটি পক্ষ। শিক্ষামন্ত্রী কমিটির ওপর আস্থা রাখতে সকলকে অনুরোধ জানিয়েছেন।

গত ৭ সেপ্টেম্বর নতুন বেতনক্রম ঘোষণা করা হলেও তা কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় গেজেট এখনো প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। অর্থবিভাগ অবশ্য দাবি করছে যে, গেজেটের খসড়া প্রস্তুত আছে। অর্থমন্ত্রী আগামী ১৬ অক্টোবর দেশে ফিরবেন। অক্টোবরেই গেজেট প্রকাশের সম্ভাবনা আছে। গঠিত মন্ত্রিসভা কমিটি বিভিন্ন শ্রেণিপেশার দাবিগুলো বিবেচনা করে বেতন বৈষম্যের বিষয়টি নিরসন করলেই তখন গেজেট প্রকাশ করা হবে কিনা-এই প্রশ্নের জবাবে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গেজেট প্রকাশ না হলে বোঝা যাবে না কোথায় কোথায় সমস্যা। তার ধারণা এবার বেতনক্রম নিয়ে অসংখ্য মামলা-মোকদ্দমার উদ্ভব হতে পারে। আর সেরকম পরিস্থিতি হলে আগামী এক বছরেও নতুন কাঠামোতে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন পাওয়া যাবে কিনা সে নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যাবে।

বেতনক্রম ঘোষণার আগে গঠিত সচিব কমিটিতে দায়িত্বে থাকা একজন জ্যেষ্ঠ সচিব ইত্তেফাককে বলেছেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যেসব দাবি তা বেতনক্রম ঘোষণার আগেই সমন্বয় করা হয়। নতুন করে যেসব কথা বলা হচ্ছে তা সমন্বয় করা সম্ভব হলেও কঠিন হবে। এ সচিবের মতে বেতনক্রম থেকে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল প্রত্যাহার করায় মূলত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। আর এ সমস্যা দূর করতে হলে পুনর্বহাল করতে হবে। শুধু বাত্সরিক প্রণোদনা (ইনক্রিমেন্ট) দিয়ে দাবির সঙ্গে সমন্বয় করা সম্ভব নয়। কারণ, যারা নতুন বেতনক্রমের বিরোধিতা করছেন, তাদের ঊর্ধ্বতন পদে পদোন্নতির সুযোগ কম। ক্ষেত্রবিশেষে এমন পদ রয়েছে যেখানে যোগদান করা হয় সেখান থেকেই অবসরে যেতে হয়। তারা সিলেকশন গ্রেড ও টাইমস্কেল প্রাপ্তিকেই পদোন্নতি বা মর্যাদার বলে বিবেচনা করেন। কারণ একজন মাঝারি গোছের কর্মকর্তা যে বেতন পান অবসরকালে তারা সে বেতনক্রম নিয়ে যেতে পারেন। এতে তাদের অবসর সুবিধাও বাড়ে। এটি সচিবালয় ও সচিবালয়ের বাইরে যারা এতদিন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তা হিসাবে পরিচিত হতেন তাদের ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য। তবে সচিবালয়ের বাইরের কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এর প্রতিক্রিয়া প্রকট। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সরকারি স্কুল কলেজ শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্যও সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল উপকারে লাগতো।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নো-ভ্যাট আন্দোলনের সফলতায় বেতনক্রম নিয়ে আন্দোলনরত পক্ষগুলো বেশ উত্সাহী হয়েছে। এখন তারা আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি নির্ধারণ করতে ব্যস্ত রয়েছেন। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহেই কর্মসূচি চূড়ান্ত করে মাঠে নামছেন তারা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বিসিএস (আনসার), সরকারি কলেজ স্কুল, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, প্রাথমিক বিদ্যালয়, সচিবালয় কর্মচারীরা এখন পর্যন্ত বেতনক্রম নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো ও স্বতন্ত্র পদমর্যাদা নির্ধারণ করাই আমাদের প্রধান দাবি। বেতন বৃদ্ধি আসল কথা নয়, প্রশ্নটি মর্যাদার। তাই বিদ্যমান বৈষম্য নিরসনের জন্য শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো নির্ধারণ করাই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সমাধান। আমলারাসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সমাজের পৃথক বেতন কাঠামো রয়েছে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ এশিয়ার অনেক দেশে শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো রয়েছে। বাংলাদেশেও শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রয়োজন। তিনি জানান, বেতন ও পদমর্যাদা নিয়ে বৈষম্যের বিষয়ে সরকারের সাথে আলোচনা শুরু হয়েছে। দাবি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন ও আলোচনা একসাথে চলবে। পরবর্তী কর্মসূচি গ্রহণের জন্য আগামী ৫ বা ৬ অক্টোবর বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভা আহ্বান করা হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অষ্টম বেতন কাঠামোতে শিক্ষকদের অবজ্ঞা করা হয়েছে। এ জন্য অর্থমন্ত্রী দায়ী। তাই বেতন বৈষম্য নিরসন কমিটিতে তাকে রাখার বিষয়ে শিক্ষকদের আপত্তি রয়েছে।

