Monday, September 14, 2015

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাপুরুষ সৃষ্টি করেনি কখনও (ছয় কিস্তি একত্রে)

মুনতাসীর মামুন


বেতন ও চাকরি কমিশন ২০১৩, ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর খুব একটা উচ্চবাচ্য হয়নি। বেতন কমিশন মানেই বেতন বৃদ্ধি। এই সন্তুষ্টিতে সবাই অপেক্ষা করছিল কবে বেতন স্কেল ঘোষণা করা হবে সেই সময়ের জন্য। একটি জাতীয় কমিশনের রিপোর্টের সারমর্ম বা সুপারিশ কেবিনেট কোন সাব-কমিটি মূল্যায়ন করে মন্ত্রিসভায় পেশ করলে তা যথাযথ হতো। কিন্তু এটি মূল্যায়নের ভার অর্পিত হয়েছিল একটি সুপ্রা কমিটি সচিব কমিটির ওপর। সচিব কমিটির মূল্যায়ন পত্রিকায় প্রকাশিত হলে ক্রমে অসন্তোষ সৃষ্টি হতে থাকে এবং এখন তা তুঙ্গে। অর্থমন্ত্রী, পত্রিকার প্রতিবেদন অনুসারে, সচিব কমিটির মূল্যায়নকেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু বিসিএস সমন্বয় কমিটি এর প্রতিবাদ জানালে বিশেষ করে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড নিয়ে তখন মন্ত্রী দ্বন্দ্বে পড়েন। একটি ক্যাডারের জন্য সামগ্রিক অসন্তুষ্টির সম্মুখীন হওয়া রাজনৈতিক দিক থেকে কতটা সমীচীন? এই চিন্তা থেকে খুব সম্ভব তিনি বলেছেন, পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করতে হবে। এর অন্য অর্থ হতে পারে, সবাইকে অন্তর্বর্তীকালীন একটি ভাতা দিয়ে বেতন স্কেল স্থগিত রাখা।

এই বেতন স্কেল সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে না পারা, আমাদের দেশের রাজনৈতিক সরকারগুলোর একটি বৈশিষ্ট্য। বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় এমনটি হয়নি। রাজনৈতিক সরকারই ছিল সত্যিকার অর্থে প্রভু। এবং তার মন্ত্রীরা প্রথমবার ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক মন্ত্রীরা যেভাবে কাজ করেন সেভাবেই কাজ করেছেন। রাজনৈতিক বা সামরিক আমলাতন্ত্র এতে অখুশি ছিল। বঙ্গবন্ধু তাতে ভ্রক্ষেপ করেননি। তারাও কোন উচ্চবাচ্য করতে সাহস করেনি।


এই অবস্থার পরিবর্তন হয় সামরিক আমলা জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করার পর। পাকিস্তানী মানসের প্রতিনিধিত্বকারী এই দুই আমলাকে সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র ভালবেসেছিল। তাদের ডিকটাটে প্রশাসন চলেছে। একগুচ্ছ মন্ত্রী বা সামরিক শাসকদের যারা কোলাবরেটর ছিলেন, তবে তারা যে নন-এনটিটি তা সবাই জানতেন। সামরিক শাসকদের পর রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় এসেছেন বটে, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকালীন রাজনৈতিক সরকার সম্পূর্ণ অর্থে প্রবর্তন করতে পারেননি। তারা শাসন করলেও আমলাতন্ত্র শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং নীতিনির্ধারকরা তাদের সহকর্মী থেকে তাদের ওপর বিশ্বাস ও আস্থা রাখতে শুরু করেন। এই আমলাতন্ত্রে সামরিক আমলাতন্ত্রের স্থান ওপরে। আজ পর্যন্ত জানা যায়নি তারা কত বেতন পান, সেই বেতন থেকে কত বেশি সুবিধা পান বা কত টাকা রেশন পান। ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনও সেটি মেনে নিয়েছেন। এই যখন অবস্থা, তখন এই আমলাতন্ত্রই সম্মিলিতভাবে আবার রাজনীতিবিদ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না থাকলে আজকের আমলারাও আমলা হতেন না, স্বাধীনতাও হতো দূরঅস্ত। বিভিন্ন সরকারের আমলে বিশেষ করে সামরিক আমলে সুযোগ পেলেই তারা আক্রমণ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। এর সর্বশেষ উদাহরণ মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের আমলাতান্ত্রিক সামরিক শাসন। ট্র্যাজেডি হলো ঢাকা বা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নুন খাওয়া আমলাতন্ত্রের সদস্যরা সুযোগ পেলেই ঢাকা বা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়কে কিভাবে অপদস্থ করা যায় তার চেষ্টা করেছেন। এটা জাতীয় ট্র্যাজেডি, পৃথিবীর কোন দেশে এমনটি হয়নি, এমনকি ভারত, শ্রীলঙ্কা বা অন্যান্য দেশেও। এর জন্য রাজনৈতিক শাসনের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা দায়ী। এই যখন অবস্থা, তখন আমলাতন্ত্রের ডিকটাট রাজনীতিবিদরা মেনে নেবেন তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অবাক হইওনি। বরং অবাক হয়েছি শিক্ষকদের এক্ষেত্রে অন্যমনস্কতা দেখে।

খুব শীঘ্রই আমি অবসরে যাব। বেতন স্কেল নিয়ে আমার মাথা ঘামানোর কথা ছিল না। এখন মাথা ঘামাইও না। কেননা এই বেতন স্কেল আমার ওপর অভিঘাত হানবে না, হানবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রজন্মের শিক্ষকদের ওপর। কিন্তু আমলাতন্ত্রের এই দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্তিগতভাবে আমার ভাল লাগেনি। এর মধ্যে সবাইকে নস্যাত করার, অধস্তন করার একটা ভাব আছে। এই সরকারের আমলে এই সময় কেন এমনটা হবে? আমলাতন্ত্রের সঙ্গে তো আমাদের বিরোধ নেই। আমি তো মনে করি, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন বিজ্ঞানীর বেতন, আমাদের সবার থেকে বেশি না হলেও সমান হওয়া উচিত। তাদের ভাতার পরিমাণ সেনাবাহিনী থেকে বেশি হওয়া উচিত। কারণ, আজ কৃষিতে যে সাফল্য তাতে কৃষিবিজ্ঞানীদের অবদান বেশি। আমার বেতনের ক্ষতি না হয়ে যদি তিনি বেশি পান তাতে আমার কী? অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ থেকে যেসব কৃষিবিজ্ঞানী গেছেন অস্ট্রেলিয়া সরকার তাদের সবাইকে লুফে নিয়েছে। কিন্তু সমস্যা হয়েছে এই বেতনক্রমের সঙ্গে রাষ্ট্রাচার বা মর্যাদার একটি প্রশ্ন আছে। সেটি আরও ক্ষোভের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের [সব বিশ্ববিদ্যালয়কেই ধরতে পারেন] সঙ্গে যুক্ত ৪৭ বছর। বিশ্ববিদ্যালয়কে মর্যাদাহানিকর দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে আমার ভাল না লাগারই কথা। কেননা ঔপনিবেশিক শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের যে অবদান তা আমলাতন্ত্রের নেই। 
শুধু তাই নয়, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের [বা সমূহের] অবদান অনেক এই সরকারকে ক্ষমতায় আনার। এটা অস্বীকার করতে পারেন কিন্তু এটাই সত্য। সুতরাং, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকি বা না থাকি এ বিষয়ে কথা বলার অধিকার আমি অর্জন করেছি। আমলাতন্ত্র করেনি। নীতিনির্ধারকরা এই কথাটি ভুলে গেলে সামগ্রিক মঙ্গল থেকে অমঙ্গল হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।

