মো. জিল্লুর রহমান
শিক্ষা জীবনের প্রাথমিক স্তরে বাদশা আলমগীরের কবিতা পড়েছিলাম, যার দুটি লাইন আজো স্মৃতি থেকে ভুলতে পারিনি। কবিতাটি একেবারে নতুন প্রজন্ম জানে কিনা জানি না, তবে কিছু আগের প্রজন্মের সবাই জানে তাতে কোন সন্দেহ নাই।
সেদিন বাদশা আলমগীর শিক্ষককে বড় কোন উপঢৌকন কিংবা আর্থিক সুবিধা দেননি। দিয়েছিলেন ছাত্র কিভাবে শিক্ষককে সেবা বা মান্য করবে তার কড়া নির্দেশনা। আবেগাপ্লুত শিক্ষক তাই বলে উঠেছিলেন- ‘আজ হতে চির উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির, সত্যিই তুমি মহান উদার বাদশা আলমগীর’।
শুরুতে এ বিষয় অবতারণার উদ্দেশ্য- আমাদের সমাজের প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা অর্থ্যাৎ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকদের সামাজিক বা অর্থনৈতিক মান মর্যাদার অবস্থান আলোকপাত করা। বলা হয়, শিক্ষক জাতি গঠনের কারিগর। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শিক্ষকের কর্তব্য ও মর্যাদা অনেক ঊর্ধ্বে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের সেভাবেই মূল্যায়ন করা হয়।
ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। আমাদের দেশের শিক্ষক সমাজ তাদের কর্তব্য পালনে কতটুকু সফল বা ব্যর্থ সে বিষয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা থাকতে পারে। তবে সামগ্রিকভাবে তাদের ব্যর্থ বলার সময় এখনো আসেনি। কারণ তাদের সংস্পর্শে গড়ে ওঠা মানুষগুলোই এখনো আমাদের দেশ ও সমাজ পরিচালনা করছে দক্ষতার সঙ্গে। শিক্ষকরা সমাজ সভ্যতার ধারক-বাহক এবং কারিগর। আর এ কারণে সমাজের আর পাঁচ-দশটি পেশা থেকে এটি সম্পূর্ণ আলাদা মর্যাদার দাবি রাখে।
কিন্তু সত্যিকার অর্থে জাতি গঠনের কারিগরদের না আছে সামাজিক-অর্থনৈতিক মর্যাদা, না আছে কোন পরিকল্পিত পৃষ্ঠপোষকতা। স্তরভেদে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এদেশের অধিকাংশ শিক্ষক অর্থনৈতিক দৈন্যতায় দিনাতিপাত করেন। আর তাদের সামাজিক মর্যাদা, সেটা অনেক আগেই সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় আর রাজনৈতিক দেওলিয়াত্বে হাবুডুবু খাচ্ছে। যে সমাজ দায়িত্বের পারস্পারিক সম্পর্ক ও সমঝোতা ভুলে অর্থ, প্রতিপত্তি আর নোংরা রাজনৈতিক চর্চায় আবর্তিত, সেখানে মর্যাদা বা সম্মান দেখানো পুরোটায় আপেক্ষিক আর অধিকারের প্রশ্ন তোলা রীতিমত বেআইনি।
এদেশে কর্তব্য ও দায়িত্ব পালন অথবা অধিকার আদায়ের দাবি রীতিমত ব্যক্তিগত বা দলীয় ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপারে পরিণত হয়েছে এবং ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত চলছে এই নেতিবাচক চর্চার মহোৎসব। বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, বেসরকারি রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত স্কুল জাতীয়করণের দাবিতে শিক্ষকরা ঢাকার রাজপথে নেমেছিলেন, তাদের পাশে এদেশের সুশীল সমাজ, কোন রাজনৈতিক দল বা সরকারের কোন মন্ত্রী-এমপিকে এতটুকু সমবেদনা জানাতে দেখা যায়নি। উল্টো পুলিশের জলকামান আর লাঠি স্তব্ধ করতে চেয়েছে দাবি আদায়ের এসব কণ্ঠকে। আঘাতে শিক্ষকের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে আর দাবির পক্ষে লাশ হয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক।