তিনি বলেন, অষ্টম বেতন কাঠামোতে সিলেকশন গ্রেড বাতিল হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সর্বোচ্চ ধাপে (গ্রেড-১) উন্নীত হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। দ্বিতীয় গ্রেডের পর তাদের বেতন বাড়লেও প্রথম গ্রেডে তারা যেতে পারবেন না। এ ছাড়া নিয়মিত ২০টি গ্রেডের বাইরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্য সচিব এবং জ্যেষ্ঠ সচিবদের জন্য দুটি বিশেষ গ্রেড থাকায় অধ্যাপকদের মর্যাদা আগের তুলনায় কমবে। আমলাতোষণ করে যে বেতন কাঠামো তৈরি হয়েছে তাতে শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে।

সরকারি কলেজ: সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাদ দেয়ার প্রতিবাদে আন্দোলনে মাঠে রয়েছে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি। কর্মসূচির অংশ হিসাবে ইতিমধ্যে সারাদেশে দুই দফা কর্মবিরতি পালন করেছেন তারা। আগামী ৭ অক্টোবর তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানববন্ধন করবেন। এছাড়া ১৪ ও ১৫ অক্টোবর ক্লাস বর্জন কর্মসূচি দেয়া হয়েছে। শিক্ষকরা বলছেন, ঘোষিত পে-স্কেলে শিক্ষা ক্যাডারে গ্রেড কয়েক ধাপ নামিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া সিলেকশন গ্রেড বাতিল করায় শিক্ষকরা আরও বৈষম্যের শিকার হবেন।

সরকারি মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়: বেতন বৈষম্য কমানোসহ ৭ দফা দাবিতে কর্মসূচি পালন করেছে সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। বেতন গ্রেড ১১তম ধাপে পুনর্নির্ধারণসহ ১১ দফা দাবিতে কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা। প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের দাবি না মানার শেষ তারিখ আজ। দাবি মানা না হলে অক্টোবর থেকে লাগাতার কর্মসূচি দেয়ার হুমকি রয়েছে তাদের।

এছাড়া প্রধান শিক্ষকদের জন্য ঘোষিত দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার পদমর্যাদা বাস্তবায়ন করা ও জাতীয় বেতন স্কেলের ১০ম গ্রেডে অন্তর্ভুক্তকরণসহ পাঁচ দফা দাবিতে কর্মসূচি রয়েছে। প্রধান শিক্ষক সমিতির নেতা আলাউদ্দিন মোল্লা জানান, প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেয়ার দেড় বছরেও প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা ও বেতন স্কেল দেয়া হয়নি। ৮ম বেতন কাঠামোতে ১০ম গ্রেডে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে তাদের।

৮ম বেতন কাঠামোতে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল পুনর্বহাল, প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা বাস্তবায়ন, ১০ গ্রেডে প্রধান শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করাসহ বিভিন্ন দাবিতে লাগাতার কর্মবিরতির হুমকি দিয়েছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির আহ্বায়ক রিয়াজ পারভেজ বলেন, দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আগামী ৩ থেকে ৫ অক্টোবর সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত কর্মবিরতি পালনের কর্মসূচি রয়েছে তাদের। আগামী ৬ অক্টোবর থেকে লাগাতার কর্মবিরতির ঘোষণা রয়েছে।

বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মচারী সমিতি:স্মারকলিপি দেয়ার মাধ্যমে বেতনক্রমে তাদের অসন্তুষ্টির কথা প্রকাশ করে আসছে সচিবালয় কর্মচারীরা। তারা অবশ্য একটু গা-ঢাকা ভাবে কর্মসূচি পালন করে আসছে। তারাও টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড পুনর্বহালের পক্ষে।

ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন: প্রতিষ্ঠানের সভাপতি একেএম আব্দুল হামিদ ইত্তেফাককে বলেন, প্রায় ৬০ হাজার ডিপ্লোমা প্রকৌশলী সরকারি চাকরিতে আছেন। অষ্টম বেতন স্কেলে তারা বেতন বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। ইনস্টিটিউশনের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে বেতন বৈষম্য দূর করার জন্য সরকারকে এক মাসের সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে।

Published in: http://www.ittefaq.com.bd/national/2015/09/30/37785.html

0 comments:

Post a Comment