Saturday, September 19, 2015

‘এই সমস্যা আমার নয়, অন্য কেউ তা সমাধান করুক’

Ali Riaz

মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে এই অভিযোগের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভাষ্য হচ্ছে এই অভিযোগ মিথ্যা। তা হলে ইউজিসির তিন কর্মকর্তার গ্রেফতারের কারন কি? আচ্ছা, সেটা না হয় তদন্তের ফলাফলের জন্যে আপাতত তোলা থাক। ফল প্রকাশের তাড়াহুড়ো করা হয়েছে এমন অভিযোগের জবাব কি? এর কোনো উত্তর আমরা পাবো বলে মনে হয় না।

প্রশ্নপত্র ফাঁস হবার ঘটনার প্রেক্ষিতে অনেকে প্রশ্ন করেছেন এই শিক্ষার্থীরা যখন চিকিৎসক হবেন তখন কী হবে। এই শিক্ষার্থীরা আগামীতে কষ্ট করে, উদয়াস্ত পরিশ্রম করে শিখতে পারবেন না তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল; সবাই পারবেন তাও মনে করার কারন নেই। যারা সহজ পথ বেছে নিলেন তার কি করবেন সেটা আমরা জানিনা। তাঁদের মেডিক্যালে পড়ার প্রয়োজনীয় ভিত্তিগত শিক্ষা আছে কিনা সেটা অবশ্যই প্রশ্ন।

যারা এই ধরণের অন্যায় অবৈধ ব্যবস্থার কারুকৃৎ তাঁরা এবং যারা এর পক্ষে সাফাই গাইছেন তাঁরা কী এসব চিকিৎসকের কাছে যাবেন? এই প্রশ্নও তুলেছেন অনেকে। আসলে তাঁদের এই সব ডাক্তারের কাছে যাবার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। এরা যথেষ্ট অর্থ-বিত্ত জোগাড় করতে পারেন, এই ধরণের/শ্রেনীর লোকজন বিদেশে চিকিৎসা করিয়ে অভ্যস্ত।

আমি উদ্বিগ্ন এই কারনে যে, এখন যে কোন ধরণের পাবলিক পরীক্ষা মানেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া। সেটা একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ের পরীক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি পর্যন্ত একই রকম। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থা, ব্যবস্থা হিসেবেই ভেঙ্গে পড়ছে। তা স্বত্ত্বেও আজকেও যে কয়েকজনকে মেধার ওপরে নির্ভর করতে দেখি, সামনে তার সংখ্যা কমতে বাধ্য। কেননা এর জন্যে প্রনোদনা তো নেই-ই, আছে উল্টো ব্যবস্থা। তার ফলে ইতিমধ্যে ক্ষতি কম হয় নি।

এসব সমস্যা সমাধানের অযোগ্য কোনো কিছু না; সারা পৃথিবীতে পরীক্ষার গোপনীয়তা রক্ষার জন্যে বিভিন্ন ধরণের প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা চালু আছে। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা তার সঙ্গে পরিচিত নয় তাও নয়। এ-লেভেল, ও-লেভেল, স্যাট, টোয়েফেল, জিআরই পরীক্ষা দিচ্ছেন। সেগুলো থেকেই বোঝা যায় যে এটা বাংলাদেশেও সম্ভব। কিন্ত আসল প্রশ্ন হল সমাধান চাইছি কিনা।

কে চাইবেন সমাধান? যারা এর থেকে সুবিধা পাচ্ছেন তাঁরা কী এর সমাধান চাইবেন? সেই আশা বাতুলতা মাত্র। নীতিগত বিবেচনায় এই পরিস্থিতির সমাধান চাইবার কথা শিক্ষকদের, তাদেরই উচিত এটা নিশ্চিত করা যে শিক্ষা যেন মেধাচর্চার জায়গা হয়। কিন্ত শিক্ষকদের সেই অবস্থান আছে এমন দাবি করা কঠিন; অনেকেই আমার চেয়েও কঠিন ভাষায় ব্লবেন, তাঁদের সেই অবস্থান নেই। কেন নেই তা আপনি জানেন। দলীয় বিবেচনায় বিভক্ত শিক্ষকরা প্রথমে বুঝতে চাইবেন তাতে তার দলের লাভ-ক্ষতির হিসেব। কিন্ত তা স্বত্ত্বেও সেই শিক্ষকদের কাছেই আবেদন জানাতে চাই যারা সরকারি চাকুরে নয়, যারা ‘স্বায়ত্ত্বশাসনের’ শক্তিতে বলিয়ান। স্বায়ত্তশাসন আপনাকে যেমন অধিকার দিয়েছে, তেমনি কিছু দায়িত্বো দিয়েছে। সেই দায়িত্বের অন্যত্ম হচ্ছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে দাঁড়ানো। সমাজে, রাজনীতিতে কোনটা ন্যায়-কোনটা অন্যায় তাই নিয়ে মতবিরোধ থাকতে পারে, কিন্ত শিক্ষার ক্ষেত্রে এই কান্ড যে অন্যায় সেই বিষয়ে ভিন্নমতের অবকাশ নেই।

এই দায়িত্ব সেই শিক্ষকদের ওপরেও বর্তায় যারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কেননা তাঁরা কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের বেতনভোগী কর্মচারী নন; গোটা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার অংশ। আপনি প্রত্যক্ষভাবে তাতে ক্ষতিগ্রস্থ কিনা সেটা যদি বিবেচনা করেন তবে যার লাভবান তারাও সেই বিবেচনা দিয়েই চালিত হবে। শিক্ষকরা কিছু করুন অথবা না করুন যাদের অবশ্যই করনীয় তাঁরা হলেন অভিভাবকরা। আপনি যদি চান আপনার সন্তান মেধার যোগ্যতায় পাশ করবে, ভর্তি হবে তা হলে আপনাকেই এই প্রশ্নে সরব হতে হবে।

যাদের জন্যে এই বিষয়ে সরব হওয়ার একইসঙ্গে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এবং নৈতিক তা হল শিক্ষার্থীরা। আপনি যদি না আগামীতে এই রকম একটি অন্যায় সুযোগের আশায় বসে থাকেন তবে আপনাকেই সুস্পষ্টভাবে কথা বলতে হবে। যদি আপনি ভাবেন যখন আমার পরীক্ষা আসবে, যখন আমার ভর্তির সমস্যা আসবে তখন কথা বলবো তা যে অসম্ভব তা আপনি জানেন। সেই সময় আপনার কাজ হচ্ছে পরীক্ষার প্রস্ততি নেয়া। ফলে আমি প্রাথমিক পাশ করে এসেছি এখন সেই ক্ষেত্রের সমস্যা আমার নয়, আমি কলেজে ভর্তি হয়েছি ফলে মাধ্যমিক পর্যায়ের পরীক্ষার সমস্যা আমার নয় - এই বিবেচনা যদি মাথায় রাখেন তবে ভর্তি পরীক্ষার এই সমস্যা আপনাকে যখন স্পর্শ করবে তখন তার সমাধান আশা করে লাভ নেই। ‘এই সমস্যা আমার নয়, অন্য কেউ তা সমাধান করুক’ এই দৃষ্টিভঙ্গি আপনাকে বেশি দূর নেবে না।

কাঠে ঘূণ ধরলে তা এক জায়গায় থাকেনা; শিক্ষা ব্যবস্থায় যে ঘূন তাও এক জায়গায় নেই – মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষা তার উদাহরণ মাত্র।

Professor, Politics and Government at Illinois State University

0 comments:

Post a Comment