Friday, September 18, 2015

শিক্ষানীতি, শিক্ষাভীতি এবং শিক্ষার দুর্গতি

সোহরাব হাসান

২০১০ সালে যখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার মহাসমারোহে নতুন শিক্ষানীতি ঘোষণা করেছিল, তখন কতিপয় মতলববাজ ছাড়া সর্বস্তরের শিক্ষাব্রতী এর প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছিলেন। সবার আশা ছিল, দিনবদলের সরকার শিক্ষাব্যবস্থায়ও আমূল পরিবর্তন আনবে। কিন্তু পাঁচ বছর পর যে আমরা সেই পরিবর্তনের ধারেকাছেও যেতে পারিনি, প্রাথমিক থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে শিক্ষার বেহাল দশাই তার প্রমাণ।

উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছিল, ‘এই শিক্ষানীতি সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশে গণমুখী, সুষম, সর্বজনীন, সুপরিকল্পিত, বিজ্ঞানমনস্ক এবং মানসম্পন্ন শিক্ষাদানে সক্ষম শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ভিত্তি ও রণকৌশল হিসেবে কাজ করবে।’ এখন দেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা চলছে, তা গণমুখী, সুষম, ও সর্বজনীন ধারণার বিপরীত। শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছিল, প্রাথমিক শিক্ষা হবে সর্বজনীন, বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক এবং সবার জন্য এক মানের। এখন প্রাথমিক শিক্ষা চলছে হরেক রকম মানে ও পদ্ধতিতে।

শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছিল, প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করা হবে, যা ১৯৭৪ সালে ঘোষিত কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনেও বিবৃত হয়েছিল। কিন্তু এখন সে ব্যাপারে সরকারের কোনো আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। পাঁচ বছর পর যদি আমরা শিক্ষানীতির দিকে তাকাই, দেখব অষ্টম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা এবং সৃজনশীল প্রশ্নের নামে কাঠামোগত প্রশ্ন তৈরির মধ্যেই এর কর্মযজ্ঞ সীমিত হয়ে পড়েছে।

নতুন শিক্ষানীতিতে মাধ্যমিক শিক্ষাকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করার কথা থাকলেও সে ব্যাপারে অগ্রগতি নেই। গত কয়েক বছরে উচ্চশিক্ষা প্রসারের জন্য নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরিতে সরকার যতটা উদ্গ্রীব ছিল, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার সংস্কারে ততটাই নিষ্ক্রিয় ছিল বলে মনে হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে পঞ্চম শ্রেণিতে সমাপনী পরীক্ষা, অষ্টম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা চালু করে শিক্ষাঙ্গনে সরকার একধরনের চাঞ্চল্য সৃষ্টি করলেও কোচিং ব্যবসা, গাইড বই ও প্রাইভেট টিউশনির দৌরাত্ম্যে তা অনেকটা ম্লান হয়ে পড়েছে। শিক্ষানীতিতে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষা না নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সেই ভর্তিপরীক্ষার মহড়া বন্ধ না হওয়ায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তিনি যথার্থই বলেছেন, শিশুটি যদি পরীক্ষা দেওয়ার মতো যোগ্যতাই অর্জন করে থাকে, তাহলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হবে কেন? ছোট শিশুদের ওপর বইয়ের বোঝা চাপানোর বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ালেও পরিস্থিতির ইতরবিশেষ পরিবর্তন হয়নি। তাদের কাছে শিক্ষা ভীতি হয়ে দেখা দিয়েছে।

এত কিসিমের সরকারি–বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকতেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তিসংকট রয়েছে। সেটি এ কারণে যে আমরা প্রয়োজনীয়সংখ্যক মানসম্পন্ন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। ফলে দু-চারটি ভালো বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা হুমড়ি খেয়ে পড়েন। এর বিকল্প হলো শিশুদের চাহিদা অনুযায়ী প্রতিটি এলাকায় মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করা। সে ক্ষেত্রে এক এলাকার শিশুদের অন্য এলাকায় ভর্তির জন্য ছোটাছুটি করতে হবে না। উত্তরার শিক্ষার্থী কেন ধানমন্ডিতে কিংবা ধানমন্ডির শিক্ষার্থী এত সময় ও ক্লান্তি বয়ে উত্তরায় পড়তে যাবে? নিজ নিজ এলাকায় শিশু শিক্ষার্থীর ভর্তি বাধ্যতামূলক করলে সব এলাকায়ই মানসম্পন্ন বিদ্যালয় গড়ে উঠবে। শিক্ষাকে সরকারি ও বেসরকারি ভাগে ভাগ না করে কমিউনিটি–ভিত্তিক করতে পারলে শিক্ষার মান যেমন বাড়বে, তেমনি ঢাকা শহরের যানজটও কমবে।

