Wednesday, September 9, 2015

পাকিস্তান শিক্ষায় যে গুরুত্ব দেয়, আমরা তাও দেই না

গোলাম মোর্তোজা॥
img
শিক্ষাকে যে জাতি গুরুত্ব দেয়নি, তারা উন্নতি করেছে- পৃথিবীতে এমন নজির নেই। আমরা উন্নতির গল্প বলছি, শিক্ষাকে গুরুত্ব না দিয়ে। শিক্ষকদের গুরুত্ব না দিয়ে। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের ওপর আমরা ‘পিপার স্প্রে’ মারি। পশুর সঙ্গে আচরণেও মানুষ চিন্তা করে, শিক্ষকদের সঙ্গে নির্দয় আচরণে আমরা চিন্তা করি না।

১ জুলাই থেকে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা নতুন স্কেলে বেতন পাবেন। এখন একজন প্রাথমিকের শিক্ষক চাকরি শুরু করেন ৪৯০০ টাকা বেতনে। নতুন স্কেলে বেড়ে কত হবে, নিশ্চিত নই। এবারের বেতন কাঠামোয় মূল বিতর্কটি তৈরি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতন তিন ধাপ কমিয়ে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে।
পাকিস্তানের মতো প্রায় ব্যর্থ একটি রাষ্ট্র তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মর্যাদা ও আর্থিক সুবিধা বাড়িয়েছেন। একজন অক্সফোর্ড ফেরত শিক্ষককে দিয়ে সামরিক শাসক পারভেজ মোশাররফ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন ও সুযোগ সুবিধা কী হওয়া উচিত, সে বিষয়ক একটি কমিশন করেছিলেন। সেই কমিশন উচ্চ বেতন ও সুযোগ সুবিধার সুপারিশ করেছিল। বেনজির ভুট্টোর গণতান্ত্রিক সরকার এসে আমলাতন্ত্রের সুপারিশে তা বাস্তবায়ন করতে অস্বীকৃতি জানায়। এগিয়ে আসে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট। রায় দেয় শিক্ষকদের পক্ষে। ফলে পাকিস্তানে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকতা আর্থিকভাবে তো বটেই, সামাজিক মর্যাদার ক্ষেত্রেও অত্যন্ত আকর্ষণীয় পেশা।
শ্রীলঙ্কাও প্রায় একই রকম নীতি অনুসরণ করেছে। ভারত তো তার নীতিতে শিক্ষকতা পেশাকে লোভনীয় চাকরি ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ভারতে প্রাথমিকের একজন শিক্ষক চাকরি শুরু করেন ২০ হাজার রুপি বেতনে। ২৫ হাজার রুপি বেতনে মাধ্যমিকের একজন শিক্ষক চাকরি শুরু করেন। কলেজের একজন শিক্ষকের শুরুতে বেতন প্রায় ৪০ হাজার টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক চাকরি শুরু করেন ৫০ থেকে ৬৫ হাজার টাকা বেতনে। একজন প্রাথমিকের শিক্ষকও প্রথম মাসের বেতন পেয়ে কিস্তিতে একটি গাড়ি কিনতে পারেন। সেখানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও সৎ আয়ে গাড়ি কেনা অকল্পনীয় ব্যাপার। স্বচ্ছল জীবনযাপন করাই কষ্টকর।

শেখ হাসিনা সরকার একজন আমলা ও একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিককে দিয়ে কমিশন করেছিলেন। সেই কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বেতন বাড়ানো হলো। এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে একটি ‘পণ্য’ হিসেবে দেখেছেন, ‘শিক্ষা’ হিসেবে নয়। অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যেমন ‘শিক্ষা বিক্রি’ করে, তিনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ‘শিক্ষা বিক্রি’ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন, আয় বাড়াতে বলেছেন। বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য যা খুবই অনৈতিক একটি সুপারিশ।

ভারতে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এক লাখ রুপির বেশি বেতন পান। অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা, গবেষণা-ভাতা মিলিয়ে সিনিয়র অধ্যাপকরা ৩ থেকে ৪ লাখ রুপির সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতনের পরিমাণ উল্লেখ করাটাও সম্মানজনক নয়। ২০০০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক চাকরি শুরু করেছিলেন ৭ হাজার টাকা বেতনে। ১৫ বছর পরে এসে এখন তিনি সহযোগী অধ্যাপক, মূল বেতন মাত্র ২৯ হাজার টাকা। আগে সচিবদের সমমর্যাদায় অধ্যাপকদের অবস্থান ছিল। এখন তিন ধাপ নামিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা আগেই উল্লেখ করেছি।
২.
শেখ হাসিনা সরকার একজন আমলা ও একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিককে দিয়ে কমিশন করেছিলেন। সেই কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বেতন বাড়ানো হলো। এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকে একটি ‘পণ্য’ হিসেবে দেখেছেন, শিক্ষা হিসেবে নয়। অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যেমন ‘শিক্ষা বিক্রি’ করে, তিনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষা বিক্রির ইঙ্গিত দিয়েছেন, আয় বাড়াতে বলেছেন। বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য যা খুবই অনৈতিক একটি সুপারিশ।

