ড. আবদুল্লাহ ইকবাল
শিক্ষকতা কেন করি, পেশা হিসেবে কেমন, কেমন লাগছে শিক্ষকতা? সব স্তরের শিক্ষকদের কাছেই এগুলো অনেক সহজ অথচ অতিপরিচিত কিছু প্রশ্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেলায়ও এমন প্রশ্ন অবধারিত। কারণ হিসেবে বলা যায় প্রশ্নকর্তাদের 'কৌতূহল'! এই প্রশ্নগুলোর উত্তর এত দিন আমার কাছে ছিল একরকম। আজ বদলাতে শুরু করেছে। হয়তো পাল্টে যাবে আরো অনেকের, অনেক দ্রুতগতিতে। এখন আর বলতে ইচ্ছা হয় না 'শিক্ষকতা এক মহান ব্রত...' বা এমন অনেক কিছু। একসময় সেই উত্তরগুলোতে থাকত শুধুই সন্তুষ্টি ও আত্মতৃপ্তি। অথচ এখন নির্মম বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে শিক্ষকতা অতি অবহেলিত এক পেশা! যে পেশায় নেই কোনো সম্মান, সামাজিক অবস্থান, নিরাপত্তা, এমনকি আর্থিক সচ্ছলতাও!
আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন শেষ করে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডরে আমার একজন সম্মানিত শিক্ষক অতি সুন্দর ভাষায় আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন শিক্ষকতা ভালো লাগছে নিশ্চয়ই, শিক্ষকতায় আসতে পেরে খুশি হয়েছ নিশ্চয়ই, ইত্যাদি কিছু অতি আন্তরিক ও অভিভাবকসুলভ প্রশ্ন। সেদিন স্যারের প্রশ্নগুলোর উত্তরে শুধুই মাথা নেড়ে, জি স্যার বলে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে তাঁর কাছে দোয়া চেয়েছিলাম। স্যার শেষের দিকে একটি কথা বলেছিলেন, 'আশপাশে অনেক চাকচিক্যময় জীবন, আরাম-আয়েশি বন্ধুবান্ধবের জীবন কিংবা অর্থ-ক্ষমতাসম্পন্ন পরিচিত মানুষদের দেখলে আক্ষেপ থাকবে না তো?' সেটিরও উত্তরে বলেছিলাম-না স্যার, শিক্ষক হতে পেরেছি, এতেই সন্তুষ্টি। সবাই তো আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারে না। দোয়া করবেন স্যার যেন ভালো শিক্ষক হতে পারি। এভাবেই সেদিন বাসায় ফিরে এসে স্যারের কথাগুলোর তাৎপর্য বুঝতে চেষ্টা করি। নিজের ভেতরে আত্মতৃপ্তি পেয়েছিলাম এই ভেবে, 'বিত্তের মাঝে কি আর চিত্তের সুখ পাওয়া যায়?' প্রায় এক যুগের শিক্ষকতা জীবনে ক্ষণিকের জন্যও চাওয়া-পাওয়া নিয়ে অতৃপ্তি আসেনি। কিন্তু হতাশ হয়েছি যখন নতুন বেতন কাঠামো মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেল। বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এটি প্রচারিত হয়েছে, দেশবাসী ভালোভাবেই জেনে গেছে। এখন মনে হচ্ছে নতুন করে ভাবতে হবে শিক্ষকতা করব কি করব না! এমন ভাবনা নিশ্চয়ই আমার মতো অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের। না করেই বা কী করবেন? রাষ্ট্র যখন নিজেই নির্মমতা দেখায় তখন বিকল্প চিন্তা না করে এই ক্ষুদ্র ও ক্ষমতাহীন, অসহায় শিক্ষকদের কি কিছু করার আছে?
