রাষ্ট্রব্যবস্থায় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সরকারের হস্তক্ষেপ কাম্য নয়; তবে তা সম্মানের দাবিতে, যৌক্তিকতার ভিত্তিতে- উপেক্ষা করার নিমিত্তে নয়। এ স্বায়ত্তশাসনের মূলে যে ধারণা অন্তর্নিহিত থাকে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে। যেমন, আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসনের কথাই ধরা যাক। যে স্বায়ত্তশাসন ৪৩ বছরে এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এশিয়ার কয়েকশ’ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্থান করে দিতে পারেনি, যে স্বায়ত্তশাসন ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের হাজারও বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান টিকিয়ে রাখতে সহায়ক হয়নি, সেই স্বায়ত্তশাসন নতুন করে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়োজন রয়েছে। তাছাড়া স্বায়ত্তশাসনের মানে এই হওয়া উচিত নয় যে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সরকারের কোনো সুপারিশ আমলে নেয়াকে অপমানজনক মনে করবে। তা হয়তো যৌক্তিক হতো যদি এই স্বায়ত্তশাসন দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব র্যাংকিংয়ে ক্রমউন্নতি নিশ্চিত করতে পারত। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বিপরীত। যে চলমান বাস্তবতায় আমরা আছি তাতে কি সরকার বলতে পারে না যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক একটির বেশি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে বা Consultancy work-এ engage থাকাটা সরকারের কাছে অনৈতিক মনে হচ্ছে? সেক্ষেত্রে কি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের স্বায়ত্তশাসনের নামে অযৌক্তিকভাবে অপমানিত হওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে? এ একটি পরিবর্তনই কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতির কাছে আরও অনেক সম্মানিত করবে না?
কিছু সংস্কার সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পদোন্নতি নিয়ে যেভাবে নানা আপত্তিকর মন্তব্য ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে করে বোধহয় স্বায়ত্তশাসনের দোহাই দিয়েও তা আর বেশিদিন থামিয়ে রাখা যাবে না। এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের (Springer, Elsevier, World Scientific, Taylor & Francis, John Wiley ভিত্তিক মানদণ্ড) মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। একটি সংস্কার সরকার স্বায়ত্তশাসনের প্রতি সম্মান রেখেও করতে পারে। তা হল, শুধু প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক হিসেবে স্থানীয় বা কন্টিনেন্টাল জার্নালে প্রকাশনা যথেষ্ট হতে পারে; কারণ প্রাথমিক দুই ধাপ পদোন্নতি না পাওয়াটা আমাদের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় অমানবিকই বটে। কিন্তু পরের দুই ধাপে অর্থাৎ সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পর্যায়ে পদোন্নতি স্থানীয় বা কন্টিনেন্টাল জার্নালে নির্দিষ্টসংখ্যক গবেষণা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সেই আন্তর্জাতিক আউটলেটগুলোয় অন্তত একটি একটি করে দুটি গবেষণা প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা উচিত। যদি কোনো ফ্যাকাল্টি মেম্বার একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা করতে না পারে, তবে তার অন্য রুটে career progress-এ নৈতিকভাবে বাধ্য থাকা উচিত। বিশ্বের যে কোনো হাই র্যাংকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি ধারা স্পষ্ট : টিচিং ফ্যাকাল্টি ও রিসার্চ ফ্যাকাল্টি। আমাদের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় আমরা একদম প্রথম ধাপ থেকেই টিচিং ও রিসার্চ ফ্যাকাল্টি requirement impose না করতে পারলেও অন্তত অধ্যাপক পদটি শুধু পিএইচডি ডিগ্রিধারী রিসার্চ ফ্যাকাল্টিদের জন্য রিজার্ভ রাখা উচিত। এতে সমাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সম্পর্কে নেতিবাচক যে ধারণা দিন দিন দানা বাঁধছে, তা অনেকটাই প্রশমিত করা যাবে। তাছাড়া এতে করে আমরা contribution-reward based পদ্ধতিটির সূচনা করতে পারি, যা প্রায় বিশ্বের সব মধ্যবিত্ত, নিু-মধ্যবিত্ত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বহুল প্রচলিত। এটি খুবই স্পষ্ট যে, আমাদের সব অধ্যাপকের যদি একটি করে গবেষণাও ওই আন্তর্জাতিক আউটলেটগুলোয় প্রকাশিত হতো, তাহলেও আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং অনেক ওপরের দিকে থাকত; এবং পদ্ধতিটির প্রচলন থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রমপতনশীল র্যাংকিং অনেকটাই ঠেকানো যেত। অর্থমন্ত্রীর মন্তব্যে বা ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় উঠতেই পারে; অনেক মন্তব্য আপত্তিকর মনে হওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়; তবে ৪৩ বছরে স্বায়ত্তশাসনের সুযোগসন্ধানী ব্যাখ্যা দিয়ে জাতিকে বিশ্বমানের শিক্ষা ও গবেষণার চ্যালেঞ্জগুলোর কাছাকাছি নিয়ে না যেতে পারার ব্যর্থতাও কম দুর্ভাগ্যজনক নয়।