গরিব মানুষ বা কৃষকের সন্তানরা যাতে উচ্চশিক্ষা না পায়, প্রকারান্তরে তেমন ব্যবস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ করেছেন এই সাবেক আমলা। এই আমলার নেতৃত্বে যে এমন কিছু ঘটছে, তা অজানা ছিল না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেতারা এতদিন মিনমিন করেছেন। জোরালো কোনও অবস্থান নেননি, বক্তব্য তুলে ধরেননি। দলীয় রাজনীতির প্রতি আনুগত্য অন্যান্য পেশাজীবী সংগঠনের মতো শিক্ষকদেরও মেরুদণ্ডহীন করে দিয়েছে। শিক্ষক নেতারা পদ-পদবি, নানা লোভের মোহে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। শিক্ষা বা শিক্ষকদের স্বার্থ দেখা তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কাজ নয়। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠায় এখন তারা আন্দোলন কর্মসূচি দিয়েছেন। তাদের আন্দোলন, রাগ, ক্ষোভ সব আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে, সরকারের বিরুদ্ধে নয়। তাদের ভাব দেখলে মনে হয়, সরকারের সম্মতি ছাড়াই আমলারা নিজেদের বেতন বাড়িয়ে নিয়েছেন। শিক্ষকদের এই আন্দোলন নিয়ে সবচেয়ে অসম্মানজনক মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী, ' আমার জানা নেই, কোথায় তাদের মর্যাদাহানি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের করাপ্ট প্র্যাকটিস নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার। প্রত্যেকেই এখানে সহজেই অধ্যাপক হয়ে যান। সহযোগী অধ্যাপকদের তারা খেয়াল-খুশি মতো পদোন্নতি দেন। দেখা গেছে, নিচে ১০ জন প্রভাষক, কিন্তু ওপরে এক হাজার অধ্যাপক। এটা কিছু হলো? শুধু উপরে পদোন্নতি হবে, এটা ঠিক না... আমলাতন্ত্রকে আমরা যেভাবে ম্যানেজ (পরিচালনা) করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফদেরও সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে।’
বাংলাদেশের দুর্নীতির প্রতিক স্বৈরাচার এরশাদ। সেই স্বৈরাচারি আমলের এবং এখনকার  মন্ত্রী বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের 'জ্ঞানের অভাব '! শিক্ষকরা ‘করাপ্ট প্র্যাকটিস’ করেন। সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা এতে অসম্মানিত বোধ করছি।
অবশ্য দলীয় শিক্ষকরা এই বক্তব্যে কতটা অসম্মানিতবোধ করেছেন, তা এখনও পরিস্কার করে বুঝতে পারছি না। তারা বিক্ষুদ্ধ হয়েছেন, বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু টকশোতে এসে যেভাবে বলেছেন 'মাননীয় অর্থমন্ত্রী বয়োবৃদ্ধ ' 'তিনি একেক  সময় একেক কথা বলেন '... ইত্যাদি বলছেন। তাতে বোঝা যাচ্ছে প্রতিবাদের 'মিনমিনে' ভাবটা এখনও পুরোপুরি যায়নি। সর্বত্র অন্ধ দল-দাসত্বের দৃষ্টান্ত দেখছি আমরা।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আন্দোলনের এই সময়ে আর একটি বিষয় পরিস্কার হলো। আন্দোলনে তারা ছাত্র সংগঠনের সমর্থন বা সক্রিয় অংশগ্রহণ পাচ্ছেন না, পাবেন না। কারণ ছাত্রলীগ যে ক্যাম্পাসের একক ছাত্র সংগঠনে পরিণত হয়েছে, তার পেছনেও এই দলীয় শিক্ষকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। অন্য ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের ক্যাম্পাস ছাড়া দৃশ্যমানভাবে ছাত্রলীগ করেছে, নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন এসব শিক্ষকরাও। যা এখন বুমেরাং হয়ে সামনে এসেছে। বিপদের দিনে, শিক্ষকদের এই অসম্মানিত করার দিনে ছাত্র সংগঠনকে পাশে পাচ্ছেন না। বাম ছাত্র সংগঠনগুলো হয়ত পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবেন। ছাত্রলীগের কারণে তারা খুব একটা সুবিধা করতে পারবেন বলে মনে হয় না।
শিক্ষকদের এত বড় অসম্মান, অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, আন্দোলন করছে না, করবে না! বিষয়টি ভাবা যায়!
৩.
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়ানো ইতিবাচক। শিক্ষকদের অবদমন নিন্দনীয়। সমাজের অন্যান্য সেক্টরের কথা না ভাবাটা অন্যায়। বেতন বাড়লে বাজারের ওপর যে প্রভাব পড়ে সাধারণ মানুষের জন্যে তা অসহনীয় হয়ে ওঠে। বেতন বাড়ানোর চেয়ে দাম স্থিতিশীল রাখার দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া জরুরি হলেও আমাদের সরকারগুলো তা করে না। সচিবদের বেতন বাড়ানোর পাশাপাশি দুর্নীতি কমানোর দিক নির্দেশনাও জরুরি ছিল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস নেওয়া এবং এনজিওর কনসালটেন্সি নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন। সবার ক্ষেত্রে ঠিক না হলেও অভিযোগটি একেবারে মিথ্যে নয়। কিন্তু আর্থিক নিশ্চয়তা না দিয়ে, গবেষণার জন্যে প্রায় কোনও বরাদ্দ না দিয়ে, শুধু দোষারোপ করলে পরিস্থিতির কোনও উন্নয়ন হবে না। আমাদের অন্যান্য সব সেক্টরের মতো শিক্ষা ব্যবস্থাও চলছে এডহক ভিত্তিতে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। তারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস নেওয়া এবং এনজিওর কনসালটেন্সি নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন। সবার ক্ষেত্রে ঠিক না হলেও অভিযোগটি একেবারে মিথ্যে নয়। কিন্তু আর্থিক নিশ্চয়তা না দিয়ে, গবেষণার জন্যে প্রায় কোনও বরাদ্দ না দিয়ে, শুধু দোষারোপ করলে পরিস্থিতির কোনও উন্নয়ন হবে না। আমাদের অন্যান্য সব সেক্টরের মতো শিক্ষা ব্যবস্থাও চলছে এডহক ভিত্তিতে।

