মুহাম্মদ নুর হোসাইন
২০০৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারী নারী উন্নয়ন নীতিমালা অনুমোদিত হলে ইসলাম ধর্মের সাথে সেটি সাংঘর্ষিক কিনা তা খতিয়ে দেখার লক্ষ্যে চট্টগ্রামে একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়। ভাগ্যক্রমে আমার ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপনের দায়িত্ব বর্তায়। সেই প্রবন্ধে একটি কথা ছিল, “কোন ব্যক্তি বা সংগঠন নারী উন্নয়নের বিরুদ্ধে যেতে পারে না। কারণ, তারা তো কারো মা, মেয়ে, বোন, সহধর্মিনী বা পরিবারের সদস্য। তাদের উন্নয়ন মানে পুরুষেরও উন্নয়ন। সুতরাং কোন পুরুষ এমন আপন জনের উন্নয়নে অসুখী হয় কী করে?”
সেই কথার লেশ ধরে বলতে চাই, যিনি আজকের সচিব বা মেজর জেনারেল তিনি তো কোন না কোন শিক্ষকের ছাত্র। তিনি তো আর ঐশী জ্ঞানে জ্ঞানী হয়ে কোন বিদ্যাপীঠের সনদ অর্জন ব্যতিত হুট করে এই পদে আসীন হননি। সুতরাং আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন শিক্ষক কোন বৈশ্বিক স্বার্থের কারণে তাঁর ছাত্রের সাথে প্রতিযোগিতায় নামবেন অথবা কোন শিষ্টাচার বিশিষ্ট ছাত্র তাঁর গুরুজনের সাথে এমন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে তাঁকে পরাজিত করে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করবেন- এটা অন্তত জ্ঞান-জগতের ইতিহাসে বিরল।
কথাগুলো অষ্টম জাতীয় পে-স্কেলকে ঘিরে। এই স্কেলে সে রকম বিষয়ের অবতারণা হয়েছে বৈকি? আসলে রাষ্ট্রকে যদি একটি দেহ ধরে নেয়া হয়, তাহলে সেই রাষ্ট্রের প্রত্যেক শ্রেণি তার এক একটি অঙ্গ। আর প্রত্যেকটি অঙ্গ মিলে একটি পূর্ণাঙ্গ দেহ; যাকে সচল রাখতে এবং যার উন্নয়নে প্রত্যেক অঙ্গ আপন আপন অবস্থান থেকে অবদান রাখছে। কারো অবদানকে খাটো করে দেখার অথবা কার অবদান কত, এখানে সেটি বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই। কিন্তু অনভিপ্রেত হলেও সত্য যে, অষ্টম পে-স্কেল কাঠামো তৈরী হওয়ার পর থেকে অসন্তোষ, বিতর্ক ও আন্দোলন শুরু হয়েছে। শ্রেণিগত বৈষম্য শ্রেণিগত বিভেদ সৃষ্টি করেছে। যার দায়-দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে, যদিও তা সম্মানিত সচিবদের কারসাজিতে হয়েছে অথবা আগের আমলা এখন মন্ত্রী-এমন ব্যক্তিদের কারণে হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের সকল মতের শিক্ষক ক্ষুদ্ধ হয়েছেন।
বর্তমান বেতনের প্রায় দ্বিগুণ বাজেট দিয়ে যে পে-স্কেল তৈরী হয়েছে এবং যেটির কারণে দেশের প্রায় একুশ লক্ষ মানুষ এবং তৎসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা উপকৃত হবেন, সেই পে-স্কেলের কারণে সরকারও সকলের বাহবা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হয়েছে বিধি বাম। এখন সমাজের সম্মানিত শ্রেণিটি সোচ্চার হয়েছেন সরকারের সমালোচনায়। এর আসল কারণ কিন্তু টাকা নয়, বরং সম্মান। কারণ, যার টাকার লোভ আছে তিনি অন্তত শিক্ষকতার পেশায় আসেন না। অথচ তিনিই তাঁর শ্রেণির সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র