Wednesday, September 16, 2015

শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেলঃ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নোয়নের একটি গুরুত্বপূর্ন শর্ত


অষ্ট্রেলিয়াতে থাকতে একবার “ইক্যুয়িটি এন্ড ডারভারসিটি” সংক্রান্ত এক ওয়ার্কশপে “রোমান্টিক মাল্টিকালচারিজম” নামে একটা টার্ম শুনেছিলাম। যতদূর মনে এর অর্থ অনেকটা এরকম, সাদা অষ্ট্রেলিয়ানরা ভিন্ন (মাইগ্রেন্ট) কালচারের উৎসব, পোশাক, খাবার-দাবার খুব এঞ্জয় করে। মসলাদার খাবার নাকে মুখে জল এনে খায়, কুর্তা-পাজমা শাড়ি পড়ে আর বলে “ইউর কালচার ইজ সো কালারফুল”। কিন্তু এই সাদারাই আবার শিক্ষা-চাকুরী-প্রোমোশনে মাইগ্রেন্টদের কম সুযোগ দেয়, মোটকথা সহজে মাথার উপর উঠতে দেয় না। আমাদের দেশে প্রশাসনের প্রবল ক্ষমতাশালী সচিব (করনিকও বলা যায়)-দের অবস্থা হয়েছে ঠিক তেমন। উনারা “রোমান্টিক রেস্পেকটিজম” এ আক্রান্ত, তাই শিক্ষক জাতির বিবেক, জাতির কারিগর, ব্লা ব্লা বলে মুখে সম্মান দেখানোটাই হয়ে গেছে রাষ্ট্রের তথাকথিত নেপথ্যের চালক এসব সোকল্ড মাল্টিস্কিল্ড সচিবদের কাজ! কেউ আবার এককাঠি সরেস, তাই নিজের শৈশবের শিক্ষককে বাসায় ডেকে এনে তার পায়ের কাছে বসে সালামের ভংগীতে ছবি তুলে ফেসবুকে দিচ্ছেন,কারন শো-অফটাই যে মুল কথা!

নিজের স্কুল শিক্ষকদের এত সম্মান করার ভান করলেও কার্যত শিক্ষকদের বেতন নির্ধারনের বেলায় সেই ব্রিটিশ আমলের “লাট সাহেবের কুকুরের এক পায়ের খরচ ইজ্যুকেল্টু পন্ডিত সাহেবের এক মাসের বেতনের” ঐতিহাসিক সুত্রই ফলো করা হচ্ছে। প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকতায় একসময় যেতেন খুব আন্তরিক, নিবেদিতপ্রান, মেধাবী ব্যক্তিরা। কালের বির্বতনে তাদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার যুগোপযোগী করার ব্যাপারে রাষ্ট্রযন্ত্র এতটাই বিমাতাসুলভ আচরন করেছে যে এই পেশায় এখন আর মেধাবীরা আসে না। একটি জাতির শিক্ষা কার্যক্রমে যেখানে শৈশবের স্কুল শিক্ষাই সবচে গুরুত্বপুর্ন, সেখানে মেধাবীদের এ পর্যায়ের শিক্ষকতায় আসা বন্ধ করে দেয়া অনেক গভীর ষড়যন্ত্রের ফলাফল। দেশের স্বার্থপর, দূর্নীতিবাজ আমলাতন্ত্র আর অদুরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব খুব সফলতার সাথেই এ কাজ সম্পন্ন করে দেশের শিক্ষা কার্যক্রমের ভিত্তিটাকেই প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছেন।

স্কুলের পর থাকলো কলেজের উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক শিক্ষা কার্যক্রম! এখানেও সরকারী কলেজ গুলোতে বিসিএস (শিক্ষা) ক্যাডার-এর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে শিক্ষকতাকে জাষ্ট একটা পেশা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। কোন বিষয়ে ভালো রেজাল্ট যেখানে সে বিষয়ের একজন ভালো শিক্ষক হবার পূর্বশর্ত, সেখানে বিসিএস (শিক্ষা) ক্যাডারে যারা সুযোগ পান তারা তার স্নাতক বা স্নাতকোত্তরে তার বিষয়ের একজন ভালো ছাত্র নাও হতে পারেন। আবার, বিসিএসে হয়তো তার প্রথম পছন্দ ছিলো ফরেন বা এডমিন বা কাষ্টমস বা পুলিশ, সেখানে প্রতিযোগীতামুলক পরীক্ষায় পিছিয়ে গিয়ে শিক্ষক হওয়ায় মানসিকভাবে ঐসব লাভজনক বা এলিট ক্যাডারদের তুলনায় ইনফেরিয়র বোধ করানোটাই এই সিস্টেমের মুল উদ্দেশ্য। জাতির বিবেক শিক্ষককে আরেকদফা নীচু করা গেলো। এই লেভেলের শিক্ষকতাতেও যেন খুব মেধাবীরা না যায় তার ব্যবস্থাও সম্পন্ন। অথচ এই কলেজ গুলোতেই একসময় শিক্ষাকতা করেছেন বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সাহিত্যিক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ, কথাসাহিত্যিক রাহাত খান প্রমুখ। এই কলেজ গুলোতে এ মানের শিক্ষকদের ঢোকার সুযোগ কোথায়? এখানেও মিশন একমপ্লিসড! রাষ্ট্র ও তার সো-কলড মাল্টিস্কিল্ড সচিবরা তাদের আজ্ঞাবহ একটি শিক্ষকশ্রেনী তৈরী করতে প্রায় সক্ষম হয়েছেন, যারা নিজেদের প্রাপ্য মর্যাদা নিয়ে কথা বলতে উচ্চকিত না।