একজন শিক্ষামন্ত্রী আছেন, বই পৌঁছানোতেই তার সমস্ত মেধা ব্যয় হচ্ছে। শিক্ষা বিষয়ে তার কোনও কাজ নেই। প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা অনিয়মে এই শিক্ষামন্ত্রীর হাত দিয়েই শিক্ষার সবচেয়ে বড় ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। উন্নয়নের জন্য মানবসম্পদ উন্নয়নের কোনও বিকল্প নেই। আমলাতন্ত্রে মেধাবীদের যাওয়া খুবই জরুরি। তার আগে শিক্ষকতা পেশায় মেধাবীদের আসা জরুরি। মেধাবী শিক্ষক না হলে মেধাবী আমলা তৈরি হবে না। একজন মেধাবীর কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চেয়ে ব্যাংক বা মোবাইল ফোন কোম্পানির চাকরি লোভনীয় হয়ে গেলে, তা দুর্ভাগ্যজনক। প্রকৃত মানবসম্পদ উন্নয়নের অপরিহার্য উপাদান শিক্ষা। আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে সামগ্রিক পরিকল্পনা দরকার।
ভারত, শ্রীলঙ্কা এমনকি পাকিস্তানের দৃষ্টান্ত সামনে রেখে কাজ করা যেতে পারে। এশিয়ার শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় পাকিস্তানের সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। স্থান পেয়েছে শ্রীলঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয়। ভারতের তো অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় আছে সেই তালিকায়। বাংলাদেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয় ওই তালিকার ধারেকাছেও নেই।
সচিবদের বেতন বাড়ল বলে শিক্ষকদের বেতনও বাড়াতে হবে, বিষয়টি তেমন নয়। মর্যাদার অবনতি ঘটানোটা অন্যায়-অনৈতিক হয়েছে। সচিবদের বেতনের সঙ্গে শিক্ষকদের বেতনের তুলনামূলক আলোচনা করাটাও সঠিক নয়। ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কায় যা করা হয়নি। শিক্ষকদের বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে স্বতন্ত্র পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে। দৃষ্টান্ত আমাদের চোখের সামনে আছে, অনুসরণ করলেই সমাধান মিলবে।
লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক
Published in: http://m.banglatribune.com/tribune/single/109720

0 comments:

Post a Comment