গত কয়েক বছরে শিক্ষায় উন্নতির দাবির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শিক্ষার মান নিয়ে সমালোচনা। সংখ্যা নিয়ে তুষ্টি আর মান নিয়ে বিতর্ক। কেউ বলছেন, পরিমাণে আগে বাড়ুক, তারপর মান দেখা যাবে। অন্যরা তা মানতে নারাজ। তাঁরা মনে করেন, পরিমাণে আর মানে মোটামুটি একসঙ্গে বাড়াতে না পারলে সেই উন্নতি টেকসই হয় না। লকলকে বেড়ে ওঠা উন্নতি নয়।
শিক্ষার চারটি প্রধান উপাদান—ঘরবাড়ি, বইপত্র, ছাত্র ও শিক্ষক। সবগুলো ভালো হলে তো সোনায় সোহাগা। কিন্তু তা তো সব ক্ষেত্রে ঘটে না। এবার যদি দেখি কোন দুটি ‘ভালো’ চাই আমাদের? প্রথম কথা হলো, ছাত্র আর শিক্ষক না হলে তো শিক্ষার প্রশ্নই ওঠে না। তাই শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো এই ছাত্র আর শিক্ষক। এবার আমরা কোনটা বেশি ‘ভালো’ চাইব? ছাত্র, না শিক্ষক? সব ছাত্রই কোনো না কোনো গুণে সমৃদ্ধ। তা ছাড়া শিক্ষা হলো সবার জন্মগত অধিকার। কাজেই সবার (প্রাথমিক) শিক্ষা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তাই সবাইকে সুযোগ দিতেই হবে। কিন্তু শুধু সুযোগ দিলেই তো হবে না, নিশ্চিত করতে হবে তারা যেন ভালো শিক্ষা পায়। ভালো শিক্ষা যদি চাই, ভালো শিক্ষক ছাড়া তা কিছুতেই সম্ভব নয়।
ভালো শিক্ষক পাব কী করে? মেধাবীদের শিক্ষকতায় নিয়োগ করে, তাঁদের আকর্ষণীয় বেতন ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করে আর অব্যাহত প্রশিক্ষণ দিয়ে ভালো শিক্ষক তৈরি করা যায়।
শিক্ষক নিয়োগে দলীয় আনুগত্য কিংবা ‘ডোনেশন’ নামের ঘুষ যদি প্রধান হয়ে ওঠে, তাহলে মেধাবীদের নিয়োগ কিছুতেই নিশ্চিত হয় না। অন্তত গত দুই-আড়াই দশকে শিক্ষক নিয়োগে যে চরম অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তার মূলে রয়েছে এই দলীয় আনুগত্য আর ঘুষের লেনদেন। শিক্ষকের পদটি নিলামে তুলে, দলীয় আনুগত্য আর স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকেই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে বলে সর্বত্র অভিযোগ।
বাংলাদেশে অতীতে শিক্ষকের ভালো আর্থিক সুবিধা না থাকলেও সামাজিক মর্যাদা ছিল খুবই উঁচু। এখন কোনোটাই নেই।
কী করে ভালো শিক্ষক হয়ে ওঠা যায়? প্রতিভাবানদের কথা বাদ দিলে ভালো শিক্ষক তৈরি করতে হয়। কে তৈরি করতে পারে? পারে সমাজ, কিন্তু শেষ বিচারে রাষ্ট্র। বাংলাদেশে কোনটি সরকারের আর কোনটি সমাজের দায়, তা নিরূপণ করা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে এবং ভাঙতে ভাঙতে সমাজ হয়ে উঠেছে প্রান্তিক এক অকার্যকর ক্ষমতাকাঠামো। ফলে রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হবে। যদিও সমাজের সঙ্গে তা ভাগাভাগি করাই উত্তম।
সংবিধানে যা-ই লেখা থাক, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। অর্থাৎ ‘নাগরিকেরা তাদের সামর্থ্যমতো কাজ করবে আর রাষ্ট্র তার সাধ্যমতো নাগরিকের সব মৌলিক চাহিদা মেটাবে’—এই সমাজবাদী অঙ্গীকার নেই আমাদের সংবিধানে। বাংলাদেশ বড়জোর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, মুক্তবাজার অর্থনীতির দেশ, যার মূল ভিত্তি মুনাফা। শিক্ষাক্ষেত্রে তার অশুভ প্রভাব দিনে দিনে স্পষ্ট হচ্ছে। শিক্ষাও হয়ে উঠছে দামি পণ্য।
