সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রতীক বর্ধন
ভ্যাট বাতিলের দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। অন্যদিকে বেতনবৈষম্য দূর করার দাবিতে আন্দোলন করছেন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। শিক্ষকদের আন্দোলন প্রসঙ্গে বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
প্রথম আলো : বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মূল দাবি কী?
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : আমাদের মূল দাবি হচ্ছে স্বতন্ত্র বেতন স্কেল। আমরা অন্য কোনো ক্যাডারের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করতে চাই না। কিন্তু এবারের অষ্টম পে-স্কেলে আমাদের মর্যাদার অবনমন করা হয়েছে, যেটা অত্যন্ত দুঃখজনক। সপ্তম পে-স্কেলে একজন শিক্ষক অধ্যাপক পদে উন্নীত হওয়ার পর তৃতীয় গ্রেডে তাঁর মূল বেতন হতো ২৯ হাজার টাকা, যেখানে সচিবদের মূল বেতন ছিল ৪০ হাজার টাকা। এরপর সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল পেয়ে তাঁদের মূল বেতন ৩৯ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত উঠত। কিন্তু এই সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল উঠিয়ে দেওয়া এবং আগামী দিনে আর পে-স্কেল করা হবে না—এমন ঘোষণা দেওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আর সে জায়গায় যেতেই পারবেন না। অর্থাৎ সচিবদের সঙ্গে অধ্যাপকদের বৈষম্য আগে থেকেই ছিল, কিন্তু সপ্তম পে-স্কেলে সিলেকশন গ্রেড থাকার কারণে কিছুটা প্রতিকার পাওয়া যেত, কিন্তু এখন আর সে সুযোগ রইল না। এটা কাম্য নয়। ফলে অন্য কারও সঙ্গে যেন প্রতিযোগিতায় যেতে না হয়, সে কারণেই আমরা স্বতন্ত্র স্কেল দাবি করছি।
প্রথম আলো : সিলেকশন গ্রেড তো আবার সবাই পেতেন না?
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : না, সিলেকশন গ্রেড সবাই পেতেন না। বয়সের কারণে অনেকেই তা পাওয়ার আগে অবসরে চলে যেতেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য এই কিছুদিন আগে সিলেকশন গ্রেড পেয়েছেন, এর ফলে সপ্তম পে-স্কেলে তাঁর মূল বেতন সচিবদের সমান ৪০ হাজার টাকা হয়েছে।
প্রথম আলো : তাহলে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল কি বৈষম্যমূলক ব্যাপার ছিল না? আর এখন নির্দিষ্ট হারে ইনক্রিমেন্টের হার নির্ধারণ করার কারণে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল?
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : সিলেকশন গ্রেড পাওয়ার জন্য কিছু মানদণ্ড ছিল: ২০ বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা আর অধ্যাপক হিসেবে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা। আবার শেষ ধাপে এসে এক বছর অপেক্ষা করতে হতো। ২৫ শতাংশ অধ্যাপক সেটা অর্জন করতেন। আবার এসব মানদণ্ড পূরণ করার পরেও যে-কেউ সিলেকশন গ্রেড পাবেন, তারও নিশ্চয়তা ছিল না।। তবে এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় খুশিই ছিল। এটা বৈষম্যমূলক ছিল কি ছিল না, সে ব্যাপারে আমি কিছু বলব না। ইনক্রিমেন্টের হার নির্ধারণ করে দেওয়ার কারণে বেতন বাড়বে, কিন্তু এই সিলেকশন গ্রেড অবলুপ্ত করার কারণে শিক্ষকেরা অন্য কোথাও যেতে পারবেন না। অর্থাৎ স্রেফ শিক্ষক হিসেবেই তাঁদের জীবনপাত করতে হবে।
প্রথম আলো : সিনিয়র সচিব পদ সৃষ্টি ও মন্ত্রিপরিষদ/মুখ্য সচিবকে আলাদা স্কেল দেওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের অবস্থান কী দাঁড়াল?
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : সে কথা যদি বলেন, তাহলে বলতে হয়, আমাদের অবস্থান এখন পঞ্চম। প্রথমে মুখ্য সচিব/মন্ত্রিপরিষদ সচিব, দ্বিতীয় অবস্থানে সিনিয়র সচিব, এরপর প্রথম গ্রেড, দ্বিতীয় গ্রেড ও তারপর তৃতীয় গ্রেড, আমরা অধ্যাপকেরা এই তৃতীয় গ্রেডভুক্ত। অর্থাৎ আমরা এখন পঞ্চম স্থানে চলে গিয়েছি। আর সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল অবলুপ্ত করার কারণে আমাদের মর্যাদা ও বেতন বৃদ্ধির কোনো সুযোগ আর রইল না। আগে শুধু মুখ্য ও মন্ত্রিপরিষদ সচিবেরা পাঁচ হাজার টাকা ভাতা পেতেন। এখন থেকে অধ্যাপকদের চাকরি তৃতীয় গ্রেড থেকে শুরু হবে, আর শেষও হবে সেখানে।
প্রথম আলো : এর কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর কী প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন?
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। ধারণা করি, এর ফলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আসতে চাইবেন না। যে পেশায় মর্যাদা ও বেতন বেশি, মেধাবীরা সাধারণত সে পেশাতেই যেতে চান। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রভাষককে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অধ্যাপক হতে হয়। তাঁকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চাকরি করতে হয়, পাশাপাশি তাঁর অন্তত ১৭টি প্রকাশনা থাকতে হয়। ফলে এত কিছু করার পর যদি তাঁর অবস্থান সচিবদের নিচে হয়, তাহলে তিনি কেন এই পেশায় আসতে চাইবেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় মেধাশূন্য হয়ে যাবে। এমনিতেই মেধাবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় এখন আসতে চান না, এর ফলে এখন আরও আসতে চাইবেন না। এর ফল জাতির জন্য ভালো হবে না।
প্রথম আলো : তাহলে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে আপনাদের অবস্থা কী দাঁড়াল?
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : সপ্তম পে-স্কেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অবস্থান ছিল ১৭তম, আর সচিবদের অবস্থান ছিল ১৬তম। যে অধ্যাপকেরা সিলেকশন গ্রেড পেতেন, তাঁদের অবস্থান ছিল ১৯তম, আর যাঁরা তা পেতেন না, তাঁদের অবস্থান ছিল ২২তম। আর এখন আমাদের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটা বলা মুশকিল।
প্রথম আলো : বিশ্বের আর কোন দেশে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র পে-স্কেল আছে?
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ l আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র পে-স্কেল আছে, আরও অনেক দেশেই আছে। সেখানকার শিক্ষকেরা আমাদের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেতন পান। আবারও বলছি, আমরা কারও সঙ্গে নিজেদের তুলনা করতে চাই না, নিজেদের মতো করে থাকতে চাই, পড়াশোনা ও গবেষণায় মনোনিবেশ করতে চাই। আর তার জন্য স্বতন্ত্র পে-স্কেল হওয়া জরুরি।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ : আপনাকেও ধন্যবাদ।
0 comments:
Post a Comment