Rahmatullah Imon
আরব্য রজনীর এই গল্পটি আমরা ছোটবেলায় কে না পড়েছি? জাহাজডুবির পর ভাসতে ভাসতে দুই ভাই এক দ্বীপে গিয়ে পৌঁছুল। সে এক মজার দ্বীপ। চারদিকে রাশি রাশি খাবার থরে থরে সাজানো। কোন কষ্ট করতে হবে না, হাত বাড়ালেই শুধু খাবার। এক ভাইয়ের তো তাই দেখে চোখ ছানাবড়া, আমরা কি তবে বেহেস্তে পৌঁছে গেলাম? সে মন ভরে চব্য চোষ্য লেহ্য পেয় সব খাবারের স্বাদ আস্বাদন করতে লাগল। আরেক ভাইয়ের মনটা প্রথম থেকেই কেমন যেন খুঁত খুঁত করতে লাগল, বিনা পরিশ্রমেই বিনা অর্থে এমন খাবার? না জানি এর অন্য কোন অর্থ আছে। সে খেতে লাগল খুব হিসাব করে, বেছে বেছে। যে ফল টেবিলে সাজানো সেটিও সে গাছ থেকেই পেড়ে খেতে লাগল, একটু মেহেনত হয় তাতে। কিছুদিনের মধ্যেই এক ভাই ফুলে ফেঁপে একদম গোলগাল হয়ে গেল। আরেকভাইয়ের স্বাস্থ্যও ভালো হল, তবে তেমন চোখে পড়ার মত নয়। যায় যায় দিন- একদিন সেই দ্বীপে এসে হাজির হল এক একচোখা দৈত্য। দ্বীপের সবচে হৃষ্ট পুষ্ট মানুষটিকেই সে বেছে নেবে তার আহারের জন্য। বলাই বাহুল্য, তার চোখ পড়ল দুই ভাইয়ের মধ্যে স্ফীত দেহের সেই ভাইটির দিকে। চিলের মত ছোঁ মেরে সে তাকে নিয়ে উধাও হয়ে গেল।
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার সংকট নিয়ে ভাবতে গেলেই আমার কেন জানি আরব্য উপন্যাসের এই গল্পটির কথা মনে পড়ে যায়। এক সর্বগ্রাসী লোভ আমাদের ঘিরে ধরেছে। আর যার সুযোগ নিচ্ছে সেই একচোখা দৈত্য। এই লোভের আবর্তে কলের পুতুলের মত নাচছি আমরা শিক্ষকেরা। আর এর ফল ভোগ করছে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম, ধ্বংশ হতে চলেছে আমাদের জাতি। আর এর কুশীলবেরা যারা আমলা মন্ত্রী তারা প্রভুদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে চলেছেন। সব কথা লিখতে গেলে লেখাটি ঢাউশ আকৃতি নেবে, আপনাদেরও ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে। কিন্তু উচ্চশিক্ষার প্রসঙ্গ এলেই প্রাথমিক আর মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার প্রসঙ্গ না এসে যায় না। এই দুই স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা আমরা প্রায় পুরোপুরি ধ্বংশ করে ফেলেছি। এখন আর স্কুল কলেজে কোন লেখাপড়া নেই, লেখাপড়া যা হচ্ছে তা তথাকথিত ‘কোচিং’ এর মাধ্যমে। তত্ত্বগত অর্থে আমাদের পাবলিক স্কুল এবং কলেজে ছেলেমেয়েদের পড়তে তেমন কোন খরচ লাগেনা। বেতন নেই, বই ফ্রি, ফি নামমাত্র। কিন্তু অভিভাবকেরা বুকে হাত দিয়ে বলুন তো আপনার স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের পেছনে আপনার খরচ কত? অর্থই যেখানে শিক্ষার গুণগত মানদন্ডে পরিওত হচ্ছে তখন প্রতিয(ওগিতায় একজন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের সন্তানের অবস্থান কোথায় দাঁড়ায়? আমাদের দেশে যারা শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের বড় কান্ডারি তারা কথায় কথায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ দেয়। তারা ভুলেও ইউরোপ, কানাডা, জাপান, চিনের উদাহরণ দেবে না। ঠিক আছে, মেনে নিলাম। পুঁজিবাদের মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রই সই। আপনারা কি জানেন না যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাবলিক স্কুল গুলোতে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত এক পয়সা বেতনও দিতে হয় না? যা খরচ তা বইপত্র স্টেশনারি বাবদ। আমার ছেলে এখানে পঞ্চম গ্রেড থেকে পড়ছে, এখন দ্বাদশ গ্রেডে, হলফ করে বলতে পারি তার পেছনে আমার মাসে বাংলাদেশের ৫০০ টাকাও খরচ হয়না, অথচ এখানে সে যে মানের শিক্ষা পাচ্ছে বাংলাদেশে তা অচিন্ত্যনীয়। অত্যন্ত মেধাবী মানসম্পন্ন শিক্ষক এখানে স্কুলে শিক্ষকতায় নিয়োজিত আছেন। তাঁদের কারও কারও বেতন বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ প্রফেসরদের থেকেও বেশি। অদ্রির সবচে’ প্রিয় শিক্ষক ছিলেন মিঃ শেফিল্ড, প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। তাঁকে বল স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির অফার দেয়া হয়েছে একাধিকবার, তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। এদেশেও শিক্ষকদের বেতন অন্য অনেক পেশার থেকে কম, কিন্তু তা অসম্মানজনক নয়। আর যাঁরা এই পেশায় আসেন তাঁরা এর প্রতি আগ্রহ, ভালোবাসা আর স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পাবেন বলেই এখানে আছেন। মিঃ শেফিল্ডের ভাষায় একজন এলিমেন্টারি স্কুলের বাচ্চাকে পড়ানো একটি না ফোঁটা কুঁড়িকে পরিচর্যা করে ফুল ফোটানোর মত আনন্দের, আমি আর কোথাও গিয়ে এই আনন্দ পাব না। আর যা বেতন পাচ্ছেন তাতে গড়ে আমেরিকার শীর্ষ ৫ শতাংশের মধ্যেই তাঁদের অবস্থান। তাই স্কুলের ক্লাস বাদ দিয়ে ঘরে বসে কোচিং করিয়ে বাড়তি আয় রোজগারের পেছনে তাঁদের ছুটতে হয় না।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সাধারণত গৃহশিক্ষকতা করেন না। কেন? তার কারণ কি এই যে স্কুল কলেজের শিক্ষকের চাইতে তাদের চাহিদা কম? না, তা নয়। এক সময় তাদের বেতন ছিল সম্মানজনক। তাঁরা তাঁদের মেধা ও মননের শতভাগই পঠন পাঠন ও গবেষণার পেছনে ব্যয় করতেন। আমার বাবা যখন রাবিতে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন তখন তাঁর বেতন ছিল ৩০০ টাকা, হ্যাঁ, মাত্র ৩০০ টাকা, কিন্তু সে সময় সোনার ভরি ১২৫ টাকা। অর্থাৎ এক মাসের বেতনে তিনি প্রায় আড়াই ভরি সোনা কিনতে পারতেন। যারা পুঁজিবাদের বড় প্রবক্তা তারাতো গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডকেই অর্থনীতির আদর্শ মান হিসেবে স্বীকৃতি দেন, তাহলে আজকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রভাষকের বেতন এক লাখ টাকা দিতে আপনারা কুন্ঠিত কেন? সময় গড়িয়ে গেল- প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় বিষবৃক্ষ রোপনের পর এবার কুচক্রী মহলের দৃষ্টি পড়ল উচ্চশিক্ষার দিকে। ভাগ্যগুণে তারা পেয়ে গেল শিক্ষক নামধারী কিছু কুলাঙ্গারকে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ধ্বংশের নীল নকশা অনুযায়ী সৃষ্টি হল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের। মান নয়, শস্তায় ডিগ্রি দেবার এক প্রতিষ্ঠান। আর এত শিক্ষকই বা পাওয়া যাবে কোত্থেকে? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাই তখন খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে এখানে নিযুক্ত হলেন। কিছ মানুষের বাড়তি আয়ের রাস্তা খুলে গেল। কিছু বলছি এই কারণে যে সব বিষয় তো আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় না। তারা বড়জোর ৫ থেকে ১০%। শিক্ষকদের মাঝে বেতন বৈষম্য প্রকট হতে লাগল। এবার শুরু হল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে নাইট শিফটে ছাত্র ভর্তি। টাকার বিনিময়ে সস্তা ডিগ্রি বিক্রির মচ্ছব। আমি মোটেও অবাক হব না কালকেই যদি শুনি বাংলা, আরবি বা দর্শন বিভাগও নাইট কোর্স খুলে বসে আছে। আমাদের ছোটবেলায় উত্তর এবং দক্ষিণ বাংলার সব কলেজ ছিল রাবি’র অধিভুক্ত। সে সময় আন্তঃকলেজ ফুটবল টুর্নামেন্টে খুলনা থেকে একটি কলেজ খেলতে আসত- দৌলতপুর দিবা নৈশ কলেজ। তাদের নাম নিয়ে আমরা খুব হাসি ঠাট্টা করতাম। তারা কিন্তু অন্যায় কিছু করত না। একই বেতনে দুই শিফটে ছাত্র পড়াত বিশেষত কর্মজীবীদের কথা ভেবে। কিন্তু এখন নাইট শিফটই প্রাধান্য পাচ্ছে যেহেতু তাতে পয়সা বেশি। না জানি কবে আমার প্রিয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ‘রাজশাহী নৈশ দিবা বিশ্ববিদ্যালয়’ এ পরিণত হয়!