দুই.
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি। বাধ্য হয়েই তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্তন করেছিলেন। শিক্ষার বিস্তার তাদের এজেন্ডায় ছিল না। কিন্তু তারা যখন এতে হাত দিলেন তখন কী যত্নে যে তা করেছিলেন তা ভাবা যায় না। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার হার্টগ ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য। একজন ইহুদী যাকে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের পছন্দ না করার কথা। কিন্তু করেছিল। হয়ত তাদের ধর্মবোধ এখনকার মানুষজনের থেকে ছিল বেশি। বাংলার গবর্নর রোনাল্ড শ’ তখন আচার্য। বাংলার গবর্নরের সঙ্গে মফস্বলের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, তিনি শ্বেতাঙ্গ হলেও তফাত অনেক। কিন্তু দু’জনে মিলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে বেছে বেছে শিক্ষক নিয়োগ করেছিলেন, বিশেষ বেতন দিয়ে। আজকের যে সব বাসায় মন্ত্রীরা থাকেন এবং নীলক্ষেত এলাকার লাল বাংলোগুলোতে শিক্ষকরাই থাকতেন। হার্টগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার ব্যাপারে মনস্থির করার পরই গবর্নর ও লন্ডনে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। কাজে যোগ দেয়ার মাস পাঁচেক থেকেই এ প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়। হার্টগের প্রথম কাজটি ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রতিশ্রুতিশীল ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করা। এ কারণে, ভারত ও গ্রেটব্রিটেনে তিনি খোঁজ করেছেন বর্ণ, সম্প্রদায়ের কথা না ভেবে। যাদের তিনি চেয়েছিলেন তাদের যে তিনি আনতে পেরেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তা নয়। তবে বেশ কিছু বিভাগের জন্য তিনি চেষ্টা করেছিলেন। তাঁর চিঠিপত্রগুলো এর প্রমাণ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি আকর্ষণীয় করার উদ্দেশ্যে বেশ উঁচু হারে বেতন স্কেল দেয়া হয়। প্রফেসরদের বেতন স্কেল ছিল ১০০০-১৮০০ আর রিডারের ৬০০-১২০০। এ বেতন স্কেল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদের বেতন স্কেল থেকে বেশি ছিল। এ কারণে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেকেই যোগ দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্যার আশুতোষ এটি পছন্দ করেননি; তবে রমেশ চন্দ্রকে বলেছিলেন : “দেখো, ঢাকায় অনেকেই দরখাস্ত করেছে এবং চাকরিও পাবে। আমি তাতে বাধা দিতে চাই না। কারণ, তোমরা যদি অনেকে ঢাকায় গিয়ে অধ্যাপনা করো, তাহলে আমি বলতে পারব যে "Calcutta University is the Grandmother of Indian Universities."

১৯২৯ সালের আইন অনুযায়ী বাংলার প্রথম বাঙালী শিক্ষামন্ত্রী হলেন প্রভাস চন্দ্র মিত্র। তিনি প্রায় জেদ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বেতন কমিয়ে দিলেন। প্রফেসরদের বেতন হার সর্বোচ্চ ১০০০ করা হলো। অন্যান্য পদের বেতনও হ্রাস পেল।

বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, আমলাতন্ত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। অথচ এ বিশ্ববিদ্যালয় না থাকলে আজকের আমলারাও হয়তো আমলা হতেন না। দেখা যায় ঢাকা বা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের নুন খাওয়া আমলাতন্ত্রের সদস্যরা সুযোগ পেলেই বিশ্ববিদ্যালয়কে কিভাবে অপদস্থ করা যায় তার চেষ্টা করেছেন। এটা জাতীয় ট্র্যাজেডি। গতকালের চতুরঙ্গ পাতার পর আজ পড়ুন দ্বিতীয় কিস্তি...

হার্টগের প্রথম কাজ ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর পদে শিক্ষক নিয়োগ। এবং লন্ডনে বসেই তিনি এ প্রক্রিয়া শুরু করেন। লন্ডনের শিক্ষা দপ্তর, চ্যান্সেলর, নির্বাচকম-লীর বিভিন্নজনের সঙ্গে নিয়মিত চিঠিপত্র আদান-প্রদান শুরু হয়।

১৯২০ সালের আগস্ট মাসে গবর্নর রোনাল্ড শ’ হার্টগকে একটি দীর্ঘ চিঠি লেখেন। বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করে তিনি লেখেন- “একটি বিষয়ে গোড়াতেই আমি গুরুত্ব দিতে চাই, তাহলো, প্রথম থেকেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত ‘চাকরি ব্যবস্থা’র শর্তাবলী থাকবে না। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিজনের সঙ্গে আলাদাভাবে বসে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি হবে। এবং এসব আলোচনার ভিত্তি হবে প্রার্থীর যোগ্যতা, বয়স, অভিজ্ঞতা, সবার ওপরে তার নিজ বিষয়ে বাজারদরও (মার্কেট ভ্যালু) যাচাই করতে হবে। মি. স্টেপলটনের বাজেটে ওভারসিজ অ্যালাউন্স নামে একটি বরাদ্দ আছে; বুঝতেই পারছেন আমি এর বিরোধী। আমি যে কোন স্টেরিওটাইপ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যেখানে জন্ম বা বর্ণের ভিত্তিতে বেতনের ক্ষেত্রে পার্থক্য করা হয় এবং এ বিষয়ে পরিষ্কারভাবে আমি আমার মতামত জানিয়ে দিয়েছি সেক্রেটারি অব স্টেটকে।”

সে সময় ইউরোপীয় কর্মচারীরা সমমর্যাদার ভারতীয় চাকরিজীবীদের থেকে বাড়তি কিছু সুবিধা পেতেন। তার একটি ছিল গ্রীষ্মকালে পাহাড়ে অবস্থান ও কয়েক বছর পর পর ‘হোমে’ যাওয়ার জন্য সবেতন ছুটিসহ ভ্রমণ ভাতা। এ বৈষম্য ভারতীয়দের মনে স্বাভাবিকভাবেই হীনম্মন্যতাবোধে আক্রান্ত শিক্ষক উচ্চ বিদ্যাপিঠে ছাত্রদের আত্মমর্যাদাবান করে তুলতে পারবেন কিনা সন্দেহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি নিয়োগ নিয়ে তারা চিঠি চালাচালি করেছেন। রোনাল্ড শ’ সফরে বেরিয়েছেন। তারপরও দেখি, তাঁবুতে বসে রাতে লন্ঠনের আলোয় হার্টগ-কে ১০ পৃষ্ঠার চিঠি লিখছেন। আমি দু’একটি উদাহরণ দেব মাত্র।

রোনাল্ড শ’ বিভিন্ন বিভাগীয় পদে নিয়োগের জন্য কয়েকজনের নাম প্রস্তাব করেছিলেন। ইংরেজীর প্রফেসর পদের জন্য তিনি প্রস্তাব করেছিলেন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ এফ সি টার্নারের নাম। আরবির প্রফেসর হিসেবে ড. জিয়াউদ্দিন ও ড. সিদ্দিকির নাম। এছাড়া আইইএস ক্যাডার থেকে দর্শনের প্রফেসরের পদের জন্য জর্জ হ্যারি ল্যাংলি, ইংরেজীর জন্য ইগারটন স্মিথ ও অঙ্কের জন্য বি এম সেনের নাম বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। প্রফেসর ল্যাংলি ছিলেন তখন ঢাকা কলেজে। বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ পদে তাকে নিযুক্ত করা হয়। পরবর্তীকালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় উপাচার্য হিসেবে ১৯২৬ সালে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ঐ পদে ছিলেন তিনি ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত।

প্রফেসর বিএম সেনগুপ্তও ছিলেন ঢাকা কলেজে এবং অঙ্কবিদ হিসেবে তাঁর খ্যাতিও ছিল। অঙ্ক বিভাগের প্রধান ও প্রফেসর হিসেবে তাঁকেও নিয়োগ করা হয়। তবে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত ছিলেন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষের ভার গ্রহণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যান। ইগারটন, স্মিথ ও টার্নারের ক্ষেত্রে গবর্নরের অনুরোধ রক্ষা করা যায়নি। টার্নারের ব্যাপারে হার্টগ গবর্নরকে জানিয়েছিলেন, টার্নার নিজেও এ পদে যোগ দিতে চাইবেন কিনা সন্দেহ। “কাগজপত্রে তাঁর যা যোগ্যতা দেখা যাচ্ছে তা সামান্য। দু’বছর ধরে তিনি বিষয়টি পড়াচ্ছেন অথচ এ বিষয়ে তাঁর কোন লেখাজোখা নেই। তাঁর এমন কোন একাডেমিক কৃতিত্বও নেই যে কারণে রিডার হিসেবেও তাঁর নিযুক্তির যৌক্তিকতা দেখানো যেতে পারে।” হার্টগ আরও লিখেছেন, টার্নার তাকে জানিয়েছেন লেকচারশিপ ও সঙ্গে একটি প্রভোস্টশিপ বা ট্রেজারার পদ দিলেই তিনি সন্তুষ্ট, তবে বেতন হতে হবে ১৯০০ টাকা। ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে টার্নার তখন হয়ত এই বেতন পেতেন। কিন্তু হার্টগ তাতেও রাজি ছিলেন না। তাঁর মতে, মাসে ১৯০০ টাকা বেতন একটু বেশি। কারণ, একজন প্রভোস্টের একাডেমিক কাজ থেকে প্রশাসনিক কাজ বেশি। টার্নার পরে ঢাকা হলের প্রভোস্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্রন্থাগারিক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সঙ্গে ইংরেজীর অনারারি লেকচারশিপ।