পাঠকদের অনেকেই হয়তো ধরে নিয়েছেন টাকার জন্য শিক্ষকতা ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছি! না, মোটেও তেমনটি না। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে এক যুগ চাকরি করে যে টাকা বেতন-ভাতা পাচ্ছি, আমার অনেক ছাত্রই দু-তিন বছর চাকরি করে, কেউ কেউ শুরুতেই তার চেয়ে অনেক বেশি বেতন পাচ্ছে, গাড়িতে করে বেড়াচ্ছে। এতে মোটেও কষ্ট নেই। ছাত্রছাত্রীরা ভালো আছে জানলেই শিক্ষকতার সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায়। তবে কষ্টটা হচ্ছে মানসিক। সারা জীবন ভালো ফল করে শিক্ষার প্রতিটি স্তরে মেধার স্বাক্ষর রেখে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম। অথচ আজ কিনা সামাজিক মর্যাদাটুকু ধরে রাখার জন্য দল বেঁধে আন্দোলন করতে হচ্ছে দিনের পর দিন! এর চেয়ে অবমাননাকর কিছু আছে? রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে যখন এই পেশার নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ দেখি, শুনি তখন নির্বাক হয়ে পড়ি। এই কি তবে 'সম্মানিত পেশার' প্রাপ্তি?
একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক অবসরে যান ৬৫ বছর বয়সে। অন্যদিকে একজন সচিব বা আমলা (সিনিয়র সচিব, পদায়িত সচিব বা অন্যান্য নামে) অবসরে যান ৫৯ বছর বয়সে। সেদিক থেকে লক্ষ করলে দেখা যাবে, ওই আমলাদের সবাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র অধ্যাপকদের সরাসরি ছাত্রছাত্রী। তাঁদের শিক্ষাজীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ৫ শতাংশ জাঁদরেল আমলারও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা নেই! অথচ তাঁদেরই পদমর্যাদা দেওয়া হয়েছে সিনিয়র অধ্যাপকদের অনেক ওপরে! এর পরও কি সরকার নিজেদের শিক্ষাবান্ধব বলে গর্ব বোধ করতে চাইবে? নাকি তারা কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার হতে যাচ্ছে তা একটু ভেবে দেখতে চেষ্টা করবে? সরকার কি এখনো অনুধাবন করতে পারছে না যে এতে মেধাবীরা ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় আসবে না। কর্মরতদেরও সবাই কি থাকবেন? আত্মসম্মান নিয়ে যে পেশায় টিকে থাকা যাবে না, সেখানে থাকার যৌক্তিকতা খুঁজতে গেলে কি খুব বেশি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে? সরকার কি আমলাদের এই ষড়যন্ত্র বুঝতে চাইবে না বা বুঝতে পারছে না? নাকি ভাবছে শিক্ষকদের ক্ষমতা নেই, আমলাদের ক্ষমতা আছে। কেউ যদি ভবিষ্যদ্বাণী করে যে এই বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের ফলে আগামী ৪০ বছর পর দেশ মেধাশূন্য হয়ে যাবে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হবে আজকের সরকারি পাটকলগুলোর মতো-অবকাঠামো থাকবে, জনবল থাকবে, শুধু থাকবে না জ্ঞানচর্চার মতো কোনো যোগ্য উপাদান-তাহলে কি ভুল হবে?
