ড. কাজী এস এম খসরূল আলম কুদ্দুসী
বাংলাদেশের প্রথিতযশা আমলা ও পন্ডিত ড. আকবর আলী খান তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত গ্রন্থ ‘গ্রেশাম’স ল সিনড্রোম এন্ড বিয়োন্ড: এন এনালাইসিস অব দ্য বাংলাদেশ ব্যুরোক্র্যাসি’ (২০১৫)-তে তাত্ত্বিক এবং প্রয়োগিকভাবে বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের বর্তমান অবস্থা ও তার গুণগত মান সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রদান করেছেন। এতে বোঝা যায়, বিশ্বব্যাংক পৃথিবীর ২০৯ টি দেশের আমলাতন্ত্রকে তিন ভাগে ভাগ করেছে, যার মধ্যে প্রথমটি হলো ‘খুবই কার্যকর আমলাতন্ত্র’ যার মধ্যে পড়েছে ৭০ টি দেশের আমলাতন্ত্র, দ্বিতীয়টি হলো ‘মোটামুটি কার্যকর আমলাতন্ত্র’ যার মধ্যে পড়েছে বিশ্বের ৭১ টি দেশের আমলাতন্ত্র এবং শেষটি হলো ‘অকার্যকর আমলাতন্ত্র’ যার মধ্যে পড়েছে ৬৮ টি দেশের আমলাতন্ত্র। এখানে বাংলাদেশের অবস্থান ‘অকার্যকর আমলাতন্ত্র’ ক্যাটাগরিতে এবং র্যাংকিং হলো ১৬৮ (প্রাপ্ত নম্বর ১০০ তে ২০) এবং দক্ষিণ এশিয়ার র্যাংকিং-এ বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের অবস্থান অন্য সব দেশের নিচে (গভর্নেন্স ম্যাটারস, ২০১২)।
ড. আকবর আলী খান লিখেছেন ‘সরকারের কার্যকারিতার সূচক বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে খারাপ। সারা পৃথিবীতে মাত্র ৩৯টি দেশ বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ করেছে এবং বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিস দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল এবং গোটা পৃথিবীর নিকৃষ্টতমগুলোর একটি’ (পৃষ্ঠা, ২৫)। তাহলে ‘গুণগতভাবে দুর্বল’ এই আমলারা কেন ‘আর্থিকভাবে দুর্বল’ কিন্তু ‘আত্মিকভাবে সবল’ শিক্ষক সমাজ এবং এমনকি সমগোত্রীয় ২৬ টি ক্যাডারের উপর এভাবে চড়াও হলেন? কোন্ যুক্তিতে নিজেদের অবস্থানকে আকাশের সীমানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য ১৯৭৩ সাল থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ৭টি বেতন স্কেলে বিদ্যমান ১নং গ্রেডের উপর ২টি ‘সুপার গ্রেড’ এর প্রস্তাব করলেন? উল্লেখ্য, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেকশান গ্রেড অধ্যাপকরা ১৯৭৩ সাল থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ৭টি বেতন স্কেলেই ১নং গ্রেডে ছিলেন।
পে কমিশনের চেয়ারম্যান ড. ফরাসউদ্দিন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো টাকা উপার্জন করে ‘স্বাবলম্বী’ হওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন। তবে তিনি আমাদের আমলাবৃন্দকে সরকারের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার পরও গুণগতভাবে একটু ‘সবল’ হওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন না কেন? দুর্নীতির সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের ১৭৬ টি দেশের মধ্যে ১৪৪ তম এবং সার্কভুক্ত দেশগুলোতে সবার নিচে (ট্রান্সপোরেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, ২০১২)।
অন্যদিকে ওয়াশিংটন ভিত্তিক ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট রুল অব ল ইনডেক্্র, ২০১৪ অনুযায়ী দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৯ টি দেশের মধ্যে ৯৫ তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় সবার নিচে। এছাড়া ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ (২০১৫)- এ বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের ১৮৯ টি দেশের মধ্যে ১৭৩তম (গত বছরের তুলনায় ৩ ধাপ নিচে) এবং সার্কভুক্ত দেশসমূহে যথারীতি সবার নিচে।