আমাদের পুলিশ সদস্যরা অথবা এর নির্দেশদাতারা হয়তো ভুলেই গিয়েছিলেন তারাও কোন এক সময়ে এদের হাতেই শিক্ষার হাতে খড়ি নিয়ে ভবিষ্যতের এমপি, মন্ত্রী অথবা পুলিশ হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সে সময়ে পুলিশের আঘাতে নিহত ওই মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষককে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল ‘শিক্ষকের বেত পুলিশের লাঠি’ ও ‘এই বোকা শিক্ষককে নিয়ে আর কিছু লেখার নেই’ শিরোনামে যে দুটি আফসোসসূচক নিবন্ধ লিখেছিলেন, তাতে বর্তমান শিক্ষক সমাজের মর্যাদার এক রুঢ় বাস্তবতা তুলে ধরেন তিনি।
আশার কথা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো জাতীয়করণের ঘোষণা দিলে শিক্ষকসমাজের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের মান বা মর্যাদা কিছুটা হলেও রক্ষা হয়। এটা নতুন কিছু না প্রায়ই খবরের শিরোনাম হয়- অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ে অমুক সংগঠনের হাতে শিক্ষক লাঞ্ছিত। অমুক ভিসি এতঘণ্টা অবরুদ্ধ। পেনশনভাতা উত্তোলন থেকে খুটখাট নানা ঝামেলায় প্রতিনিয়ত নাজেহাল হন জাতি গঠনের কারিগররা।
আমি আমার এক মুক্তিযাদ্ধা স্কুলশিক্ষকের কথা জানি যিনি গত পাঁচ বছরেও অবসর উত্তর টাকা উত্তোলন করতে পারেননি। অথচ তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন এই টাকায় হজ করার। তিনি হয়ত এখনো হজ করতে পারবেন কিন্তু চার বছর আগের খরচ থেকে বর্তমানে তা অনেকগুণ বৃদ্ধি পেলেও তার পেনশনের টাকা কিন্তু বাড়েনি। এ ধরনের অসংখ্য শিক্ষকের মনের অব্যক্ত ব্যথা কতজনের কতটুকুই বা আমরা জানতে পারি বা জানার চেষ্টা করি।
স্কুল-কলেজের বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র আরো ভয়াবহ। বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য থেকে সকল ক্ষেত্রে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ শিক্ষাকে ধ্বংসের দ্বাপ্রান্তে নিয়ে গেছে। একটি জাতির ভবিষ্যত দক্ষ ও যোগ্য নাগরিক তৈরির স্থান যদি এভাবে ধ্বংস হয়ে যায়, তবে এ জাতির ভবিষ্যত কোথায়? অন্তত মৌলিক কিছু জায়গা রাজনৈতিক চর্চার বাইরে রাখা দরকার। রাজনৈতিক বিবেচনায় আর যায় হোক না কেন শিক্ষা, চিকিৎসাসহ কিছু মৌলিক বিষয় না আনার মধ্যে আমাদের ভবিষ্যত কল্যাণ নিহিত।
সামগ্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদা কোথাও আছে বলে মনে হয় না। এছাড়া কম বেতন এবং রাজনৈতিক বিবেচনার কারণে এখন মেধাবী অনেকেই এই মহান পেশায় আসতে বিমুখ। যেখানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তানে আমাদের তুলনায় প্রায় কয়েকগুণ বেশি বেতনসহ শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো সেখানে এই অবস্থায় ক্লাসের সব থেকে মেধাবী ছাত্রটি কেন আসবে শিক্ষকতায়, এই প্রশ্নটি অবান্তর নয়।