ইতোমধ্যে দেশ-বিদেশে বিজ্ঞাপনের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকে আবেদন করেছিলেন এবং যাদের যোগ্য বিবেচনা করা হয়নি তাদের জানিয়ে দিতে বলা হয়েছিল। এদের মধ্যে ছিলেন ফনেটিকসে নোয়েল আর্মফিল্ড, ইংরেজীতে মি. পিংক ও ইতিহাসে মি. হালিম। আবদুল হালিম পরে অবশ্য ইতিহাস বিভাগে যোগ দিয়েছিলেন লেকচারার হিসেবে।

৫ অক্টোবর লন্ডনের বোর্ড অব এডুকেশনের পরিচালক টুয়েন্টিম্যান হার্টগকে জানালেন যে পদার্থবিদ্যা বিভাগের তিনজন প্রার্থী- মল্লিক, সাহা ও মসকে ডাকা হচ্ছে। এক সপ্তাহ পর গবর্নরকে হার্টগ বিভিন্ন বিভাগের নিয়োগের একটি সারমর্ম পাঠান। তিনি জানান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ছাড়া বাকি বিভাগগুলোর উচ্চতর পদসমূহ সম্পর্কে মোটামুটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে চেয়ারম্যান ও রিডারশিপের জন্য উপযুক্ত কাউকে পাওয়া যায়নি। ইতিহাস ও পলিটিক্যাল ইকোনমির ক্ষেত্রে একই আস্থা। 

রসায়ন বিভাগের জন্য ড. জ্ঞান চন্দ্র ঘোষ নামে একজন, ‘রিমার্কেবল ইয়ং ইন্ডিয়ান’কে পাওয়া গেছে যার গবেষণা ইতোমধ্যে দেশে-বিদেশে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কিন্তু, হার্টগ জানালেন, তাঁর বয়স মাত্র ২৮। বিশেষজ্ঞরা দৃঢ়ভাবে জানিয়েছেন এবং নির্বাচকম-লীও একমত যে, সম্ভব হলে অর্গানিক কেমেস্ট্রির ‘চেয়ার’ ও পরিচালনার ভার দেওয়া উচিত ঢাকা কলেজের ভূতপূর্ব অধ্যাপক ও বর্তমানে (অর্থাৎ ১৯২০ সালে) কানপুরে কর্মরত ইআর ওয়াটসনকে এবং ঘোষকে ‘ফিজিক্যাল কেমেস্ট্রি’র প্রফেসর পদ দেওয়া উচিত। এটি হবে একটি ‘Admirable combination’. তারপর ভারতবর্ষ থেকে ইনঅর্গানিক কেমেস্ট্রির জন্য একজন রিডার খুঁজে বের করতে হবে।


বিজ্ঞাপন প্রকাশের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক পদের জন্য অনেকে আবেদন করেছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন ফনেটিকসে নোয়েল আর্মফিল্ড, ইংরেজীতে মি. পিংক ও ইতিহাসে মি. হালিম। যাদের যোগ্য বিবেচনা করা হয়নি তাদের জানিয়ে দিতে বলা হয়েছিল। আবদুল হালিম পরে ইতিহাস বিভাগে যোগ দিয়েছিলেন। গতকালের পর আজ পড়ুন তৃতীয় কিস্তি...

পরে অবশ্য জ্ঞান চন্দ্র ঘোষকেই কেমেস্ট্রির প্রফেসর ও চেয়ারম্যানশিপ দেওয়া হয়। ড. ঘোষ ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঋণ শোধ না করে তাঁর পক্ষে ঢাকায় যোগ দেওয়া সম্ভব ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর ক্যাপিটাল গ্রান্ট থেকে এ ঋণ শোধ করে দিয়েছিল। টাকার পরিমাণ ১০,৭০০ টাকা। এ পরিপ্রেক্ষিতে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল ১৩ ডিসেম্বর ১৯২১ সালে ৩৬ নং প্রস্তাব নিয়েছিল এভাবে-
“That Rs. 10,700 be paid to Dr. J.C. Ghosh to pay his debt to the Calcutta University and that the sum be debited to the annual capital expenditure of the University provided that Dr. Ghosh gives an undertaking that he will remain in service of the University for a period of five years and his scale of salary remain unaffected.”

পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে জানিয়েছেন হার্টগ, আরেকজন ভারতীয়ই শ্রেষ্ঠ। তাঁর নাম মেঘনাদ সাহা; যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন লেকচারার এবং তখন ছিলেন লন্ডনে। হার্টগ, ড. সাহাকে উল্লেখ করেছেন- ‘Man of great ability’ হিসেবে। কিন্তু বিভাগ প্রধানের দায়িত্ব তিনি পালন করতে পারবেন কিনা সে বিষয়ে তাঁর সন্দেহ ছিল, কারণ ড. সাহার বয়স খুবই কম। এ পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা কলেজের অধ্যাপক ডব্লিউ, এ জেনকিনসের কথা তাঁরা ভাবছিলেন।
পদার্থবিদ্যা বিভাগের নিয়োগ নিয়ে হার্টগ আসলে মনস্থির করতে পারছিলেন না। ১৯ অক্টোবর স্যার অলরি সুস্টার এফ আর এস কে জানালেন, কেমব্রিজে রাদারফোর্ডকে তিনি লিখেছেন, কয়েকজনের নাম প্রস্তাব করতে। ড. সাহাকে হার্টগের বেশ পছন্দ হয়েছিল। সুস্টার ও রাদারফোর্ডকেও তিনি তা জানিয়েছিলেন। সুস্টারকে লিখেছিলেন- “The most promising candidate was Saha but we were all of opinion that inspite of brilliant abilities he had not the experience necessary to take charge of a Department.”

হার্টগের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে রাদারফোর্ড গ্লাসনের নাম প্রস্তাব করেন। ১০ নবেম্বর হার্টগ রাদারফোর্ডকে জানালেন, গ্লাসনের সাক্ষাতকার নেয়া হয়েছে এবং নির্বাচকম-লী তাঁকে পছন্দও করেছে। কিন্তু বিচার করতে হবে, এ ক্ষেত্রে জেনকিন্স থেকে তিনি যোগ্যতর কিনা। জেনকিন্স শেফিল্ডে ছিলেন এবং রিসার্চ স্কলারশিপ নিয়ে ক্যাভনডিশ ল্যাবরেটরিতেও ছিলেন। তা সত্ত্বেও হার্টগ জানিয়েছিলেন, এ পরিস্থিতিতে গ্লাসনকেই শক্তিশালী মনে হচ্ছে। তবে, গ্লাসন বা সাহা নন, শেষ পর্যন্ত জেনকিন্সকেই পদার্থবিদ্যা বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। 

ইতিহাস বিভাগের জন্য তখনও উপযুক্ত কাউকে পাওয়া যায়নি। হার্টগের ইচ্ছে ছিল আলিগড় থেকে এ এফ রহমানকে আনা; কিন্তু রিডার হওয়ার মতো উপযুক্ত যোগ্যতা তাঁর ছিল না। হার্টগ শিক্ষা বিভাগের পরিচালক হর্নেলকে লিখেছিলেন, ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর ও চেয়ারম্যান পদের প্রার্থী হিসেবে রহমানের দরখাস্ত তিনি দেখেছেন এবং ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে নিতে তিনি বড়ই ইচ্ছুক। কিন্তু এ পদে রহমানের নিযুক্ত তিনি ডিফেন্ড করতে পারবেন না, কারণ রহমানের কোন প্রকাশনা নেই। তবে হার্টগ যেহেতু চেয়েছিলেন সেহেতু তিনি পথও বের করেছিলেন। এফ রহমানকে এস এম হলের প্রভোস্ট ও ইতিহাস বিভাগের রিডার হিসেবে নিয়োগ করা হয়। আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিনকে হার্টগ লিখেছিলেন, রহমান যেন এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করে, কারণ “I think the post had great opportunities for him and for Dacca” হার্টগের ভবিষ্যতবাণী মিথ্যা হয়নি। এ এফ রহমান ১৯৩৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন এবং সে পদে তিনি ছিলেন ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত। তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় উপাচার্য।

