আজ শিক্ষা দিবস। শিক্ষা নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তা করার একটা উপলক্ষ এই দিবসটি করে দিতে পারে, কিন্তু সে রকম কোনো উদ্যোগ কেউ নেবে, তা মনে হয় না। তবে শিক্ষা নিয়ে শুধু এক দিন নয়, সারা বছরই আমাদের ভাবতে হবে। কারণ, শিক্ষায় আমাদের অর্জন আর সব অর্জনকে ছাপিয়ে না গেলে বিশ্বের সমীহ আমরা আদায় করতে পারব না, আমাদের শিক্ষাদর্শনও অসমাপ্ত থেকে যাবে।
শিক্ষায় যে সংকট বিদ্যমান, তা মেনে নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। এই সংকট সবার কাছে শিক্ষা না পৌঁছানোর এবং যাদের কাছে তা পৌঁছাচ্ছে যথাযথ মানসম্পন্ন না হওয়ার। এই সংকটের আরও দিক আছে, যেমন: প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় থেকে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া; পরীক্ষাগুলোয় বড় সংখ্যায় শিক্ষার্থীদের অকৃতকার্য হওয়া; শিক্ষা উপকরণ, গবেষণাগার, মানসম্পন্ন শ্রেণিকক্ষ অথবা গ্রন্থাগারের অপর্যাপ্ততা এবং যোগ্য শিক্ষকের অভাব। শিক্ষার্থীরা যে নোট বই এবং কোচিং-নির্ভর হয়ে পড়ছে অথবা গণিত ও ভাষার ক্ষেত্রে তাদের যে দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে, তাও সংকটকে ঘনীভূত করছে।
আমরা একটি জাতীয় শিক্ষানীতি তৈরি করেছি, কিন্তু তার ঘনিষ্ঠ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আমরা পাঠদান-পদ্ধতি নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি, কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি ও সামাজিক চাহিদা অনুযায়ী কোনো পদ্ধতির উদ্ভাবন করতে পারছি না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা জ্ঞানমুখী না হয়ে ক্রমেই সনদমুখী হয়ে পড়ছে। আমাদের বিজ্ঞানচিন্তা, দর্শনচিন্তা সমাজ ও পরিবেশ নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা একটা নির্দিষ্ট মাত্রাতেই আটকে আছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘শিক্ষার মিলন’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বর্তমান যুগের সাধনার সঙ্গেই বর্তমান যুগের শিক্ষার সংগতি হওয়া দরকার।’ আমাদের দেশে কি সেই লক্ষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি? লক্ষণীয় যে রবীন্দ্রনাথ এখানে সাধনার কথা বলেছেন। সাধনা হচ্ছে সর্বোচ্চ সক্ষমতার চর্চা ও প্রয়োগ। বর্তমান যুগকে আমরা তথ্যের যুগ বলে অভিহিত করি। ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন তথ্য অত্যন্ত সহজলভ্য। ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত একেকটি মুঠোফোন একেকটি গ্রন্থাগারও বটে। কিন্তু তথ্যকে প্রক্রিয়াজাত করে জ্ঞানে রূপান্তরের এবং জ্ঞানকে প্রক্রিয়াজাত করে প্রজ্ঞার স্তরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য যে সাধনার প্রয়োজন, আমাদের শিক্ষা কি তা উৎসাহিত করে? তার আয়োজন করে?
আমাদের শিক্ষার সংকটের মূলে আছে শিক্ষা সম্পর্কে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। স্কুলে পড়ার সময় আমাদের বলা হতো, ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে।’ এ বিষয় দৃষ্টির একটি বড় গলদ হলো জ্ঞানকে কর্মসম্পাদনের দক্ষতার পর্যায়ে নামিয়ে আনা। আমাদের সমাজ শিক্ষাকে একটি সুযোগ বলে ভাবে, অধিকার হিসেবে ভাবে না। এখনো না। যদি ভাবত, তাহলে সামাজিক চুক্তিতে তার প্রতিফলন থাকত। বাঙালি জাতির আত্মপ্রকাশের পর এতগুলো শতাব্দী চলে গেল, এখনো শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ (পশ্চিমবঙ্গকে অন্তর্ভুক্ত করলে) বাঙালি শিক্ষাবঞ্চিত। আমরা যদিও মানি যে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পরাধীনতা আমাদের শিক্ষার পথে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাহলেও ১৯৭১ সাল থেকে নিয়ে এ পর্যন্ত দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ যে শিক্ষার আলো পেল না, তার পেছনে কী যুক্তি আছে?
আমাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্য যখন সীমিত ছিল, তখন শিক্ষার পেছনে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ সরকারগুলো দিতে পারেনি। কিন্তু সক্ষমতা যখন বাড়ল, তখনো যে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়ল, তা তো নয়। শিক্ষা নিয়ে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির একটি প্রতিফলন হলো শিক্ষকদের প্রতি এর দায়বদ্ধতা। কাগজে-কলমে শিক্ষকদের অনেক সম্মান দেওয়া হয়। বলা হয়, তাঁরা ‘মানুষ গড়ার কারিগর’। কিন্তু তাঁদের জীবনধারণকে সহজ করার, তাঁদের সামাজিক মর্যাদা দেওয়ার ব্যাপারে সমাজ ক্রমাগত কার্পণ্য দেখিয়েছে। সমাজের পক্ষে রাষ্ট্রও সেই কার্পণ্যের ধারা বজায় রেখেছে। ফলে জীবনসংগ্রামে বিপর্যস্ত এই কারিগরেরা, বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ে এই দায়িত্ব যাঁরা পালন করেন, সেই শিক্ষকেরা তাঁদের দু-একটি অধিকার আদায়ে রাজপথে নামলে পুলিশের জলকামানের সামনে পড়েন। কিছুদিন আগে যে নতুন বেতনকাঠামো ঘোষণা করা হলো, তা প্রধানত হলো লেখাপড়া শিখে যঁারা গাড়িঘোড়ায় চড়েন তঁাদের জন্য। যাঁদের হাতে লেখাপড়ার ভিত্তিটা তৈরি হয়, তাঁদের এই বেতনকাঠামোতে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
কাগজে দেখেছি, দেশের অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ দখল করে নিচ্ছেন স্থানীয় ক্ষমতাবানেরা। সরকারি যে প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষকদের পেনশন ইত্যাদি দিয়ে থাকে, তাতে দিনের পর দিন ধরনা দিয়েও অনেক শিক্ষক পেশন আদায় করতে পারছেন না। তাহলে কোন যুক্তিতে বলা যায়, এই সমাজ শিক্ষকদের এবং শিক্ষাকে মর্যাদা দেয়? এখন পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতেও ‘পাবলিক’ পরীক্ষা হচ্ছে। গণসাক্ষরতা অভিযান জরিপ করে, সমীক্ষা করে দেখিয়েছে, এতে শিক্ষার্থীদের মুখস্থ ও নোটনির্ভরতা এবং কোচিং-বাণিজ্য বাড়ছে। এখন সরকারি চাকরিতে ঢোকার পরীক্ষাটি (বিসিএস) এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে (যেহেতু গাড়িঘোড়ায় চড়ার অধিকার আদায়ের অঞ্চলে ঢোকার এটি হচ্ছে স্বর্ণতোরণ) যে একজনকে সেদিন বলতে শুনলাম কীভাবে এই পরীক্ষায় সফল হওয়া যায়, তা বিভাগনির্বিশেষে স্নাতক শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে একটি বিষয় হিসেবে নির্ধারিত হতে পারে।
শিক্ষার সংকট তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখছে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ। আমাদের সংবিধানে উল্লেখ আছে, শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার। শিক্ষাকে কখনো পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা উচিত নয়, এ রকম একটি চিন্তা আমাদের শিক্ষাদর্শনের ভিত্তি। কিন্তু যেদিন ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল ও পরে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় চালু হলো, কোচিং-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠা পেল, সেদিন থেকে শিক্ষা পণ্যের মোড়কে হাজির হতে থাকল। এটি ঘটছে নানা কারণে, তার একটি হলো বিশ্বায়নের ফলে সারা বিশ্বে একটি বিশাল পণ্যসংস্কৃতি তৈরি হওয়া। এই পণ্যসংস্কৃতি অসম্ভব শক্তিশালী। পশ্চিমে টেলিভিশন জনপ্রিয় হওয়ার পর ধর্মপ্রচারও একটি লাভজনক কাজ হিসেবে দেখা দেয়। ‘টেলিইভাঞ্জেলিজমের’ প্রবক্তারা টেলিভিশনে ধর্ম প্রচার করে কোটি কোটি ডলার আয় করেছেন। এসব দেখে মার্কিন ঔপন্যাসিক ডন ডিলিলো কৌতুক করেই বলেছিলেন, টেলিভিশন তাহলে ধর্মকেও পণ্য বানায়। সেই তুলনায় শিক্ষা তো অনেক সহজে পণ্যায়নযোগ্য। এবং শিক্ষা যখন পণ্য হয়, তখন শিক্ষার মধ্য দিয়ে উচ্চতর জ্ঞানসাধনার বিষয়টি চাপা পড়ে যায়, প্রধান হয়ে ওঠে বাজারের চাহিদা।