বা ছাত্রী। তেমন অর্থ-কড়ি না থাকলেও তিনি এই পেশা বেঁচে নিয়েছেন শুধু সম্মানজনক পেশা আর জাতিগঠন মূলক প্রধান কাজ বলে। সেই বাস্তবতায় দেখা যায় যে, নিজের ছাত্র যখন ব্যাংকে বা প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকুরী করার সুবাদে এসি গাড়ীতে চড়ে অথবা ক্যাডরের চাকুরী পাওয়ার কারণে একাই একটি সরকারী জীপ বা পাজেরুতে চড়ে পথ পাড়ি দেন, তখন তার শিক্ষক কিন্তু ৪০/৫০ জনের বাসে করে কর্মস্থলে আসা-যাওয়া করেন, চাই সেটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস অথবা লোকাল বাস।
শিক্ষক কিন্তু তাঁর ছাত্রের উক্ত অবস্থান দেখে মহাখুশি। গাড়িতে তাঁর সাইডম্যানকে লক্ষ্য করে বলেন, এই আমাদের অমুক ছাত্র। আবার শিক্ষকের সাথে দেখা হলে, তাঁর ছাত্র বিনয়ের সাথে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করে কদম ছুঁয়ে সালাম করে অথবা বিনয়ের সাথে কুশল বিনিময় করে, তখন শিক্ষকের মন শ্রদ্ধায় সিক্ত হয়। তিনি মনে করেন এটাই আমার সাধনার ফসল, এটাই আমার জীবনে বড় পাওনা। তাঁর নিকট আর বাড়ি-গাড়ির বাসনা থাকে না। তাই দেখা যাচ্ছে ভারতের সর্বোচ্চ পদবীধারী ব্যক্তি বর্তমান বাঙালী প্রেসিডেন্ট শ্রী প্রণব মূখার্জী এখন রীতিমত উচ্চ মাধ্যমিক লেবেলে ক্লাস নিচ্ছেন। আরো মজার বিষয় হলো তিনি শিক্ষার্থীদেরকে বলে দিয়েছেন যেন তাঁকে মহামান্য রাষ্ট্রপতি না বলে ‘স্যার’ সম্বোধন করা হয়। বর্তমানে আত্মকেন্দ্রিক ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থায় ছাত্র-শিক্ষকের সেই শ্রদ্ধা আর স্নেহপূর্ন সম্পর্কে ক্রমশ ভাটা পড়ছে। আর সেটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে অষ্টম পে-স্কেল। তাই বলতে হয়, শিক্ষক শ্রেণির যেন আমও গেল ছালাও গেল। কথাটি একটু অতিরঞ্জন করে বলে ফেললাম কিনা জানি না। তবে পে-স্কেলের হিসাবটি পরিষ্কার হলে হয়ত অতিরঞ্জন মনে হবে না। ঘোষিত ও অনুমোদিত পে-স্কেল কাঠামোতে গ্রেড রাখা হয়েছে বিশটি। আবার তার উপরে সুপার গ্রেড রাখা হয়েছে দু’টি। সবমিলে বাইশটি। সুপার গ্রেডে থাকবেন মুখ্যসচিব, মন্ত্রীপরিষদ সচিব এবং মেজর জেনারেলগণ। গ্রেড১ এবং গ্রেড২ তে থাকবেন যথাক্রমে সচিব ও এডিশনাল সচিবগণ এবং তৎমর্যাদার সামরিক ব্যক্তিবর্গ। উল্লেখ্য যে, সকল সচিব বা সামরিক ব্যক্তি সুপার গ্রেড বা প্রথম গ্রেড পাবেন না। তবে তাদের কিছু সংখ্যক সিনিয়র ব্যক্তি পাবেন। অর্থাৎ সুপার গ্রেডে তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকবে।
পূর্বের পে-স্কেলগুলোতে সিলেকশন গ্রেড পেয়ে আনুপাতিক হারে কিছু সিনিয়র অধ্যাপক সেই গ্রেড পেতেন। এক কথায় সচিবদের সমান স্কেল পেতেন। অষ্টম পে-স্কেলে সিলেকশন গ্রেড বাতিল করা হয়েছে। আর অধ্যাপকদেরকে রাখা হয়েছে তিন নম্বর গ্রেডে। অর্থাৎ উপর থেকে হিসেব কষলে যা পঞ্চমে দাঁড়ায়। এটাই শিক্ষকগণের অর্থাৎ শিক্ষক শ্রেণির সর্বোচ্চ স্তর, আর উপরে যাওয়ার সুযোগ নেই। আবার চাকুরীগত মর্যাদা নির্ধারণ হবে সেই গ্রেডের ভিত্তিতেই। এটাই বর্তমান পে-স্কেলের মহিমা-গরিমা; যার মাধ্যমে শিক্ষকদেরকে শায়েস্তা করা হয়েছে বলা যায়। তবে কোন অপরাধে এভাবে শায়েস্তা করা হলো বা পদাবনতি দেয়া হলো, তা বোধগম্য নয়।