আদি নিয়োগের ক্ষেত্রে দেখা যায়, শিক্ষকদের যোগ্যতার একটি মাপকাঠি ছিল নিজ বিষয়ে দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং গবেষণা। ঐ সময় বিভিন্ন পদে নিয়োগের ব্যাপারে সাম্প্রদায়িক প্রশ্নও উঠতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্টের মুসলমান সভ্যরা চাইতেন মুসলমান প্রার্থী যদি তুলনামূলকভাবে কম যোগ্যও হয় তবুও যেন পদটি তারই হয়। এখানেই শেষ নয়। আমলাতন্ত্রের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দ্বন্দ্ব গোড়া থেকেই ছিল। অধ্যাপকদের বেতনের হার ও আবাসস্থল নিয়ে ক্ষোভ ছিল। প্রধান ক্ষোভ ছিল পদমর্যাদা নিয়ে। ঢাকায় যে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স ছিল তাতে এক নম্বরে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। দু’নম্বরে ঢাকার কমিশনার। লাট-বেলাট কেউ ঢাকায় এলে, লাঞ্চ বা ডিনার খেতে হলে উপাচার্যের সঙ্গেই তা খেতেন। বলাবাহুল্য, এই ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সের জন্য কমিশনার, জজ প্রভৃতি আমলারা অসন্তুষ্ট ছিলেন। 

এ ধরনের ভাষ্যে পূর্ণ ইতিহাস তুলে ধরা অপ্রাসঙ্গিক মনে হবে। আমি শুধু বোঝাতে চেয়েছি, শিক্ষা সংকোচন যেখানে সরকারী নীতি, সেখানে পূর্ববঙ্গের জলাভূমিতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য তারা কত যতœ করেছে। প্রেসক্লাব, মিন্টো রোডের বাড়ি, পুরনো মেডিক্যাল কলেজ, পররাষ্ট্র ভবন, সিরডাপ থেকে শুরু করে পুরোটাই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের দখলে। এমনকি পুরনো হাইকোর্ট ভবনও। প্রতিষ্ঠান গড়ার জন্য তারা আমলাতন্ত্রের থেকে উচ্চবেতন ও সুবিধা দিয়েছিলেন। এর ফলও তারা পেয়েছিলেন। পদের ক্ষেত্রে বয়স বা সিনিয়রিটি কোন প্রতিবন্ধক ছিল না। এখনও তাই। সারা ভারতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। সত্যেন বোস থেকে ড. শহীদুল্লাহ কে না জড়িত ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে! বুদ্ধদেব বসু থেকে শামসুর রাহমান, ১৯৩০ সালের সশস্ত্র বিপ্লবী অনিল রায় থেকে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান কে না জড়িত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু দিয়েছে দেশ ও জাতিকে, বিনিময়ে চায়নি কিছু, নেয়নি কিছু। 

তিন.
ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ আমল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে বিরোধ শুরু হয়েছিল আমলাতন্ত্রের। সেই ১৯২৬ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয় শিক্ষার্থীদের। ঐ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে ক্রিকেট খেলার জন্য সেনাবাহিনীর মেজর কারবেরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমতি নেয়। ছাত্র ও দর্শকরা খেলা দেখছিল। একজন খেলোয়াড়ের অপটুতা নিয়ে জনতা হেসে ওঠে। এ নিয়ে ক্ষোভ, কথা কাটাকাটি এবং এক পর্যায়ে কয়েকজনকে সেনা কর্তৃক ‘চোপ শালা হট যাও’ বলার পরই হাতাহাতি শুরু হয়। যথারীতি তদন্ত ইত্যাদি শুরু হয়। উপাচার্য ল্যাংলি শ্বেতকায় বিধায় সৈন্যদের মৃদু সমর্থন করায় তার সঙ্গেও ছাত্রদের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। অনেকদিন পর্যন্ত ছাত্রদের ক্ষোভ প্রতিবাদ চলেছিল।
১৯৩০-৩৫ সালে সৈন্যদের একটি দলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় রাখা হয়েছিল। তাদের গর্হিত আচরণের কারণে ছাত্র-শিক্ষকের যৌথ প্রতিবাদ শুরু হয়। সেটিও দীর্ঘদিন চলে। আরও পরে ২০০৭ সালেও একই ঘটনা ঘটে। প্যাটার্নটি একই রকম। ঔপনিবেশিক মানসিকতা যা উপযুক্ত নয় স্বাধীন দেশের। 
দেশ মুক্তির আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অসহযোগ আন্দোলনের সময় থেকেই জড়িত হয়ে পড়ে। সেটি এমন কিছু নয়। কিন্তু ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন ও অন্যান্য আন্দোলনে ছাত্ররা অংশ নেয়া শুরু করে। বিপ্লবীদের দল শ্রীসংঘের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ইংরেজীর অনিল রায়, প্রথম ছাত্রী লীলা রায়, রেনুকা সেনগুপ্ত, শৈলেন বসু, ইতিহাসে প্রথম হওয়া হরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য প্রমুখ। তারা সবাই জেল খেটেছেন। শ্রীসংঘের সভাপতি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিচ্ছু ছাত্র অজিতনাথ ভট্টাচার্য ১৯৩০ সালে কার্জন হলের সামনে পুলিশের পিটুনিতে মারা যান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শহীদ। 

শিক্ষকদের যোগ্যতার একটি মাপকাঠি ছিল নিজ বিষয়ে দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং গবেষণা। ঐ সময় বিভিন্ন পদে নিয়োগের ব্যাপারে সাম্প্রদায়িক প্রশ্নও উঠতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্টের মুসলমান সভ্যরা চাইতেন মুসলমান প্রার্থী যদি তুলনামূলকভাবে কম যোগ্যও হয় তবুও যেন পদটি তারই হয়। গতকালের পর আজ পড়ুন চতুর্থ কিস্তি...

সেই গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদদের সংখ্যা বাড়তে থকে। পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক আমলে ১৯৫২ সালে শহীদ বরকত, তারপর ইতিহাসের ছাত্র আসাদ থেকে এ পর্যন্ত শহীদের সংখ্যা হ্রাস পায়নি। ১৯৭১ সালের কথা বাদ-ই দিলাম। ১৯৬৯ সাল থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা এসব আন্দোলনে ভূমিকা গ্রহণ করতে থাকেন। তারপর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়। রাজশাহীর অধ্যাপক ড. জোহা শহীদ হলে গণঅভ্যুত্থানের সূচনা হয়। ১৯৭১ সালে প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক শহীদ হন বা নির্যাতিত হন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গ্রেফতার শুরু হয় ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে, শেষ গ্রেফতার দেখি এ শতকে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গ্রেফতারে। 
একটি রাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের যে অবদান তা আর কারও নেই, গরিব জনসাধারণ ছাড়া। আমলাতন্ত্রের এই ঐতিহ্য নেই। তারা যে ঐতিহ্য বহন করছে ঔপনিবেশিক আমল থেকে, তা’হলো নিপীড়ন, প্রতিক্রিয়া ও অগণতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা দখল এবং দায়িত্বহীন ভোগের। রাষ্ট্রের জন্য আমলাতন্ত্রের কোন সদস্য জেল খাটেনি ও গ্রেফতারও হয়নি। সে জন্য ঢাকা [ও অন্যান্য] বিশ্ববিদ্যালয় সমাজে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। আর এ কারণেই দ্বন্দ্বের সৃষ্টি। ঔপনিবেশিক আমলে দ্বন্দ্বের সৃষ্টির কারণ আমলাতন্ত্রকে রাজনৈতিক শক্তির প্রতিভূ বা অংশ মনে করা হতো। যারা আমলাতন্ত্রে যোগ দিয়েছেন তখন তারাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করেছেন। কিন্তু আমলাতন্ত্রে আসার পর নিজেদের কর্তৃত্বের অধিকারী মনে করেছেন এবং সেই কর্তৃত্বের একমাত্র চ্যালেঞ্জ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দ্বন্দ্বটা সেখান থেকে। কিন্তু আমলাদের মধ্যে যথার্থ অর্থে যারা শিক্ষিত ছিলেন গত শতকের সেই ৫০ বা ৬০ দশকে তাদের অনেকে আমলা থেকে নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয় ও বাঙালী রাজনৈতিক নেতাদের সংলগ্ন মনে করেছেন বেশি। এখনও যে ব্যতিক্রম নেই তা বলা যাবে না।

