রোমান সাম্রাজ্যের পতন থেকে শুরু করে রেনেসাঁর সূচনা পর্যন্ত মধ্যযুগের (৫০০-১৫০০) একটা বড় অংশ ইউরোপের ইতিহাসে ‘অন্ধকার যুগ’ (৬০০-১৩০০) নামে পরিচিত, কারণ এ সময়কালে বর্বর জার্মানদের আক্রমণে গ্রিক-রোমান জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্য প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আরববিশ্বে এটা আলোক-বিচ্ছুরণের যুগ, কারণ ইসলামের পতাকাতলে সংগঠিত আরবেরা এ সময়ে সক্রেটিস-আফলাতুন-আরস্থসহ বহু গ্রিক ও রোমান চিন্তকের পাণ্ডুলিপি আরবি ভাষায় অনুবাদ করে পুরোদমে সুশৃঙ্খল জ্ঞানচর্চায় রত হয়েছিলেন। একাদশ-দ্বাদশ শতকে ক্রুসেড যুদ্ধের যুগে আরবদের সঙ্গে যোগাযোগের ফলে ইউরোপীয়রা বহু পূর্বে হারিয়ে যাওয়া গ্রিক-রোমান জ্ঞানচর্চার ধারাটি আবার খুঁজে পেয়েছিলেন।
মধ্যযুগের মধ্যভাগে একদিকে জ্ঞানের এক বিশাল ঐতিহ্যের সন্ধান মিলেছিল, অন্যদিকে অর্থনৈতিক অগ্রগতির ফলে নিত্যনতুন জ্ঞান এসে হাজির হচ্ছিল ইউরোপের মনোজগতে। এগুলো বোঝা, চর্চা ও বোঝানোর জন্য শিক্ষিত লোকের প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে শিক্ষিত লোকদের মধ্যে পার্থক্য করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সনদেরও প্রয়োজন হলো। জার্মান আক্রমণে রোমান আইন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। মধ্যযুগের শুরুতে নগরজীবনের পুনরুত্থান ও ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের পটভূমিতে রোমান আইন ও রোমান আইনজ্ঞের প্রয়োজন দেখা দিল।
একাদশ শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা ইতালির বোলোনিয়ায় রোমান আইন পড়তে আসতেন। ছোট শহর বোলোনিয়ায় বহু বিদেশি ছাত্র আসার ফলে স্থানীয় লোকজন জিনিসপত্রের দাম আর বাড়িভাড়া ভীষণ বাড়িয়ে দিত। এ পরিস্থিতিতে পরস্পরকে সহায়তা করার জন্য বোলোনিয়ার বিদেশি ছাত্ররা একটি ‘গিল্ড’ গঠন করেছিলেন। সমপেশার লোকদের সংঘ বা গিল্ডকে ইউনিভার্সিতাস (Universitas) বলা হতো লাতিন ভাষায়। মধ্যযুগের ইতালির বহু শহরে নাপিত, ছুতোর, ছাত্র...সব পেশার লোকদের ‘ইউনিভার্সিতাস’ ছিল। কালক্রমে ‘ইউনিভার্সিতাস’ শব্দটি ‘ছাত্রসংঘ’ এবং আরও পরে শুধু ‘বিশ্ববিদালয়’ অর্থে ব্যবহৃত হতে শুরু করল।
বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় বেসরকারি উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছিল, যদিও পরে রাজা বা পোপ ডিক্রি জারি করে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়কে বৈধতা দিয়েছেন। তবে রাজা, নগর কর্তৃপক্ষ এবং গির্জার উদ্যোগেও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা বা প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বীকৃতি দেওয়ার পেছনে কর্তৃপক্ষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ ছিল। প্রথমত, কোনো নগরে বিশ্ববিদ্যালয় থাকাটা সেই নগরের জন্য গৌরবের, আর দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা হাজার হাজার শিক্ষার্থী ছিল নগর বা রাষ্ট্রের আয়ের অন্যতম উৎস।
অভিজাত, যাজক সম্প্রদায় আর সাধারণ জনগণ—এই তিন ভাগে বিভক্ত মধ্যযুগের সমাজে কর প্রদান, সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়া, প্রয়োজনে যুদ্ধে যাওয়া ইত্যাদি দায়িত্ব ছিল জনসাধারণের ঘাড়ে, বাকি দুই সম্প্রদায় ঝাড়া হাত-পা। গির্জার অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়কেও সব রকম কর ও দায় থেকে মুক্তি দিয়ে ডিক্রি জারি করতেন রাজা ও পোপ। ‘হাবিতা’ (Habita) নামে পরিচিত এই ডিক্রি সারা ইউরোপ মেনে চলত। উদাহরণস্বরূপ, ১২০০ সালে প্যারিসে স্থানীয় অধিবাসী আর ছাত্রদের মধ্যে সংঘটিত এক দাঙ্গায় একাধিক ছাত্র খুন হয়। রাজা ফিলিপ অগুস ‘স এই অপরাধে প্যারিসের প্রভোস্টকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন, অথচ ছাত্রদের কোনো শাস্তিই দেননি। এই উপলক্ষে জারি করা অর্ডিন্যান্সে রাজা বলেছিলেন: ‘কোনো ছাত্রের অপরাধ যা-ই হোক না কেন, “আমাদের” (অর্থাৎ রাষ্ট্রের) বিচারালয় তার বিচার করার অধিকার রাখে না।’ বিশ্ববিদ্যালয় বা গির্জার প্রশাসন ছাত্রের বিচার করতে পারত।
