Wednesday, September 23, 2015

শিক্ষকদের ভিন্ন বেতন স্কেল দিতে আপত্তি কেন

আলী ইমাম মজুমদার

শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল করার দাবি কয়েক বছর ধরে ক্রমান্বয়ে জোরদার হচ্ছে। শিক্ষামন্ত্রী এ বিষয়ে তাঁদের কথাও দিয়েছেন। অবশ্য অষ্টম বেতন কমিশন যখন গঠন করা হয়, তখন এর আওতায় শিক্ষকদেরও নেওয়া হয়। স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের ধারণাটি সরকার তখন পর্যন্ত গ্রহণ করেনি। অষ্টম বেতন কমিশনের প্রধানের কাছে শিক্ষকেরা সাক্ষাৎকার দিয়ে পৃথক বেতন স্কেলের কথা বলেছিলেন কি না, জানা যায় না। তবে বললেও তা সেই কমিশনের আওতাধীন বিষয় ছিল না। তবে তাঁদের বেতন-ভাতাদি ন্যায্যতার সঙ্গে পারস্পরিকভাবে ধার্য করার কথা বলেছিলেন তাঁরা। কমিশন প্রতিবেদন দিয়েছে। মন্ত্রিসভা সেই প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করতে একটি সচিব কমিটিকে দায়িত্ব দিয়েছিল। কমিটি তাদের মতামত-সংবলিত প্রতিবেদন অর্থ বিভাগে পাঠালে তা আবারও মন্ত্রিসভায় পেশ করা হয়। অনুমোদিত হয় অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল।

এখানে শুরু থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তাঁদের পদ প্রশাসনের অন্য পদগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক অবনমনের অভিযোগ করছেন। এ অভিযোগ নিতান্তই অমূলক এমনটা বলা যাবে না। আবার ঢালাওভাবে তা করা হয়েছে এমনটিও নয়। এমন কিছু ঘটেনি প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক আর সহযোগী অধ্যাপকদের ক্ষেত্রে। তবে ঘটেছে ওপরের দিকে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা আগে স্কেলের তৃতীয় ধাপে বেতন পেতেন। তাঁদের এক-চতুর্থাংশ পদকে সিলেকশন গ্রেড বলে গণ্য করার রেওয়াজ চলছে। তাঁরা বেতন পেতেন স্কেলের প্রথম ধাপে। জিরো গ্রেড বলে পরিচিত মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্য সচিব—এ দুজন কর্মকর্তা স্কেলের বাইরে ছিলেন। বছর তিনেক আগে এ ধরনের আরেকটি স্কেল করে আটটি সিনিয়র সচিব পদ সৃজন করা হয়। সামরিক বাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল ও সমপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিল করতে গিয়ে এ পদগুলোর ধারণা আসে, এমনটাই বলা হচ্ছে। এ নিয়ে অষ্টম বেতন স্কেল-সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনার আগে তেমন কোনো বাদ–প্রতিবাদ জানা যায়নি।

তবে হাল আমলে বিষয়টি তুঙ্গে উঠেছে। একটি অঙ্কের হিসাব দেখিয়ে বলা হয়েছে, বেতন বৃদ্ধির নতুন নিয়ম চালু হলে সিলেকশন গ্রেড, টাইম স্কেলের আবশ্যকতা থাকবে না। বেতন নাহয় বাড়ল, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের যে অধ্যাপক তিন নম্বর গ্রেডে বেতন পান, সিলেকশন গ্রেড না থাকলে তিনি এক নম্বর গ্রেডে যাবেন কীভাবে? একটি দুর্বল ব্যাখ্যা দিয়ে এর যৌক্তিকতা দেওয়ার প্রচেষ্টা গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সংখ্যা চার সহস্রের অধিক। সিলেকশন গ্রেডও পাচ্ছেন এবং পাবেন সহস্রাধিক। এগুলো সব ক্যাডারের এক নম্বর গ্রেডের সম্মিলিত পদসংখ্যার অনেক বেশি। তা সত্ত্বেও তাঁরা যে অবস্থানে ছিলেন, এর থেকে অবনমিত করার কোনো যুক্তিই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সিনিয়র সচিবের আটটি পদের সঙ্গে তাঁদের কোনো পদকে এরূপ উন্নীত করা যায় কি না, তা-ও বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখার বিষয়।

তবে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির সঙ্গে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডকে গুলিয়ে ফেলায় অকারণ বিভ্রান্তির কারণ ঘটানো হয়েছে। তা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, হয়েছে সরকারি কলেজ–স্কুলসহ অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তেমনি অন্যান্য দপ্তরেও বিষয়টি তালগোল পাকিয়েছে। অবশ্য সেগুলো ক্রমান্বয়ে হিসাব-নিকাশ করে নতুন স্কেলকে মেনে নিচ্ছে। তবে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন শিক্ষকদের পদোন্নতির সুযোগ নেই, তাঁদের জন্য সিলেকশন গ্রেড চালু রাখা অপরিহার্য। আর সেটা অন্য বিভাগের জন্যও একইভাবে প্রযোজ্য। একটি প্রতিষ্ঠিত প্রথাকে ভেঙে নতুন কিছু গড়া সহজ নয়। আর খুব প্রয়োজনীয় না হলে এর চেষ্টাও যথার্থ বলে মনে হয় না।

আলোচনায় আসে শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন স্কেল প্রসঙ্গ। স্বাধীনতার আগে তো এ দেশে কয়েক হাজার বেতন

==============================
এখন প্রশ্ন, কীভাবে শিক্ষকদের জন্য একটি স্বতন্ত্র বেতন স্কেল তৈরি হবে? কারা করবেন? কত দিনই বা সময় লাগতে পারে? প্রশ্নগুলোর জবাব সহজ নয়। তবে দায়িত্বটি সরকারকেই নিতে হবে। আস্থায় রাখতে হবে শিক্ষকদের
===============================

