Tuesday, July 7, 2015

বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী শিক্ষক পাওয়া যাবে না!

ড. আবদুল্লাহ ইকবাল॥


বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নাকি বলা হয় ‘জাতির বিবেক’। কী কারণে এমনটি বলা হয় তার সঠিক উত্তর মনে হয় আমার মতো অনেকের অজানা। শিক্ষকতায় আসার আগে ‘জাতির বিবেক’ হবো এমনটি চিন্তা করিনি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুর দিকে একটু ভালো ফল করায় স্বপ্ন দেখেছিলাম শিক্ষক হওয়ার। আল্লাহর রহমতে সুযোগও পেয়ে গেলাম। আর অমনি হয়ে গেলাম তথাকথিত ‘জাতির বিবেকের’ অংশ। শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর প্রথম যখন গ্রামের বাড়িতে
গেলাম তখন পাড়া-পড়শী, দাদা-চাচা থেকে শুরু করে সবাই জিজ্ঞাসা করছেন, ‘এত্ত এত্ত পড়ালেখা করে মাস্টারি চাকরি পাইলা- এসপি, ম্যাজিস্ট্রেট হইতে পারলা না …’ ইত্যাদি আজব আজব প্রশ্ন! আসলে তারা তো আমার জন্য অনেক বেশি আশাবাদী ছিলেন। তাদের বিশ্বাস ছিল, আমি পড়ালেখা শেষ করে ভালো কিছু করব বা হতে পারব! কারণ তখনও আমার গ্রামের বা আমি যে স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছি সেখান থেকে হাতেগোনা দু-একজন মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। অনেকেই জানতে চেয়েছেন বেতন কত পাই? এর উত্তর সরাসরি না দিলেও তারা ঠিকই জেনে বা বোঝে গেছেন! কাউকে কাউকে বলতে শুনেছি, ‘পড়াশোনার অনুপাতে বেতনটা কম হয়ে গেছে।’ এই নিয়ে বাড়ির পাশের রাস্তায় বসে একের পর এক আলোচনা চলছেই। মনে হচ্ছে, আমার খুশি বা আনন্দের চেয়ে গ্রামবাসীর হতাশাই বেশি! তাদের একটাই আর্তনাদ, এতদিন পড়ালেখা করেও ‘মাস্টার’ (যদিও কারও কারও ভাষায় ‘প্রফেসর’)। এর আরেকটি কারণ ছিল, আমার বাবা ছিলেন প্রাইমারির শিক্ষক। আর মাস্টার মানেই সবাই এক! তাই সবার ভেতরে হতাশা। সবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতের একপর্যায়ে একজন কৌতূহলী বৃদ্ধ মানুষ জিজ্ঞেস করে বসলেন, কোন সাবজেক্ট পড়াই, কাদের পড়াই বা আমার ছাত্ররা পাস করে কোথায় কোথায় চাকরি পায় ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি যখন বললাম, আমার ছাত্ররা এসপি হতে পারবে বা হবে, ম্যাজিস্ট্রেট হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে, কৃষিবিদ হবে …তখন তারা একটু আগ্রহ ভরেই শুনছিল। যাই হোক, এই ধারণা অনেকটাই ভাঙল অন্য একজনের কথায়। তার ভাষায়, উপজেলা বা থানাতে যেসব অফিসার আছেন (যেমন নির্বাহী কর্মকর্তা, মৎস্য কর্মকর্তা, কৃষি কর্মকর্তা ইত্যাদি) তারা আমার মতোই কোনো না কোনো শিক্ষকেরই ছাত্র। তখন সবাই খুশি। তার মানে তাদের সবার স্যার আমি! এবার তারা অনেক খুশি! তাহলে আমার চাকরিটা মোটেই খারাপ না বা ছোট না!
আমার পরিচিত বা বন্ধু-বান্ধবের বেলায় দেখেছি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপেক্ষাকৃত কম মেধাবীরা বিসিএস দিয়ে সরকারি কর্মকর্তা হয়েছে। তাদের সঙ্গে বা অন্য সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিজেকে কখনও তুলনা করতে চাইনি। সবকিছু জেনেই শিক্ষকতায় এসেছি। এখানে ভোগবিলাস বা সুযোগ-সুবিধা নিতান্তই কম বা উল্লেখ করার মতো না। তবুও একজন ভালো ছাত্র বা ভালো মানুষ হিসেবে সমাজের স্বীকৃতিটুকু আছে_ এটিই কম কিসের? কিন্তু কিছু দিন আগে ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন বেতন কমিশনের প্রতিবেদন এবং তৎসংক্রান্ত সচিব কমিটির পর্যালোচনার বিষয়ে কিছু জিনিস জেনে অনেকের মতো আমিও একটু লজ্জা ও অপমানিত বোধ করছি। একই সঙ্গে সরকারের ভূমিকাকেও আমার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ মনে হচ্ছে। বেতন কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় যত দিন স্বাবলম্বী না হবে, ততদিন স্বতন্ত্র বেতন স্কেল দেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে না। অন্যদিকে, সচিব কমিটির সুপারিশ বা প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ২০০৯ সালে বাস্তবায়িত বেতন কাঠামোর পদমর্যাদা থেকে দুই ধাপ নামিয়ে আনা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো শিক্ষকের জন্য তা অত্যন্ত অবমাননার শামিল। সরকারের কাছে খুব জানতে ইচ্ছা করে, এই প্রতিবেদনটি কিছু অতি উৎসাহী পদস্থ আমলার অযাচিত নগ্ন হস্তক্ষেপের বহিঃপ্রকাশ, নাকি বাস্তবতা?
