বর্তমান পদ্ধতিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতার সর্বোচ্চ পদ হল সিলেকশন গ্রেড-অধ্যাপক। প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজস্ব অধ্যাপকদের মধ্য থেকে শুধু শতকরা ২৫ ভাগ সিনিয়র অধ্যাপক সিলেকশন গ্রেড পান। দেশ-বিদেশের সর্বোচ্চ একাডেমিক ডিগ্রিধারী একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপক-প্রারম্ভিক (৭ম স্কেলের গ্রেড-৩) এবং অধ্যাপক-মধ্যম (৭ম স্কেলের গ্রেড-২) পদ পেরিয়ে তার শিক্ষকতা জীবনের শেষ ধাপে এসে প্রায় ৫৮-৬০ বছর বয়সে এই সিলেকশন গ্রেড-অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেয়ে থাকেন। অপরদিকে, সিভিলিয়ান সরকারি কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ পদ হল সচিব বা সমমর্যাদার অন্যান্য পদ। বিগত সপ্তম জাতীয় পে-স্কেলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেকশন গ্রেড-অধ্যাপক এবং সরকারি সচিব বা সমমর্যাদার কর্মকর্তা সবাই জাতীয় পে-স্কেলের শীর্ষ গ্রেড অর্থাৎ গ্রেড-১-এর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এতে সিভিলিয়ানদের শীর্ষ পদগুলোয় এক ধরনের সমতা বিরাজমান ছিল, যদিও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধায় সচিবরা সিলেকশন গ্রেড-অধ্যাপকদের তুলনায় অনেক এগিয়ে ছিলেন।
অথচ অষ্টম পে-স্কেলে বিরাজমান সমতা ভঙ্গ করে এবং এ দেশের সংবিধানের মূল স্পিরিট- সমপর্যায়ে সাম্য ও সমতার বিপরীতে কৌশলে সরকারি কর্মকর্তাদের শীর্ষস্থানীয় পদের জন্য তৈরি করা হল জাতীয়-গ্রেডবহির্ভূত উচ্চতর সুপার-গ্রেড। অর্থাৎ সরকারি কর্মকর্তাদের শীর্ষস্থানীয় পদকে এক ধাপ আপগ্রেড করা হল। অপরদিকে, সিলেকশন গ্রেড বিলুপ্ত করাসহ টাইমস্কেল বাদ দিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের শীর্ষস্থানীয় পদকে গ্রেড-১ থেকে মর্যাদাহানি করে অন্যায্যভাবে পৌঁছে দেয়া হল জাতীয় গ্রেড-৩/গ্রেড-২ তে। এতে সরকারি কর্মকর্তাদের শীর্ষপদ থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সর্বোচ্চ পদ পিছিয়ে পড়ে ৩/৪ ধাপ। এর মাধ্যমে অসম্মান করা হল এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকতা পেশাকে।
এ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার পেছনে রয়েছে একটি সুপরিকল্পিত কৌশল ও চক্রান্ত। অষ্টম জাতীয় পে-কমিশন এ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ন্যায্য অধিকার নির্ধারণ ও প্রস্তাবনাতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ। আর এর পেছনে যে সরকারি শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের এক ধরনের প্রভাব-ভূমিকা রয়েছে, তা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় সচিব কমিটির চরম বৈষম্যমূলক পর্যালোচনা প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে। অতএব রাষ্ট্রের জন্য সহনশীল ও বাস্তবসম্মতভাবে শিক্ষকদের পেশাগত বেতন-ভাতা নির্ধারণের দায়িত্ব এ দেশের শিক্ষক প্রতিনিধিদের হাতেই ন্যস্ত করা আজ সময়ের এক অপরিহার্য দাবিতে পরিণত হয়েছে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সর্বোচ্চ সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। রাষ্ট্রের আলোকিত-দক্ষ মানবসম্পদ গঠনে তারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকেন। তাদের পেশাগত ত্র“টি-বিচ্যুতি থাকতেই পারে, যেমনটি রয়েছে অন্যান্য সব পেশায়। কাজেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অধিকার রক্ষা করার দায়িত্ব সরাসরিভাবে রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকারের ওপরই বর্তায়। সব বৈষম্য নিরসনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দ্রুত