উল্লেখিত পরিসংখ্যান কি আমাদের আমালাতন্ত্রের আমলনামার পরিচায়ক নয়? এই আমলাতন্ত্রকেই চিত্রায়িত করতে গিয়ে ড. আকবর আলী খান ‘আইসোমরফিক মিমিক্রি’ নামের একটি পরিভাষা ব্যবহার করেছেন যার সোজাসাপ্টা অর্থ হলো ‘দেখতে সুন্দর কিন্তু অকার্যকর’। আমাদের মন্ত্রী-আমলাদের কেউ কেউ এখন বেশ সদর্পেই বলে বেড়াচ্ছেন – বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের ১ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নেই। তবে এর পেছনের কারণগুলো নিয়ে তারা আলোচনা করতে চান না। বিশ্ব র্যাংকিংয়ে স্থান পেতে শিক্ষকদের গবেষণা কর্মকে গুরুত্ব দেয়া হয়। বিশ্বের প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, গবেষণার জন্য ব্যাপক বরাদ্দ দেয়া হয়। যেমন, ভারতের লক্ষেœৗ বিশ্ববিদ্যালয়কে ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে গবেষণার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৬ কোটি রুপি, যেখানে ছাত্র ও শিক্ষক সংখ্যা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে অনেক কম।
অথচ ২০১৫-১৬ অর্থ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ৪৯ টি বিভাগ/ইনিস্টিটিউট-এর গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ পেয়েছে ৩০ লক্ষ টাকা। সাংসদ জনাব মঈনুদ্দিন খান বাদল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের ২৭ তম সভায় (৩১/০৭/২০১৫ তারিখ অনুষ্ঠিত) আক্ষেপ করেই বলেছেন, সাংসদরা ৪ কোটি টাকার গাড়ি ব্যবহার করেন আর একটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ১ বছরের গবেষণা মঞ্জুরী মাত্র ৩০ লক্ষ টাকা। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাও তথৈবচ। গবেষেণা খাতে কোন ধরনের বিনিয়োগ ছাড়া আপনি বিশ্বমানের গবেষণা প্রত্যাশা করবেন, এটা তো যুক্তির কথা হতে পারে না।
তথাপি, এ সীমিত সুযোগের ভেতরেই বাংলাদেশে যে পরিমাণ আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা ও প্রকাশনা হয়, তার ৯০% পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই করে থাকেন। আর বিদেশে ডিগ্রি করার জন্য বৃত্তির জন্য শিক্ষকদেরকে রীতিমতো লড়াই করতে হয় বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায়, যেখানে আমাদের আমলাতন্ত্রে গবেষণা বৃত্তি গড়াগড়ি খায় এবং ফিরেও যায় যোগ্য প্রার্থীর অভাবে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ নেয়ার অভিযোগ তোলা হচ্ছে। সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে মাত্র ৭% শিক্ষক হলেও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও কম। বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠন এর মান কমে যাওয়ার পেছনে সরকারের কি কোন দায় নেই? বাংলাদেশের মানুষ কি জানেনা, কারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠন বিঘিœত করে? বিভিন্ন রাজনৈতিক সরকারের আমলে কাদের ছাত্র সংগঠন বিভিন্ন ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারের জন্য হাজার হাজার শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে এবং ভিসি-প্রোভিসি হওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গুটিকয়েক শিক্ষক কাদের তোষণ করে? আমি হলফ করেই বলতে পারি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮৯৫ জন শিক্ষকের মধ্যে বড়জোড় ১% শিক্ষক ভিসি-প্রোভিসি হওয়ার দৌড়ে থাকেন, যেটি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন কোন ক্ষেত্রে মান বজায় না রাখার অভিযোগ রয়েছে। আপনারা কি খবর নিয়েছেন, কোন্ কারণে এখানে মাঝে মাঝে নিয়োগের জন্য যোগ্যতার শর্তপূরণকারী কিন্তু মেধাতালিকায় নি¤েœ অবস্থানকারী প্রার্থী নিয়োগ লাভ করে? মূলত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও আমলাদের চাপের কারণেই ইদানিং এসব হচ্ছে। আমাদের আমলারা যে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হবার গৌরব করেন, সে বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে ড. আকবর আলী খান তাঁর বইয়ে লিখেছেন: ‘নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আস্থাহীনতা বিদ্যমান। একটি স্বাধীন পাবলিক সার্ভিস কমিশন থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এখন দুর্নীতি, দলীয় করণ ও প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ ব্যাপক।