ঢাকা ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এ দেশের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজ সৃষ্টি করেছে, এ দেশের শিক্ষা, আইন, শাসন সর্বক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই অধিকার করেছেন। এ দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি থেকে শীর্ষ আমলা সব বিশ্ববিদ্যালয়েরই, বিশেষ করে ঢাকারই। 

বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ কথাটি মনে রেখেছিলেন। ১৯৭৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বিশেষ আইন করে একে স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে একে বিশেষ মর্যাদা বা ‘স্পেশাল স্টেটাসে’ ভূষিত করার কথা ছিল তাঁর।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর, জিয়ার আমল থেকে আমলাতন্ত্রের সঙ্গে ঢাকা ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বন্দ্ব জোরালো হয়ে ওঠে, আমলাতন্ত্রের বিশেষ মর্যাদার জন্য। আজকে যারা ক্ষমতায় তারা নিশ্চয় ভুলে যাননি জিয়া থেকে খালেদা-নিজামীর আমল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কী ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং ছাত্ররাও। আজকে যারা আমলাতন্ত্রে আছেন তখন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে মৌলবাদ জঙ্গীবাদবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন ও গণতন্ত্রের জন্য লড়েছেন। এর জন্য কি ক্ষণিকের তরেও তারা গৌরব বোধ করেন না? তাদের জীবনে ঐটিইতো একমাত্র গৌরবের কাল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন কাঠামো নিয়ে শিক্ষকদের আন্দোলন বহুদিনের। পূর্ববর্তী আমলাতান্ত্রিক সরকারসমূহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা হ্রাস করার চেষ্টা করেছে। এ ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক বা আমলাতন্ত্র থেকেও খারাপ। এর মধ্যে লুকিয়ে আছে এক ধরনের হীনম্মন্যতাবোধ ও পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক সঙ্কীর্ণ দৃষ্টি। আমরা যখন তরুণ শিক্ষক তখন এ আন্দোলন আরও জোরদার হয় এবং এক সময় সরকার এ দাবির যৌক্তিকতা মেনে নেয়। সেই আন্দোলনের সময় শিক্ষক নেতা অধ্যাপক সা’দউদ্দীনের সঙ্গে কেবিনেট সচিবের বৈঠক হয় বলে শুনেছি। সচিব পৃষ্ঠপোষকতার সুরে বললেন, ‘আপনাদের বেতন বাড়াবার যৌক্তিকতা কী?’ অধ্যাপক সা’দউদ্দীন নাকি উত্তর দিয়েছিলেন, আপনাদের বেতনে বরকত আছে। আমরা কাছাকাছি বেতনে হলেও ঢাকা শহরে আপনার বাড়ি আছে, ছেলেরা বিদেশে পড়ে, আমার বেতনে তেমন বরকত নেই। মেয়েরা এখানে পড়ে, বাড়িও নেই গাড়িও নেই। সপ্তম বেতন কমিশনে ঠিক হয়, সর্বোচ্চ স্কেলটি পাবেন সবধরনের সচিব ও অধ্যাপকবৃন্দ। এখানে একটি ফাঁক রাখা হয় যা শিক্ষকদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল বা ততটা মনোযোগী ছিলেন না তারা এ ক্ষেত্রে। অধ্যাপকদের বেতন অতিরিক্ত সচিবের কোঠায় রেখে, ২৫% ভাগ সিনিয়র অধ্যাপকদের সিলেকশন গ্রেড দিয়ে এক নম্বরে রাখা হয়েছিল। এর কারণ ছিল, অধ্যাপকরা যেন সচিবের সমমর্যাদা না পান। যেসব ভাতা দেয়া হয়েছিল সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের তা দেয়া হয়নি শিক্ষকদের, বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা ছাড়া। পরে, শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয় ফান্ড থেকে বই বা অন্যান্য ক্ষেত্রে সামান্য ভাতার ব্যবস্থা করেন। 

সপ্তম থেকে অষ্টম পে-স্কেলের মাঝে আরও কিছু ঘটনা ঘটে যা শিক্ষকরা নজরে আনেননি। কারণ, সামষ্টিকভাবে তারা সুযোগ-সুবিধা সেভাবে আদায় করে নিতে অভ্যস্ত নন। হঠাৎ দেখা গেল, তিন বাহিনী প্রধান, কেবিনেট ও প্রধানমন্ত্রীর প্রধান সচিবকে স্কেলের বাইরে নিয়ে আসা হয়। এতে অধ্যাপকরা দুই নম্বরে চলে যান (আদতে ৩ নম্বরে)। বর্তমান সরকারের আমলে আমলাদের তুষ্ট করার জন্য সিনিয়র সচিব পদ সৃষ্টি করা হয়। তাদেরও নিয়ে আসা হয় নিয়মিত স্কেলের বাইরে। অধ্যাপকরা চলে যান ৩ নম্বরে (আদতে চার নম্বরে)। অষ্টম বেতন কমিশনের এবং পরবর্তীকালে সচিব কমিটির সুপারিশে সচিবদেরও নিয়ে আসা হয় নিয়মিত স্কেলের বাইরে। আমরা চলে আসছি এখন ৪ নম্বরে (আদতে ৫ নম্বরে)। পত্রিকার প্রতিবেদনে দেখেছি, সচিব কমিটি আরেকটি পদ [পদায়িত সচিব] স্কেলের বাইরে নিয়ে আসতে চান। তা যদি হয়, তাহলে আমরা চলে আসব ৫ নম্বরে (আদতে ৬ নম্বরে)। প্রতারণাটা হলো বলা হয়েছে, বেতন স্কেলের শীর্ষে থাকবেন অধ্যাপকরা। অর্থাৎ অধস্তন বেতন স্কেলের শীর্ষে। আসলে পে-স্কেল এখন দুটি- উর্ধতন ও অধস্তন। 

হার্টগের ইচ্ছে ছিল আলিগড় থেকে এ এফ রহমানকে আনা। কিন্তু রিডার হওয়ার মতো উপযুক্ত যোগ্যতা তাঁর ছিল না। তারপরও হার্টগ শিক্ষা বিভাগের পরিচালক হর্নেলকে লিখেছিলেন, ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর ও চেয়ারম্যান পদের প্রার্থী হিসেবে এ এফ রহমানের দরখাস্ত তিনি দেখেছেন এবং তিনি ব্যক্তিগতভাবে তাঁকেই নিতে ইচ্ছুক। গতকালের পর আজ পড়ুন পঞ্চম কিস্তি...

কমিশন ভূমিকায় উল্লেখ করেছে- ‘একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রের সরকারী চাকুরেগণের মধ্যে শ্রেণী বিভাজন মোটেও কাম্য নয়। তাই এর বিলুপ্তিকরণ সুপারিশ করা হয়েছে। এখন থেকে একজন সরকারী চাকুরের গ্রেড বা স্কেল দ্বারা তাঁর আপেক্ষিক অবস্থান জানা যাবে।’ যৌক্তিক অবস্থান। তা’হলে আমি এখন ১ থেকে ৫ (বা ৬ চলে আসব)? হবুচন্দ্র রাজার দেশে আছি বোধহয়। ১ থেকে আমি উপরে উঠতে না পারি, ৫/৬-এ আমাকে নামানো হবে এটি কোন্ ধরনের যৌক্তিকতা বা ন্যায়বিচার? বিবেকবান প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ প্রশ্ন রইল। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব খ-কালীন শিক্ষক ছিলেন এই কমিশনে তাদেরও এ প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। 