এ বাস্তবতা সত্যিই অপমানজনক। এমনকি পে-স্কেল ঘোষণাকালে সাংবাদিক বন্ধুরা শিক্ষকদের দাবী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে মন্ত্রীপরিষদ সচিব সাহেব যে দাম্ভিক সুর ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সাথে উত্তর দিয়েছেন- তাতে শিক্ষক সমাজ ক্ষুদ্ধ। আবার শিক্ষকগণের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর অসংলগ্ন মন্তব্য যেন কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা। অবশ্য তজ্জন্য মাননীয় মন্ত্রী গত ১০ সেপ্টেম্বর প্রকাশ্যে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি ভুল স্বীকার করেছেন। এই জন্য তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমার বাকী কথায় আসি। শিক্ষা যদি জাতির মেরুদ- হয়ে থাকে তাহলে সেই দ-ের কারিগর হলেন শিক্ষকগণ। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তো শুধু শিক্ষক নন, একজন গবেষকও বটে। যে গবেষণার হাত ধরে দেশে নোবেল আসে, দেশ খাদ্যে স্বনির্ভর হয়, পাটের জীবন রহস্য উদঘাটিত হয়, আইটিতে বিপ্লব সাধিত হয়, নাসাতে বাংলাদেশের গবেষক স্বীকৃতি পান ইত্যাদি, সেই শিক্ষা আর গবেষণাকে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে পদে পদে।
ছোট্ট ভূখন্ড, সীমিত সম্পদ, জনসংখ্যা সমস্যা ইত্যাদিতে জর্জরিত এই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে এবং চলমান অগ্রগতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হলে উন্নত শিক্ষা ও গবেষণাই তো হবে প্রধান অবলম্বন। যেমন মালয়শিয়াকে এই পর্যায়ে আনার ক্ষেত্রে ড. মহাথির মুহাম্মদের অন্যতম কৌশল ছিল বিদেশে কর্মরত শিক্ষক ও গবেষকগণের সাথে নিজে সরাসরি যোগাযোগ করে সমান সুযোগ-সুবিধা দিয়ে স্বদেশে ফিরিয়ে আনা। আর আমাদের দেশে চলছে উল্টো পরিকল্পনা! শিক্ষা ও গবেষণাকে বাধাগ্রস্ত করে বা অবমূল্যায়ন করে কি দেশকে মধ্যআয়ের দেশ বা উন্নত দেশে পরিণত করা যাবে?
শিক্ষকগণকে অবমূল্যায়ন আর গবেষকদেরকে অনুৎসাহিত করে কি মেধাপাচারের পথকে আরো ত্বরান্বিত করা হচ্ছে না? যে বৈশ্বিক সুখ আর খ্যাতি ছেড়ে শিক্ষক ও গবেষকগণ এই পেশায় এসেছেন, তাঁরা তো উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন। উপরন্তু এই পেশায় আগ্রহ হারাবেন মেধাবীরা । কারণ, একজন মেধাবী ছাত্র সুপার গ্রেড টার্গেট না করে সর্বোচ্চ পঞ্চম স্তরকে বেঁচে নেবেন কেন? এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে শিক্ষা, গবেষণা ও চলমান অগ্রগতি আর হেরে যাবে দেশ, জাতি ও আগামী প্রজন্ম।
লেখক : শিক্ষক, আবরি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
hmnhossain@gmail.com
hmnhossain@gmail.com
Published in: http://edainikpurbokone.net/content/2015/2015-09-16/zoom_view/4c.jpg
0 comments:
Post a Comment