১.
একটি জাতি, ২১শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে বিশেষ বানিয়ে পৃথিবীকে উপহার দিয়েছে । একটি জাতি, ১৪ই ডিসেম্বর দিনটিকে পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধি বা মনন হত্যার জঘন্য ঘটনার শোক-স্মারকে পরিণত করেছে। পৃথিবীকে উপহার দেয়া এমন দুটি দিন, নির্মাণ করেছে, পূর্ব বাংলাদেশের ছাত্রশিক্ষকগণ । আর, তাদের অঙ্গীভূত জৈবিক-অংশ – সাংস্কৃতিক কর্মীগণ । বাংলাদেশে, এই জ্ঞানজীবী, মননশীল অংশ [ছাত্রশিক্ষক] তার ‘বুদ্ধিবৃত্তিক দায়’কে কখনও হালের বাজারি প্যাশনের উত্তুঙ্গ ব্যক্তিবাদিতার মীমাংসাহীন বাহাসের ব্যাপার বলে মনে করেনি। তারা বারবার, অন্যেরা ব্যর্থ কিংবা আপসে চলে যেতে থাকলে– কোনো কূটতর্কে না গিয়ে, দেশ-জাতি-সংস্কৃতিকে রক্ষা করেছে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এবং তা, প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতিকদের হাতে তুলে দিয়ে ফিরে গেছে নিজের ঘরে, নিজের কাজে। এ-দেশের ছাত্রশিক্ষকগণ এ দায় স্বভাব হিসেবে অর্জন ও বরণ করেছে। এ-স্বভাব, থিয়োরি আর প্রাক্সিসের যুগলবন্দিতে রচিত । এ-দেশের প্রাতিষ্ঠানিক বুদ্ধিজীবিতা বা মননজীবিতা কখনোই কেবল, আপন সামাজিক বর্গ বা শ্রেণিস্বার্থের পক্ষে, মতাদর্শিক হেজিমনি তৈরির তত্ত্ব হয়ে থাকেনি ।
২.
এই তো, এই সেদিনও [২০০৭], মাইনাস টু ফরমুলার মুলা ঝুলিয়ে, দেশকে পশ্চিমা নিওলিবারালদের হাতে তুলে দেবার পাঁয়তারা সাঙ্গ হয়ে গেলে, সেই জাল থেকে দেশ-জাতি-সংস্কৃতিকে টেনে বের করে – রাজনীতিকদের কাছে [উপায়-বিকল্পহীন] ভরসায় তুলে দিয়েছে এই শিক্ষক-ছাত্রছাত্রীরা । ‘মাইনাস টু’ ঘটে যেত বলে মানা হয়, যদি, আনোয়ার হোসেন, হারুণ-অর-রশীদদের মতো অকুতোভয় [বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের] ছাত্রশিক্ষকরা, সেনাবন্দুকের সামনে বুক চিতিয়ে না দাঁড়াতেন । আপনারা, রাজনীতিকরাই হামেশা বলেন – আপনাদের পরীক্ষিত সংগ্রামীদের সেদিন আর কেউ-ই প্রায় বাকি ছিলেন না – পশ্চিমা গ্লাসনস্ত [খুলে ফেলা] আর পেরেস্ত্রোইকা [সংস্কার-বর্জন] গিলে ফেলতে । তাই, পশ্চিমা লগ্নির হিস্যাদার আমলা কবলিত প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতিকরা যখন, শিক্ষকদের নৈতিক চরিত্রের খলন নিয়ে কথা বলেন; তখন ওগুলো আর কথা মনে হয় না - মনে হয় গোঙানি । আমরা, তখন কোনও শব্দবাক্য শুনি না আর । আমরা শুনি, একটা হাড়মাংসহীন জেলিফিশ থেকে কিছু অশ্লীল, অসত্য, অ-মীমাংসিত, অ-কার্যকারণ প্রসূত কিছু প্রলাপ বেরিয়ে আসতে।
৩.
‘শিক্ষকরা দুর্নীতিগ্রস্ত, এটা বন্ধ করা দরকার।’ – মহামান্য সরকারের অর্থমন্ত্রক-এর বাণীটি অনেক কথার ইঙ্গিত দেয়। জানতাম সেনাবাহিনি, পুলিশ, আইন, আদালত, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, সচিবালয়– দুর্নীতি দমন কমিশনও দুর্নীতিগ্রস্ত । আর প্রায় স্বতঃসিদ্ধ ধারণার মতো জানতাম – রাজনীতি তথা রাজনীতিকরা দুর্নীতিগ্রস্ত । এবার অনেকটা ওহীর মতো বাণীতে শুনলাম ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা দুর্নীতিগ্রস্ত । এবং, এমন নিশ্চয়কারক ঘোষণায় কথাটি বলা হয়েছে – যেন, এই স্বতঃসিদ্ধের পর আর কোনও পূর্বাপর নাই । সব দুর্নীতি গেছে অবসান হয়ে - ইন আ ফাইন মর্নিং – জেগে দেখি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা দুর্নীতিগ্রস্ত । বলা হলো : ওদের কোথায় সম্মান গেছে? ওদের জ্ঞান নাই। ওদের পাত্তা নাই। ‘পাত্তা’ আছে কি নাই তা বোঝার ও জানার আগে ‘পাত্তা’ মানেটা কী; তা বুঝতে ইচ্ছা করে। পাত্তা মানে কী? খবর, সংবাদ, ভূমিকা, অংশগ্রহণ, গ্রহণযোগ্যতা, সম্মান? নিওলিবারাল শিক্ষার উন্নয়ন-লক্ষ্য অর্জনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের এতদিনের অর্জিত-লালিত বুদ্ধিবৃত্তিক [পরীক্ষিত] সত্যদায়ের ‘পাত্তা’ থাকার প্রয়োজন নাই। তাই তাদের পাত্তা দেবারও প্রয়োজন নাই।
৪.