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আমার যে বিরূপ মনোভাব সেটা আমি কখনোই লুকিয়ে রাখতে চাইনা। এর মূল কারণ হল বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশনে এগুলো চালু করা হয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ধ্বংশের নীল নকশা অনুযায়ী। কিন্তু বর্তমানে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এক বাস্তবতা। আমরা চাইলেও রাতারাতি এগুলোকে আর বন্ধ করে দিতে পারব না। লাখ লাখ ছাত্র এখানে পড়ছে। তাদের জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থা আমরা করে দেইনি। হাজার হাজার মানুষের রুটি রুজি জড়িয়ে আছে এর সাথে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নোংরা রাজনৈতিক পরিবেশে টিকতে না পেরে অনেক গুণী শিক্ষক আজ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এমন গুণী মানুষের সংস্পর্ষে অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এখন মানের দিক থেকে অগ্রগামী হয়েছে। শুধু বড় লোকের বখাটে সন্তান নয়, মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্ন মধ্যবিত্তের সন্তানেরাও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে অপ্রতুল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কারণে অথবা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কলুষিত নোংরা রাজনৈতিক পরিবেশ থেকে পরিত্রাণের আশায়। তাতেও রেহাই নেই, ভ্যাট বসছে এবার ছাত্রদের ওপর। হায়রে... এত কিছুর পরেও আমি মনে করিনা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিপূরক হতে পারে। আমাদের উচ্চ শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে পুরোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কার এবং নতুন নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কোন বিকল্প নেই। রাষ্ট্রকেই এক্ষেত্রে উদ্যোগী হতে হবে।
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার সবচে’ বড় বিষফোঁড়াটির নাম হল বিশ্বব্যাংক। এদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সরকার দুই দিন পর পর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে চাপ দিচ্ছে ছাত্র বেতন ফি বৃদ্ধি করে স্বাবলম্বী হতে। এদের পরামর্শেই চালু হয়েছে সর্বগ্রাসী নাইট শিফট। ছাত্রদের পকেট কেটে মাস্টারের বেতনের ব্যবস্থা করার মতলবে। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শর্তই বেঁধে দেয়া হচ্ছে এত বছরের মধ্যে তাদের স্বাবলম্বী হতে হবে, অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর রাষ্ট্র আর এর পেছনে কোন অর্থ খরচ করবে না। কী চমৎকার কনসেপ্ট- পাবলিক নামধারী প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। এদিকে সুপ্রতিষ্ঠিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রাইভেটাইজেশনের কাজও এগিয়ে চলেছে। ক’বছর হল বিশ্বব্যাংক HEQEP নামের এক প্রাণঘাতী ভাইরাস পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য কোটি কোটি টাকা ‘দান’ করছে বিশ্বব্যাংক। প্রথমে শুনলাম দান, এখন শুনছি ঋণ, সহজ শর্তে ঋণ। হাজার টাকার লোভ যেখানে সামলানো যায়না সেখানে কোটি কোটি টাকা। আমাদের বাম ডান মধ্য সব আদর্শের শিক্ষকেরাই মুক্তকচ্ছ হয়ে ছুটছেন এই হরিলুটের পেছনে। কাজের কাজ যা হয়েছে তা খুবই সামান্য- প্রায় সব জায়গাতেই চলেছে অবাধ লুটপাট। আর এই ঋণের জালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছে বিশ্বব্যাংক। এখন শুরু হবে চাপ দেয়া। আমাদের কথা মত চল না হলে টাকা ফেরত দাও। সব অবকাঠামো তৈরি (কাজীর গরুর মত)- সুতরাং আর তো কোন খরচ নেই। এখন ছাত্রদের কাছ থেকে বেতন নাও আর মাস্টারদের বেতন দাও। সোজা হিসেব- সুতরাং রাষ্ট্রের আর কোন দায় থাকছেনা এখানে।