স্কেল ছিল। সরলীকরণের স্বার্থে প্রথমে ১০টি এবং পরে ২০টি হয়। তবে ক্রমান্বয়ে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটছে। অধস্তন
বিচার বিভাগের জন্য ভিন্ন বেতন স্কেল রয়েছে। বাংলাদেশ বিমানসহ কয়েকটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে রয়েছে পৃথক বেতন স্কেল। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে পৃথক স্কেলের আওতায় নেওয়ার প্রস্তাবও প্রক্রিয়াধীন। অনেক প্রতিষ্ঠানে দেওয়া হয় দুপুরে খাবারের টাকা। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলশিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন স্কেল হতে আপত্তি থাকার যৌক্তিক কারণ নেই।

আর তাঁদের মর্যাদার বিষয়টি নিয়ে অকারণ টানাহেঁচড়া করা অসংগত। শিক্ষকেরা যুগবাহিত প্রথা অনুসারে সমাজে উচ্চ সম্মান পেয়ে থাকেন। এর বিপরীতধর্মী যেকোনো প্রচেষ্টায় জাতি হিসেবে আমরাই খাটো হব। তবে বেতন সব ক্ষেত্রে পদমর্যাদার সূচক নয়। আমাদের রাষ্ট্রায়ত্ত কয়েকটি ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীরা তো রাষ্ট্রপতিরও অধিক বেতন-ভাতাদি পেয়ে থাকেন। ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের প্রধান নির্বাহীর বেতন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কয়েক গুণ। সুতরাং অকারণ শঙ্কা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষকদের জন্য ভিন্ন বেতনকাঠামোর প্রস্তাবকে স্বাগত জানাতে আমাদের আপত্তি থাকার কথা নয়।

আর সেই বেতন স্কেল যিনি বা যাঁরা করবেন, তাঁরা অবশ্যই শিক্ষকদের চাহিদার পাশাপাশি রাষ্ট্রের সামর্থ্য বিবেচনায় রাখবেন। বস্তুতপক্ষে, আমাদের সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রদের বেতন থেকে আয়ের পরিমাণ নগণ্য। বলতে গেলে গোটাটাই ভর্তুকি দিতে হয় সরকারকে। তবে শিক্ষককে সামর্থ্য অনুযায়ী উদার হাতেই দেওয়া উচিত, এ বিষয়ে কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কৃতী শিক্ষক সম্প্রতি বলেছেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে বেতন দেওয়া হয়, তা দিয়ে কোনো প্রতিভাবান ব্যক্তিকে আকর্ষণ করা যাবে না। তাঁর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণের কোনো সুযোগ নেই। ঠিক তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষক কিংবা সিভিল সার্ভিসে সদ্য নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে ২২ হাজার টাকা। এ টাকাতেই কি এসব পদে প্রকৃত প্রতিভাবানেরা আসবেন? হয়তো কিছু আসবেন পদগুলোর ধার ও ভারের আকর্ষণে। তবে ভোগবাদী সমাজে এঁদের সংখ্যা খুব কমই হবে।

বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই। আমাদের সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো একরকম অস্থিরতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। দ্রুত এর সমাধান করতে না পারলে ঈদের পর পরিস্থিতির অবনতি ঘটার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পাঠদান ও পরীক্ষা গ্রহণ কার্যক্রম। অনেক কারণে এগুলোতে তা হয়ে চলছে। তবে এরূপ ঘটতে সরকারের কোনো ভুল কিংবা বিলম্বিত ভূমিকা দুঃখজনক হবে। বিষয়টি অনুধাবন করার মতো প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা সরকারের দায়িত্বে থাকা অনেকের মধ্যে রয়েছে। একটু বিলম্বিত হলেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বেতনের ওপর ভ্যাট প্রত্যাহারে তাঁরা দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। এতে সরকার হারেনি, বরং জিতেছে। পরিস্থিতিকে অকারণ উত্তপ্ত করার সুযোগ তাঁরা দেননি।

এখন প্রশ্ন, কীভাবে শিক্ষকদের জন্য একটি স্বতন্ত্র বেতন স্কেল তৈরি হবে? কারা করবেন? কত দিনই বা সময় লাগতে পারে? প্রশ্নগুলোর জবাব সহজ নয়। তবে দায়িত্বটি সরকারকেই নিতে হবে। আস্থায় রাখতে হবে শিক্ষকদের। সামর্থ্যের বিষয়টিও এখানে না আনলে চলবে না। তাই অর্থমন্ত্রী বা অর্থ মন্ত্রণালয়কে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। তবে দ্রুত বিষয়টি নিষ্পত্তি করা গেলে ভালো। কিন্তু মনে হয় কিছুটা সময় নিতে পারে। অন্তর্বর্তী সময়ে অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলে তঁাদের আগের ঐতিহ্য অনুসরণে মর্যাদার সঙ্গে স্থান দেওয়া যায় কি না, সেটা দেখা যেতে পারে। অবশ্য শিক্ষকেরা এতে অনিচ্ছুক হলে তা চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। সবকিছুই হওয়া সংগত সমঝোতা ও পারস্পরিক সদিচ্ছার ভিত্তিতে। আর এরূপ একটি সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টি এবং একে স্থায়ী রূপ দেওয়াও সম্ভব ও সমীচীন। এমনিতেই উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বেশ কয়েকটি নিজেদের মধ্যকার সমস্যা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল এতে আরেকটি নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে। এর আশু ও যৌক্তিক অবসান সবাই চান।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

Published in: http://www.prothom-alo.com/opinion/article/638977

0 comments:

Post a Comment