সমস্যাটি আজ প্রকট আকার ধারণ করার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। স্বায়ত্তশাসনের নামে নিয়োগের স্বচ্ছতা সম্পর্কে বাস্তবিক জবাবদিহিতার কোনো ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া এবং সেই সুযোগে সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের চাপে বহু কম যোগ্যকে নিয়োগ দিতে প্রশাসনকে বাধ্য করা। বস্তুত অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগের অবস্থা এতই খারাপ যে, সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বমান রক্ষার যে চ্যালেঞ্জগুলো নিতে হয় সে সম্পর্কে ধারণাই আজ অনুপস্থিত। এটি এক ধরনের প্রতারণা। কিন্তু তার পেছনে সরকারের সুবিধাবাদী অবস্থানই সবচেয়ে বেশি দায়ী। আজ দু’-একটি ছাড়া অন্যসব সরকারি বিশ্ববিদ্যালগুলোর কর্তাব্যক্তি হিসেবে যে ভিসি, প্রোভিসিরা নিয়োজিত আছেন, তাদের কতভাগ সেই বিশ্বমানের প্রতিযোগিতা সম্পর্কে ধারণা রাখেন? যারা রাখেন তাদেরই বা কতটুকু নৈতিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার সুযোগ দেয়া হয়? এ নগ্ন হস্তক্ষেপ কমবেশি সব সরকারের আমলেই বিদ্যমান ছিল এবং সেই কয়েক দশকের উদাসীনতা আজকের এ সমালোচনার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। তবু ভালো, অন্তত সমালোচনাটি শুরু হল; কোনো অদৃশ্য কারণে যেন তা থেমে না যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবি যেন যৌক্তিক চ্যালেঞ্জগুলো মেনে নেয়ার প্রতিশ্র“তির বিনিময়েই মেনে নেয়া হয়। আর সে চ্যালেঞ্জগুলো গ্রহণের নিমিত্তে সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ হবে সেসব মন্ত্রীর আপত্তিকর হস্তক্ষেপ বন্ধ করা, যারা আজ আপত্তিকর মন্তব্য করতে গিয়ে সব ধরনের ভদ্রতার সীমা লংঘন করছেন। আইন করে এসব আপত্তিকর হস্তক্ষেপ বন্ধের ব্যবস্থা নিয়ে স্বায়ত্তশাসনের যৌক্তিকতার মধ্যেই নিয়োগের জবাবদিহিতার ব্যাপারটি ইউজিসির মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর রিভিউ করার পদ্বতি চালু করে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেয়ার এখনই মোক্ষম সময়।
অন্যদিকে স্বায়ত্তশাসনের সত্যিকারের সুফল ভোগ করার চাবিকাঠিও রয়েছে সরকারেরই হাতে। সরকার যদি ঘোষণা দেয় এবং সত্যিকারভাবে প্রয়োগ করে যে, ঠিক আছে, তাদের চিন্তাভাবনার লোকদের মধ্যে যাদের যোগ্যতা এবং আন্তর্জাতিক এক্সপোজার সবচেয়ে বেশি তাদেরই ভিসি, প্রোভিসি ইত্যাদি পদে নিয়োগ দেয়া হবে, শুধু বেশি বেশি করে মিডিয়ায় উপস্থিত হওয়াটা কোনো ক্রাইটেরিয়া হবে না, তাহলেও পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হয়ে যাবে। একজন সুশিক্ষিত লোক স্বশিক্ষিতও বটে, সুতরাং তখন হয়তো সরকারের নিয়োগে নগ্ন হস্তক্ষেপ করার সুযোগ থাকবে না। তবে তখন যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ নিয়েও কোনো প্রশ্ন থাকার কথা নয়, যা স্বায়ত্তশাসনের আমলেই বাস্তবিক জবাবদিহিতার নামান্তর। সে ধরনের ভিসিরাও বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ নির্বাচনের যে পদ্ধতিটি আজ সব দুর্নীতির কেন্দ্রবিন্দুতে তা নিয়েও নতুন করে ভাববেন। ডিনসহ একাডেমিক পদগুলোর যে চ্যালেঞ্জ ও দায়িত্ব, তা সে ধরনের যোগ্যতাসম্পন্ন ও দায়িত্বশীল শিক্ষকদের ওপরই বর্তাবে। সরকার তখন ভিসিদেরও চ্যালেঞ্জ ফেস করার যোগ্য হিসেবে দেখতে পাবে; স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখার মধ্যেই ভিসিরা বিশ্ব র্যাংকিংয়ে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থানের উন্নতি সাধনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে বদ্ধপরিকর হবে এমনটি সরকার আশা করতে পারবে। ৩-৪ বছর সময় নিয়েও যদি কোনো ভিসি বিশ্ব র্যাংকিংয়ে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থানের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে না পারে, তাহলে সরকার সেই সত্যিকারের সম্মানিত ভিসিকে সম্মাজনকভাবে অব্যাহতি দিতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের মতো সম্মানিত ব্যক্তিরা এ ধরনের চ্যালেঞ্জ নেবে না তা হয় না। এ ধরনের চ্যালেঞ্জ নেয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন একজন ভিসির রাষ্ট্রীয় Warrant of Precedence-এ অবস্থান নিয়ে ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই, কারণ তিনি হবেন বিশ্বের Warrant of Precedence-এ নিজের অন্তর্ভুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা। হয়তো সে কারণেই উন্নত বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বা অধ্যাপকরা রাষ্ট্রীয় Warrant of Precedence-এ নিজেদের অবস্থান নিয়ে ভাবেন না এবং রাষ্ট্রও হয়তো বা তাদের সে ধরনের তুলনামূলক ক্রমধারায় মূল্যায়নের সাহস পায় না।
আমাদের বাস্তবতায় প্রশ্ন হল, আমাদের সরকারে যারা আছেন, তারা আসলে কী চান? সরকার কতটুকু পজিটিভলি চায়, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, তারা নেগেটিভলি যা করছে তার কতটুকু করবে না বলে জাতির কাছে প্রতিশ্র“তিবদ্ধ হচ্ছে?
ড. শরীফ মজুমদার : সহযোগী অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
sharif-math2000@yahoo.com
Published in: http://www.jugantor.com/window/2015/09/17/325099
0 comments:
Post a Comment