Wednesday, September 9, 2015

‌‘অর্থ নয়, শিক্ষকদের মর্যাদা দিতে ব্যর্থ সরকার’

আবদুল মাজেদ পাটোয়ারী

লজ্জা তাদের জন্য, যারা শিক্ষকদের মর্যাদার ব্যাপারে আপত্তিকর মন্তব্য করছেন। ধিক তাদের শত ধিক। যেখানে শিক্ষকদের মর্যাদা দিতে রাষ্টের আর্থিক কোনো ক্ষতি হবার নয়, সেখানে কেন এত টালবাহানা? সেখানে সরকারের দুই বিজ্ঞ মন্ত্রীর এমন মন্তব্য শিক্ষক সমাজ নয় বরং তাদের মানসিকতার এবং চিন্তা চেতনার প্রতিই অঙ্গুলি নির্দেশ করে।

গত সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন ৯১ থেকে ১০১ শতাংশ বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। সরকারি-বেসরকারি যে শ্রেণির চাকরিজীবীই হোন না কেন, তাঁদের কাছ থেকে যথাযথ সেবা পেতে হলে তাঁদের আর্থিক সচ্ছলতা নিশ্চিত করা জরুরি। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এই বেতন কাঠামো পেয়ে আনন্দের পরিবর্তে দেশের সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত ৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকেরা কর্মবিরতি পালন করেছেন। কেন? বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন বরাবরই জানিয়ে আসছিল শিক্ষকদের যেন অসম্মান করা না হয়। মনে হলো, সরকার এ ব্যাপারে কর্ণপাতই করেনি। উপরন্তু মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা অনেকটা কটাক্ষের মতো করেই বললেন যে, শিক্ষকেরা যে গ্রেডের, তাদের বেতন তেমনই ধরা হয়েছে। এর মানে বুঝতে দেরি হয়নি শিক্ষকদের।
পরবর্তীতে শিক্ষামন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য শিক্ষকদের আরও হতাশ করেছে। শিক্ষামন্ত্রী কিছুদিন আগেও শিক্ষকদের দারির প্রতি একাত্ততা পোষণ করেছিলেন। এমনকি তিনি বিভিন্ন জায়গায় ডিও লেটারও পাঠিয়েছিলেন। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, শিক্ষকদের মনোবিজ্ঞানী দিয়ে চেক আপ করাতে হবে। অন্যদিকে, শিক্ষকদের কর্মবিরতি চলার মধ্যে সচিবালয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপকালে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত শিক্ষকদের আন্দোলনের সমালোচনা করে বলেন, দেশের সবচেয়ে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী জ্ঞানের অভাবে আন্দোলন করছেন। তাঁদের কর্মবিরতির কোনো যুক্তি নেই। তাঁরা জানেনই না যে নতুন বেতনকাঠামোতে তাঁদের জন্য কী আছে, কী নেই।

এ খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হওয়ার পরই শিক্ষকদের মধ্যে আরও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন এক বিবৃতিতে বলেছে, শিক্ষকদের বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর বিরূপ মন্তব্য শুধু অনভিপ্রেতই নয়, অসংলগ্নও বটে। অর্থমন্ত্রী অতীতে অন্যদের ক্ষেত্রেও বিরূপ মন্তব্য করেছেন। এসবের মাধ্যমে তিনি জাতির কাছে নিজেকে ইতোমধ্যে হাস্যকর করে তুলেছেন। বস্তুতপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষক ও শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানের অভাবের কারণেই তিনি এরূপ দায়িত্বহীন মন্তব্য করেছেন।
চিত্র: বর্তমান কাঠামোতে ৯ম বছরে প্রফেসরগণ ১ম গ্রেডে বেতন পাবেন, তার গাণিতিক হিসাব।

যা হোক, আসলে সরকারের সচিব এবং অর্থমন্ত্রীর এমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখে খালি চোখে দেশবাসির মনে হতে পারে শিক্ষকরা হয়তো ৭ম বেতন স্কেলের মতো অবস্থানে থাকলে কিছুটা হলেও আর্থিক সুবিধা পাবেন। আসলে ব্যাপারটা মোটেও তা নয়।

গ্রেড তিনে থাকলেও শিক্ষকরা অর্থাৎ প্রফেসরগণ ৯ বছর পর ঠিকই গ্রেড ১এর বেতন ভোগ করবেন। এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিরা যেহেতু সাধারণত বয়োজেষ্ঠ্যরা হন এবং তাদের আলাদা ভাতা থাকে। সুতরাং তাদের বেতন ভাতা একজন মুখ্য সচিবের সমতুল্যই হবে এবং তাই যুক্তিযুক্ত। অন্যদিকে শুধু বাকী থাকেন সিনিয়র প্রফেসর। যা সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়োজেষ্ঠ্যরাই হন এবং এজন্য বেশ কিছু শর্ত রয়েছে। যেহেতু প্রফেসররা ৯ বছর পর গ্রেড ১এর বেতন ভোগ করবেন, তাহলে সিনিয়র প্রফেসর- যারা চাকরির একবারে শেষ প্রান্তে চলে যাবেন, তাদের জ্যেষ্ঠ সচিবের সমতুল্য বেতন ভাতা দিতে আপত্তি কোথায়?