অধ্যাপক ও শিক্ষার্থীরাই শুধু নয়, ছাত্র ও শিক্ষকদের ভৃত্যেরা, লিপিকর, রেজিস্ট্রার, সংবাদবাহক...বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত অনেকেই উপরোক্ত সুবিধাগুলো ভোগ করত। নগর বা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে কখনো কখনো এর স্বায়ত্তশাসন, বিশেষ অধিকার ও সুবিধাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে বসতেন বটে, কিন্তু যাবতীয় ব্যক্তিগত, বেসরকারি, সামরিক, প্রশাসনিক ও মধ্যযুগীয় করপোরেট ঈর্ষার অস্তিত্ব সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের প্রাপ্ত সুবিধা ও অধিকার অক্ষুণ্ন রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য একটি অধিকারের নাম ছিল: ‘সেসাসিও’ (Cessatio), অর্থাৎ মুহূর্তের নোটিশে ধর্মঘট করার অনুমতি। ১২৩১ সালে পোপ নবম গ্রেগরি অধ্যাপক ও শিক্ষার্থীদের লিখিতভাবে জানিয়েছিলেন: ‘যদি হত্যা বা মারাত্মকভাবে আহত হওয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটে এবং ১৫ দিনের মধ্যে যদি আপনারা সুবিচার না পান, তবে যতক্ষণ না আপনারা স্পষ্ট হন, ততক্ষণ পর্যন্ত পাঠদান বন্ধ রাখার অধিকার আপনাদের দেওয়া হলো।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সদস্যকে যদি গ্রেপ্তার করা হতো বা অন্যায়ভাবে কারারুদ্ধ করা হতো, সে ক্ষেত্রেও বিশ্ববিদ্যালয় ধর্মঘটের ডাক দিত।
প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা চারটি জাতিগাষ্ঠীতে বিভক্ত ছিলেন: ফরাসি, নর্মান, পিকার্ড ও অ্যাংলো-স্যাঙ্গ। অধ্যাপকদের বেশির ভাগের অন্যতম কাজ ছিল তুচ্ছ স্বার্থ নিয়ে দলাদলি ও ঝগড়া করা। হেন কোনো গালাগাল, অপমান নেই যে এই অধ্যাপকেরা একে অপরকে করতেন না। তবে সবই করতে হতো লাতিন ভাষায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ ফরাসি, ইংরেজি ইত্যাদি মাতৃভাষা ব্যবহার করলে জরিমানা দিতে হতো। ঝগড়া একবার শুরু হলে চলত দীর্ঘসময় ধরে এবং ঝগড়াকালীন গালিবিনিময় প্রায়ই হাতাহাতি-ঘুষাঘুষিতে পর্যবশিত হতো। বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানপিপাসু, সুশীল ছাত্র অবশ্যই ছিল, কিন্তু অনেক ছাত্র রীতিমতো অসভ্য ছিল। বাজনা বাজিয়ে, চিৎকার করে চার জাতিগোষ্ঠীর ছাত্ররা একদল অন্য দলকে আক্রমণ করত প্যারিসের লাতিন কোয়ার্টারের রাস্তায়। রেহাই পেত না স্থানীয় অধিবাসী বা দোকানদারেরাও। নাগরিকদের বাড়িতে ঢুকে মহিলাদের বলাৎকার করার ঘটনাও ঘটত। ১২২৯ সালে এক উৎসবের সময় প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র মাতাল হয়ে মদের দোকান লুট করে, দোকানের মালিক ও তার কর্মচারীদের বেদম প্রহার করে। খবর পেয়ে প্রভোস্ট তার দলবল নিয়ে এসে ছাত্রদের আক্রমণ করলে দুজন ছাত্র নিহত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় অবিলম্বে তার সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। অধ্যাপকেরা প্যারিস ছেড়ে চলে যান, কেউ বিদেশে, কেউবা ফ্রান্সের অন্যান্য শহরে। দুই বছরের মাথায় শেষ অধ্যাপকটিও যখন বিদায় হলেন, তখন পোপ মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে এসেছিলেন। শিক্ষকদের ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়েছিল, রাজাও আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছিলেন। সর্বতোভাবে বিজয়ী হয়ে ১২৩১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় আবার তার কার্যক্রম শুরু করেছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি মডেল ছিল মধ্যযুগে: বোলোনিয়া আর প্যারিস। বোলোনিয়ার প্রশাসন চালাত ছাত্ররা আর প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন চালাতেন অধ্যাপকেরা। ইউরোপের সর্বত্র নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেল অনুসৃত হয়েছে। কালক্রমে প্যারিস মডেলের তিনটি পৃথক ধারা সৃষ্টি হয়েছিল। একটি ধারায় (আচার্য/উপাচার্যের) কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণে একাধিক ফ্যাকাল্টি ছিল। দ্বিতীয় ধারাটিতে একাধিক কলেজে শিক্ষাদান করা হতো, আর প্রশাসন ছিল বিকেন্দ্রীকৃত। তৃতীয় ধারার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উপরোক্ত দুটি মডেলের সমন্বয়ে পরিচালিত হতো, অর্থাৎ কলেজও ছিল, আবার কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণও ছিল। প্রথম দিকে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলো ছিল নিছকই গরিব ছাত্রদের জন্য নির্মিত এক একটি ছাত্রাবাস। কিন্তু ধীরে ধীরে এসব কলেজ জ্ঞানার্জনের কেন্দ্রে পরিণত হয়। আজ ‘কলেজ’ নামক বিদ্যায়তনটি অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরিহার্য অঙ্গ। কলেজেই এখানে পাঠদান করা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব শুধু পরীক্ষা নেওয়া এবং ডিগ্রি দেওয়া। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি-ভিত্তিক মডেলটি অনুসৃত হয়, যদিও হলগুলোর কার্যক্রমে অক্সফোর্ডের কলেজ-সিস্টেমের ছায়া কিছুটা আছে।
উত্তর আমেরিকায় ফ্যাকাল্টি-ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্থায়ীভাবে নিযুক্ত শিক্ষকেরা পাঠদান ও গবেষণা করেন, প্রশাসনিক দায়িত্বও পালন করেন। নোম চমস্কি তাঁর সাম্প্রতিক এক লেখায় অভিযোগ করেছেন যে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সর্বোচ্চ মুনাফা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্থায়ীভাবে অধ্যাপক নিয়োগে আর আগ্রহী নয়। অন্য সব করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মতো কর্মকর্তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চালাবেন, আর পাঠদান সম্পন্ন হবে প্রধানত খণ্ডকালীন শিক্ষকদের দিয়ে। এতে করে একদিকে যেমন শিক্ষকদের কম বেতন দিতে হবে, অন্যদিকে শিক্ষকদের একতা আর প্রাধান্য নষ্ট হবে। বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও সম্ভবত এই নীতিই অনুসৃত হচ্ছে। চমস্কির আশঙ্কা, এই অসুস্থ করপোরেট মানসিকতা আখেরে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ নামক প্রতিষ্ঠানটিকে সমূলে বিনষ্ট করবে।
মধ্যযুগের অধ্যাপকদের সবাই মহাজ্ঞানী-মহাজন ছিলেন না। কিন্তু যে দুই-একজন অধ্যাপককে আজও যুগপৎ শ্রদ্ধা ও বিস্ময়ের সঙ্গে স্মরণ করা হয় তাদের জ্ঞান ও পাঠদানের অভিনবতার জন্য, যেমন প্যারিসের আবেলার (১০৭৯-১১৪২) বা বোলোনিয়ার ইউনেরিউস (১০৬৭-১১৫০)-এর সমকক্ষ একজন লোকও গির্জা, প্রশাসন বা প্রতিরক্ষা বিভাগের ইতিহাসে কখনো সৃষ্টি হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়েই শুধু অনুরূপ প্রতিভার সৃষ্টি ও বিকাশ সম্ভব। মধ্যযুগে রাজা ও পোপ উভয়ে প্রতিরক্ষা ও প্রশাসনের তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশেষ সুবিধা ও অধিকার দিয়েছিলেন। এর ফল হয়েছিল বিস্ময়কর! ইউরোপীয় সমাজে উচ্চশিক্ষার প্রসার ঘটেছিল, যার অনিবার্য ফল এক শতকের মধ্যেই শুরু হয়েছিল ইউরোপীয় পুনর্জাগরণ, যার পরবর্তী ধাপ হচ্ছে যুক্তিনিকষিত আধুনিক সভ্যতা, যার সুফল আজ আমরা সবাই ভোগ করছি। পৃথিবীর অন্য কোনো যুগে বা সমাজে এ ব্যাপারটা ঘটেনি, কারণ উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো জ্ঞান ও কাণ্ডজ্ঞান সেসব সমাজের কর্তাব্যক্তিদের ছিল না। ‘বিশ্ববিদ্যালয়কে তার জন্মগত সুবিধা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করার সিদ্ধান্ত আখেরে সমাজ ও রাষ্ট্রের বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক হবে’—বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনের ইতিহাসের ভিত্তিতে এই ভবিষ্যদ্বাণীটুকু করাই যায়।
Published in: http://www.prothom-alo.com/opinion/article/632434/
0 comments:
Post a Comment