এই রাষ্ট্রের যতগুলো গ্লোরিয়াস অধ্যায় আছে তার সবগুলোর পেছনে শিক্ষক এবং ছাত্রের অবদান। আর এই রাষ্ট্রের কপালে যতগুলো কলঙ্কের তিলক লেপিত হয়েছে তার সবগুলোর দায় প্রশাসনিক আমলাদের। দুর্নীতিতে চেম্পিয়ান অথবা চাম্পিয়ান না হলেও কাছাকাছি সবসময় থেকেছি কাদের দুর্নীতির জন্য? শিক্ষকদের জন্য নাকি আমলাদের দুর্নীতির জন্য? শিক্ষকদের উপর যে সকল বড় বড় দায়িত্ব আছে তার মধ্যে একটি হলো ভর্তি পরীক্ষা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের যত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা হয় তা আজ পর্যন্ত সম্পূর্ণ pilfer-proof এবং leak-proof অর্থাৎ এখন পর্যন্ত কোন ধরনের স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি, প্রশ্নপত্র ফাঁস ইত্যাদি হয়নি বললেই চলে। পাশাপাশি মন্ত্রনালয়ের আন্ডারে যেসকল পরীক্ষা হয় সেগুলোর দিকে একবার তাকান এবং তুলনা করে দেখুন। কিছুদিন আগে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভর্তি সিস্টেম করতে গিয়ে যে কি পরিমান হ-য-ব-র-ল অবস্থা সৃষ্টি করেছে তা আমরা সবাই অবগত আছি। তাছাড়া ছোট্ট ছেলেমেয়েদের যত পাবলিক পরীক্ষা তারা আয়োজন করে তার প্রায় প্রত্যেকটি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। তাছাড়া আমাদের আমলারা তাদের মনিবদের খুশি করতে গিয়ে পরীক্ষার inflated ফলাফল নিয়েও জনমনে অসন্তোষ সুস্পষ্ট।
এছাড়া স্কুল কলেজের শিক্ষকদের কাছে বিভীষিকাময় একটা ভবনের নাম "শিক্ষা ভবন"। এই ভবনে কর্মরত কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কর্মচারী পর্যন্ত জাতির বিবেক, জাতি গঠনের কারিগর স্কুল কলেজের শিক্ষকদের কাছ থেকে ঘুষ বিহীন কোন কাজ করাতে পেরেছে বলে আমি আজ পর্যন্ত শুনিনি। কোন শিক্ষককে যখন ওই ভবনে যাবার প্রয়োজন পরে তখন কপালে পরে দুশ্চিন্তার বলিরেখা। ওখানে যাওয়া মানেই হলো এক গাদা টাকার ঘুষ। কেউ যদি টাকা ছাড়া কোন কাজ করাতে পেরে থাকে সেটা পেরেছে ওই শিক্ষকের যদি কোন খুটির জোর থাকে অন্যথায় ঘুষ বিহীন কোন কাজ ওই ভবনে হয় না। প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্ব কাদের উপর ন্যাস্ত? এটা প্রায় ওপেন সিক্রেট যে, প্রতিটা প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগে ৩ থেকে ৪ লক্ষ টাকা ঘুষ দিতে হয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন নিয়োগ প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ। জাতির ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে তারা পারত অন্তত এই ক্ষেত্রটাকে দুর্নীতির আওতামুক্ত রাখতে। ঘুষের মাধ্যমে যারা চাকুরী পায় তারা স্বাভাবিক অপেক্ষাকৃত খারাপ যোগ্যতাসম্পন্ন। আর যেই শিক্ষক ঘুষ দিয়ে শিক্ষক হন সেই শিক্ষক তার ছাত্রছাত্রীদের মরাল শিক্ষা দেওয়ার সমস্ত মরাল রাইট চাকুরীর শুরুতেই হারিয়ে ফেলেন। আর প্রাইমারি স্কুল শিক্ষকদের বেতন সম্পর্কে যত কম বলা যায় ততই মঙ্গল। অথচ বিল্ডিং-এর যেমন ফাউন্ডেশন হলো piling তেমনি শিক্ষার ক্ষেত্রে শক্ত ফাউন্ডেশন মানে প্রাইমারি education। এই কথাটি আমাদের academician-রা বার বার বলে এসেছেন কিন্তু আমাদের আমলারা এটা বুঝতে অপারগ। শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমে শিক্ষা ক্ষেত্রে যত কাজ হয় তার প্রায় সবগুলো দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি দ্বারা জর্জরিত।