মূল বেতন নিয়ে আলোচনা করেছি। ভাতা নিয়ে নয়। আমরা সিভিল অফিসারদের ভাতার বিষয় জানি, সেনাবাহিনীর নয়। কারণ, তাদের সব তথ্যই গোপন তথ্য বলে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সিভিল আমলাতন্ত্র কী ভাতা পান সেটিও জানা দরকার। বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা সবাই কমবেশি পায়, আমরাও পাই। এ নিয়ে আলোচনার কিছু নেই। কিন্তু-
১. সরকারি উর্ধতন কর্মকর্তারা [বর্তমানে ১-৩] সার্বক্ষণিক গাড়ি পান। বিকল্প আরেকটি ব্যবস্থা আছে। গাড়ি কেনার জন্য তিনি ২৫ লাখ টাকা সুদবিহীন ঋণ পেতে পারেন। এর সঙ্গে মাসে পাবেন গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ ও অন্যান্য খরচের জন্য ৪৫,০০০ টাকা।
২. শিক্ষা সহায়তা ভাতা তাদের বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। এক সন্তানের জন্য ১,০০০, একাধিকের জন্য ২,০০০ টাকা।
৩. ভৃত্যভাতা মাসিক ৩,০০০ টাকা পেতেন, পাবেন। 
৪. আপ্যায়ন ভাতা সর্বোচ্চ ৩,০০০ টাকা, সর্বনিম্ন ১,৫০০ টাকা প্রতি মাসে। 
৫. আবাসিক টেলিফোন।
৬. পার্বত্য অঞ্চলে বদলি হলে অতিরিক্ত ভাতা মাসে ৫,০০০ টাকা।
৭. অষ্টম গ্রেডে বা চাকরিতে ঢোকাকালীন স্থিতি ভাতা ১০,০০০ টাকা।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা এর কোন সুবিধাই পান না। দাবিও করেননি কখনও। এটা ঠিক সরকার পক্ষ থেকে বলা হতে পরে, স্বইচ্ছায় আপনি শিক্ষক হয়েছেন, না পোষালে চলে যান। এই কথা তা’হলে সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে হবে। 

ড. ফরাসউদ্দিন ও তার সহকর্মীরা সেনাবাহিনীর বেতন ভাতা নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেননি। হতে পারে, তারা সরকারের বাইরে। বা তারা জানেন কাদের সম্পর্কে বলতে হয়, কাদের সম্পর্কে নিশ্চুপ থাকতে হয়। কাদের তোষামোদ করতে হয়, কাদের দলন বা অপমান করতে হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মকসুদ কামাল ‘দৈনিক প্রথম আলো’য় এক প্রবন্ধে বাংলাদেশসহ পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের অধ্যাপকদের বেতনের তুলনামূলক বিচার করেছেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে সব দেশেই শিক্ষকদের বেতন বেশি। আমি সে প্রসঙ্গে যাব না। আমাদের দেশের সম্পদের তুলনায়ই আমরা বিচার করব। তিনি মর্যাদার কথাও তুলেছেন। তার প্রবন্ধ পড়লে পাঠকরা সমিতির যুক্তিগুলো অনুধাবনের সুযোগ পাবেন। আমি তার পুনরাবৃত্তি করছি না।

অষ্টম পে স্কেলের বিজ্ঞজনরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পর্কে তাদের মূল্যবান একটি বক্তব্য রেখেছেন। তাদের মতে ‘সরকারী মঞ্জুরিপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে কর্মরত শিক্ষকগণ সরকারী বেতন কাঠামোর অনুরূপ বেতন-ভাতাদি পেয়ে থাকেন [বক্তব্য সঠিক নয়]। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ একটি দায়িত্বপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত থেকে শিক্ষার্থীগণকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলেন। তাঁদের এ বিশেষায়িত পেশার কারণে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ উচ্চতর বেতন স্কেল সম্বলিত স্বতন্ত্র বেতন-কাঠামো প্রত্যাশা করেন। কিন্তু সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী নয়, বরং সম্পূর্ণভাবে সরকারী মঞ্জুরির ওপর নির্ভরশীল। তাই কমিশন মনে করে যে, সরকারী অনুদানের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আর্থিকভাবে সম্পূর্ণ স্বাবলম্বী না হওয়া পর্যন্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের জন্য উচ্চতর স্কেলের আলাদা বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা সমীচীন হবে না।’ [পৃ. ১৩৯]

সেনাবাহিনী ও সরকারী কর্মচারীদের জন্য এটি প্রযোজ্য হবে না? কেন? সেনাবাহিনী, সরকারী আমলারা যদি একটি প্রতিষ্ঠান হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ও একটি প্রতিষ্ঠান। সেনাবাহিনী ও সরকারী আমলারা উৎপাদনমুখী কোন কর্মের সঙ্গে যুক্ত নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত। তাদের যে আয় বিশেষ করে সেনাবাহিনীর যে ব্যবসা ও আয় তা দিয়েই তো তাদের বেতন দেয়া যেতে পারে। সরকারের বেতনের দরকার কী? সরকারী কর্মচারীদের এত বেতন-ভাতা দিতে হবে কেন, তাদের তো নিজস্ব কোন আয় নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে জমি ছিল তা সরকার কেড়ে নিয়েছে, ব্যবসাপাতির সুযোগ নেই। থাকলে এ প্রশ্ন উঠত না। কেন ড. ফরাসউদ্দিনের মনে হলো না সেনাবাহিনী ও সরকারী কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও এ মন্তব্য প্রযোজ্য হতে পারে?

এর কারণ হচ্ছে, তারা শিক্ষাকে এখন সম্পূর্ণ পণ্য হিসেবে বিবেচনা করছেন; কিন্তু যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন তখন শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে বিবেচনা করেননি। তবে তারা মনে করেনÑ ‘তবে দেশ ও জাতির অগ্রবর্তী চলার পথে বিশেষ ও নিরন্তর অবদানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটকে বিশেষ মর্যাদা দানের বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে’। তাদের করুণার জন্য ধন্যবাদ। তারা কি মনে করেন সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র ‘দেশ ও জাতির অগ্রবর্তী চলার পথে বিশেষ ও নিরন্তর অবদান রাখছে?’ এ মন্তব্য তারা করেননি, কারণ তারা যথেষ্ট জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান, জানেন যে এ ধরনের মন্তব্য হাস্যকর মন্তব্য বলে বিবেচিত হবে। তাই যদি হয়, যারা দেশের জন্য নিরন্তর অবদান রাখছেন, কোন্্ লজিকে যারা রাখছেন না, তাদের চেয়ে কম মর্যাদা ও বেতন পেতে হবে?

॥ চার ॥

ড. ফরাসউদ্দিন ও তার কমিশন সদস্যরা যে সুপারিশ করেছেন তার একটি ভিত্তি আছে। তারা কে কোন্ পেশায় ছিলেন সে বিশ্লেষণে আমি যাব না। কিন্তু মনোভঙ্গিটি এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় [অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়] সম্পর্কে নিরন্তর কুৎসা প্রচারণায়। এসব কুৎসা-অভিযোগ-প্রচারণা এলিট ও আমলাতন্ত্রের। সেগুলো কী?
১. বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা ক্লাস নেন না।
২. তারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান ও কনসালটেন্সি করেন।
৩. তারা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
৪. ছাত্ররা রাজনীতি করে, অপকর্ম করে বেড়ায়, তারা শিক্ষিত না।
৫. শিক্ষকরা দ্রুত প্রমোশন পান।
৬. যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ পান না।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা ক্লাস নেন না, তো কী করেন? ভেরেন্ডা ভাজেন। ক্লাস না নিলে পরীক্ষা হয় কিভাবে, ক্লাস না হলে ছাত্ররা পরীক্ষা দেয় কিভাবে, নিয়মিত ফল প্রকাশিত হয় কিভাবে? আমলাতন্ত্রে যারা আছেন, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস না করে পরীক্ষা না দিয়ে সার্টিফিকেট পেয়েছেন?
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮০০ শিক্ষকের মধ্যে কয়জন পড়ান? বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কয়টি বিভাগ আছে এবং কী কী? বাণিজ্যহীন বিভাগ তারা রেখেছেন? প্রাইভেটে বাণিজ্য সংক্রান্ত বিভাগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক পড়ান। তার হার কি ১%-এর বেশি হবে? তারা কি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস না করে সেখানে পড়ান? বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকরা যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়/মঞ্জুরি কমিশনের কোন নির্দেশ মানে না সেজন্য কি প্রবল প্রতাপান্বিত মন্ত্রী ও আমলারা ব্যবস্থা নিতে পেরেছেন? আমলাদের কত পার্সেন্ট প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত? কনসালটেন্সি আমলারা বেশি করেন না শিক্ষকরা? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ১৮০০ শিক্ষক কি কনসালটেন্সি করেন? করার সুযোগ আছে?

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮০০ শিক্ষকের মধ্যে কতজন পড়ান। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়টি বিভাগ আছে। যারা পড়ান তারা সংখ্যায় ১%-এর বেশি হবে কী? তারা কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস না করে সেখানে পড়ান। আজ পড়ুন শেষ কিস্তি...