হস্তক্ষেপ শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট সবার কাম্য। উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা গতিশীল রাখতে নতুন পে-স্কেলের প্রধান বৈষম্যগুলো ত্বরিত গতিতে দূর করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। কারণ নতুন পে-স্কেলের বৈষম্যের মাধ্যমে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বিশেষ করে বর্তমানের তরুণ/মধ্যবয়সী শিক্ষকদের কর্মস্পৃহা ধ্বংস হবে। এটা স্পষ্ট যে নতুন এই পে-স্কেল সম্পূর্ণভাবে শিক্ষকদের ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হলে, তরুণ/মধ্যবয়সী শিক্ষকরা ভবিষ্যতে তাদের সমসাময়িক সরকারি কর্মকর্তাদের তুলনায় অন্তত দুই গ্রেডে পিছিয়ে যাবে। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়টি এই যে, নতুন পে-স্কেল অনুসারে, দেশ-বিদেশের সর্বোচ্চ একাডেমিক ডিগ্রিধারী এ দেশের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের পেশাগত দক্ষতা/প্রোফাইল যত ভালোই হোক না কেন, সে তার শিক্ষকতা জীবনের শেষ পর্যায়ে এসেও এ দেশের সিভিলিয়ান কর্মকর্তাদের পেশাগত সর্বোচ্চ পদ অর্থাৎ নতুন করে তৈরি হওয়া জাতীয়-গ্রেডবহির্ভূত সুপার-গ্রেডে পদায়িত হতে পারবে না। যে পদে কিনা তার চেয়ে নিু ডিগ্রিধারী, মেধাসম্পন্ন ও কর্মদক্ষ একজন সরকারি আমলা অধিষ্ঠিত/পদায়িত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। এ দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হতে এর চেয়ে বেশি আর কি প্রয়োজন রয়েছে? সরকারের শিক্ষা নীতিনির্ধারকদের প্রতি এটাই সবিনয় জিজ্ঞাসা।
উচ্চশিক্ষার স্বার্থে, একজন তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হিসেবে এ দেশের শিক্ষাবান্ধব প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের ন্যায্য চাওয়া উপস্থাপন করার যথার্থ প্রয়োজন রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি আমাদের পেশাগত সব ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করুন। আমরা আমাদের মেধা ও দক্ষতার সবটাই দেশের ভিত্তি আরও সুদৃঢ়করণে প্রয়োগ করব। উচ্চশিক্ষার উৎকর্ষ সাধন ও প্রকৃত মানবসম্পদ সৃষ্টি এবং প্রয়োজনে আমাদের নিজস্ব দক্ষতা বৃদ্ধিতে গঠনমূলক সব প্রস্তাব ও পরামর্শ গ্রহণ করব। পাশাপাশি এ দেশের সংবিধানের মূল স্পিরিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, বিশেষ শ্রেণীর জন্য নতুন করে তৈরি করা বৈষম্যমূলক সুপার গ্রেড বিলুপ্ত করুন। আর বৈষম্যমূলক এই সুপার গ্রেড যদি রাখতেই হয়, তবে সব ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদেরও অন্তর্ভুক্ত করুন; যোগ্যতা হিসেবে যৌক্তিক যে কোনো মানদণ্ডই নির্ধারণ করা হোক না কেন এ দেশের তরুণ/মধ্যবয়সী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা তা চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করতে সদাপ্রস্তুত। শিক্ষা, মেধা ও দক্ষতা কোনো মানদণ্ডেই আমরা ভীত নই, আমরা আমাদের অর্জন/যোগ্যতা দিয়েই সুপার গ্রেডে পদায়িত হব, ইনশাআল্লাহ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মহান পেশাকে তার সঠিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা আজ আমাদের সবার পেশাগত ও নৈতিক কর্তব্যে পরিণত হয়েছে। এখানে মনে রাখা দরকার, আমাদের বিন্দুমাত্র ব্যর্থতা পরবর্তী সব প্রজন্মের কাছে একেবারেই অমার্জনীয় হয়ে থাকবে।
ড. মোঃ ইকবাল হোসেন : সহকারী অধ্যাপক, কেমিকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
iqbalhossain@che.buet.ac.bd
Published in: http://www.jugantor.com/sub-editorial/2015/09/12/322551
0 comments:
Post a Comment