বাকী থাকলো বিশ্ববিদ্যালয় ও এর শিক্ষকবৃন্দ। এরা সায়ত্বশাসিত, এর শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রন করা মুস্কিল, এরা পত্রিকায় বিবৃতি দেয়, সব রাজনৈতিক সরকারের সমালোচনা করে আবার এরা মেধার দিক থেকেও সামনের সারির। এরা বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করে, উন্নত সুযোগ সুবিধা পেলে ভালো মানের গবেষনা করে। স্বাভাবিক ভাবেই এদের দাবিয়ে রাখতে পারলে অনেক নির্বিঘ্ন থাকা যায়। জনগনকে বোকা বানানো যায়, প্রতিবাদহীন অন্যায় করা যায়। তাই এবার লক্ষ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা। আমলানির্ভর রাজনৈতিক সরকারগুলো যেহেতু সচেতন শিক্ষকসমাজকে নিয়ে শংকায় ভোগেন তাই সরকারের মদদে আমলারা এবার হাত দিয়েছেন শিক্ষকদের মর্যাদায়। নতুন পে-স্কেলে (৮ম পে-স্কেল) শিক্ষকদের কার্যতঃ ৫ ধাপে নিচে রেখে নানা গাল-ভরা নামে সচিবদের গ্রেডোন্নয়ন করা হয়েছে অযৌক্তিক ভাবে। উপরন্ত শিক্ষকদের ক্ষোভের মুখে পে-স্কেল পর্যালোচনার নামে নানা ধরনের অসম্মানজনক প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে, যেমনঃ সিনিয়ার প্রফেসর পদ সৃষ্টি, সিনিয়ার পদে যাবার জন্য সচিবদের নিয়ে গঠিত কমিটির কাছে ইন্টারভ্যু দেয়া (একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলে শিক্ষা সচিবের সাক্ষাতকার ১৬/০৯/২০১৫), শিক্ষকদের নিয়োগ ও পদোন্নতি পদ্ধতির আমুল পরিবর্তন ও শিক্ষকদের অন্যান্য সরকারী কর্মচারীর মত নিয়ন্ত্রন করতে চাওয়া ইত্যাদি। এদের মাথা এতই উর্বর যে এরা কোনদিন হয়তো বলবে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের জন্যও বিসিএস পরীক্ষা দিতে হবে। এভাবে এখানেও একসময় মেধাবিরা আসা বন্ধ করে দেবে, সুবিধা বেশি দেখে সচিব হতে চাইবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এভাবেই নিজেদের ইনফেরিয়র ভাবা শুরু করবে। সেই পরিকল্পনা প্রক্রিয়াধীন।

দেশের তথাকথিত নেপথ্যের চালক, যারা মাল্টিস্কিল্ড, ইসলামের ইতিহাসে পড়েও বিজ্ঞান বিষয়ক কোন মন্ত্রানালয় বা সংস্থার প্রধান হয়ে যাওয়ার অবিশ্বাস্য যোগ্যতা সম্পন্ন এসব আমলারা তাহলে আসলেই কি করছেন? দেশের শিক্ষা-ব্যবস্থা ধাপে ধাপে ধ্বংস করার এমন নীলনকশার বাস্তবায়নের তাদের ভূমিকা দেখে তাই সন্দেহ জাগে, আসলেও কি তারা দেশের ভালো চান? এত অতিবুদ্ধিমানরা কি জেনেশুনেই এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত?

তাই এটাই সুযোগ, বলতে গেলে শেষ সুযোগ! প্রাইমারী, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকদের সম্মান পুনরুদ্ধারের এটাই শেষ লড়াই। তাই ঘরে বসে না থেকে যে যার স্থান থেকে আন্দোলন গড়ে তুলি, দেখিয়ে দেই আমরাও পারি। দেখিয়ে দেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নে আমরা কতটা আন্তরিক!

শিক্ষকদের জন্য একটি স্বতন্ত্র স্কেল একটি মৌলিক দাবি, একটি যৌক্তিক দাবি। আসুন যৌক্তিক দাবীর কথা বলতে নিসংকোচ হই, অলীক জুজুর ভয়ে ভীত না হই!

শিক্ষকতাই হোক মেধাবীদের প্রথম পছন্দ!

0 comments:

Post a Comment