শিক্ষকরা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, সেটিই স্বাভাবিক। পৃথিবীর সব বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। যুক্ত না থাকাটাই অস্বাভাবিক। কারণ, এটি বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু আমলারা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়- এ কথা শুনলে পাগলও হাসবে। পত্র-পত্রিকায় খবরাখবর কি প্রকাশিত হয় না বিএনপি আমলে, আওয়ামী লীগ ভাবাপন্ন আমলাদের কী ব্যবস্থা করেছিল বিএনপির আমলারা [তখন আওয়ামীপন্থী আমলারা শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন] ? আওয়ামী লীগ আমলে বিএনপি-জামায়াত আমলাদের অবস্থা এখন কী? কেবিনেট থেকে সিনিয়র সচিবরা কি বিএনপি-জামায়াতপন্থী?

ছাত্ররা রাজনীতি করবে, সেটিই স্বাভাবিক। তারাই তো দেশ সৃষ্টি করেছে, গণতন্ত্র এনেছে। আমার এক বন্ধু তার ও তার জেনারেশনের বন্ধুদের সন্তানদের ইংরেজী মিডিয়ামে পড়ানো নিয়ে ঠাট্টা করে বলেছেন, এরা ফার্মের মুরগি। প্রশ্ন- বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কি আমলা/এলিটদের সন্তানদের মতো ইংরেজী মিডিয়াম স্কুলে পড়ে ফার্মের মুরগি হবে? 


স্বৈরশাসকরা [এবং এক সময় প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দীন, যিনি আমলা ছিলেন] বলতেন, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। কারণ, ছাত্ররা রাষ্ট্রে এ ধরনের অবাঞ্ছিত কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে। তারা তাই ছাত্রদের হুমকি মনে করেন। ছাত্রদের একাংশ অপকর্ম করতে পারে। সেটি আমলাতন্ত্রের একাংশও করে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস না করে কেউ সরকারী চাকরি পায় না। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররা অশিক্ষিত হলে আমলারাও স্বাভাবিকভাবে অশিক্ষিত।

বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান ও প্রমোশন বিষয়ে একটি পদ্ধতি আছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলেই দেখা যায় ২৭ বছর বয়সে প্রফেসর ও চেয়ারম্যান করার। বিশ্ববিদ্যালয়ে বয়স বা সিনিয়রিটি যোগ্যতার মাপকাঠি নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষকের পরীক্ষার ফল ভালো। বিশেষ করে গত এক দশকে চারটি ফার্স্ট ছাড়া কেউ নিয়োগ পেয়েছে বলে মনে হয় না। সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রে ফলাফল বিষয় নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন প্রথম শ্রেণী ছাড়া কেউ নিয়োগ পান না। পিএইচডি করতে গেলেও ন্যূনতম নাম্বার লাগে বা এম.ফিল ডিগ্রি থাকতে হয়।

প্রমোশনের ক্ষেত্রে অনেক শর্ত আছে যেটি আমলাতন্ত্রে নেই। এবং প্রতিটি প্রমোশনের অর্থ নতুনভাবে নিয়োগ পাওয়া। শুধু ১২ বছর হলেই অধ্যাপক হওয়া যায় না। সঙ্গে আরও অনেক কিছুর দরকার হয়। আমার অধ্যাপক হতে প্রায় ২০ বছর লেগেছে।

আমি কতগুলো অপপ্রচারের উত্তর দিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়কে ডিফেন্ড করার কোন দরকার নেই। কিন্তু কোন বেসামরিক কর্মকর্তা বা সামরিক কর্মকর্তা নিজেদের কোন সমালোচনা করবেন না। কিন্তু আমি সব সময় নিজেদের সমালোচনা করেছি, এখনও করব।

বঙ্গবন্ধু আমাদের যে উপহার দিয়েছিলেন ‘১৯৭৩ সালের আইন’- তার অনেক অপব্যবহার আমরা করেছি। এই আইন সময়োপযোগী করা উচিত। জনপ্রতিনিধিরা তা করতে পারেন এবং এতে আমাদের স্বায়ত্তশাসন বিঘিœত না হলে, আমাদের প্রতিবাদ করা বিধেয় নয়। যেমন, সর্বক্ষেত্রে নির্বাচন হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। প্রমোশনের ক্ষেত্রে শৈথিল্য প্রদর্শন কাম্য নয়। শিক্ষকদের দায়-দায়িত্বের ব্যাপারেও শৈথিল্য গ্রহণযোগ্য নয়।

রমেশ চন্দ্র মজুমদার যখন উপাচার্য তখন মুসলমান সম্প্রদায় থেকে কথা উঠেছিল, মুসলমানদের জন্য প্রধানত বিশ্ববিদ্যালয়টি হয়েছে সেজন্য তাদেরই বেশি সুযোগ পাওয়া উচিত। রমেশ চন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যেসব মুসলমান নেতা যুক্ত ছিলেন তাদের সঙ্গে আলাপ করেন। তিনি বলেছিলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের উৎকর্ষ নির্ভর করে তার শিক্ষকম-লীর ওপরে। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানত মুসলমান ছাত্রদের কল্যাণের জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং যোগ্য শিক্ষক যদি নিযুক্ত না হয় তাহলে মুসলমান ছাত্রদের পক্ষেই তা পরিণামে অনিষ্টের কারণ হবে। এর উত্তরে তারা যা বলতেন সেটিও খুবই বিচার বিবেচনা করে দেখার মতো। তাদের মতে প্রধান প্রধান অধ্যাপক (চৎড়ভবংংড়ৎ, জবধফবৎ) নিয়োগের বেলায় সাম্প্রদায়িক কোন প্রশ্নই তোলা উচিত নয়। গুণানুসারে যাতে যোগ্যতম ব্যক্তিই নিযুক্ত হন তা তারা সম্পূর্ণ অনুমোদন করেন। কিন্তু অন্যান্য শিক্ষক এবং কর্মচারীর বেলায় কতকাংশে নিকৃষ্ট হলেও তারা একমাত্র মুসলমানকেই নিযুক্ত করতে চান।

তার কারণ এই যে, বাংলাদেশে, বিশেষত পূর্ববঙ্গে, মুসলমানদের অবনতির একটি প্রধান কারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের অভাব। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী সৃষ্টি করতে হলে শিক্ষক দিয়েই তা আরম্ভ করতে হবে।”

বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে এ যুক্তি অসার মনে হলেও মূল বিষয়টি কিন্তু যুক্তিযুক্ত। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষ নির্ভর করে শিক্ষকদের ওপর এবং প্রধান প্রধান পদে গুণানুসারে যোগ্যতম ব্যক্তিকেই নিয়োগ প্রদান বাঞ্ছনীয়। এখানে বর্ণ, ভাষা, ধর্ম, দল, গোষ্ঠী যাতে কোন বাধা না হয়ে দাঁড়ায়। আদি প্রতিষ্ঠাতারা এটি মনে রেখেছিলেন, যে কারণে অচিরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল যা এখনও আমরা ভোগ করছি। উত্তরসূরিদের জন্য এবং যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় সম্পূর্ণভাবে সমাজের টাকায় চলে, সেহেতু উচ্চতর পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব রূঢ় সমালোচনা হচ্ছে সেগুলো দেশের, আমাদের সবার স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিবেচনা করে দেখা উচিত।

আমলাতন্ত্রের অবস্থা কি এর চেয়ে উত্তম? সামান্য একটি খসড়া তৈরিতে তাদের লাগে কয়েকদিন। একজন আরেকজনের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়। সেকশন অফিসারের নোটই মূল। এ কারণে পাঁচ স্তর বিশিষ্ট পিরামিড অপ্রয়োজনীয়। তিন স্তরই যথেষ্ট। আর আমলাতন্ত্রে প্রতিটি প্রমোশন নতুন নিয়োগ নয়। আমার/আমাদের পুরনো ছাত্র যারা সচিব, এখনও পড়াশোনা করেন, দীন-দুনিয়ার খবর রাখেন, তারা বলেছেন, ক্রমেই অদক্ষ হয়ে যাচ্ছে আমলাতন্ত্র, যে কারণে সরকার বিপাকে পড়ছে ও সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে।

আমলাতন্ত্র বনাম শিক্ষক- এই বিতর্কে আমি ইচ্ছুক নই। কিন্তু বেতন কমিশন ও সচিব কমিটির দৃষ্টিভঙ্গি একপেশে ও উদ্ধত মনে হওয়ায় এত কথা লিখতে হলো। রাষ্ট্রের এসব প্রতিষ্ঠানই দরকার। কিন্তু কেউ কারও ওপরে নয়, বড়ও নয়- এ দৃষ্টিভঙ্গিই যথাযথ।

বেতন কমিশন বা সচিব কমিটির সুপারিশ নীতিনির্ধারকরা পুরোপুরি মানবেন কি মানবেন না তা জানি না। কিন্তু, এতটুকু বুঝি বা জানি, সচিব কমিটির ডিকটাট পুরোপুরি মানলে যে দ্বন্দ্ব ও ক্ষতের সৃষ্টি হবে তা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যাঁর ওপর সবার গভীর আস্থা, তিনিও দূর করতে পারবেন না। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষকদের একটিই ক্ষোভ, শেখ হাসিনার মতো মানুষ আমলাতন্ত্রের ডিকটাটে চলবেন কেন? তাঁর মন্ত্রীরা চলেন, তাই বলে তিনিও? তা’হলে, ভরসা রাখব কার ওপর?

