অপূর্ব অনির্বাণ
একটা দেশ কতটা মর্যাদার আসনে আসীন তা বিবেচিত হয় সে দেশ তার দেশ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের কীভাবে এবং কতটুকু মর্যাদা দেয় তার ওপর। আবার একটা দেশ কতটুকু অগ্রসর তা নিরূপিত হয় তার শিক্ষাব্যবস্থায় জিডিপির কতটুকু ব্যয় করা হয়, তা দিয়ে। কেননা শিক্ষিত-সচেতন জাতি উন্নত দেশ গড়ার মূল চালিকাশক্তি। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে রাষ্ট্র বা সরকারের ব্যয়কে শুধু ব্যয় হিসেবে বিবেচনা না করে বিবেচনা করা হয় বিনিয়োগ হিসেবে; যে বিনিয়োগ একসময় দেশ গড়ার কাজে লাগে অর্থাত্ আসলে-সুদে ফিরে আসে। সরকারকে এই বিনিয়োগ করতে হয় তার নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকে; যেহেতু সরকার তার নিজের পকেট থেকে খরচ করে দেশ চালায় না, বরং দেশ চালায় জনগণের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ করের টাকায়।
বাংলাদেশের বাস্তবতা বিবেচনা করলে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি সরকারের সময়ে সবচেয়ে বেশি অবহেলার শিকার হয় এই শিক্ষা খাত। যেখানে শিক্ষা খাতে একটা দেশের জিডিপির ৬% বরাদ্দ থাকা উচিত, সেখানে আমাদের দেশে তার এক-তৃতীয়াংশও বরাদ্দ (বর্তমান বরাদ্দ ১.৮৩%) রাখা হয় না। অথচ বঙ্গবন্ধুর সরকারে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দের এবং ভাবনা-বিবেচনার ক্ষেত্র ছিল এই শিক্ষা খাত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা ‘এক পা এগিয়ে দুই পা পেছানো’-র মতো আত্মবিধ্বংসী পথ অবলম্বন করছে বলেই প্রতীয়মান হয়। যার পরিণতিতে আমরা ক্ষুধা-দারিদ্র্য জয় করেও স্বস্তিতে নেই; আমাদের এখন প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হচ্ছে জঙ্গিবাদ-মৌলবাদের বিরুদ্ধে।
একদিকে বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম এবং মাদ্রাসা শিক্ষা এই তিন ধারায় বিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থা; অন্যদিকে সাধারণ মানুষের শিক্ষার মাধ্যম তথা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বাস্তবসম্মত তথা গণমুখি, দীর্ঘমেয়াদি ও ফলপ্রসূ পরিকল্পনার অভাব আমাদের কাঙ্ক্ষিত সৃজনশীল ভবিষ্যত্ প্রজন্ম গড়ার পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাংক আমাদের উচ্চশিক্ষা তথা স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যেভাবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নিজ আয়ে তথা শিক্ষার্থীদের বেতন বাড়িয়ে চলার প্রেসক্রিপশন দিচ্ছে, ড. মো. ফরাসউদ্দিন বেতন কমিশনও একই ধরনের মতামত ব্যক্ত করেছেন। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকেরা বাধ্য হয়ে অবস্থান ধর্মঘট এবং কর্মবিরতিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন। যেখানে অষ্টম বেতন কাঠামোতে প্রায় সকল গ্রেডে আগের চেয়ে বেতন দ্বিগুণ করা হয়েছে, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কাছে তা আনন্দের বিপরীতে অপমান-অমর্যাদার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ হলো সিলেকশন গ্রেড না রাখার প্রস্তাব। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক পূর্ববর্তী ৭ম বেতন কাঠামোতে ২য় গ্রেডে এবং সিলেকশন গ্রেডের (বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের অনুমোদিত পদের মাত্র ২৫%, সচিবরা অবসরে যাবার বয়স বা তারও পরে এই সুযোগ পান) একজন অধ্যাপক ১ম গ্রেডে সচিব এবং সিনিয়র সচিবদের পদমর্যাদায় বেতন পেতেন। কিন্তু অষ্টম বেতন কাঠামোয় মন্ত্রিপরিষদ ও মুখ্য সচিব এবং সিনিয়র সচিবদের দুটি আলাদা গ্রেড-ঊর্ধ্ব পদ সৃষ্টি করায় এবং সিলেকশন গ্রেড তুলে দেওয়ায় অধ্যাপকদের অবস্থান তিন ধাপ বা তারও নিচে নেমে গেছে! এহেন অমর্যাদাকর পরিস্থিতি কোনো সুস্থ-বিবেকসম্পন্ন মানুষের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব কি না, তা কেন ফরাসউদ্দিন উত্তর পর্যালোচনাকারী সচিব কমিটি এবং পরবর্তী সময়ে সরকার ভাবনায় নিলেন না—এটাই এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সমতুল্য আমলা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনভাতা বেশি। এমনকী পাকিস্তানেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২.৫% অধ্যাপক মুখ্য সচিবের সমান স্কেলে এবং অধ্যাপকেরা সচিবদের স্কেলে বেতন পান। শ্রীলঙ্কায়ও শিক্ষকদের বেতনভাতা আমাদের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি এবং পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য রয়েছে উচ্চশিক্ষা কমিশন।
তাছাড়া রাষ্ট্রীয় ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স-এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেকশন গ্রেডের একজন অধ্যাপকের অবস্থান ১৯তম এবং সমবেতনের একজন সচিবের অবস্থান ১৬তম! এমনকী একজন উপাচার্যের অবস্থান ১৭তম! স্বৈরশাসক এরশাদ প্রবর্তিত এই অবস্থানগত বৈষম্য দূরীকরণও সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। নতুবা প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া না গেলে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের না রাখাই হবে যৌক্তিক।
বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে শিক্ষা-গবেষণায় যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে স্বতন্ত্র বেতনস্কেলের পাশাপাশি উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠনও এখন সময়ের দাবি। সরকারি, প্রাইভেট মিলিয়ে প্রায় ২০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন করে মন্ত্রীর (ন্যূনতম প্রতিমন্ত্রীর) সমমর্যাদায় একজন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া যায়। কেননা, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের মূল কাজ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অর্থ মঞ্জুর করা, অথচ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অর্থ মঞ্জুরির কোনো ব্যাপার নেই। তাছাড়া শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য শুধু বেতনভাতা বাবদ অর্থ মঞ্জুর করলেই চলবে না, শিক্ষার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের যে মূল কাজ গবেষণা, সেই গবেষণার বর্তমান অপ্রতুল বরাদ্দ বাড়ানো দেশের স্বার্থেই প্রয়োজন। কেননা আমরা যদি নিজেদের গবেষণার মান বাড়ানোর সুযোগ না পাই এবং প্রয়োজনীয় নতুন নতুন গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি করতে না পারি তাহলে আন্তর্জাতিক ‘মেধাস্বত্ব আইনের’ জাঁতাকলে আমাদেরকে বিরাট অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।
অপূর্ব অনির্বাণ, শিক্ষক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
Published in: http://www.ittefaq.com.bd/print-edition/pathok-ovimot/2015/09/19/73406.html
0 comments:
Post a Comment