Monday, September 7, 2015

বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাজনীতি ও এর প্রভাব

Kamrul Hassan

আমাদের শিক্ষা বান্ধব সরকার ৮-ম পে-স্কেলের মাধ্যমে শিক্ষকদের দারুন একটা শিক্ষা দিয়েছেন। এমন দারুন শিক্ষা যে এই প্রফেসনে আর ভালো কেউ আসার পথ প্রায় রুদ্ধ হয়ে গেল। আসলে ভালো শিক্ষক তারা কেন চাইবেন? ভালো শিক্ষক মানেই তাদের মাথা ঘড়ের ছাদ ফুড়ে আকাশ স্পর্শ করা মানুষ। তারা সর্বদা সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলবে। এখন একদল আগাছা শিক্ষক বনে গিয়েছে। তারা কোন দিন হয়ত স্বপ্নও দেখেনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে। ফসলের খেতে আগাছা থাকেই। কিন্তু এখন আগাছাই ফসল স্বরূপ হয়ে উঠছে এবং উৎকন্ঠা সেখানেই। আমাদের সরকারগুলো এমনই শিক্ষা বান্ধব যে তারা সর্বদাই ওই আগাছাদেরই শিক্ষক হিসাবে চেয়েছে কারণ তারা জানে এই এরা খুব উপকারী। এরা সামান্য কিছু পাওয়ার আশায় চাতকের মত আকাশ পানে তাকিয়ে থাকবে। মাঝে মাঝে উচ্ছিষ্ট স্বরূপ এক ফোটা কিংবা দুই ফোটাই তাদের লালসা নামক তৃষ্ণা নিবারণে যথেষ্ট। এরা প্রভুর গুনকির্তন আর প্রভুর শত্রুর বিরুদ্ধাচরণে বিন্দুমাত্র পিছপা হয় না।

যারা academically sound দেখা গেছে তারা গোষ্টিবদ্ধ হতে চায় না বা হয় না। দুর্বলরা সর্বদাই দলবদ্ধ হয়ে চলে। যে শিকারী একা শিকার করতে পারে না তারাই তখন দলবদ্ধ এবং দলবদ্ধ হয়ে শিকার করে। আমাদের সমাজেও তাই দেখা যায়। যারা যত বেশি দুর্বল তারা তত বেশি সমিতি গঠনে সচেষ্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠিক তাই ঘটছে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষকরা রাজনীতির ছত্রছায়ায় দলবদ্ধ হয়। তারা একে অপরের সুবিধা অসুবিধা দেখবাল করে এভাবে আস্তে আস্তে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটে। ব্যাপারটা শুধু যে এই সরকারই করছে তা নয়। ৯০-এর পর থেকে আমাদের সকল সরকারই ধারাবাহিক ভাবে করে গিয়েছেন। এখন শুধু কফিনের লাস্ট পেরেগ মারা অবলোকন করছি। সন্তানের সুশিক্ষা দানই হলো আমাদের সমাজের প্রতিটি ঘরের সবচেয়ে বড় কনসার্ন। অথচ এই শিক্ষাই আজ সবচেয়ে উপেক্ষিত। শিক্ষা ভবন নামক এক বিভীষিকাময় অফিসের মাধ্যমে স্কুল কলেজের শিক্ষকদের ক্রমাগত অপমান করে যাচ্ছে আমাদের আমলারা। এবার সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পালা। বেতন কম জেনেও আমাদের ক্লাসের সেরা ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চায় শুধু একটু সম্মানের আশায়। আজ সেই সম্মানটুকুও হুমকির মুখে।

এখন দেখা যায় দুর্বলই নেতৃত্বে চলে এসেছে। এরা আস্তে আস্তে শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে প্রমোসন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে তারা ধীরে ধীরে প্রমোশন নীতিমালা শিথিল করে ফেলেছে। ভালো রেখে অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের নিয়োগে তারা বেশি উৎসহি। আর আমাদের আমলা এবং সরকার এই দুর্বল ক্ষণের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কমুনিটির নেতৃত্ব এখন দুর্বল কারণ যারা নেতৃত্বে আছেন তারা নিজেদের চাওয়া-পাওয়ার হিসাবে ব্যস্ত সুদুর প্রসারী ক্ষতি তাদের হিসাবের মধ্যে নেই। এবং সেইজন্য, শুধু সেই জন্য এরকম একটা অবমাননাকর পে-স্কেল করে সরকার পার পেয়ে যাচ্ছে। সরকার নিশ্চই বুঝতে পেরেছে এটা নিয়ে শিক্ষকরা বেশি কিছু ঝামেলা করতে পারবে না কারণ শিক্ষকদের নেতৃত্ব এখন তাদের কুক্ষিগত। এমনই নেতৃত্ব যে, আজ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের অবস্থান জানানোর জন্য সাক্ষাত প্রার্থনা করে পর্যন্ত ব্যার্থ হয়েছে। যতটুকু শুনতে পাই প্রধানমন্ত্রী সাক্ষাত দেননি।

অথচ ইতিহাস বলে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সকল আনদোলনের পুরোধা ছিলেন। আমরা যে ১৪-ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবি হত্যা দিবস পালন করি ওই বুদ্ধিজীবী কারা ছিলেন? গুনে দেখুন প্রায় ৮০% বুদ্ধিজীবিই যাদের ওই দিন পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা হত্যা করে ছিল তারা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এখনও দেশ কোন বিপদে পড়লে এই শিক্ষক এবং ছাত্র এগিয়ে আসে সবার আগে এই থেকে উদ্ধারের জন্য। বিশ্বিবিদ্যালয় হলো জ্ঞানী মানুষ তৈরীর কারখানা আর শিক্ষকরা হলেন ওই কারখানার কারিগর। অথচ ৮ম পে-স্কেলের মাধ্যমে শিক্ষকদের অপমানের চূড়ান্ত করে ছেড়েছে। দুঃখের বিষয় হলো যে, যারা একদিন এই কারখানারই প্রোডাক্ট হিসাবে বের হয়েছিলেন তারাই আজ সেই কারখানাকে ধংশ করতে উদ্যত। তার মানে হলো তারা চায় না ভবিষ্যতে তাদের চেয়ে মেধাবী প্রোডাক্ট আর বের হোক। এমন থাপ্পর খেলাম যে দুঃখ প্রকাশের ভাষা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছি। তারপরও আমি নিশ্চিত আমাদের শিক্ষকরা থাপ্পর কর্তাদের গুনকির্তন করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যদি এখন decide করে এখন থেকে আর গুনকির্তন করবে না তাহলে আমাদের ন্যায্য দাবি আদায় একটা তুরীর ব্যাপার মাত্র।

কামরুল হাসান
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

0 comments:

Post a Comment