এসব সংকট সমাধানের উপায় আছে। বাইরের যেসব চর্চা ভালো, যেগুলো শিক্ষাবিস্তারে এবং শিক্ষার মানোন্নয়নে উপকারী প্রমাণিত হয়েছে, সেগুলো গ্রহণ করতে কোনো আপত্তি থাকার কথা নয় এবং আমাদের সংস্কৃতি ও সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারলে সেসব অত্যন্ত ফলদায়ক হতে পারে। কিন্তু বাইরে থেকে আনা নানা পথ-পদ্ধতি-শিক্ষণ/শিখনতত্ত্ব অন্ধভাবে প্রয়োগ করে গেলে বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে। এখানে দুটি উদাহরণ দেওয়া যায়। প্রথমটি সত্তরের দশক থেকে ইংরেজি শিক্ষায় আরোপিত কমিউনিকেটিভ পদ্ধতি। আগে যে ব্যাকরণ অনুবাদ-পদ্ধতি চালু ছিল, তা ছিল মন্দের ভালো। কিন্তু নতুন পদ্ধতিটি চালুর জন্য যতগুলো আবশ্যকতা রয়েছে, তার বেশির ভাগ অনুপস্থিত থাকায় এ পদ্ধতি কোনো ফলই বয়ে আনেনি। পদ্ধতিটি ভালো, কিন্তু তার শর্তগুলো হাজির না থাকলে তা আর ভালো থাকে না। এর ফলে ইংরেজি শিক্ষার ক্ষেত্রে একটা হ–য–ব–র–ল তৈরি হয়েছে।
দ্বিতীয় উদাহরণটি ঢাকাসহ নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিমা ‘সেমিস্টার’ পদ্ধতি গ্রহণ। এ ক্ষেত্রেও অর্থাৎ এ পদ্ধতি কার্যকরভাবে চালু করার জন্য যেসব আবশ্যকতা প্রয়োজন, যেসব আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে না থাকার জন্য—এ পদ্ধতিও শিক্ষাকে বিপদগ্রস্ত করছে। অন্তত আমার অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে। সাহিত্য, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ের জন্য সেমিস্টার-পদ্ধতি আমাদের জন্য সুফল আনবে না। এই সুফল পেতে হলে এটি প্রয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তগুলো আগে পূরণ করতে হবে।
শিক্ষাক্ষেত্রে সংকটের নানা প্রকাশ আছে, প্রতিবিধানও আছে। এবং সফল প্রতিবিধানের জন্য কয়েকটি বিষয় ও প্রস্তুতি অপরিহার্য। এর একটি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক সংকল্প ও সদিচ্ছা, দ্বিতীয়টি পর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং তৃতীয়টি জাতির শিক্ষা চিন্তায় শিক্ষাকে সর্বাগ্রে রাখা। আমরা বলি বটে শিক্ষায় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত। বিশ্বে যেসব দেশ উন্নতি করেছে, যাদের দেখে আমরা অবাক হই এবং কিছুটা ঈর্ষাও অনুভব করি, তারা সবাই শিক্ষায় সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করেছে, অনেক সময় সাধ্যের বাইরে গিয়ে, যেমন কিউবা ও কোরিয়া। দীর্ঘদিন থেকে কিউবার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো অবরোধ আরোপ করেছে, তাতে তার অর্থনীতি খুবই নাজুক অবস্থায় পড়েছে। কিন্তু দেশটি শিক্ষা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ থেকে পিছপা হয়নি। এর সুফল তারা এখন পাচ্ছে। একটি গোটা প্রজন্ম বিশ্বমানের শিক্ষা পেলে বিজ্ঞান থেকে নিয়ে সাংবাদিকতা, বাস্তুকলা থেকে নিয়ে কৃষিকাজ সর্বত্র যে বিশাল মাপের অর্জন সম্ভব, কিউবা তা করে দেখাচ্ছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র কিউবাকে কাছে পেতে চায়। কয়েক বছর ধরে দেশটি তার জিডিপির ৯ শতাংশ বরাদ্দ দিচ্ছে শিক্ষায়। আমরা দিচ্ছি ২ দশমিক ১ শতাংশ। নেপালেরও কম।
শিক্ষার মান উন্নত হয় না ভালো শিক্ষক না থাকলে; বইপত্র, শিক্ষা উপকরণ ইত্যাদি মানসম্পন্ন না হলে; শিক্ষাদান ও গ্রহণ আনন্দময় না হলে; শিক্ষায় হেরফের থাকলে; তিন-চার ধারায় শিক্ষাব্যবস্থা বিভক্ত থেকে গেলে, প্রতিটি বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগার, খেলার মাঠ এসব না থাকলে এবং শ্রেণিকক্ষ উজ্জ্বল ও আরামদায়ক না হলে। আমরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে বেতন দিই, তা কোনো মেধাবী শিক্ষার্থীকে শিক্ষকতা পেশার প্রতি আকর্ষিত করবে না। প্রাথমিক শিক্ষকদের যে ‘মর্যাদা’ আমরা দিই, তাতে শিক্ষকতাকে মহান পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ার মানুষ পাওয়াও মুশকিল হবে।
শিক্ষার সংকট এক দিনে দূর হবে না, কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজ যদি সংকল্পবদ্ধ হয় শিক্ষাকে সংকটমুক্ত করতে, তাহলে ওই পথে অনেক দূরই এগিয়ে যাওয়া যাবে। তারপর বিনিয়োগের প্রশ্নে সেই সংকল্পের প্রতিফলন ঘটলে শিক্ষার মান, ব্যাপ্তি ও গভীরতা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকবে।
আমরা জোড়াতালি দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, এমনকি সরকারি কাজকর্মও চালাতে পারি, কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে জোড়াতালির কোনো সুযোগ নেই। শিক্ষা হচ্ছে বিনিয়োগের শ্রেষ্ঠ জায়গা, যার সুফল একটি পুরো দেশ পায়।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
Published in: http://www.prothom-alo.com/opinion/article/633616
0 comments:
Post a Comment