ড. আবদুল্লাহ ইকবাল
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, শিক্ষা ছাড়া বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো যাবে না, উন্নতির শিখরে পৌঁছানো যাবে না- এগুলো অতি প্রচলিত কতগুলো বাক্য। সবাই চায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মানসম্মত শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা। সরকার ও বিরোধী দলগুলো প্রতিনিয়তই দেশবাসীকে বোঝাতে চায় তারা নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সবাই মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার ব্যাপারে আন্তরিক ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ! কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন কতটুকু? শুধু সভা-সমাবেশ বা বক্তৃতায় বললেই কি মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত হয়ে যাবে? এর জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার গুরুদায়িত্ব সরকারের। তবে সরকার এককভাবে এটি করতে পারবে না। সরকারের আন্তরিকতার পাশাপাশি সব রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে
সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতাও অপরিহার্য। মানসম্মত শিক্ষার একটি অপরিহার্য উপাদান হলো যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষক। কিন্তু মেধাবী তরুণ-তরুণীরা কি শিক্ষকতা পেশায় আসছে বা রাষ্ট্র কি আনতে পারছে? নাকি তারা এ পেশার প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে বা অনীহা প্রকাশ করছে? সরকার বা রাষ্ট্র কি এগুলো ভেবে দেখেছে? সময় এসেছে এগুলো ভেবে দেখার। লক্ষ করলে দেখা যাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে পারলেও অন্য স্তরগুলোতে এটি সম্ভব হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ অপর্যাপ্ত বেতন-ভাতাদি ও যথাযথ সামাজিক মর্যাদা না পাওয়া। পাশাপাশি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতাও একটা বড় কারণ।সাধারণত মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসাগুলোর ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির পদটি দখল করে থাকেন কোনো রাজনৈতিক দলের নির্বাচিত কিংবা অনির্বাচিত ব্যক্তিরা, যার ফলে তাঁদের কাছে যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষক নিয়োগের চেয়ে প্রাধান্য পায় ব্যক্তিগত-পারিবারিক কিংবা দলীয় সুবিধালাভের বিষয়টি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অধিকতর মেধাবী বা যোগ্য প্রার্থীকে বাদ দিয়ে অর্থের বিনিময়ে তাঁরা 'নিয়োগ বাণিজ্য' করে থাকেন। সমাজে তাঁদের প্রতিপত্তি এতটাই বেশি যে কারো প্রতিবাদের উপায় থাকে না। অনেক সময় স্থানীয় প্রশাসনের সংশ্লিষ্টতা থাকায় ব্যাপারটি আরো কষ্টদায়ক ও নিন্দনীয় হয়ে পড়ে। ফলে অপেক্ষাকৃত মেধাবী বা যোগ্য প্রার্থীদের পক্ষে অনেকটা নিরুপায় হয়ে দুর্বল-অসহায়ের মতো সহ্য করা ছাড়া কিছুই করার থাকে না। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের বেলায়ও এই অভিযোগ প্রযোজ্য! যার ফলে প্রক্রিয়াগত জটিলতার কারণেই প্রতিষ্ঠানগুলোতে মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। এতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বা কলেজ পর্যায়ের শিক্ষকদের মান কেবলই কমছে। এই নিয়োগসংক্রান্ত সমস্যা থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোকে মুক্তি দিতে চাইলে মাধ্যমিক ও কলেজ পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগের উদ্দেশ্যে আলাদা একটি কমিশন বা অনুরূপ কিছু করা জরুরি হয়ে পড়েছে। ওই কমিশন কেন্দ্রীয়ভাবে মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াটি অধিকতর স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন করবে- এমনটি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি বিদ্যমান প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াটিও রাজনৈতিক বা অন্য কোনো প্রকার প্রভাব থেকে মুক্ত করে আরো স্বচ্ছ করতে হবে।
এটি কেউই স্বীকার করবে না যে ভালো শিক্ষক ছাড়া ভালো মানের শিক্ষাদান সম্ভব। আবার কম মেধাবী ছাত্রটি কিছু বিতর্কিত বা প্রশ্নবিদ্ধ প্রক্রিয়ায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেকে দক্ষ করে তুলবেন সেই সুযোগও নেই। শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকায় বা যথাযথ পরিকল্পনা ও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার অভাবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বা কলেজ পর্যায়ের সব শিক্ষককে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা যাচ্ছে না। অন্যদিকে প্রতিবছরই কমছে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ। চলতি বছরের বাজেটেও বিগত বছরের চেয়ে বরাদ্দ কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় নিজেও এতে উদ্বিগ্ন। একদিকে প্রতিবছরই সব পর্যায়ে শিক্ষার্থী-শিক্ষক ও আনুষঙ্গিক জনবল বাড়ছে, অন্যদিকে বাজেটে বরাদ্দ কমছে! তাহলে মানসম্মত শিক্ষা কিভাবে নিশ্চিত করা যাবে? আবার শিক্ষকদের জন্য আকর্ষণীয় বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা বিধান না করতে পারায় প্রতিনিয়তই এই পেশায় মেধাবীরা আসতে অনিচ্ছুক হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ শিক্ষকতায় এসেও পরবর্তী সময় থাকছে না। এর কারণ হলো পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা ও পদোন্নতির অভাব। প্রাথমিক বা মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজগুলোর শিক্ষকদের একটা বড় ক্ষোভ হলো পদোন্নতির সুযোগ না পাওয়া। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁদের একই পদে সারা জীবন চাকরি করে অবসরে যেতে হয়। আবার একই পদমর্যাদার বা যোগ্যতাসম্পন্ন অন্য চাকরিজীবীরা পদোন্নতিসহ অধিকতর আর্থিক সুবিধাদি ভোগ করে থাকেন। যার ফলে স্বাভাবিকভাবেই চাকরিপ্রার্থীরা শিক্ষকতার প্রতি অনীহা প্রকাশ করেন। এমনিতেই যেখানে বেতন-ভাতাদি নিয়ে অনেক অসন্তোষ বিদ্যমান, সেখানে নতুন করে প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোতে তাঁদের আরো বঞ্চিত করা হচ্ছে বলে বিভিন্ন পত্রিকার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। ফলে ভবিষ্যতে এই পেশায় যোগ্য ও মেধাবীদের পাওয়া কঠিনতর হয়ে উঠবে।
প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোয় শিক্ষকদের অবমূল্যায়নের চরম ধৃষ্টতা দেখানো হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ২০০৯ সালে বাস্তবায়িত বেতন কাঠামোর পদমর্যাদা থেকে দুই ধাপ নামিয়ে আনার মাধ্যমে! এতে ভবিষ্যতে মেধাবীরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতায় আগ্রহী হবে না, এটি অনেকটাই নিশ্চিত। এখনো পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ মেধাবী শিক্ষার্থীর জীবনের স্বপ্নই থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার। শিক্ষকতার সুযোগ না পেলে যেতে চায় অন্য পেশায়। কিন্তু বর্তমানে প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোতে বেতন কমিশন ও সচিব কমিটির সুপারিশে প্রকারান্তরে মেধাবীদের শিক্ষকতায় আসতে নিরুৎসাহী করার অশুভ ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। আমরা খুশি হতাম যদি সরকারের পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হতো যে বেতন কমিশনের সদস্য বা সচিব কমিটির সদস্যদের সঙ্গে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যোগ্যতার তফাতটা কেমন তার একটি তুলনামূলক চিত্র দেখতে পারলে। কী কারণে অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী হয়েও সচিব বা অন্যদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের থেকে অধিক মর্যাদা বা সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে? কিংবা কোন যোগ্যতাবলে তাঁরা এই অধিক পদমর্যাদা বা সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাশা করেন সেটিও দেশবাসীর কাছে স্পষ্ট করলে আমাদের মতো 'বঞ্চিত শিক্ষকগণ' নীরব হয়ে যেতাম। খুব জানতে ইচ্ছা করে তাঁদের কতজনের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার আবেদন করার ন্যূনতম যোগ্যতাটুকু আছে বা ছিল?
প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বর্তমান সরকারের মন্ত্রীদের বহুবার বলতে শুনেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রদান করতে সরকার সচেষ্ট। তাহলে কি ধরে নেব যে সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে প্রতারণা করছে? সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির বয়স বাড়িয়ে ৬৫ বছর করে মেধার স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে সম্মানিত করেছে। কিন্তু কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তির অশুভ তৎপরতায় যেন সেই শিক্ষকরা অসম্মানিত না হন তার নিশ্চয়তার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মানসম্মত শিক্ষার নিশ্চয়তা বিধান করতে হলে মেধাবীদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক হিসেবে আকৃষ্ট করতে আমাদের পাশের দেশগুলোর মতো শিক্ষকদের পদমর্যাদার পাশাপাশি অন্যান্য গবেষণার সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো বা সুপারিশ বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সম্মানিত শিক্ষক নেতারা সরকারের কর্তাব্যক্তিদের বিষয়টি জানানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সরকার বিষয়টি সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ না করলে চলমান এই আন্দোলন নতুন মাত্রা পেতে পারে। যার ফলে ব্যাহত হতে পারে শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ, দীর্ঘ হয়ে যেতে পারে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন, যার দায়ভার সরকারের ওপরই বর্তাবে, অন্য কোনো স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ওপর নয়।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি
বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
iqbal21155@bau.edu.bd; iqbalfoodtech@yahoo.com
0 comments:
Post a Comment