Wednesday, September 9, 2015

৮ম পে স্কেলঃ ‘রাষ্ট্র মানেই লেফট রাইট লেফট রাইট লেফট’

Zobaer Al Mahmud


৮ম পে স্কেল আবারো প্রমাণ করল ‘রাষ্ট্র মানেই লেফট রাইট লেফট রাইট লেফট’!! 

এই পে স্কেল নিয়ে অত্যন্ত সযত্নে প্রতিক্রিয়া দেয়া থেকে বিরত ছিলাম, কারণ নিজের বেতন নিয়ে কথা বলতে লজ্জা বোধ করি আমি। আমার অনেক শিক্ষক বন্ধুর অনুরোধ উপেক্ষা করেই এটা বজায় রেখেছিলাম। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর উদ্ধত আক্রমণে এখন নীরবতা ভাঙতে বাধ্য হলাম। প্রথমত আমি মনে করি শুধু মাত্র ভার্সিটির শিক্ষকদের বেতন-ভাতা নয়, সামগ্রিকভাবে সকল শিক্ষকদের উপর বৈষম্যের প্রতিবাদ করতে হবে। প্রাইমারি, সেকেন্ডারি, কলেজ লেভেলের শিক্ষকদের উপর যে বৈতনিক বৈষম্য তার প্রতিবাদও ভার্সিটির শিক্ষকদেরও করতে হবে। সেটা ভার্সিটির শিক্ষকরা না করলে তা গোষ্ঠীচিন্তার বহিঃপ্রকাশ বৈ আর কিছুই নয়। সমাজে জারি থাকা বৈষম্য কমিয়ে আনাই আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু ৮ম পে স্কেল সে বৈষম্যকে আরও উস্কে দিল। ভার্সিটির শিক্ষকদের ক্ষোভের জায়গা হচ্ছে তাদের গ্রেড অবনমন হয়েছে কয়েক ধাপ। আমলারা চরম কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট এর প্রমাণ হাজির করে নিজেরা নিজেদের জন্য ৩ সুপার গ্রেড তৈরি করেছেন ( মন্ত্রীপরিষদ সচিব, সিনিয়র সচিব, পদায়িত সচিব) এবং এর মাধ্যমে নিজেদের বেতন বৃদ্ধি করেছেন ব্যাপকহারে। অন্যদিকে সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপক বাদ দিয়ে শিক্ষকদের মোট ৪ গ্রেড অবনমন করা হয়েছে। এটা চরম অবমাননাকর এবং বৈষম্যমূলক। ৭ম পে স্কেলেও সিলেকশন গ্রেড অধ্যাপক সচিবদের সমান বেতন পেত। কিন্তু এখন তাদের গ্রেড-২ তেই থাকতে হবে। এর মানে যত যোগ্যতাই থাকুক দেশের সেরা মেধাবীরা এখন আর গ্রেড-২ ক্রস করতে পারবেন না।

দুনিয়ার ইতিহাসে কোন পেশার তাও শিক্ষকতার মত পেশার এরকম চরম অবমাননাকর গ্রেড অবনমন হয়েছে কিনা তা গবেষণার বিষয়। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেই ছিল শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেল প্রণয়ন করার অঙ্গীকার। তারা তা বাস্তবায়ন না করে উল্টা গ্রেড এর মহা অবনমন করে শিক্ষকদের মর্যাদা হানির কসরত দেখালেন। অন্যদিকে আলাদা বেতন স্কেল করা হল সামরিক বাহিনীর। এর মানে সরকার একটা সুস্পষ্ট বার্তা দিল যে তার কাছে দাপ্তরিক কাজ আর লেফট রাইট এর গুরুত্ব শিক্ষার চেয়ে বহুগুণ বেশি। ‘রাষ্ট্র মানেই লেফট রাইট লেফট রাইট লেফট’। সরকার এর ক্ষমতার জন্য দরকার জনপ্রশাসন আর সামরিক বাহিনীর আনুকূল্য। শিক্ষক সমাজের আনুকূল্য সরকারের দরকার নাই বলেই তাদের গ্রেড নামিয়ে দেয়া। আমার কিছু কলিগ আবার বলেন, কেন এই সরকার ক্ষমতায় আসার পিছনে ভার্সিটির ছাত্র-শিক্ষকদের অবদান আছে, আগস্টের আন্দোলনই ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল মইনুদ্দিন ফখরুদ্দিন সামরিক সরকারের। ঢাকা ভার্সিটি এবং রাজশাহী ভার্সিটির কয়েকজন শিক্ষক কারাবরণ পর্যন্ত করেছেন------ কিন্তু সরকার তা আমলে নেন নাই----