বহু বছর আগে লেখক ও সাবেক শিক্ষাসচিব কাজী ফজলুর রহমান, পরবর্তীকালে যিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাও হয়েছিলেন, আক্ষেপ করে বলেছিলেন, বাংলাদেশে শিক্ষার দুর্গতির জন্য সরকারি হস্তক্ষেপ ও রাজনীতিকরণই দায়ী। আগে জেলা শহরগুলোর মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর সুনাম ছিল। এখন সবকিছু আমরা ঢাকায় কেন্দ্রীভূত করে ফেলেছি। শিক্ষাব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলার এটিও অন্যতম কারণ।

সরকার এত দিন শিক্ষানীতির সাফল্য হিসেবে যেগুলোকে বর্ণনা করে আসছিল, সেগুলোই এখন ‘পথের কাঁটা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনৈক বিদেশি শিক্ষাবিদের গবেষণাজাত কাঠামোগত প্রশ্নকে নাম বদলে আমরা সৃজনশীলে রূপান্তর করলেও শিক্ষায় কোনো রূপান্তর হয়নি। তারও অনেক আগে মুখস্থবিদ্যা পরিহারের উদ্দেশ্যে যে নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্নমালা চালু করা হয়েছিল, তাতে শিক্ষার্থীরা পাঠমুখী না হয়ে টিকচিহ্নমুখী হয়েছে। দেড় শ পৃষ্ঠার বই পড়ার স্থলে তারা দেড়-দু শ প্রশ্ন মুখস্থ করেই পরীক্ষাকেন্দ্রে হাজির হয়।

নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন চালুর পরই পরীক্ষায় নকলবাজি, শ্রেণিকক্ষের বাইরে প্রাইভেট টিউশনির প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। হালে পাবলিক পরীক্ষায় নকল কমলেও নতুন উপদ্রব হিসেবে দেখা দিয়েছে প্রশ্নপত্র ফাঁস। সৃজনশীল প্রশ্ন চালুর পাঁচ বছর পর এখন বলা হচ্ছে, বিষয়টি নাকি অনেক শিক্ষকও বুঝতে পারছেন না। শিক্ষকেরা না বুঝলে শিক্ষার্থীদের কী করে বোঝাবেন? সৃজনশীল প্রশ্ন চালু করে কর্তৃপক্ষ যেদিন পরীক্ষকদের উদারভাবে উত্তরপত্র দেখার পরামর্শ দিল, সেদিনই শিক্ষার দুর্গতি পাকাপোক্ত হলো। এখন টোটকা ওষুধে এই ব্যাধি সারবে বলে মনে হয় না।

একটি দেশের শিক্ষার গতি-প্রকৃতি, উন্নয়ন-অবনমন নির্ভর করে সরকার শিক্ষাকে কীভাবে দেখে, তার ওপর। জিপিএ ফাইভ বাড়িয়ে কোনো জাতি শিক্ষায় উন্নতি করতে পারে না; সে জন্য প্রয়োজন জ্ঞান সৃজন ও নিরন্তর জ্ঞানসাধনা। শিক্ষার উন্নতির প্রধান শর্ত মেধাবীদের অধিক সংখ্যায় শিক্ষকতা পেশায় নিয়ে আসা। কিন্তু সেদিকে কোনো সরকার নজর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। সংবিধানে শিক্ষাকে সর্বজনীন বলা হলেও আমরা অর্থজনীন শিক্ষার দিকেই সবাই ঝুঁকে পড়েছি।

২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষানীতিটি আগের সরকারের শিক্ষানীতি থেকে চিন্তা–চেতনায় প্রাগ্রসর ছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু কথায় বলে ‘কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’। শিক্ষানীতিতে যেসব মৌলিক পরিবর্তন আনার কথা ছিল, সেসব আনতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে অথবা শিক্ষানীতি ঘোষণাকেই চূড়ান্ত সাফল্য বলে মনে করে হাত গুটিয়ে বসে আছে। স্বাধীনতার পর এর আগে প্রণীত কোনো শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হয়নি। কোনোটি জনরোষের কবলে পড়ে অক্কা পেয়েছে, কোনোটি নতুন সরকার এসে বাতিল করে দিয়েছে। সেদিক থেকে ২০১০ সালের শিক্ষানীতিটির কপাল ভালো। এটি সবাই মেনেই নেননি, মনে মনে সফলতাও চেয়েছেন।