যা-ই হোক, সরকার বা রাজনীতিবিদরা তাঁদের মতো করে তাঁদের কর্ম করে যাবেন, সেটাই স্বাভাবিক। তবে বিশেষ কোনো গোষ্ঠী বা পদবিধারী, অপেক্ষাকৃত কম মেধাসম্পন্ন অতিলোভী কিছু কর্মকর্তাকে মাত্রাতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদান করার পাশাপাশি অন্যদের ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করা ন্যায়বিচার বা সুশাসনের অংশ হতে পারে না। সরকারের উচিত সমাজের সব ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রেখে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে যোগদানের পর থেকেই সংগ্রাম করতে হয় কিভাবে নিজেদের জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ করে দেশ ও জাতির কল্যাণে কিছু অবদান রাখা যায়। এসবের সবটুকু করতে হয় নিজের প্রচেষ্টায়। একজন শিক্ষকের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী শিক্ষার্থীটি যখন কতগুলো ধাপ পেরিয়ে এসে আমলা হওয়ার প্রথম ধাপটিতে পৌঁছান, সেটিই একটু লক্ষ করি। তাঁরা জীবনের শুরুতেই যে সুযোগ-সুবিধাদি ভোগ করেন, সেগুলোর সঙ্গে একজন সিনিয়র অধ্যাপকের সুযোগ-সুবিধাদিরও তুলনা করা চলে না। সরকারি গাড়ি, বাড়ি, টেলিফোন, কম্পিউটার, হরেক রকম ভাতা, বিপুলসংখ্যক সহযোগী...। যার সব কিছুরই জোগান আসে দেশের গরিব জনগণের টাকায়! অথচ একজন শিক্ষক নিয়োগ পেয়ে শুধুই বসার জন্য একটি কক্ষ ও চেয়ার-টেবিল ছাড়া অন্য কিছুই পান না (অন্তত আমার ক্ষেত্রে এটিই বাস্তবতা!)। গাড়ি-বাড়ি-টেলিফোন ইত্যাদির কথা বাদই দিলাম। যে কম্পিউটার ছাড়া বলতে গেলে এখন দুনিয়া অচল, সেটিও পেলাম না! প্রায় এক যুগ শিক্ষকতা করেও সরকার বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি কম্পিউটার পাইনি। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষকের বেলায়ই সম্ভবত এটি সত্য! ডিজিটাল বাংলাদেশের নামে যখন দেখি প্রাইমারি স্কুলগুলোতে ল্যাপটপ বা কম্পিউটার দেওয়া হচ্ছে তখন আনন্দের পাশাপাশি লজ্জাও পাই! নিজ চেষ্টায় শিক্ষাবৃত্তি জোগাড় করে বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে এসে চেষ্টা করছি দেশের জন্য, সাধারণ ঘরের দরিদ্র সন্তানদের জন্য কিছু করতে। এত সব বঞ্চনা-অবহেলার পরও ভাবতাম, আমার যা অর্জন বা প্রাপ্তি তার সবটুকুই তো এই বিশ্ববিদ্যালয় বা দেশ থেকেই। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এর দাবিদার পুরোটাই এই 'বাংলাদেশ'। এসব চিন্তা থেকেই অনেকের কাছে 'স্বপ্নের দেশ' হিসেবে খ্যাত একটি দেশে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার সুযোগ ছেড়ে দিয়েও চলে এসেছিলাম মাতৃভূমির কল্যাণে কাজ করতে। অথচ যখন দেখি প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোতে বিগত বেতন কাঠামো থেকে অবমূল্যায়িত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্রমেই অসম্মানিত করার প্রয়াস অব্যাহতভাবে চলছে, মেধাবীদের অবহেলা করা হচ্ছে বা তাঁদের ত্যাগ ও অবদানকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অস্বীকার করার অপপ্রয়াস চলছে, তখন চরম কষ্ট ও অপমানিত বোধ করা ছাড়া অন্য কোনো প্রাপ্তি চোখে ভাসে না। তখন স্বাভাবিকভাবেই নতুন করে ভাবতে ইচ্ছা করে রাষ্ট্র বা সরকারের কাছে যে পেশার যথাযথ মূল্যায়ন হয় না, সেই পেশায় থাকার দরকার কী? এর থেকে অনেক পেশাই আছে যেখানে অনেক কিছু না থাকলেও অন্তত এতটা বঞ্চনা আর অবহেলা নেই। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অগণিত মেধাবী শিক্ষক এখন দিন গুনছেন এভাবেই-কবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি দেশ ছেড়েও চলে যাবেন!
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ফুড টেকনোলজি ও গ্রামীণ শিল্প বিভাগ,
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
iqbal21155@bau.edu.bd
Published in: http://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2015/09/18/269934
আরো পড়ুনঃ "স্বতন্ত্র স্কেল চাই, অন্য কোন দাবি নাই!!"
Sorry sir, nothing to say, may Allah please save this nation from evils!
ReplyDelete