মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে টিউশন ফিতে ভ্যাট প্রদানের সরকারি সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়েছে। তবে এখনো ইংরেজি মাধ্যম বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ভ্যাট প্রদান করতে হয়। যদিও অতিসম্প্রতি উচ্চ আদালতে একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত আগামী ছয় মাসের জন্য ভ্যাট আদায় স্থগিত করেছেন। উচ্চ আদালতের ওই আদেশ শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের পথ রুদ্ধ করবে বলে আমাদের মনে হয়। পাশাপাশি সরকারও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর থেকে ভ্যাট আদায়ের সিদ্ধান্ত বাতিল করবে। শিক্ষাকে পণ্য বিবেচনা করে ভবিষ্যতেও যেন কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অথবা শিক্ষার যেকোনো পর্যায়ে বা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর ভ্যাট আরোপ না করা হয়, সে বিষয়ে উদ্যোগী হবে।
শিক্ষায় ভ্যাট আরোপের বিষয়টি বাংলাদেশের সংবিধান, শিক্ষানীতি, শিক্ষা আইন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার, গঠনতন্ত্র ও লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ইতিহাস অথবা ১৪ দলের অন্য দলের গঠনতন্ত্র ও প্রধানমন্ত্রীর জাতিসংঘে বক্তব্য পরিপন্থী। আর শিক্ষায় ভ্যাট আদায় কর আইনও অনুমোদন করে না। মূল্য সংযোজন কর আইন ১৯৯১ মতে, মূল্য সংযোজন কর প্রদান করবেন— ক. আমদানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে, আমদানি পর্যায়ে আমদানিকারক; খ. বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত বা উত্পাদিত পণ্যের ক্ষেত্রে, প্রস্তুতকরণ বা উত্পাদন পর্যায়ের সরবরাহকারী; গ. সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে, সেবা প্রদানকারী; এবং ঘ. বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমারেখার বাইরে থেকে সেবা সরবরাহের ক্ষেত্রে, সেবা গ্রহণকারী; এবং ঙ. অন্যান্য ক্ষেত্রে, সরবরাহকারী ও সেবাগ্রহণকারী। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এর কোনো খাতে পড়ে না। ফলে শিক্ষার্থীর টিউশন ফির ওপর ভ্যাট আরোপের বিষয়টি কর আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
দ্বিতীয়ত. কর আইনে স্পষ্টত পণ্য থেকে কর আদায়ের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ করেন। আর শিক্ষা কোনো পণ্য নয়। কারণ শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা ক্রয় করেন না। তারা শিক্ষা অর্জন করেন। ওই অর্জনে তাদের পরিশ্রম করতে হয়। মেধা ও যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে হয়। পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হওয়ার পরই কেবল তারা সনদপত্র লাভ করেন। তারা অর্থ প্রদান করছেন বলেই সনদ পাচ্ছেন, বিষয়টি এমন নয়। কিন্তু শিক্ষা যদি পণ্য হতো, তবে শিক্ষার্থীদের পরিশ্রম করতে অথবা মেধা ও যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে হতো না। তাদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ও পাসের কোনো প্রশ্ন আসত না। তারা বাজারে যেমন টাকার বিনিময়ে আলু-পটোল কিনতে পারেন, তেমনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে টাকা দিয়ে শিক্ষা তথা সনদপত্র ক্রয় করতেন।
সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে স্পষ্টতই বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উত্পাদন শক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতি সাধন। আর এর মাধ্যমে রাষ্ট্র নাগরিকের অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিত্সার ব্যবস্থা করবে।’ সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল প্রত্যেক নাগরিকের জন্য মৌলিক অধিকার শিক্ষা গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করা। কিন্তু রাষ্ট্র তার সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে বলেই ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা রাষ্ট্রের সেই দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন। অভিভাবকরা টাকার বিনিময়ে তার সন্তানের জন্য জামাকাপড় ক্রয় করেন, এক্ষেত্রে শিক্ষা বা সনদ ক্রয় করছেন বিষয়টি এমন নয়। বরং এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণের জন্য যে খরচ রাষ্ট্রের বহন করার কথা ছিল, তারা সেই খরচ বহন করছেন মাত্র। আর যেহেতু শিক্ষার্থী বা অভিভাবকরা ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কিছু ক্রয় করছেন না, সেহেতু কর আইন অনুযায়ী তাদের ওপর ভ্যাট ধার্য করার কোনো সুযোগ নেই।
যদিও সরকারের পক্ষ থেকে যুক্তি উত্থাপন করা হতে পারে যে, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো লাভজনক প্রতিষ্ঠান। ফলে তাদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করা যেতে পারে। কিন্তু ভ্যাট আইন অনুসারে কেবল পণ্যের ওপরই ভ্যাট প্রযোজ্য হবে। তাই যদি ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীর টিউশন ফির ওপর ভ্যাট আরোপ করা হয়, তবে তা শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করে। আর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরই শিক্ষাকে পুঁজি করে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার সুযোগ নেই। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অধ্যায়ের ৮ অনুচ্ছেদ শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করার বিষয়টি অনুমোদন করে না। ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘বৈষম্যহীন সমাজ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে মেধা ও প্রবণতা অনুযায়ী স্থানিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক নির্বিশেষে সকলের জন্য শিক্ষা লাভের সমান সুযোগ অবারিত করা। শিক্ষাকে মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যে পণ্য হিসেবে ব্যবহার না করা।’ জাতীয় শিক্ষানীতি শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করার বিষয়টি অনুমোদন না করায় ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো লাভ করছে— এমন অজুহাত তুলে শিক্ষার্থীর টিউশন ফির ওপর ভ্যাট আদায় করার কোনো সুযোগ নেই। আর এমনটি যদি অব্যাহত থাকে অর্থাত্ টিউশন ফির ওপর ভ্যাট আরোপ অব্যাহত রাখা হয়, তবে তা বর্তমান সরকার প্রণীত শিক্ষানীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিরোধী কাজ। এরূপ দ্বিমুখী নীতি বর্তমান সরকারের শিক্ষায় সাফল্য লাভের বিষয়টিকে কলঙ্কিত করবে। বর্তমান সরকার শিক্ষাবান্ধব এমন প্রচারণাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। তাই সরকারের উচিত হবে অচিরেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টিউশন ফির ওপর থেকে ভ্যাট আদায়ের সিদ্ধান্তটি বাতিল করা।
সরকারের দায়িত্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করছে কিনা, তা তদারক করা। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ পরিপন্থী কাজ পরিচালনা করে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যাতে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত না হতে পারে, সে বিষয়টি নিশ্চিত করা। কিন্তু সরকার সেই দায়িত্ব পালন না করে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মুনাফা করছে অজুহাত তুলে টিউশন ফির ওপর ভ্যাট আরোপ করে, তবে জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০-এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে যতটুকু অর্থ প্রয়োজন, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সেই টাকাই টিউশন ফি হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গ্রহণ করছে কিনা, তা নিশ্চিত করার দায়িত্বও সরকারের। কিন্তু সরকার সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়ে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ‘ব্যবসা করছে’, ‘লাভ করছে’ অজুহাত তুলে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। তবে তা কোনোভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। এর মাধ্যমে সমাজে যারা আইন অমান্য করছে, তারা উত্সাহিত হবে। এমনো হতে পারে ভবিষ্যতে সরকার ইয়াবা বা ফেনসিডিল আমদানি বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়ে কাজটিকে বৈধতা দিতে তার ওপর ভ্যাট আরোপ করবে! কিন্তু সরকার একটি অন্যায় কাজ প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়ে অন্য একটি অনৈতিক কাজের মাধ্যমে ওই কাজের বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করলে তা কোনোভাবেই নাগরিক সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।
ভ্যাট আদায় না করে কোনো ইংরেজি মাধ্যম স্কুল বা কলেজ কত লাভ করছে, তার তালিকা প্রকাশ করা হোক, যাতে শিক্ষার্থীরা সত্য জানতে পারে। পাশাপাশি সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আইন মেনে যতটুকু অর্থ ব্যয় নির্বাহে প্রয়োজন, ততটুকুই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করতে বাধ্য করা হোক। আর এভাবে যদি আইনের যথার্থ প্রয়োগ করা যায়, তবে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর যে বিশাল অঙ্কের টিউশন ফির বোঝা চেপে বসেছে, তা থেকে তারা মুক্তি পাবে। অভিভাবকরা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারবেন।
ইংরেজি মাধ্যমে বিত্তশালী পরিবারের সন্তানরা পড়ে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ছে। ইংরেজি মাধ্যমে পড়া শিক্ষার্থীদের দেশের বাইরে যাওয়ার সহজ সুযোগ থাকায় এবং কর্মসংস্থান সহজ হওয়ায় মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানরাও সেখানে পড়ে। অনেক শিক্ষার্থীর পরিবার অনেক কষ্ট করে অথবা অভিভাবকরা অন্য কোনো খণ্ডকালীন কাজে নিযুক্ত হয়ে নিজ সন্তানের সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে অতিরিক্ত অর্থ আয়ের মাধ্যমে টিউশন ফি প্রদান করেন।
সংবিধানমতে, এসব শিক্ষার্থীর শিক্ষার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের। কিন্তু সরকার বা রাষ্ট্র যখন সেই দায়িত্ব পালনে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে, তখন ওই শিক্ষার্থী বা তার অভিভাবকরা রাষ্ট্র বা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেননি, বরং নীরবে রাষ্ট্রের ওই ব্যর্থতাকে মেনে নিয়ে নিজেরাই নিজেদের বা সন্তানের শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। রাষ্ট্র বা সরকারের উচিত ছিল ওই অদম্য অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সাধুবাদ জানানো। সহজ শর্তে শিক্ষায় ঋণসহ নানা সুযোগ সুবিধা প্রদান করা। কিন্তু উল্টো তাদের চলার পথ আরো কণ্টকাকীর্ণ করতে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে, যা কোনো যুক্তিতে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাই সংবিধান, শিক্ষানীতিবিরোধী শিক্ষায় ভ্যাট প্রত্যাহার করার জোর দাবি জানাচ্ছি। পাশাপাশি যদি কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অমান্য করে শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করে লাভজনক ব্যবসায় নিয়োজিত হয়, তবে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় salah.sakender@gmail.com
Published in: http://www.bonikbarta.com/news/details/50743.html
0 comments:
Post a Comment