Monday, September 28, 2015

মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা - প্রশ্ন ফাঁস, না স্বপ্নের ফাঁসি?

মো. জাকির হোসেন

প্রশ্ন ফাঁসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে ছাত্রছাত্রীরা
নিজেদের মেধা ও শ্রম দিয়ে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয় অসংখ্য তরুণ-তরুণী। কিন্তু সমাজে ভদ্রতার মুখোশধারী কিছু দুর্বৃত্ত তাদের সে স্বপ্নকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিল। পরীক্ষার আগের দিনই চাউর হয়ে যায় ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের কাহিনি। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন। ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের কাহিনি পরীক্ষার আগের দিনই বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত হয়। এত কিছুর পরও নির্বিকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
তবে নড়েচড়ে বসে সরকারের আরেক সংস্থা—র্যাব। প্রশ্ন ফাঁসে র্যাবের হাতে আটক হন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের এক সহকারী পরিচালকসহ তিনজন। র্যাব তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করে এবং আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডে নেয়। এদিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর বিতর্কিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে তড়িঘড়ি ফলাফল প্রকাশ করে প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নিরপরাধ বলে লাইসেন্স দিয়ে দেয়। সরকার বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করলেও প্রশ্ন ফাঁসের হোতাদের ধরতে র্যাবের অভিযান থেমে থাকেনি।
মেডিকেল কলেজে ভর্তির প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে রংপুরে তিন চিকিৎসকসহ সাতজনকে আটক করে র্যাব। আটককৃত তিন চিকিৎসক সরকারি চাকুরে এবং পদস্থ কর্মকর্তা। তিন চিকিৎসক হলেন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার জিল্লুর হোসেন, সার্জারি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার শরিফুল ইসলাম ও সদর উপজেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান। অন্য চারজন হলেন রংপুরের প্রাইমেট কোচিং সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঞ্জুরুল রহমান, এ ওয়ান কোচিং সেন্টারের কর্মকর্তা জামিল উদ্দিন ও আতিকুর রহমান এবং সাজরাতুল ইয়াদিন রানা।
প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় সরকারের সন্দেহজনক ও পরস্পরবিরোধী আচরণ বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এক. প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠার পর র্যাব কয়েকজনকে আটক করল। এরপরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কোনো যাচাই-বাছাই না করে কেন কোন যুক্তিতে তড়িঘড়ি করে ফলাফল প্রকাশ করল?
দুই. ঘটনার তিন দিন পর কোনো তদন্ত বা অনুসন্ধান ছাড়াই কিসের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মিনমিনে গলায় বিবৃতি প্রকাশ করল যে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় অনিয়ম ও প্রশ্ন ফাঁস হয়নি, সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা হয়েছে। বিবৃতিতে দাবি করা হয়, প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উত্থাপন ও ভর্তি পরীক্ষা বাতিল চেয়ে দাখিলকৃত রিট আবেদনটি হাইকোর্ট কর্তৃক খারিজের মাধ্যমে বিষয়টি ইতিমধ্যে মীমাংসিত। বিবৃতিদাতারা বিবেকের দর্পণে নিজেকে দেখুন আর প্রশ্ন করুন, সবকিছুর সমাধান হয়ে থাকলে ঈদের দিনেও প্রতারিত ভর্তি-ইচ্ছুকেরা কেন নতুন করে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার দাবিতে শহীদ মিনারে জমায়েত হলো। এই কোমলমতি তরুণ-তরুণীরা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী জামায়াত-বিএনপির সমর্থক বলে পার পাওয়ার জো নেই।
তিন. প্রশ্ন ফাঁস না হয়ে থাকলে র্যাব কিসের ভিত্তিতে ১০ জন মানুষকে এ অভিযোগে আটক করল? তাদের বিরুদ্ধে মামলা করল? রিমান্ডে নিল?