ঠিক এই বিন্দুতে দাঁড়িয়েই চূড়ান্ত কথাটা বলতে চাই। মন যখন বিষাদে ভারি হয়ে যায় – তখন অভিমানী মন চাঁচাছোলা হয়ে সরাসরি বের হয়ে আসে - ব্যাখ্যা আর বাহাস বাতুল মনে হয় । অন্তত, বাংলাদেশ কালের কথাই স্মরণ করুন না । এ-স্বাধীন দেশেও কবে, কখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের জ্ঞানতাত্ত্বিক চিন্তা ও চর্চায় স্বাধীন [অটোনোমাস] থাকতে পেরেছিল? তাদের মরিয়া চেষ্টা ও নির্মাণের ফলভোগী হয়েও, আপনারা সবসময় তাদের দখলে রেখেছেন। তাঁদের লাল-নীল, লীগ-দল বানিয়ে রেখেছেন। প্রয়োজনে পুলিশি পাহারা বসিয়ে তাদের দাস্য আদায় করেছেন। যখন যারা ক্ষমতায় থেকেছেন, থাকছেন; তাঁরা, বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আচার্য বনেছেন, বনছেন । আচার্য মানে, যার আচার বা আচরণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে আচরণীয় হবে । সেই আচার্যগণ, তাঁদের আচার বা ফর-মুলা [!] বিকেন্দ্রিত করতেন-করছেন রাজনৈতিক উপ-আচার্য মোতায়েন করে । দুঃখের সাথে জানতে চাই; আপনারা, রাজনৈতিক আচার্য ও উপাচার্যগণ, আপনাদের আচারে-আচরণে, চর্চা ও চর্যায়, থিয়োরি ও প্রাক্সিসে, উপলব্ধি ও সংযোগে, আকাঙ্ক্ষা ও আগ্রহে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার সত্য ভূমিকাকে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, হয়েছেন, হচ্ছেন; কেন, কোথায়, কী কারণে? কেন আপনারা, এই ব্যর্থতার দায় মাথা পেতে নেবেন না?
৫.
বাজারি রাজনীতি-সংস্কৃতির বিনাশী ধস-পতনের ভিতরে বসেও; পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ তাদের [মন্দের ভালো] আধা-জ্ঞানতাত্ত্বিক, আধা-রাজনৈতিক ভূমিকাকে সামনে রেখে যে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাতিষ্ঠানিকতাকে এখনও মরিয়া হয়ে আঁকড়ে রেখেছে, তাদের, নিত্যদিনের সচেতন চর্চায় । সেই চর্চা সাম্রাজ্যবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে, এ-দেশের সমাজ-প্রগতির শত্রু মনে করেছে; তার বিরুদ্ধে সতর্ক থেকেছে; তাকে রুখে দিতে ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথেও নেমেছে ।
উত্তুঙ্গ ‘পিপিপি’র ফাঁদে ফেলে, এদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের গণমুখি ভূমিকাকে নষ্ট ও নস্যাৎ করা গেলে কারা কারা লাভবান হয় – আমরা তা জানি । একে তাই, এতোদিক থেকে ঘিরে ধরে; হেয়, অপ্রাসঙ্গিক, অকার্যকর, ভূমিকা ও পাতাহীন করে তোলার খেলা গুলো খেলা হয় । সে খেলায় আপনাদের সম্পৃক্তি, সহযোগিতা, অংশগ্রহণ এবং [সাময়িক] লাভালাভ কতটা – তা আপনারা জানেন না - আমরা আপনাদের এতোটা অন্ধ ও কাণ্ডজ্ঞানহীন কখনও দেখিনি। বরং, আপনারাই সমাজের সবচেয়ে সেয়ানা জৈবিক অংশ বলে তাত্ব্বিকভাবে সত্যায়িত । আপনারা শুধু, এটুকু মনে রেখে, মনে করে – এদেশের শিক্ষাঙ্গনসমূহের সামগ্রিক মান অবনমনের দায় মাথা পেতে নিন।
স্বপ্ন দেখি, রাজনীতিকরা খেলা খেলতে থাকুক - একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট ভবনে এ-দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ভূত[জীবিত] - বর্তমান সকল আচার্য-উপাচার্য [গণ] একত্রিত হয়েছেন; একত্রিত হয়ে, নিজেদের ব্যর্থতাগুলো স্মরণ করছেন; তারপর, নিজেদের অসম্মানের জন্য্, নিজেদের কাছে ১ মিনিট দাঁড়িয়ে দুঃখ প্রকাশ করছেন। এবং তারপর, সবাই একসাথে বসে, খোলা মনে ভেবে দেখছেন - নিজেদের চর্চায় ও চর্যায় [আচার্য ভূমিকায়] নিজেদের গায়ে এঁটে যাওয়া ‘করাপ্টেড’ কলঙ্কতিলক, কোন ঝামায় ঘষে তুলে ফেলা যায়।
published in :http://www.banglamail24.com/news/105877
0 comments:
Post a Comment