ভালো শিক্ষক তৈরির পথ নিয়ে বরং ভাবা যেতে পারে। তত্ত্বটা খুব সোজা। ‘যত চর্চা, তত দক্ষতা’। কিন্তু চর্চা করতে হবে সঠিক পথে। কী করে জানব সেই সঠিক পথ? অব্যাহত প্রশিক্ষণ সেই সুযোগ দেয়। বলা হয়, প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। সত্যিই নেই। তাহলে দেখা যাক, আমাদের শিক্ষকদের সেই প্রশিক্ষণের সুযোগ কতটুকু আছে।
আমরা এখানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিয়ে আলোচনা করব।
প্রাথমিক: বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক শিক্ষকের সংখ্যা তিন লাখের বেশি। তাঁদের প্রায় এক লাখ এইচএসসি পাস। অন্যরা গ্র্যাজুয়েট, পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট। এই বিপুলসংখ্যক প্রাথমিক শিক্ষকের প্রশিক্ষণের জন্য আছে তিনটি বেসরকারিসহ ৫৯টি প্রাথমিক শিক্ষক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (পিটিআই)। তাঁদের জন্য রয়েছে এক বছর মেয়াদি সার্টিফিকেট-ইন-এডুকেশন কোর্স। এখন এই কোর্স ১৮ মাসের ডিপ্লোমা-ইন-এডুকেশন (ডিপ-ইন-এড) কোর্সে উন্নীত করার কাজ চলছে। ইতিমধ্যে পাইলটিং শেষ হয়েছে। তা ছাড়া, গ্র্যাজুয়েট, পোস্ট-গ্র্যাজুয়েটরা সরকারের অনুমতি নিয়ে এক বছরের ব্যাচেলর-ইন-এডুকেশন (বিএড) ডিগ্রি, এমনকি এমএড কোর্সও করতে পারেন।
প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য পিটিআইগুলোতে রয়েছে ইনস্ট্রাক্টর-সংকট। আগে প্রতিটি পিটিআইতে ১২টি করে পদ ছিল। ডিপিএড কোর্সের জন্য পদ বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৬টি করে। এখনো নিয়োগ করা যায়নি। ২০১৬ সাল থেকে ডিপিএড কোর্স ঠিকমতো চালু হলে প্রাথমিক শিক্ষায় গুণগত উন্নতি আশা করা হচ্ছে।
মাধ্যমিক: শিক্ষক তৈরিতে পরের ধাপে মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ আছে ১৪টি। আছে একটি মাদ্রাসাশিক্ষক ট্রেনিং কলেজও। পদের সমস্যা সবখানে। আরও শতাধিক বেসরকারি ট্রেনিং কলেজ গড়ে উঠেছে দেশের নানা প্রান্তে, মুনাফাভিত্তিক। সেখানে ব্যাচেলর অব এডুকেশন (বিএড) ট্রেনিং দেওয়া হয়। ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজসহ বেশ কয়েকটিতে
অনার্স এবং এমএড কোর্স চালু আছে। এ ছাড়া ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউট) বিভিন্ন এডুকেশন কোর্স আছে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএড, এমএড কোর্স করা যায়।
কলেজ পর্যায়: কলেজশিক্ষকদের প্রশিক্ষণের সুযোগ প্রায় নেই বলাই ভালো। নায়েমে শিক্ষকদের বুনিয়াদি কোর্স করানো হয় চার মাসের। সেই প্রশিক্ষণে শিক্ষক তৈরির চেয়ে নজর বেশি কেরানি তৈরির দিকে। পেডাগজি সেখানে অনুপস্থিত, পড়ানোর মতো যোগ্যতাসম্পন্ন লোক নিয়োগেরও ব্যবস্থা নেই। কিছু স্বল্পমেয়াদি কোর্সের ব্যবস্থা যা আছে, তাতে কলেজশিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক পাঠদানের দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ নেই। নায়েমে মাধ্যমিক ও মাদ্রাসাশিক্ষকদেরও ট্রেনিং দেওয়া হয় বটে, তবে তা খুবই অপ্রতুল, খানিক বেমানানও।
কলেজশিক্ষকদের প্রশিক্ষণে আরও আছে পাঁচটি উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (এইচএসটিটিআই)। সেখানে প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি বিষয়ভিত্তিক কিছু ট্রেনিং দেওয়া হয়। তবে পড়ানো হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে অতিথি বক্তা দিয়ে, যাঁদের পেডাগজি জানা আবশ্যকীয় শর্ত নয়। এইচএসটিটিআইতে পদায়নে বিএড, এমএড ডিগ্রি বা শিক্ষায় কোনো ডিগ্রি থাকারও কোনো আবশ্যকতা নেই।
