পাঁচ বছর আগে প্রণয়ন করা জাতীয় শিক্ষানীতিতে সব স্তরের শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতনকাঠামো করার কথা বলা হলেও সরকার সেটি করেনি। এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগও নেই। আলাদা বেতনকাঠামোর দাবিতে এখন দেশের সব সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আন্দোলন করছেন।
প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজ থেকে শুরু করে শিক্ষার অন্য স্তরেও পৃথক বেতনকাঠামো শিক্ষকদের অন্যতম দাবিতে পরিণত হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকদের পৃথক বেতন স্কেল দেওয়ার আশ্বাস দেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ লক্ষ্যে বছর দুয়েক আগে একটি বেতন কমিশন গঠনের আলোচনা শুরু করলেও তা আর এগোয়নি।
শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করছেন, শিক্ষানীতির খণ্ডিত বাস্তবায়ন ও শিক্ষা আইন প্রণয়নে অস্বাভাবিক ধীরগতি এবং জাতীয় বেতন স্কেলে জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে শিক্ষকদের বৈষম্য দেখা দেওয়ায় নতুন করে অস্থিরতা শুরু হয়। শিক্ষকদের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন ও পদমর্যাদায় দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে, যা নিরসনে শিক্ষকেরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।
অষ্টম বেতন স্কেল ঘোষণার পর অধিকাংশ শিক্ষক তা মেনে নিতে পারছেন না। তাঁরা বেতন বৈষম্যের অভিযোগ তুলেছেন। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বেতন বৈষম্যের পাশাপাশি মর্যাদার প্রশ্নেও ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতনকাঠামো হওয়া জরুরি। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে শিক্ষকদের বেতন অনেক বেশি। এ দেশেও শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো উচিত।
বেতন বৈষম্য নিরসন-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি গতকাল বুধবার পুনর্গঠন করা হয়েছে। মন্ত্রিসভা এই কমিটিকে বেতন বৈষম্যের বিষয়টি পর্যালোচনা করার দায়িত্ব দিয়েছে। শিক্ষকেরা মনে করছেন, এই কমিটির কাছে পর্যালোচনার জন্য পাঠানোর অর্থ হচ্ছে, তাঁদের দাবি যৌক্তিক।
এদিকে শিক্ষানীতির কার্যকর বাস্তবায়নে শিক্ষা আইন প্রণয়নের বিষয়টি প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে ঘুরছে। এই আইন প্রণয়ন না হওয়ায় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের বিষয়টিও অনেকটা ঐচ্ছিক হয়ে পড়েছে। আইনি বাধ্যবাধকতা ছাড়া এই নীতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এ রকম পরিস্থিতির মধ্যে আজ বৃহস্পতিবার পালিত হচ্ছে শিক্ষা দিবস। ১৯৬২ সালে তৎকালীন সরকারের করা শিক্ষানীতির প্রতিবাদে আন্দোলন করতে গিয়ে কয়েকজন ছাত্র মারা যান। তখন থেকে শিক্ষক ও ছাত্রসংগঠনগুলো দিবসটি পালন করে আসছে। তবে সরকারিভাবে কোনো কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে না। ছাত্রসংগঠনগুলো শিক্ষা ভবনের সামনে শিক্ষা অধিকার চত্বরে শ্রদ্ধা নিবেদনসহ কিছু কর্মসূচি পালন করবে।
স্বাধীনতার পর বেশ কয়েকবার জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও কোনোটিই শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। এর আগের সরকারগুলো শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে চূড়ান্ত বা বাস্তবায়ন শুরুর আগেই ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। সে ক্ষেত্রে ২০১০ সালের শিক্ষানীতিটি বাস্তবায়নে লম্বা সময় পেয়েছে সরকার।
জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, প্রাথমিক স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহী এবং সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সব শিক্ষকের মর্যাদার বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনা করে পুনর্বিন্যাস করা হবে, যাতে তাঁরা যথাযথ মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা পেতে পারেন। একই সঙ্গে শিক্ষকদের অধিকারের সঙ্গে তাঁদের দায়িত্বের সামঞ্জস্য থাকতে হবে।