চার. প্রশ্ন ফাঁস না হয়ে থাকলে এ মর্মে সরকারের বিবৃতির পরও র্যাব রংপুর থেকে কেন সাতজনকে আটক করে কারাগারে পাঠাল? অভিযোগের কোনো ভিত্তি না থাকলে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুজন সহকারী রেজিস্ট্রার ও সদর উপজেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তার মতো সমাজের সম্মানীয় ব্যক্তিদের কেন আটক করা হলো? কেবল সন্দেহের ভিত্তিতে সমাজের এমন সম্মানীয় ব্যক্তিদের র্যাব আটক করেছে, তা কি আদৌ গ্রহণযোগ্য?
পাঁচ. প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগের কোনো ভিত্তি না থাকলে আদালত কিসের ভিত্তিতে আটককৃতদের রিমান্ড মঞ্জুর করলেন?
ছয়. প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে পুনরায় পরীক্ষা নেওয়ার দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনরত মেডিকেলে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের পুলিশ কেন লাঠিপেটা করল? এটা তো কোনো রাজনৈতিক দলের আন্দোলন ছিল না।
সাত. বিগত বছরগুলোয় যেখানে শিক্ষার্থীরা ৫০-এর কিছু অধিক নম্বর পেয়েই সরকারি মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে, সেখানে কীভাবে এবার ভর্তির সর্বনিম্ন নম্বর ৭৭ দশমিক ৪০ হলো? আলাদিনের কোন চেরাগের স্পর্শে এটা সম্ভব হলো যে ৮০-৯০-এর ঘরে নম্বর পেয়েছে দুই হাজারেরও অধিক পরীক্ষার্থী? এটা কী করে সম্ভব হলো যে যারা কলেজের টেস্ট পরীক্ষায় প্রথমবার উত্তীর্ণ হতে পারেনি, বিশেষ বিবেচনায় দ্বিতীয়বার টেস্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও এবারের মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় স্থান পেল? কোন গায়েবি মদদে তারা মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পেয়ে গেল?
আট. প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই না করেই সরকার যে সবকিছু তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে, ভবিষ্যতে যদি ফাঁসের সত্যতা প্রকাশ হয়ে পড়ে, তখন কী হবে?
নয়. সরকার প্রশ্ন ফাঁসের বিষয় আমলে না নিলে র্যাব যাদের আটক করেছে, তাদের অপরাধের শাস্তি দেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ, তাদের পক্ষ থেকে তাদের আইনজীবীরা সাধারণ একটি যুক্তি তুলে ধরবেন, প্রশ্ন যদি ফাঁস হতো, তাহলে সরকার ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করত। নিদেনপক্ষে তদন্ত কমিটি গঠন করত। যেহেতু সরকার এসব কিছুই করেনি, তার মানে প্রশ্ন ফাঁস হয়নি। তাই আমার মক্কেল নিরপরাধ। এ যুক্তিতেই অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যাবে।
দশ. সরকার কিসের ভিত্তিতে জোরগলায় বলছে যে প্রশ্ন ফাঁস হয়নি? কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয়, এ সরকারের বড় ব্যর্থতা কী? উত্তরের জন্য রকেটবিদ্যার দরকার নেই। চোখ বন্ধ করে তিনি বলে দিতে পারবেন প্রশ্ন ফাঁস প্রতিরোধ করতে না পারা এবং ফাঁস প্রশ্ন জায়েজ করতে তার পক্ষে নানা সাফাই গাওয়া।
কোন প্রশ্ন ফাঁস হয়নি? বোর্ড পরীক্ষা থেকে শুরু করে, চাকরির পরীক্ষা, ভর্তি পরীক্ষা। এমনকি শিক্ষা সমাপনী ও জেএসসি পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হওয়ার খবর বেরিয়েছে পত্রপত্রিকায়। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, কোন প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, সেটা আলোচনার বিষয় নয়, বরং কোনটা ফাঁস হয়নি, তা-ই আলোচনার বিষয়। শিক্ষামন্ত্রী নিজেই তো সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন, প্রশ্ন ফাঁস ঠেকানো সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ।
তাই, সরকারকে বলি, গোঁ ধরে থাকবেন না। এখনো সময় আছে। তদন্ত করুন, সত্য উদ্ঘাটন করুন। দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির পথ প্রশস্ত করুন। প্রয়োজনে আবারও ভর্তি পরীক্ষা নিন।


মো. জাকির হোসেন: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
zhossain@justice.com

Published in: http://www.prothom-alo.com/opinion/article/641503

0 comments:

Post a Comment