সমাজের অন্য পেশা থেকে একটু আলাদা শিক্ষকতা। কোন চাকরির বিধিমালায় সর্বক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণি আবশ্যক নয়, শুধুমাত্র ব্যতিক্রম বিশ্ববিদ্যালয়। সুতরাং এই সুষ্পষ্ট পার্থক্যই যথেষ্ঠ তাদের একটি স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিভিন্ন দেশের বেতনভাতার একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হলো;
বাংলাদেশে সর্বনিম্ন ১১ ও সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা বেতন। একই সময়ে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে সর্বনিম্ন ৬০ হাজার ও সর্বোচ্চ দেড় থেকে ২ লাখ রুপী, পাকিস্তানে সর্বোচ্চ ২.৩ থেকে ৪ লাখ রুপী এবং শ্রীলঙ্কায় সর্বোচ্চ দেড় থেকে ২ লাখ রুপী বেতন পান শিক্ষকরা।
একটি বাস্তব ঘটনা বলার প্রয়োজন মনে করছি। চাকরিতে যোগদানের পর সহকর্মীকে নিয়ে বাজারে মাছ কিনতে গিয়েছিলাম। বিক্রেতা তিনশ’ টাকা প্রতিকেজি বললে আমার সহকর্মী তাকে দাম একটু কম নিতে বলেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে আমাদের দু’জনকে চেনা ওই বিক্রেতা পরিষ্কার জানান- এক পয়সাও কম হবে না। অবাক হতে বেশি সময় লাগেনি। আমরা থাকাকালীন লোকাল থানার এক এসআই আসলেন। দাম জিজ্ঞাসা করতেই পাশের মাছ বিক্রেতা বললেন- থানার সেকেন স্যার, দাম কম রাখ। আড়াইশ’ টাকা কেজি দরে তিনি সবগুলো মাছ পেলেন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণীর আমরা দু’জন ব্যর্থ হলাম বা হতে হলো।
মাঝে মধ্যে ভাবতে কষ্ট হয়, কোন আন্দোলন ছাড়াই এদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো ঘোষণা হয় অথবা দ্বিতীয় শ্রেণীর পদকে প্রথম শ্রেণীতে উন্নত করা হয়। অথচ সেই একই দেশে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের আন্দোলনে লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল আর পিপার স্প্রে মেরে অধিকার বঞ্চিত করা হয়। যখন দেখি কোন আন্দোলন ছাড়াই বিচার বিভাগ, ব্যাংক কর্মকর্তাদের আলাদা এবং মান সম্পন্ন বেতন কাঠামো তৈরি করতে, ঠিক তখনই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এই দাবি আদায়ে রাস্তায় নেমে মানববন্ধন করতে হয়।
রাষ্ট্রের বিভিন্ন দপ্তরের বেতন বা আনান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানে নিঃসন্দেহে শিক্ষক সমাজের কোন আপত্তি থাকার কথা নয়। কারণ ওই সমস্ত দপ্তরে কর্মরত সম্মানিত নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা তো এই শিক্ষক সমাজেরই পরিশ্রম বা সাধনার ফসল। তারা সামাজিকভাবে ভালো থাকলে তার পিতামাতার পর শিক্ষকেরই বেশি খুশি হওয়ার কথা। পাশাপাশি রুঢ় বাস্তবতা হলো- শিক্ষকের সকল প্রকার মান-মর্যাদা নিশ্চিত করা না গেলে সম্রাট আলমগীরের দরবারের শিক্ষকের ভাষায় চির উন্নত শিক্ষাগুরুর শির এভাবে অব্যাহতভাবে অবনত হলে এক সময় এই সমাজের শিরই অবনত হবে, তাতে কোন সন্দেহ নাই।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ভাষা ও যোগাযোগ বিভাগ
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল: zillu1977@yahoo.com
Published in: http://goo.gl/yQEoOs
0 comments:
Post a Comment