একবার ভাবুনতো দেখি উচ্চ শিক্ষাও যদি এই মন্ত্রনালয়ের আন্ডারে থাকত? আমাদের শিক্ষক নিয়োগ এখন যেরকমই হোক না কেন এখন পর্যন্ত কেউ বলতে পারবে না যে ঘুষ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রনালয়ের আন্ডারে যদি শিক্ষক নিয়োগ হত!! আমি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি প্রত্যেকটা নিয়োগে ঘুষ বানিজ্য হত। আমরা যারা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তারা পৃথিবীর সর্বনিম্ন সুযোগ সুবিধা পাই। সুযোগ এবং আউটপুটের একটা তুলনামূলক লেখচিত্র করলে দেখানো যাবে আমরাই হলাম পৃথিবীতে সবচেয়ে efficient শিক্ষক। এত কম বাজেটে এত ভালো পারফরমেন্স আমাদের দ্বারাই সম্ভব হয়েছে। প্রায়ই তুলনা করে blame করে বলা হয় আমাদের শিক্ষকরা গবেষণা করে না। গবেষনার যে পরিমান সুযোগ সুবিধা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দেওয়া ওই পরিমান টাকা দিয়ে আমরা যতটুকু গবেষণা করি পৃথিবীর আর কেউ পারবে বলে আমরা বিশ্বাস হয় না। আরো একটি অভিযোগ হলো আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে খন্ডকালীন বা পার্ট-টাইম শিক্ষকতা করেন। এসবই সত্যি কথা। হ্যা পার্ট-টাইম শিক্ষকতা করেন অর্থাত কষ্ট করে পড়িয়ে দুটো টাকা অতিরিক্ত আয় করেন ঘুষ বা দুর্নীতি তো করেন না। আর তাও করার সুযোগ পায় শতকরা ১০ ভাগের মত শিক্ষক।
বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে উন্নত করতে হলে উপায় একটিই আর সেটি হলো শিক্ষায় উন্নতি। এখন শিক্ষায় উন্নতি কি এমনি এমনি হবে? তার জন্য প্রয়োজন বরাদ্দ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক বরাদ্দ হলো উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন একটি বিভাগের বরাদ্দ থেকেও কম। ঘুরে আসুন বিশ্বের যে কোন একটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয়। দেখে আসুন ওখানকার ক্লাসরুম, শিক্ষকদের অফিস কক্ষ ও আনুষঙ্গিক ভৌত অবকাঠামো, ছাত্রছাত্রীদের আবাসিক সুবিধা ইত্যাদি তারপর তুলনা করে দেখুন আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অথবা যে কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। ঘেন্না লাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টয়লেটের অবস্থা দেখলে। কান্না পায় ছাত্রদের আবাসিক হলগুলোর দিকে তাকালে। এত অবহেলা, এত অবহেলা তারপরও যে আমাদের ছেলেমেয়রা বিদেশে সারা বিশ্বের ছাত্রছাত্রীদের সাথে compete করে বিশ্বের নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য যাচ্ছে, বিশ্বের নামীদামী কোম্পানিতে চাকুরী পাচ্ছে এটা এক আশ্চর্য্যের ব্যাপার। এত অবহেলার পরও আমাদের ছাত্ররা, শিক্ষকরা সুবোধ বালকের মত সহ্য করে চলেছে। বাঁচার মত ন্যুনতম মর্যাদাসম্পন্ন একটা বেতন কাঠামো দিয়ে দেখুন আমাদের শিক্ষকরা পার্ট-টাইম পড়াতে কোথাও যায় কিনা। হ্যা, আমরা আমাদের প্রমোসন নীতিমালা অত্যন্ত সহজ করে ফেলেছি। কিন্তু কেন? সেটার কারণও কিন্তু স্বল্প বেতন। প্রমোসনকে দেখা হয় হয় আর্থিক সুবিধা হিসাবে। অথচ প্রমোসন হওয়া উচিত ছিল যোগ্যতার মাপকাঠি। প্রশ্ন হলো শুধুই কি শিক্ষকদের প্রমোশনের নীতিমালা সহজ করা হয়েছে? আমলা বা অন্যান্য ক্ষেত্রে কি একইভাবে সহজ করা হয় নি?
যাহোক এসব তুলনামূলক ব্যাপার স্যাপার করতে গা ঘিনঘিন করছে। কিন্তু আমাদের জাতীয় বেতন স্কেল যেভাবে আছে বা ছিল তাতেইতো তুলনার বীজ বপিত। তাই আমাদের একটাই দাবি হওয়া উচিত আর সেটা হলো আমাদেরকে জাতীয় বেতন স্কেল থেকে decouple করে দিয়ে স্বতন্ত্র বেতন স্কেল করে দেওয়া হোক। In fact, সমস্ত পর্যায়ের শিক্ষকদের জন্য একটা স্বতন্ত্র শিক্ষা স্কেল তৈরী প্রয়োজন। অর্থাত প্রাইমারি থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত সকল শিক্ষকদের জন্য একটি স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোই হচ্ছে শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নতির চাবিকাঠি। এছাড়া শিক্ষা সংক্রান্ত সমস্ত বিষয় আমাদের মন্ত্রনালয় থেকে decouple করে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষাকে মন্ত্রনালয়ের আন্ডারে রাখলে আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থার উন্নতি কোনদিন আমাদের কাঙ্খিত অবস্থায় যাবে না।
কামরুল হাসান
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
0 comments:
Post a Comment