সিভিল সার্ভিস এর নিরপেক্ষতার ব্যাপক ক্ষয় সাধন হয়েছে। কোটা সিস্টেমের কারণে মেধা কার্যকারিতা হারাচ্ছে। পদোন্নতিতে দলীয়করণ হচ্ছে। অপরাধীদের শাস্তি ও সফলদের পুরস্কার দেয়া যাচ্ছে না। অযথাযথ বেতন কাঠামো, অযথাযথ চাকুরি কাঠামোর কারণে পেশাদারিত্ব লোপ পাচ্ছে’ (পৃষ্ঠা, ৩০)।
ফলশ্রুতিতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, আমলারা যুগ যুগ ধরে চলে আসা গ্রেডগত মর্যাদা কেড়ে নেয়ার কূটচালের মাধ্যমে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে এবং নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য ভাল প্রশাসন উপহার দেয়ার চেয়ে নিজেদের জন্য ২ টি ‘সুপার গ্রেড’ সৃষ্টি করে এবং ড. ফরাসউদ্দিনের সিলেকশান গ্রেড ও টাইম স্কেল বাদ দেয়ার ফর্মুলার পুরোপুরি সৎব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদেরকে এবং পূর্বে প্রাপ্ত অনেককে কার্যত বেতন স্কেলের ১ নং গ্রেড থেকে ৪ নম্বরে ঠেলে দেবার প্রয়াসের মাধ্যমে নিজেদের অন্তঃসারশূন্যতাকে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত এবং প্রদর্শিত হবার ঝুঁকি নিচ্ছেন। আমলাতন্ত্রের কেউ কেউ নাকি দম্ভোক্তি করে মন্তব্য করছেন ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পারলে আন্দোলন করে তাঁদের দাবি আদায় করুক।’ সরকারকে আমলাদের এমন দম্ভের কার্য-কারণ খুঁজতে হবে।
আমলারা হয়তোবা নিশ্চিতভাবেই চান, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অশান্ত হোক যদিও শিক্ষকরা কোন আন্দোলন বা ক্লাশ বর্জন করতে চান না।
তবে অহেতুক অপমানিত করে শিক্ষকদের অবদমিত করার এই আমলাতান্ত্রিক নীল নকশার ফাঁদে সরকার যাতে পা না দেয় সে ব্যাপারে সরকারের সকল শুভানুধ্যায়ীকে সজাগ থাকতে হবে। শিক্ষকরা এযাবৎ অত্যন্ত নিয়মতান্ত্রিকভাবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক, প্রশাসনিক এবং গবেষণা কার্যক্রম এর তেমন কোন ক্ষতি না করে সর্বোচ্চ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। তবে একে দুর্বলতা মনে করা বড় ভুল হবে। এটি বিস্মৃত হবার অবকাশ নেই যে, ২০০৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিন সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন।
এখানে উল্লেখের দাবি রাখে যে, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বেশীরভাগ শিক্ষক চিন্তা-চেতনায় অগ্রসর, প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত। তাঁরা নিজেদের যোগ্যতা নিয়ে আত্মবিশ্বাসী এবং রাজনীতি সচেতন আদর্শ ও মনের টানেই, কোন দল থেকে কিছু পাবার আকর্ষণে নয়। আত্ম-মর্যাদা নিয়ে আত্মপ্রত্যয়ী এই শিক্ষক সমাজ তাই কোন চাপিয়ে দেয়া অন্যায় মেনে নিতে পারে না, যা এ জাতির গৌরবোজ্জ্বল ও দীর্ঘ ইতিহাসে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। সরকারি নীতি বাস্তবায়নে আমলাতন্ত্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে সরকারকে আর্ম-টুইস্ট করে অন্যায্য দাবি আদায় করার মানসিকতা থেকে একে বের হয়ে আসতে হবে, কেননা আমরা আলবার্ট আইনস্টাইন এর মতো আমলাতন্ত্রকে ‘সকল ভাল কাজের মৃত্যু’ (দি ডেথ অব অল সাউন্ড ওয়ার্ক) হিসেবে আখ্যায়িত করতে চাই না।
লেখক: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক
ইমেইল: kkhasru@gmail.com
Published1: http://www.esuprobhat.com/content/2015/2015-08-29/zoom_view/2015_08_29_4c.jpg
Published2: http://goo.gl/wbEsE3
আরো পড়ুন:
ক্যাডারের রাজা "প্রশাসন ক্যাডার"
প্রশাসন ক্যাডার দুর্নীতির শীর্ষে!
ঔপনিবেশিক জনপ্রশাসন এবং ক্যাডার সার্ভিস সংস্কার
আরো পড়ুন:
ক্যাডারের রাজা "প্রশাসন ক্যাডার"
প্রশাসন ক্যাডার দুর্নীতির শীর্ষে!
ঔপনিবেশিক জনপ্রশাসন এবং ক্যাডার সার্ভিস সংস্কার
0 comments:
Post a Comment