এতে আরও বলা হয়, শিক্ষকদের প্রকৃত অর্থে সামাজিক মর্যাদা দেওয়া না হলে শিক্ষার মানোন্নয়ন করা সম্ভব নয়। আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সব স্তরের শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতনকাঠামো প্রণয়ন করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী শিক্ষকদের জন্য বেতনকাঠামো হয়ে গেলে এখন এ ঝামেলা হতো না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের আন্দোলনের সাম্প্রতিক ঘটনার উদাহরণ টেনে রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, শিক্ষানীতিতে স্থায়ী শিক্ষা কমিশনের কথা বলা হয়েছিল। সেটি করা গেলে আগেই দিকনির্দেশনা দেওয়া যেত।
২০০৯ সালের ৮ এপ্রিল শিক্ষানীতি কমিটি গঠন করা হয়। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে কমিটি সরকারের কাছে সুপারিশ দেয়। এর ওপর ভিত্তি করে ২০১০ সালের মে মাসে মন্ত্রিসভায় জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০১০ অনুমোদন পায়। জাতীয় সংসদেও সেটি গৃহীত হয়। কিন্তু শিক্ষানীতি অনুযায়ী পৃথক বেতনকাঠামোর দাবি শিক্ষক সংগঠনগুলোও সেভাবে তুলে ধরেনি। সম্প্রতি জাতীয় বেতন স্কেল ঘোষণার পর বিষয়টি সামনে এসেছে।
বিশেষ করে সিলেকশন গ্রেড বাতিল হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সর্বোচ্চ ধাপে (গ্রেড-১) যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়। দ্বিতীয় গ্রেডের পর তাঁদের বেতন বাড়লেও প্রথম গ্রেডে তাঁরা যেতে পারবেন না। এ ছাড়া নিয়মিত ২০টি গ্রেডের বাইরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্য সচিব এবং জ্যেষ্ঠ সচিবদের জন্য দুটি বিশেষ গ্রেড থাকায় অধ্যাপকদের মর্যাদা আগের তুলনায় কমবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব এ এস এম মাকসুদ কামাল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরাও শিক্ষানীতি অনুযায়ী পৃথক বেতনকাঠামোর দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তাঁর মতে, শিক্ষানীতি অনুযায়ী যদি শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতনকাঠামো হয়ে যেত, তাহলে আজকের এই সংকট তৈরি হতো না।
আইন নিয়ে টানাটানি: শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষা আইন অপরিহার্য হলেও সাড়ে চার বছর ধরে এ আইনের খসড়া নিয়েই শুধু টানাটানি হচ্ছে, কোনো কিছুই চূড়ান্ত হচ্ছে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, নীতি বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক নয়। এর জন্য আইনের প্রয়োজন হয়। কিন্তু আইনটি করতে দেরি হওয়ায় শিক্ষানীতির অনেক বিষয় বাস্তবায়িত হচ্ছে না।
মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, ২০১১ সালে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের জন্য কয়েকটি উপকমিটি করা হয়েছিল। এর মধ্যে শিক্ষা আইন করার জন্যও একটি কমিটি করা হয়। কিন্তু সাড়ে চার বছর হয়ে গেলেও আইনের খসড়া চূড়ান্ত হয়নি।
রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, আইন ছাড়া অনেক কিছুই বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। অথচ আইনের শুধু খসড়ার পর খসড়াই হচ্ছে, চূড়ান্ত রূপ দেখা যাচ্ছে না।
শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খান অবশ্য প্রথম আলোকে বলেছেন, শিক্ষানীতির অনেক বিষয় বাস্তবায়িত হয়েছে। কিছু কাজ বাস্তবায়নের জন্য প্রক্রিয়াধীন আছে। শিক্ষা আইনটিও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানান তিনি।
Published in: http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/634240/
0 comments:
Post a Comment