শিক্ষকতা জীবনে কখনও পাওয়া না-পাওয়ার হিসাব মিলাতে যাইনি। আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ভালো ফল করেছি, তাদেরই একটি অংশ শিক্ষকতায় আসতে পেরেছি। অনেকেই সে সুযোগ পায়নি। কেউ কেউ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদে কর্মরত। এটি মনে হয় কেউই অস্বীকার করবে না যে, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগেরই সর্বোচ্চ মেধাবী শিক্ষার্থীদের জীবনের স্বপ্নই থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া)। না পারলে অন্য কোথাও_ প্রশাসন বা অন্য ক্যাডারে। আর তাদের থেকেই একদিন হয়ে ওঠেন প্রজাতন্ত্রের জাঁদরেল আমলা! দিকনির্দেশনা দেন সরকারকে_ কীভাবে দেশ চালাতে হবে …। এই ধারাবাহিকতায়ই সম্ভবত প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন করার এই ‘অভিনব প্রয়াস’। যতটুকু জানি, সচিব হওয়ার প্রাথমিক ধাপগুলোতেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরাই বড় ভূমিকা পালন করেন। তাদের বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, খাতা মূল্যায়ন, মৌখিক পরীক্ষা নেওয়াসহ আনুষঙ্গিক কার্যাবলির একটি বৃহৎ অংশই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ‘অবহেলিত’ শিক্ষকরাই করে থাকেন। তার পরও শিক্ষকদের প্রতি এ কেমন আচরণ? এ কি কৃতজ্ঞতাবোধের অভাব নাকি নেহাতই ধৃষ্টতা? আবার যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বাবলম্বী করার নামে শিক্ষাকে ‘অভিজাত পণ্যে’ পরিণত করা হয়, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান সুযোগ্য গভর্নর বা এমন অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তিই হয়তো উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবেন। এটি কি আমাদের কারও কাম্য হতে পারে? এমনটি ঘটলে রাষ্ট্র কি এর দায়ভার এড়াতে পারবে? সরকার কি চোখ বুঝে তা নীরব দর্শক হয়ে কেবল উপভোগ করবে নাকি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে উদ্যোগী হবে।
আসলে শিক্ষাকে আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকরা মনে করে থাকে একটা অনুৎপাদনশীল খাত বা বিনিয়োগ হিসেবে। মনে করা হয়, এখান থেকে কোনো ‘রিটার্ন’ আসবে না। এটিই হলো আমাদের বড় সমস্যা। এমনিতেই বিভিন্ন স্তরের সম্মানিত শিক্ষকদের বিভিন্নভাবে অপমানিত বা নাজেহাল করা হয়েছে_ সেটি সংসদের ভেতর থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট বা পরীক্ষার হলে সর্বত্র! কখনও মুখে, কখনও গায়ে হাত উঠিয়ে। কখনও রাজনীতিবিদদের দ্বারা। কখনও পোশাক পরিহিত বাহিনীর হাতে, আবার কখনও সিভিল প্রশাসনের কর্মকর্তার দ্বারা! এসবই মিডিয়ার বদৌলতে দেশবাসী জেনেছে। বেতন কাঠামোর এই দুটি সুপারিশ বা প্রতিবেদন বাস্তবায়িত হলে এই ধারণা বা কর্মকাণ্ডগুলোকে আরও পাকাপোক্ত করে তুলবে। একদিকে এটি শিক্ষাকে পণ্যে পরিণত করার মাধ্যমে বাণিজ্যিকীকরণের সুযোগ সৃষ্টি করবে; অন্যদিকে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসার আগ্রহ হারাবে বা অনীহা প্রকাশ করবে। এতে করে ‘জাঁদরেল আমলা’র জন্মদাতা প্রতিষ্ঠান তথা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মেধাশূন্য হয়ে পড়বে এটা নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যেতে পারে। আমলারা কি মনে করেন শিক্ষকরা কিছুই করেন না? তারা একবারও স্মরণ করতে চেষ্টা করেন না যে, তাদের মতো জাঁদরেল আমলা সৃষ্টিতে এই ‘অকর্মা’ শিক্ষকরাই কোনো না কোনোভাবে ভূমিকা রেখেছেন। এমনিতেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধায় সন্তুষ্ট না হয়ে অনেকেই বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। আর প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো কার্যকর করলে এর মাত্রা বাড়বে বহুগুণে। যার প্রভাব পড়বে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর। তাই সরকারকেই এটি গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করতে হবে। বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে অন্য অনেক মন্ত্রী মহোদয়ের মুখে বিগত কয়েক বছরে অসংখ্যবার শুনেছি সব শিক্ষকের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রদান করতে সরকার সচেষ্ট। তাহলে কি ধরে নেব এটি সেই প্রচেষ্টার প্রতিফলন বা বাস্তবায়ন? শিক্ষকদের এই সম্মানটুকু দিতে রাষ্ট্রের এত কার্পণ্য কেন? এতে করে কি রাষ্ট্রের অনেক বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে? ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই প্রস্তাবিত সুপারিশ বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছে। সরকার বিষয়টি সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ না করলে এর দায়ভার সরকারের ওপরই বর্তাবে, আমলাদের ওপর না।

লেখকঃ
সহযোগী অধ্যাপক, ফুড টেকনোলজি ও গ্রামীণ শিল্প
বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
Source: http://www.esamakal.net/pop_up.php?img_name=2015%2F06%2F12%2Fimages%2F05_100.jpg

0 comments:

Post a Comment