Wednesday, September 9, 2015

মাননীয় অর্থমন্ত্রী, পাইকারী মন্তব্য করবেননা!

Rahman Nasir Uddin 

অষ্টম বেতন কাঠামো নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অসন্তোষ এবং চলমান আন্দোলন নিয়ে অর্থমন্ত্রী যেভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তাতে অত্যন্ত বাজেভাবে ক্ষমতার দাম্ভিকতা এবং ঔদ্ধত্যের শারীরীক বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। উনি যেভাবে কথা বলেছেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক হিসাবে অত্যন্ত অপমান বোধ করেছি। তিনি যা বলেছেন, তাতেই উনার জ্ঞানের দৌঁড় কতোটা পাতলা প্রকারান্তরে সেটাই প্রকাশিত হয়েছে। উনার বক্তব্য থেকেই বোঝা যায়, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে উনার ন্যূনতম কোন ধারণাই নাই। তাই বলি, মাননীয় অর্থমন্ত্রী, অন্যকে জ্ঞান দেবার আগে নিজের জ্ঞানটুকু একটু পরখ করে নেবেন। বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না-নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলবেননা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আপনার চাকুরী করেননা। তাই, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে আপনার অধিনস্ত কর্মচারী মনে করবেননা। কথা বলার সময় মেহেরবানী করে এ বাণীটুকু মনে রাখবেন। 

  
আবুল মাল আ. মুহিতআবুল মাল আ. মুহিত

বহু সার্কাসের পরে অষ্টম বেতন কাঠামো মন্ত্রীসভায় অনুমোদিত হয়েছে। বাংলাদেশের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র যেভাবে চেয়েছে সেভাবেই বেতন কাঠামো ঘোষিত হয়েছে। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো নিয়ে নিজেদের অসন্তোষ জানিয়ে নানান প্রতীকি কর্মসূচির মাধ্যমে বিগত তিন বা সাড়ে তিনমাস ধরে কিছু সুনির্দিষ্ট দাবিদাওয়া পেশ করে আসছিলেন, সেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আশা করেছিলেন যে, প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোকে কিছুটা সংশোধন করে তাঁদের দাবি দাওয়ার প্রতিফলন ঘটানো হবে। কিন্তু সেটা হয়নি। বরঞ্চ তাঁদের বেতনগ্রেড দুই ধাপ নিচে নামানোর পাশাপাশি সিলেকশান গ্রেড তুলে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নূন্যতম মর্যাদাটুকুও কেড়ে নেয়া হয়েছে। ফলে, স্বাভাবিক কারণেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী আজকে (০৮/০৯/২০১৫) কর্মবিরতি পালন করা হয়েছে। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় অর্থমন্ত্রী যেভাবে বললেন, ‘দেশের সবচেয়ে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী জ্ঞানের অভাবে আন্দোলন করছেন।‌’ প্রথমে আমার হাসি পেয়েছে; পরে ভেতরে গভীর ক্ষত তৈরী হয়েছে। পৃথিবীর সব সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনকারী, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাকারী বাংলাদেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বৃহৎ অংশটি এখনও বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকতা করেন। আর তাঁদের জ্ঞানের এতই অভাব পড়েছে যে, অষ্টম বেতন কাঠামোতে তাঁদের অবস্থানকে কোথায় রাখা হয়েছে সেটা তাঁরা বুঝতে পারছেননা। কেবল অর্থমন্ত্রীই বুঝতে পারছেন! তিনি নিজেকে এতো জ্ঞানী কীসের ভারে (!) মনে করেন আমি বুঝিনা। মাননীয় অর্থমন্ত্রী কথাবার্তা সাবধানে বলবেন। ক্ষমতায় গেলে ধরাকে সরা জ্ঞান করা আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরিত্র আমাদের জানা আছে। আপনার মতো সব সরকারের আমলে কীভাবে মধু খেতে হয়, সে জ্ঞান হয়তো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকের না-থাকতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানের অভাব কখনও পড়েনি। এখনও এদেশের জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার মূলকেন্দ্র হচ্ছে এসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই।

তিনি আরো বললেন, ‘আমার জানা নেই, কোথায় তাঁদের মর্যাদার হানি হয়েছে।’ যদি আপনার জানা না-থাকে সেটা আপনার অজ্ঞানতা। তাছাড়া আপনি এতো সহজে কেন ভুলে গেলেন যে, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ যখন আপনার সাথে দেখা করে তাঁদের দাবিদাওয়া আপনাকে বুঝিয়ে বলেছিলেন, তখন আপনিই বলেছিলেন, আপনি তাঁদের দাবিদাওয়ার সাথে একমত কিন্তু এটা মানার ব্যাপারে কোন কথা দিতে পারবেননা। আর এখন বোল পাল্টে বলে দিলেন আপনি বুঝতে পারছেননা। আপনি ‘অবুঝ’ হতে পারেন; তবে আপনার এ-অবুঝত্বের কারণ কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ঠিকই বুঝেন! তিনি আরো বললেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের করাপ্ট প্র্যাকটিস নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার।’ এ ‘করাপ্ট প্র্যাকটিস’ শব্দটি অত্যন্ত আপত্তিজনক। আপনি যদি মিন করে থাকেন ‘অনিয়ম’, তাহলে সে বিষয়ে খুব আপত্তির কিছু থাকবে না। কেননা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রমোশন বা আপগ্রেডেশনে কিছু অনিয়ম হয়, এটা সবাই জানে। কিন্তু সেটার পেছনেও আপনাদেরদের মতো রাজনীতিবিদদের বেপরোয়া নাক-গলানোই যে প্রধানত দায়ি, সেটাকেও অস্বীকার করা যাবেনা। তাছাড়া আপনারাইতো রাজনৈতিক বিবেচনায়, দলীয় লেজুড়বৃত্তির দৌঁড়ে যারা এগিয়ে থাকেন, তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিচালনার দায়িত্ব দেন। আর তাদের দিয়ে আপনাদের অবৈধ আবদার আদায় করে নেন বলেই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়। কাজেই, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব অনিয়ম হয়, তার দায়দায়িত্ব আপনাকে এবংআপনার মতো রাজনৈতিক নেতৃত্বকেও নিতে হবে। সুতরাং হঠাৎ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষকদের নিয়ে গণ-মন্তব্য করার আগে নিজেদের আমলনামাটা একটু দেখে নেয়াটাই ‘জ্ঞানী’র কাজ হবে।

অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, ‘প্রত্যেকেই এখানে সহজেই অধ্যাপক হয়ে যান। সহযোগী অধ্যাপকদের তাঁরা খেয়াল খুশিমতো পদোন্নতি দেন।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদোন্নতির নীতিমালা সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান থাকলে আপনি এরকম মন্তব্য করতেন না। প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পদোন্নতির নিজস্ব নীতিমালা আছে। এবং প্রমোশন দেয়ার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ বোর্ড থাকে সেখানে সরকার কতৃক নিয়োগকৃত বিষেশজ্ঞরাও থাকেন(চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও আছে)। স্ব স্ব বিভাগের পরিকল্পনা কমিটির সুপারিশ এবং বিশেষজ্ঞ কমিটির মতামতের ভিত্তিতে একজন সহযোগী অধ্যাপক তার শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা, বিদেশী ডিগ্রী, পর্যাপ্ত গবেষণা-প্রবন্ধ নিয়েই অধ্যাপক পদে প্রমোশন পান। আর কিছু অনিয়ম যদি হয়েই থাকে, সেটাও হয় আপনাদের মতো কিছু রাজনীতিবিদদের অবৈধ না-গলানোর কারণে। নিয়মবহির্ভুত সুপারিশের কারণে। সুতরাং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে পাইকারী মন্তব্য করার আগে এগুলো সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করা উচিত বলে আমি মনে করি। তিনি আরো বলেন, ‘দেখা গেছে, নিচে ১০ জন প্রভাষক; কিন্তু ওপরে এক হাজার অধ্যাপক। এটা কিছু হলো? শুধু ওপরে পদোন্নতি হবে, এটা ঠিক না।’ এ-ধরনের কথা বলার আগে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা সংক্রান্ত ১৯৭৩-এর এ্যাক্টটি ভালো করে একবার পড়ার অনুরোধ করছি। আপনার এ-বাক্যটিই যথেষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে আপনার অজ্ঞানতা উপলব্ধির জন্য। এ-বিষয়ে সত্যিকার অর্থে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। তবে, অর্থমন্ত্রীর যে কথাটি খুবই আপত্তিজনক সেটি হচ্ছে, ‘আমলাতন্ত্রকে আমরা যেভাবে ম্যানেজ (পরিচালনা) করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফদেরও সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করব।’ পাবলিক বিশ্ববিদ্যলয়গুলো মগের মুল্লুক নয়। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আপনার অধিনস্ত কোন কর্মচারীও নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আর সরকারী আমলা যে এক নয়, এসামান্য জ্ঞানটুকু যার নাই, তিনি যখন অন্যকে জ্ঞান দেন তখন সেটা তামাসায় রূপ নেয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়িত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। এখানে বেপরোয়া না-গলানোর বৃথা চেষ্টা করবেননা্। ১৯৭৩ এ্যাক্ট পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে (বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে) নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়ার ক্ষমতা দিয়েছে। আলগা লোকের নাগ-গলানোকে প্রতিহত করার নজির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে। ইতিহাস একটু পাঠ করে নিলে ভালো হয়। আর যাকে ‘সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়’ বলে কতৃত্ব দেখাচ্ছেন, আপনার জ্ঞাতার্তে জানাচ্ছি যে, এগুলো সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় নয়; পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। পাবলিকের বিশ্ববিদ্যালয়। জনগণের বিশ্ববিদ্যালয়। জনগণের টাকায় চলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়। আর সত্যিকার অর্থে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এই জনগণের কাছেই দায়বদ্ধ। তাই, নিজের জ্ঞানের সীমাহীন সীমাবদ্ধতা নিয়ে অন্যকে জ্ঞানহীন বলাটাও এক ধরনের অজ্ঞানতার লক্ষণ। পরিশেষে অনুরোধ করবো, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে পাইকারী মন্তব্য করার আগে নিজের জ্ঞানের পরিধিটা একটু মাপঝোঁক করে নিয়েন। এতেই সকলের মঙ্গল।  

অধ্যাপক, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
লালখান বাজার, চট্টগ্রাম
আট. নয়. পনের


0 comments:

Post a Comment