আবারও চোখ ফেরাই মার্কিন মুলুকের দিকে। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বেতন বৃদ্ধির প্রসঙ্গ এলেই যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ টানা হয়। এ কথা সত্যি, দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত বেতন ফ্রি হলেও এখানে উচ্চশিক্ষা অবৈতনিক নয়। বরং বলা চলে ছাত্র বেতন এখানে বেশ বেশি। আমেরিকার ছাত্ররা এত বেতন দিয়ে পড়ে, বাংলাদেশে কেন এত অল্প বেতনে পড়বে এমন কথা প্রায়ই বোদ্ধারা বলে থাকেন। আমেরিকায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্রদের বেতন অস্বাভাবিক বেশি কথাটি সত্যি নয়। আমরা অনেক সময় প্রাইভেট এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একসাথে গুলিয়ে ফেলি। আমেরিকার অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় আসলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে বেতন বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে অনেক ভাল বিশ্ববিদ্যালয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে বেতন তুলনামূলকভাবে অনেক কম। বিদেশি ছাত্রদের ক্ষেত্রে বেতন বেশি, আরবদের পেলে এরা ঘাড় মটকানো বেতন চায়, সেটা ব্যবসা। কিন্তু স্থানীয় বিশেষ করে নিজের স্টেটের ছাত্রদের ক্ষেত্রে বেতন বেশ কম। এর পাশাপাশি আছে স্কলারশীপ। মেধাবী ছাত্ররা কেউই বেতন দিয়ে পড়েনা, বরং যা স্কলারশিপ পায় তা দিয়ে দিব্যি চলে যায় তাদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে কাজের নানা সুযোগ থাকে যার আয় দিয়েও একজন ছাত্র ভালভাবেই চলতে পারে। আর যার কিছু নেই তার জন্যেও আছে সুলভ এবং সহজ শিক্ষাঋণ। ছেলেমেয়ের পড়ার খরচ কিভাবে আসবে অভিভাবকদের তা নিয়ে মোটেই ভাবতে হয়না। ঋণ নিয়ে যে ছাত্রটি পড়ছে সে চাকরি পাবার পর সহজ কিস্তিতে বেতন থেকে ঋণ পরিশোধ করছে, তেমন কোন চাপ সে অনুভব করেনা। আর এখানেও ছাত্রদের বেতন দিয়ে শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ করা হয় না। ফেডারেল ও স্টেট বাজেট থেকে বিপুল অর্থ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য বরাদ্দ করা হয়। আর গবেষণার জন্য বরাদ্দকৃত বিলিয়ন ডলারের কথা বাদই দিলাম। যারা আমেরিকার উদাহরণ দেন, তাদের আগে বলি যদিও আমেরিকা আমার আদর্শ নয়, তবুও আমেরিকা তাদের বাজেটে উচ্চশিক্ষার জন্য যে হারে অর্থ বরাদ্দ করে সেই হারে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অর্থ বরাদ্দ দিন, তারপর কথা হবে আপনার সাথে।
অর্থমন্ত্রী মহোদয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের দুর্নীতির মাধ্যমে পদোন্নতির কথা বলেছেন। দুর্নীতি তো আছেই, শুধু পদোন্নতি কেন, নিয়োগেও আছে। স্কুলে চাকরি পায়নি, বিসিএসে রিটেনে ফেল, পরের বার বিসিএসে নকল করে বহিষ্কৃত- এমন লোক কি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পদে নেই? আছে, আমার বন্ধুদের মধ্যেই আছে। এই তো সেদিন একজন ব্যক্তি বাসের ভেতর আক্ষেপ করে বলছিলেন আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা হত ক্রিমের ক্রিম আর এখন হচ্ছে ঘোলের ঘোল। সবাই সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালেন, মানুষ এভাবেই ভাবে এখন। আমি বললাম ভাই আপনি ঘোলের দামে যদি ক্রিম কিনতে চান তাহলে কী পাবেন? তিনি আর কথা