বা-
আমরা জানি, সরকার নির্ভরশীল সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের ওপর। কিন্তু, তার বিপদে এরা তো পাশে থাকেনি, থেকেছি আমরা। তা’হলে?
বা-
আমাদের পেটে লাথি মারুন ঠিক আছে। কিন্তু অপমান করার অধিকার কাউকে দেয়া হয়নি।
আমি বিষয়টি অন্যভাবে দেখি। সারা জীবনে আমি যা করি অন্তিমে তার মূল্যায়ন করে সমাজ ও সময়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যা অর্জন তা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরাই অর্জন এনে দিয়েছেন, অন্য কেউ নয়।

সেই শুরুতে সত্যেন বোস, জ্ঞান ঘোষের মতো বিজ্ঞানীরা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ্্, মোহিতলাল মজুমদার বা জসীমউদ্দীনের মতো কবিরা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। রমেশ চন্দ্র মজুমদারের মতো ঐতিহাসিক ছিলেন শিক্ষক ও উপাচার্য। বুদ্ধদেব বসুর মতো কবি, অমলেন্দু বসুর মতো প্রাবন্ধিক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। পাকিস্তান ঔপনিবেশিক আমলে শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বা হাসান হাফিজুর রহমানের মতো জ্যোতিষ্করা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মুনীর চৌধুরী, কবীর চৌধুরী, কাজী মোতাহার হোসেন বা আবদুর রাজ্জাক ছিলেন শিক্ষক। অগ্নিযুগের লীলা রায়, বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, রাষ্ট্র গঠনে নেতৃত্বদানকারী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ বা আরও পরে জিল্লুর রহমান এবং সর্বশেষ শেখ হাসিনা সবাইই তো ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

আমাদের ভুলোমনা রাজনৈতিক প্রভুদের একটি বিষয় মনে আছে কিনা জানি না। না থাকারই কথা কারণ, এটি তাদের জন্য সুখপ্রদ নয়, এমনকি সেই সময় নির্যাতিত শেখ হাসিনাও অনেক বিষয় জানেন না। যখন তিন-উদ্দিনের অত্যাচার-নিপীড়নে বাংলাদেশ জর্জরিত, যখন সামরিক-বেসামরিক আমলারা রাজনীতিবিদদের বাপান্ত করছে, যখন মিডিয়ার শক্তিশালী অংশ অরাজনৈতিক শাসনের পক্ষে জনমত গড়ছে, যখন শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া বন্দী, যখন আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকে জেলে পুরে অত্যাচার করা হচ্ছে, তখন আজকে যারা মন্ত্রী ও উপদেষ্টা তাদের একটি বড় অংশ নিষ্ক্রিয় ছিলেন বা বিদেশে ছিলেন। অনেকে সামান্য সময় শেখ হাসিনাকে লিপ সার্ভিস দিচ্ছিলেন। তখন বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ছাত্র-শিক্ষকরা একমাত্র রুখে দাঁড়িয়েছিল গণতন্ত্র রক্ষায়। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নেতৃত্ব দিয়েছিল। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা মার খেয়ে অপরাজেয় বাংলার নিচে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল। সংসদীয় কমিটি এ কারণে যাদের শাস্তি ও যাদের সহায়তা করতে সুপারিশ করেছিল বর্তমান সরকার সামরিক আমলাতন্ত্রের ভয়ে সেসব সুপারিশ কার্যকর করেনি। যখন ইউনিফর্ম পরা শ্বাপদরা ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তুলে নিয়ে তুমুল অত্যাচার চালাচ্ছিল তখন বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা বাংলাদেশ রক্ষায় নেমে এসেছিলেন। এরপর এসেছিলেন রাজনীতিবিদরা। যারা অত্যাচারিত হয়েছিলেন তারা কোন কিছু চাননি। যারা অত্যাচার করেছেন তারাই পেয়েছেন। তাতে কারও ক্ষোভ নেই। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ দেয়, নেয় না। রাজনীতিবিদ ও আমলারা নেয়, দেয় না। পারতপক্ষে বাধ্য না হলে। বার বার অপমানিত হলে দ্রোহের সে ঐতিহ্য আর বহন করবে কিনা বিশ্ববিদ্যালয় সন্দেহ।

বার বার অপমানিত ও উপেক্ষিত হওয়ার পর একটি কথাই বলব, অন্তিমে জয় আমাদেরই। খালেদা যখন নিজামীদের ক্ষমতায় নিলেন তখন অনেকে ক্ষোভে-দুঃখে ভেঙ্গে পড়েছিলেন। লিখেছিলাম তখন, একজন মুক্তিযোদ্ধা গরিবের সন্তান সব সময় মাথা উঁচু করে বলতে পারবে আমি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। কোটিপতি রাজাকারের সন্তান কখনও মাথা উঁচু করে বলতে পারবে না আমি রাজাকারের সন্তান। আজ যারা আমলা হিসেবে সুবিধা নিয়ে অন্যদের অপমান করছেন, তাদের সন্তানরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলে গর্বিত হয়ে বলবে, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তার বাবার পদমর্যাদা তখন তার কাছে মুখ্য নয় এবং পরবর্তী জীবনে সে যে পেশায়ই থাকুক, তার বড় পাসপোর্ট হয়, সে ঢাকা [বা অন্য কোন] বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সমাজ এ সম্মান সব সময় দিয়ে এসেছে। এখনও দেয়। কারণ, বাংলার কৃষকের রক্তে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে যে দ্রোহ বহমান তা বহন করছে উত্তরসূরি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যার প্রতিভূ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালের পর আমলাতন্ত্র ও তাদের সহযোগী কুলাঙ্গার রাজনীতিবিদরা কি বঙ্গবন্ধুর চরিত্র হনন করেননি? কিন্তু তাতে তাঁর কী এসে গেছে? তিনি স্বমহিমায় উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছেন। অভিযোগকারীরা আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপিত হচ্ছে।

আমরা তাঁর উত্তরসূরি, সেই দ্রোহে আচ্ছন্ন ছিলাম দেখে সপ্তম বেতন স্কেল অর্জন করতে পেরেছিলাম। আমরা আজ চলে যাচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয় অনেক বদলেছে, শিক্ষক-ছাত্ররা বদলেছেন। তারা কী করবেন তা জানি না। কেননা তাদের আমার বেশি পদ-মনস্ক মনে হয়েছে। হয়ত এটি এক বৃদ্ধের ভুল। কিন্তু, অভিজ্ঞতা বলে, অষ্টম পে-স্কেল মেনে নিলে নবীন শিক্ষকদের ভবিষ্যত অন্ধকার হয়ে যাবে আইয়ুব আমলের মতো। সবশেষে বলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কখনও কাপুরুষ সৃষ্টি করেনি। নবীনদের বলব, যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য বিনষ্ট না হয়, যেন তারা কাপুরুষ না হোন, কাপুরুষ তৈরি না করেন।

Published in:

1. http://www.dailyjanakantha.com/details/article/139186/
2. http://www.dailyjanakantha.com/details/article/139430/
3. http://www.dailyjanakantha.com/details/article/139618/
4. http://www.dailyjanakantha.com/details/article/139782/
5. http://www.dailyjanakantha.com/details/article/139989/
6. http://www.dailyjanakantha.com/details/article/140185/

আরো পড়ুনঃ
নিরস্ত্র বলেই কি অপমানিত হতে হবে? (দুই কিস্তি একত্রে)-মুনতাসীর মামুন
"স্বতন্ত্র স্কেল চাই, অন্য কোন দাবি নাই!!"

0 comments:

Post a Comment