‘কী আশায় বাঁধি খেলাঘর বেদনার এই বালুচরে।’ আশা, আস্থা, ভরসা, সম্মান, বিশ্বাস—এ ধরনের ইতিবাচক শব্দগুলো বালুচরে ঢেউয়ের ভিড়ে বারবারই হারিয়ে যাচ্ছে। তাই এ আস্থা ভাঙাগড়ার খেলায় আজ আর কোনোভাবেই আশার সঞ্চার হয় না। শিক্ষকসমাজের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য সম্মানজনক বেতন কাঠামোর কথা সরকার প্রথম থেকেই বলছে, হচ্ছে, হবে। আর শিক্ষকরা বলে যাচ্ছেন, কবে? এখন বলতে হয়, আর কবে?
বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েই ঈদুল আজহার ছুটি ৫ অক্টোবরের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর আগামী ৬ অক্টোবর সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেডারেশনের বৈঠক ডাকা হয়েছে। ওই দিনই পরবর্তী কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ভর্তি মৌসুম চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এরই মধ্যে ভর্তি-ইচ্ছুকদের আবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী ৯ অক্টোবর এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হবে। ফেডারেশনের সূত্রে জানা গেছে, সবাই ভর্তি পরীক্ষা বন্ধের পক্ষেই মত দিয়েছেন। একই সঙ্গে লাগাতার কর্মবিরতি ডেকে সব বিশ্ববিদ্যালয় অচল করে দেওয়ার পক্ষে সবার অবস্থান।
শিক্ষাবান্ধব এ সরকার বেতন বৈষম্যকে দূর করার জন্য আগের কমিটিকে পুনর্গঠন করেছে। শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী এ কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। নিঃসন্দেহে এটা অত্যন্ত শক্তিশালী কমিটি। কিন্তু অর্থমন্ত্রী কমিটির প্রধান থাকায় শিক্ষকরা এ কমিটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। যদিও তিনি শিক্ষকদের কটূক্তি করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন; কিন্তু তাঁর ওপর আবারো আস্থা রাখা শিক্ষকসমাজের জন্য কঠিন।
গত ৭ সেপ্টেম্বর কমিটির ওপর দায়িত্ব দেওয়া হলো, অথচ এর মধ্যে এ কমিটিতে একটি সভাও অনুষ্ঠিত হয়নি। উপরন্তু কমিটি প্রধান শিক্ষকদের অপমান করে এক মাসের জন্য চলে গেছে দেশের বাইরে। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর ওপর শিক্ষকদের আস্থা থাকলেও এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ কমিটির প্রধান যখন গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেন না, তখন আস্থা শব্দটি অনাস্থাতেই পরিণত হয়।
আসলে অনেকেই চাইছেন না, যে শিক্ষকদের মর্যাদা অটুট থাকুক। কোনো এক স্বার্থান্বেষী মহল অপরকে বঞ্চিত করার মধ্য দিয়ে নিজেকে চিরস্থায়ীভাবে ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত করতে চাইছেন। এবং এটা করে বারবার তারা হীনমন্যতার পরিচয় দিচ্ছেন।
অনেক আগে থেকেই আমরা শুনে আসছি, শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হবে, যা শিক্ষকদের স্বতন্ত্র ও সম্মানজনক বেতন কাঠামোও নিশ্চিত করতে পারে। তবে এ নীতি বাস্তবায়িত হতে আইন পাস করা জরুরি। কিন্তু এ নীতি বাস্তবায়ন দূরের কথা, যতগুলো কমিটি করা হয়েছে কোনো কমিটি থেকেই পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পেশ করা হয়নি। যদি শিক্ষা খাতে বরাদ্দের কথা বলি, তবে সেটাও অন্যান্য খাতের তুলনায় অনেক কম। আমাদের দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই বিশ্ব র্যাংকিংয়ের পাঁচ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও নেই। এ ব্যাপারে কোনো ব্যক্তি বিশেষ দায়ী নয়। সমগ্র ব্যবস্থা দায়ী, যা নতুন করে ঢেলে সাজানো দরকার। সত্যিকার অর্থে বিনিয়োগ যদি ঠিকভাবে না হয়, তবে মুনাফার আশা করা বৃথা। আমাদের শিক্ষা খাতেরও একই অবস্থা। তার পরিণতি আজ শিক্ষার দুরবস্থা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সারির শিক্ষার্থী মানেই সে হবে আগামী দিনের উজ্জ্বল শিক্ষক। এ স্বপ্ন আর কেউই হয়তো দেখবে না। বা খুব ভালো ফল করে বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে হয়তো আজ আর কেউ দেশে ফিরে আসবে না মাটির টানে, দেশের টানে, শিক্ষার্থীর টানে। পাচার হয়ে যাবে সকল মেধাবী, মেধা। আর থেকে যাওয়া মেধাবীরা হয়তো শিক্ষার্থীর পড়াশোনার চেয়ে বেশি নজর দেবে বিদেশি এনজিও বা ডোনার এজেন্সির প্রকল্পে।
তাই বোধকরি বেতন কাঠামো ঠিক করার এখনই সময়, আর দেরি নয়; হচ্ছে-হবে, কবে-কবে করে আর আশায় বুক বাঁধতে চান না শিক্ষকরা। হলে সেটা এখনই হতে হবে। না হলে তরুণ শিক্ষকরা হয়তো হতাশ হয়ে পড়বেন এবং তাদের পেশা পরিবর্তন করবেন, নয়তো বিদেশে পাড়ি জমাবেন।
লেখক : প্রভাষক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।Published in: http://www.ntvbd.com/opinion/22550
0 comments:
Post a Comment