বাড়ালেন না। হ্যাঁ, আমি দ্ব্যর্থহীনভাবেই চাই মেধাবী যোগ্য শিক্ষকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসুক। অমুকের স্ত্রী, অমুকের সন্তান, অমুকের শ্যালিকা, অমুকের বাজার সরকার, অমুকের শয্যাসঙ্গী, অমুক দলের ক্যাডার এসব পরিচয়ে যেন কেউ শিক্ষক নিয়োগ না পায়। পদোন্নতির মান উন্নত করা হোক, আমি আছি আপনার সাথে। কিন্তু তার সাথে বেতনের প্রসঙ্গ আসবে কেন? এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক বিষয়। আর দূর্নীতির জন্য কি কেবল শিক্ষকেরাই দায়ী? সাদাচোখে তাই মনে হয়, যেহেতু কলের পুতুলের মত কাজগুলো শিক্ষকেরাই করেন। কিন্তু ভেবে দেখুনতো নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কারা যুক্ত থাকেন? নিয়োগ/পদোন্নতির ক্ষেত্রে ৯৯.৯৯৯৯৯৯... ভাগ দায় দায়িত্ব স্বয়ং উপাচার্যের। তার সম্মতি ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন নিয়োগ পদোন্নতি সম্ভব নয়। কে তাঁকে নিয়োগ দিচ্ছে? সরকার। একদম তার মর্জি মাফিক। তাহলে? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি আজ দুর্নীতি হয় তার ৯৯.৯৯৯৯৯৯... ভাগ দায়িত্ব অবশ্যই সরকারকেই নিতে হবে, মন্ত্রী মহোদয় আপনি কি এই দায় নেবেন?
আরও বলার ছিল অনেক কিছুই। কিন্তু কথা শেষ করতে হবে। শিক্ষকদের নিজেদের মর্যাদা সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন হতে হবে। বাবা বলতেন ‘ওগো, আমাকে সম্মান কর’ এভাবে বিলাপ করে নিজের সম্মান বাড়ানো যাবেনা, সম্মান আসে মনের অন্তঃস্থল থেকে। সেখানে আপনাদের পৌঁছুতে হবে। অর্থের পেছনে ছুটলে আপনার সম্মান বাড়বে না। আমি যেখানে শিক্ষকতা করি সেখানে এডমিশন টেস্ট নেই, পরীক্ষায় ইনভিজিলেশনের জন্য পয়সা নেই, প্রশ্ন করা খাতা দেখায় টাকা নেই, মডারেশন নেই, টেবুলেশন নেই, ভাইভা নেই, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এক্সটার্নাল হয়ে যাবার কোন প্রথা নেই, এম এস পিএইচডি থিসিস গাইড করে পয়সা নেই- শুধু নেই নেই আর নেই। তাহলে আছে টা কী? সম্মানজনক বেতন আর মেধা ও কাজের মূল্যায়ন। এখানে বাৎসরিক কোন ইঙ্ক্রিমেন্ট নেই, তবে কাজের স্বীকৃতি এত বেশি যে ভুতের বাবা আপনাকে টাকা দিয়ে যাবে, টাকার পেছনে ছুটতে হবে না। আমলাতন্ত্রকে বুঝতে হবে শিক্ষকেরা কারও প্রতিপক্ষ নয়। একজন ভালো আমলার পেছনেও অবদান আছে একজন ভালো শিক্ষকের। শিক্ষাখাতে ব্যয় রাষ্ট্রের কোন বোঝা নয়, বরং এটা সর্বোত্তম বিনিয়োগ। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ বেশি নেই, কিন্তু আমাদের যে সম্পদ আছে তা বিশ্বের খুব বেশি দেশের নেই। তা হল মানব সম্পদ। বাঙ্গালী অসম মেধাবী একটি জাতি যাদের কেরানী বানানোর শিক্ষা দিলেও নোবেল ছিনিয়ে আনে, হয়ে যায় জগতের সেরা বিজ্ঞানী। এই দেশ এই জাতিকে বাঁচাতে হলে শুধু একটি পথই খোলা আছে, তা হল শিক্ষা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ। শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আকৃষ্ট করতেই হবে আর সেটা কেবল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নয়, স্কুল কলেজ সব পর্যায়েই। আর শিক্ষক সংজ্ঞাটি প্রসারিত হবে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র সহ সব পেশার সব শিক্ষকদের ক্ষেত্রেই। আপনি ভালো শিক্ষক নিয়োগ দিন, আমরা আপনাকে দক্ষ আমলা, প্রশাসক, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক কী চান, সব উপহার দেব।
লেখকঃ
প্রফেসর রহমতুল্লাহ ইমন
বেল স্টেট ইউনিভারসিটি
https://www.facebook.com/rahmatullah.imon
Very nice
ReplyDelete