তবে এ কথা বলাও জরুরি যে, শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের দায়টি শিক্ষামন্ত্রীর একার নয়। শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আমলা, শিক্ষক, লেখক-বুদ্ধিজীবী—সবার। তাঁদের কেউ কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন, তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন? সোজা উত্তর, করেননি। গত পাঁচ বছরে তাঁরা ইতিহাসের সাল, তারিখ ও লেখক তালিকার অদলবদল নিয়ে যতটা মাথা ঘামিয়েছেন, শিক্ষার মৌলিক চ্যালেঞ্জগুলো ততটাই এড়িয়ে গেছেন। উত্তর প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানানোর প্রয়োজন আছে। কিন্তু সেই ইতিহাস জানানোর ভাষাটা কেন আমরা তাদের শেখাতে পারলাম না?

শিক্ষাঙ্গনে সাম্প্রতিক কালে যে অঘটন ঘটে গেল এবং ঘটে চলছে, তা ব্যাধি নয়, ব্যাধির উপসর্গ মাত্র। সরকার যদি মনে করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দাবি মেনে বেতনকাঠামোর সমতা আনলে কিংবা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর ভ্যাট প্রত্যাহার করলেই শিক্ষার সংকট দূর হবে, সেটি মস্ত বড় ভুল হবে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থী বা শিক্ষকদের প্রতি সরকারের ভুল নীতি সংশোধন হতে পারে। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হতে হবে, আমরা কী করেছি, কী করার কথা ছিল, আর কী করতে পারিনি। প্রশ্ন করতে হবে, নতুন শিক্ষানীতি চালু হওয়ার পর আমরা কতগুলো বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি? এই পাঁচ বছরে দেশ কত লাখ দক্ষ জনশক্তি এবং কত হাজার বিশেষজ্ঞ তৈরি করতে পেরেছে?

একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে আশা করি। বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে যেসব বিদেশি কাজ করেন, বেতন বাবদ প্রতিবছর তাঁরা ৩২ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ অর্থ নিয়ে যান। বাংলাদেশের ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাজেটের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসাবমতে এটি বাজেটের ৯ শতাংশ। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সিইও বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তৈরি করছে ভারত। আমাদের কয়েক শ অদক্ষ শ্রমিক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে অর্থ উপার্জন করেন, বাংলাদেশে অবস্থানরত একজন বিদেশি তার থেকে অনেক বেশি আয় করেন। এর পেছনে আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেই, আছে শিক্ষা।

লেখক-শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লিখেছেন, শিক্ষা নিয়ে এক দিন নয়, সারা বছরই আমাদের ভাবতে হবে। প্রকৃত সত্য হলো শিক্ষা নিয়ে আমরা বছরে একটি দিনও ভাবি না। ভাবি শিক্ষাঙ্গনের অস্থিরতা নিয়ে, ভাবি ক্যাম্পাসের দখলদারি নিয়ে, ভাবি উপাচার্য-শিক্ষক দ্বন্দ্বের নিরসন কীভাবে ঘটানো যায়, সেটি নিয়ে। অথবা আমরা শিক্ষায় ভ্যাট আরোপের যৌক্তিকতা নিয়ে তর্কে মাতি। কিন্তু সরকারি বা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান পরিমাপ করে দেখি না। উন্নত দেশগুলোর কথা বাদই দিলাম, প্রতিবেশী ভারত বা শ্রীলঙ্কা থেকে শিক্ষায় আমরা কতটা পিছিয়ে আছি, তা–ও তলিয়ে দেখছি না।

শিক্ষার বেহাল দশা দেখে রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত উক্তির কথাই মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা বিশ্বাস করি, তাহা পালন করি না; ভুঁড়ির পরিমাণ বাক্য রচনা করিতে পারি, তিল পরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না;...আমরা সকল কাজেই পরের প্রত্যাশা করি, অথচ পরের ত্রুটি লইয়া আকাশ বিদীর্ণ করিতে থাকি; পরের অনুকরণে আমাদের গর্ব, পরের অনুগ্রহে আমাদের সম্মান, পরের চক্ষে ধূলিনিক্ষেপ করিয়া আমাদের পলিটিক্স এবং নিজের বাকচাতুর্যে নিজের প্রতি ভক্তিবিহ্বল হইয়া উঠাই আমাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য।’

অতএব, শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমাদের আরও গভীরভাবে ভাবা উচিত।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।

Published in: http://www.prothom-alo.com/opinion/article/635398

0 comments:

Post a Comment