ভার্সিটির শিক্ষকদের এই গ্রেড অবনমনকে জায়েজ করার জন্য ক্ষমতাবলয়ের লোকজন কিছু যুক্তি তুলে আনে যেসব যুক্তির ভিত্তিতে আমলা আর সামরিকদের গ্রেড ১০ গুন কমাতে হবে। এদের যুক্তি হচ্ছে ভার্সিটির শিক্ষকরা ক্লাস নেন না, দ্রুত প্রোমোশন হয় তাদের, প্রাইভেটে খেপ মারেন এরা ব্লা ব্লা ব্লা—ক্লাসের ব্যাপারে ভার্সিটিতে দুই ধারাই আছে- কেউ কেউ ক্লাস কম নেন , কেউ কেউ আবার এক্সট্রা ক্লাসও নেন। ফলে ক্লাস না নেয়ার ব্যাপারটা অতিরঞ্জিত। ক্লাস নেয়াই গ্রেডের মাপকাঠি হলে যারা এক্সট্রা ক্লাস নেন তাদের সুপার গ্রেডে রাখা হল না কেন? দ্রুত প্রোমোশন এর যে ঢালাও অভিযোগ অর্থমন্ত্রী করলেন তা আংশিক সত্য। প্রায় সব ক্ষেত্রেই নিয়ম মেনেই প্রমোশন হচ্ছে। সুস্পষ্ট নীতিমালা আছে, তাই ফলো করা হয়। তবে যারা দলীয় রাজনীতিতে আছেন তাদের মাঝে কাউকে কাউকে এই নীতিমালা লঙ্ঘন করেই প্রমোশন দেয়া হয় তা অস্বীকার করার উপায় নাই। কিন্তু নিয়োগ- প্রমোশনে যে অনিয়ম হচ্ছে তার দায়ভার দলবাজিতা যা টিকে আছে শাসক চক্রের কারণেই। শাসকচক্র ভার্সিটির সব নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য দলবাজিতা জারি রাখেন। অভিজ্ঞতা, দেশি বিদেশি আর্টিকেল এর সংখ্যা , PhD, এসব বিবেচনায় নিয়েই অধ্যাপক করা হচ্ছে। কারো PhD না থাকলে ১৬-২০ বছর লেগে যায় অধ্যাপক হতে, আর PhD গবেষণা থাকলে ১২ বছরে অধ্যাপক হওয়ার সুযোগ থাকে যদি অন্যান্য শর্ত পূরণ হয়। তাহলে প্রমোশনের শর্ত তো ঠিক আছে। এখানে গবেষণার মান এবং প্রকাশিত জার্নালের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। কেউ কেউ ভাল প্রকাশনা ছাড়াই প্রোমোশন পাচ্ছেন, এটা ঠিক। কিন্তু আবার এটাও দেখতে হবে ভার্সিটির বাজেটের ১% বরাদ্দ দিয়ে আর শিক্ষকদের ১৫০০ টাকা গবেষণা ভাতা দিয়ে কিভাবে ভাল গবেষণা সম্ভব? একজন থিসিস স্টুডেন্ট সুপারভাইজ করার জন্য ৪ হাজার টাকা দেয়া হয়, অথচ এই টাকায় কোন গবেষণাই সম্ভব না। ছাত্র-শিক্ষক নিজেদের গাঁটের টাকায় আর কি মানের গবেষণা করবে? এত সীমাবদ্ধতার পরো এখানে কেউ কেউ যে গবেষণা করছেন সেটাই তো বিস্ময়। এখন আমার কথা হচ্ছে ভার্সিটির শিক্ষকদের নিয়োগ-প্রমোশনে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগে যদি তাদের গ্রেড ৪/৫ ধাপ কমিয়ে দেয়া হয় তাহলে সচিবালয় আর মিলিটারিতে যে রাজনৈতিক এবং অরাজনৈতিক অনিয়ম দুর্নীতি হয় তার কারণে তাদের গ্রেড ১০ গুন কমিয়ে দেয়া উচিত। আর ভার্সিটির শিক্ষকদের প্রাইভেটে ক্লাস নেয়ার অজুহাতে তাদের বেতন গ্রেড কমানোর যুক্তি হাস্যকর – কেননা মাত্র ৫-৭% শিক্ষক প্রাইভেট ভার্সিটিতে ক্লাস নেন। বাকি ৯৩% শিক্ষকের কি হবে? যেসব সাবজেক্ট বাণিজ্য ভিত্তিক না সেগুলা প্রাইভেট ভার্সিটিতে নাই, ফলে প্রচুর বিভাগের শিক্ষক খেপ মারার ফুরসত পান না। আবার অনেক শিক্ষক আছেন তাঁরা নীতিগতভাবেই প্রাইভেটে পড়াতে চান না। ৭% শিক্ষকের এক্সট্রা ইনকামের জন্য কেন সব শিক্ষকের গ্রেড কমানো হবে? ফলে এসব বাজে যুক্তি। একদম বাজে যুক্তি। একই যুক্তিতে বলা যায় আমলারা অনেক আলগা ইনকাম করেন তাই তাদের গ্রেড কমিয়ে দিতে হবে---- অবশ্য মুহিত সাহেব এই আলগা ইনকাম বা দুর্নীতির টাকাকে ‘স্পিড মানি’ বলে হালাল করেছেন বলে জানতে পারলাম। মুহিত সাহেব গতকাল বলেছেন, এত এত অধ্যাপক কেন? উনার মতে নিচে লেকচারার ১০ জন হলে উপরে ১ হাজার থাকেন--- এসব ঢালাও তথ্য উনি কই পাইলেন? ইউজিসির তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মরত আছেন-অধ্যাপক- ৩৯০০; সহযোগী অধ্যাপক-1800, সহকারী অধ্যাপক-1600, এবং প্রভাষক-6000।
  • ফলে এটা সহজেই অনুমেয় এই পে স্কেল সামরিক- আমলাতন্ত্রের উপনিবেশিক কাঠামোকে শক্তিশালী করে পাওয়ার এলিটদের উপর ভর করে ক্ষমতা বলয়কে নিরঙ্কুশ করার জন্যই করা হয়েছে। ভার্সিটি শিক্ষকদের গ্রেড অবনমনের আরেকটা বড় কারণ বোধ হয় শিক্ষাকে নিরঙ্কুশভাবে প্রাইভেটাইজ করার হীন চক্রান্ত বাস্তবায়ন। বিশ্বব্যাংক- আইএমএফ এর পরামর্শে ইউজিসির যে উচ্চ শিক্ষার কৌশলপত্র তাতে সুস্পষ্টভাবে দেশের পাবলিক ভার্সিটিকে ধীরে ধীরে প্রাইভেটে পরিণত করার রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে এবং শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ এবং বাণিজ্যিকীকরনই সরকারের চলমান শিক্ষাভাবনার ভারকেন্দ্র। এই বাজারি চিন্তা থেকেই পাবলিক ভার্সিটির শিক্ষকদের গ্রেড তথা বেতন-ভাতা তুলনামূলকভাবে কমিয়ে দেয়া হয়েছে যেন প্রাইভেট ভার্সিটিতে খেপ মারার যে চলমান প্রক্রিয়া তার শিক্ষা-অর্থনৈতিক সিস্টেম যেন আরও শক্তিশালী হয়। স্যার ফরাস উদ্দিন যেহেতে বেসরকারি শিক্ষার প্রসারের একজন দিকপাল তাই উনার মাথায় এই গুঁড়-বুদ্ধি খেলা করা অসম্ভব নয়। পে কমিশন শিক্ষকদের আলাদা বেতন কাঠামোর ব্যাপারে বলেছে, দেশের পাবলিক ভার্সিটিগুলা আয়ের ক্ষেত্রে স্বাবলম্বী না হলে আলাদা বেতন স্কেল সম্ভব না। এর মানে সরকার চায় পাবলিক ভার্সিটির পাবলিক চরিত্র ধ্বংস করে তাকে প্রাইভেটে পরিণত করতে। বিশ্বব্যাংক - ইউজিসির ২০ বছর মেয়াদি উচ্চ শিক্ষার কৌশলপত্রেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির উপর জোর দেয়া হয়েছে এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। কৌশলপত্রে বলা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে “নিজস্ব সম্পদ/সম্পত্তি নিজেরাই তৈরি করতে হবে”। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষায় রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি ৫০ শতাংশ হ্রাস করা হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে বাকি ৫০ শতাংশ খরচ বহন করতে হবে। অর্থাৎ টিউশন ফি এবং অন্যান্য ফি ব্যাপকহারে বৃদ্ধি করতে বাধ্য হবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এর মানে পে কমিশন মূলত বিশ্বব্যাংক এর নীতিরই বাস্তবায়ন চায় যা বাস্তবায়ন হলে উচ্চ শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরন ছাড়া আর কিছুই হবে না। ফলে গরিব এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অনেক ছাত্রই উচ্চ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে। শিক্ষকদের আলাদা বেতন স্কেলের ক্ষেত্রে পে কমিশন পাবলিক ভার্সিটিকে অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার হাইকোর্ট দেখালেওএই পে স্কেলে ঠিকই সামরিকদের জন্য স্বতন্ত্র স্কেল দেয়া হয়েছে। এই ভণ্ডামি কেন? আমলারা এবং সামরিকরা কি নিজস্ব মানিতে বেতন নেন নাকি পাবলিক মানি। তাহলে কেন শিক্ষকদের আলাদা স্কেলের কথা উঠলেই স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার সবক দেয়া হচ্ছে?
এদেশে শিক্ষা, শিক্ষক- শিক্ষানীতি এসবের কোন মূল্য তো আর রইল না। প্রাইমারি স্কুলের, হাই স্কুলের শিক্ষকদের অবস্থা তো ভয়াবহ অমানবিক। ভার্সিটির শিক্ষকদের তো কিছু হলেও একটা অবস্থান আছে, তাদের ভয়েস শুনা যায়। কিন্তু প্রাইমারি স্কুলের, হাই স্কুলের শিক্ষকদের, বেসরকারি স্কুলের লক্ষ লক্ষ শিক্ষকদের সাব–অলটার্ণ করে রাখা হয়েছে। বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকদের দাবি দাওয়ার জবাব দেয়া হয়েছে পুলিশের লাঠিপেটা আর পিপার স্প্রে দিয়ে। এসব শিক্ষকদের গ্রেড অনেক নিচের সারিতে এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে ঢালাও ভাবে বলা হচ্ছে বেতন ১০০% বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু গ্রেডভেদে বেতন বৃদ্ধির হার দেখলেই বুঝা যায় ভয়ানক বৈষম্য বজায় রাখার বন্দোবস্ত করা হয়েছে এই পে স্কেলে। আমলারা তাদের গ্রেড এর বেতন ১০০% বাড়ালেও নিচের দিকের গ্রেডের বেতন বৃদ্ধি অনেক কম। এরপর সর্বোচ্চ গ্রেড আর সর্ব নিম্ন গ্রেডের বেতনের ব্যবধান আকাশ –পাতাল। যেখানে এই দুই গ্রেডের ব্যবধান ১ঃ ৫ হওয়া উচিত সেখানে তা ১ঃ ১০ এর উপরে। 

ফলে এই পে স্কেল আমলা বান্ধব- সামরিক বান্ধব –ক্ষমতা বান্ধব হলেও মোটেই শিক্ষক বান্ধব নয়। বরং দেশের পাবলিক ভার্সিটি গুলাকে ধীরে ধীরে প্রাইভেট করার চক্রান্তের ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী --- 

অবিলম্বে এই পে স্কেল সংশোধন করে সমস্ত বৈষম্য দূর করা হোক ------
Zobaer Al Mahmud
Assistant Professor at Department of Clinical Pharmacy and Pharmacology, University of Dhaka

Original Post Link: https://goo.gl/fQa8eq

0 comments:

Post a Comment