মোটা দাগে, বাংলাদেশে ৩ লাখ ২৭ হাজার ৪১৩ জন প্রাথমিক, ২ লাখ ৩২ হাজার ৯৯৪ জন মাধ্যমিক, ১ লাখ ৫ হাজার ৫৪ জন কলেজ ও ১ লাখ ৪২ হাজার ৭৪৯ জন মাদ্রাসাশিক্ষকের দক্ষতা বৃদ্ধির এই হলো সমুদয় ব্যবস্থা। কিন্ডারগার্টেন, ব্র্যাক ও অন্যান্য কিছু স্কুল ধরা হলে আরও প্রায় এক লাখ শিক্ষককে এই গণনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। (সূত্র: বাংলাদেশ এডুকেশন স্ট্যাটিসটিকস ২০১৪)
প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের একটি গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা দেশে গড়ে তোলা হচ্ছে। কিন্তু মাধ্যমিক শিক্ষকদের ট্রেনিং দেওয়ার ব্যবস্থাটি আগের তুলনায় এখন ভঙ্গুর। আগে দেশে-বিদেশে ট্রেনিং করিয়ে উপযুক্ত পেডাগগ তৈরি করে তাঁদের দিয়ে চলত ট্রেনিং কলেজগুলো। কয়েক বছর ধরে সেখানে শীর্ষ পদসহ সব পদে নন-পেডাগগদের (যাঁদের শিক্ষাবিজ্ঞানে কোনো প্রশিক্ষণ নেই) আধিপত্য। অবস্থা এমন পর্যায়ে নেমে গিয়েছিল যে ১৪টির মধ্যে এই সেদিন পর্যন্ত নয়টিতেই ছিলেন নন-পেডাগগ অধ্যক্ষ। অবস্থার সামান্যই উন্নতি হয়েছে গত কয়েক মাসে। ২০০৫ সাল থেকে নিয়োগ-পদোন্নতি বিধি উপেক্ষা করে এসব কলেজের কর্মরত শিক্ষকদের সহযোগী অধ্যাপক, উপাধ্যক্ষ বা অধ্যক্ষের (সহযোগী অধ্যাপক/অধ্যাপক) পদে পদোন্নতি আটকে রাখা শুরু হয়। দেশে-বিদেশে ডিপ্লোমাও তাঁদের পদোন্নতির কাজে লাগছে না। ট্রেনিং কলেজগুলোয় নন-পেডাগগরা উচ্চতর পদ দখল করে থাকায় পেডাগগরা বঞ্চিত হচ্ছেন পদোন্নতি থেকে। ফলে মাধ্যমিক শিক্ষক তৈরির কলেজগুলো আর ভালো শিক্ষক তৈরিতে ভূমিকা রাখছে না। ২০০৫ সাল থেকে শুরু হয়ে ট্রেনিং কলেজগুলো এখন সর্বকালের বেহাল অবস্থায়।
একজন শিক্ষক প্রায় ৩০ বছর শিক্ষকতা করেন। জ্ঞান অর্জন আর জ্ঞান বিতরণ দুটি আলাদা পদ্ধতি। অধীত জ্ঞান হালনাগাদ করতে তাঁকে প্রতিবছর প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ না দিয়ে ভালো শিক্ষক আশা করা বাতুলতা মাত্র। আমরা চাই ভালো শিক্ষা। ভালো শিক্ষা মানে বিশ্বমানের শিক্ষা। সারা দুনিয়ার মতোই বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। তাদের বিশ্বমানের শিক্ষা নিশ্চিত করেই আমরা দেশ ও জগৎ-সভ্যতায় অবদান রাখতে পারি।
বাংলাদেশে আমরা যখন মানসম্মত শিক্ষার দাবি তুলি, তখন আমরা মনে রাখতে বলি যে ভালো, দক্ষ শিক্ষক তৈরি ছাড়া আধুনিক, মানসম্মত শিক্ষা সম্ভব নয়। আর প্রশিক্ষণ ছাড়া ভালো শিক্ষক তৈরি হয় না। অবিলম্বে ট্রেনিং কলেজগুলোর অরাজকতা দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে।
আমরা যখন ভালো শিক্ষা নিয়ে আমাদের ভাবনার কথা বলি, তখন এসব বিষয়ের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করি। উত্তম শিক্ষা কেবল উত্তম, দক্ষ শিক্ষকই নিশ্চিত করতে পারে। এই মৌলিক প্রশ্নে তাই একটি জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন। সরকারে যে দলই থাকুক, এই প্রশ্নে তারা যেন অভিন্ন অবস্থান নেয়।
আমিরুল আলম খান: শিক্ষাবিদ।
amirulkhan7@gmail.com
Published in: http://www.prothom-alo.com/opinion/article/632647
0 comments:
Post a Comment