অর্থাৎ, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের শিক্ষকরা কাঠামোগত বেতন ভাতা ঠিকই পাবেন। সরকারের হঠকারী সিদ্ধান্তে, প্রফেসররা এক সময় গ্রেড-১ এর বেতন ভোগ করবেন। কিন্তু তারা সেই মর্যাদা পাবেন না। কেন? শিক্ষকরা কী দোষ করেছেন? ৭ম বেতন কাঠামোতে তাদের যে মর্যাদা ছিল, আজ কেন তা হারাবেন? বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল ক্ষেত্রে আজ শিক্ষকরা বঞ্চিত। কেন? দোষ কি সম্পূটাই শিক্ষকদের? যদি শিক্ষকদের হয়, তবে শাস্তির ব্যবস্থা করুন। দোষী ব্যক্তির অবশ্যই আইন অনুযায়ী শাস্তি পাওয়া উচিত। দোষী ব্যক্তিকে সনাক্ত না করে পুরো শিক্ষক সমাজকে একই সাথে দায়ী করবেন, এটা কেমন বিচার? দোষী ব্যক্তি যেই হোক, রাষ্ট্রের আইনের কাছে তো সবাই সমান। বরঞ্চ দেখা যায়, বর্তমান ও পূর্ববতী সকল সরকারই নিজেদের পছন্দে, তুলনামূলক কমযোগ্য ব্যক্তিদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পদে নিয়োগ দিয়েছেন। যা দেশবাসীর অজানা নয়। এমনকি ডক্টরেট ডিগ্রিহীন শিক্ষকও ভিসি পদে আসীন হয়েছেন, তাদের সক্রিয় হস্তক্ষেপে।

বিশ্ববিদ্যালয় যদি অনুৎপাদনশীল হয়, তাহলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা দিয়ে সারাদেশের প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় করার পরিকল্পনা অনর্থক। বিশ্ববিদ্যালয় না করে কলেজ করাই যুক্তি যুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয় হলো গবেষণা নির্ভর, আর কলেজ ক্লাস নির্ভর। সরকার যেহেতু গবেষণার বরাদ্দ দিতে নারাজ। তাহলে কেন নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়? নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় করে সেখানে কর্ম বিমূখদেরকেই তো পাঠাতে হবে। অন্যদিকে, শিক্ষকদের পদোন্নতিকে ঘিরে অর্থমন্ত্রী যখন দুর্নীতির কথা বলেন, হলমার্ক কেলেঙ্কারিকে তিনি কিছুই মনে করেন না এবং বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি অত্যন্ত হালকাভাবে দেখেন। তাঁর মুখে অন্তত জাতি গঠনের কারিগর শিক্ষকদের বিষয়ে এরূপ অবাঞ্ছিত বক্তব্য নিতান্তই অশোভন।

ঘোষিত বেতনকাঠামো সম্পর্কে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের বিবৃতিতে বলা হয়, এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ৪দফা দাবির কোনোটিই গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি দাবি পূরণের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো দিকনির্দেশনাও দেয়া হয়নি। অনতিবিলম্বে শিক্ষকদের দাবি পূরণ না হলে কঠোর আন্দোলনের হুমকি দেয়া হয়।

সর্বোপরি পরিতাপের বিষয় যে, বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যাকে সবাই শিক্ষাবান্ধব প্রধানমন্ত্রী বলে জানেন। তাঁর সময়ে শিক্ষকদের প্রতি এ অবিচার কারো কাছেই কাম্য নয়। আমরা আশা করি, তিনি শক্ত হাতে এর একটি সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য সমাধান দিয়ে পুরো জাতিকে এ গ্লানি হতে মুক্তি দিবেন।


লেখক: মো: আবদুল মাজেদ পাটোয়ারী
অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, রসায়ন বিভাগ
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

Published in: http://www.campuslive24.com/campus.141915.live24/














0 comments:

Post a Comment