আলী ইমাম মজুমদার
রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অর্থ আবশ্যক। এ অর্থের প্রধান উৎস জনগণের দেওয়া কর। সেই কর কোথা থেকে আসবে আর ব্যয় হবে কোথায়, তা চূড়ান্ত করার দায়িত্ব আমাদের সংবিধান জাতীয় সংসদকে দিয়েছে। ধরে নেওয়া যায়, আয় হবে অধিকতর সক্ষমদের কাছ থে
কে। আর রাষ্ট্রযন্ত্র সচল রাখা এবং এর কল্যাণধর্মী চরিত্র বা বৈশিষ্ট্যের চাহিদা অনুযায়ী হবে ব্যয়। সংবিধানের প্রস্তাবনায়ও ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য’ নিশ্চিত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে বিবেচনা করা যায় যে শিক্ষার প্রসারে রাষ্ট্রের সহায়তা থাকবে সর্বতোমুখী। এর জন্য ব্যয় করবে সামর্থ্য অনুসারে। অবশ্য গোটা শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক ব্যয়ভার আমাদের মতো দেশের সরকারের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। এই ব্যয়ের অংশীদার হতে হবে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজকেও। তা–ই হয়ে চলছে দীর্ঘকাল যাবৎ। প্রয়োজনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না হলেও এ ব্যবস্থাই আমাদের সমাজে ক্রমান্বয়ে শিক্ষার প্রসার ঘটাতে অবদান রাখছে। এই ব্যয়কে একটি সামাজিক বিনিয়োগ বলেই বিবেচনা করা হয়। তাই এ খাতে করারোপ করে অর্থ সংগ্রহের প্রচেষ্টা রাষ্ট্রের মূলনীতির সঙ্গে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা ভেবে দেখার বিষয়।
উল্লেখ্য, ৪ জুন ঘোষিত বাজেটে অর্থমন্ত্রী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের আয়ের ওপর ১০ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর আরোপের প্রস্তাব করেছিলেন। পরে সাড়ে ৭ শতাংশ বহাল রাখা হয়। তাঁর মতে, শিক্ষাসহ অন্যান্য সামাজিক খাতে অধিকতর বিনিয়োগের জন্য এসব প্রতিষ্ঠান থেকে কর সংগ্রহ করা যৌক্তিক। আলোচনা প্রাসঙ্গিক যে এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর করারোপ করা হলেও তা আদায় করা হবে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই। সংসদে প্রতিনিধিত্বের ধরনে বিভিন্ন দল থাকলেও মূলত কার্যকর কোনো বিরোধী দল নেই। সে কারণে প্রস্তাবটির বিরুদ্ধে সংসদে কেউ সোচ্চার হননি। তবে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে পত্রপত্রিকায়। এর সমর্থক কারও মতে, সচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরাই এসব প্রতিষ্ঠানে পড়ছেন। তঁাদের আরেকটু বেশি ব্যয় করা অসংগত হবে না। তবে প্রায় বিনা মূল্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল ও প্রকৌশল কলেজের চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ আসন থাকলে এত অধিক টাকা ব্যয় করে খুব কমসংখ্যকই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পথে চলতেন। কেউবা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেশন জট, মন্দ ছাত্র রাজনীতিসহ কোনো কোনো কারণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছেন। তাঁদের সেই যাওয়াও যৌক্তিক। এর জন্য তাঁরা দিচ্ছেন চড়া মাশুল। আবার কর দেবেন কেন এবং কী যুক্তিতে?
যতটুকু জানা যায়, এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৮৩টি, শিক্ষার্থী আছেন সাড়ে চার লাখ। তেমনি ৬৬টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে আছেন ২০ হাজার ছাত্রছাত্রী। তাঁদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব তো ছিল রাষ্ট্রের। তা করা হলো না। বরং উল্টো কর বসিয়ে আরও ব্যয়বহুল করে পথের বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজে উচ্চ–মধ্যবিত্ত শ্রেণির পাশাপাশি নিম্ন–মধ্যবিত্ত শ্রেণিরও প্রচুর ছাত্রছাত্রী রয়েছেন। সরকারের কোনো ব্যয় ছাড়াই তাঁরা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট রয়েছেন। এতেও বাধা! এর নৈতিক দিকটি কোথায় তা বোঝা দুর্বোধ্য। পাশাপাশি এই স্তরে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীরা প্রায় বিনা মূল্যে পড়ছেন। তা পড়ুক। সরকারের সামর্থ্য থাকলে সেখানে আরও ব্যয় করা উচিত। সে দাবিও সবাই করেন। তবে যাঁরা সেগুলোতে পড়তে পারেন না বা পড়েন না কোনো না কোনো কারণে, তাঁদের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ কেন?
বলা হয়, বেসরকারি এসব প্রতিষ্ঠান অযৌক্তিক হারে ছাত্র-বেতনসহ অন্যান্য ফি নিচ্ছে। অভিযোগ অনেকাংশে সত্য হতে পারে। আর তা ঠেকানোর জন্য তো বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও সরকার রয়েছে। তা না করে এ ধরনের করারোপ তো ছাত্রছাত্রীদের বোঝা আরও বাড়াল। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গুটি কয়েক উঁচু মানসম্পন্ন। তবে বেশির ভাগই নয়। আর সেসব প্রতিষ্ঠানে কিন্তু খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করছেন অনেক ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরাই। আর মানের এই দুর্বলতা দূর করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোনো ভূমিকাই তো লক্ষণীয় হয় না। সেদিন শিক্ষাসচিব রাজধানীর দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করে মন্তব্য করলেন—একটি ভালো স্কুলের সুযোগ-সুবিধাও এগুলোতে নেই। তিনি সাহস করে সত্য কথা বলেছেন। তবে এদের পরিচালনার অনুমতি কারা দিল? আর সময়ান্তরে নবায়ন করছে কারা? নিজ ক্যাম্পাসে যাওয়ার একটি সময়সীমা একবার বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সিংহভাগ ক্ষেত্রেই তেমন কিছু হয়নি। কিছুই হয়নি, যারা আদেশকে মানল না তাদের। সময়ান্তরে পরিদর্শন ও ব্যবস্থা নেওয়ার কার্যকর দায়িত্বও নিতে হবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে। তাদের জনবল বা অন্য কোনো সক্ষমতার অভাব থাকলে তা দূর করতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। জানা যায়, আরও শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদন বিবেচনাধীন আছে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজের ক্ষেত্রে এতৎসংক্রান্ত দায়িত্ব স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং এফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয়ের। নামকাওয়াস্তে রোগী নিয়ে একটি হাসপাতাল জরাজীর্ণ কিছু যন্ত্রপাতি নিয়েই শুরু করছে চিকিৎসা শিক্ষার ন্যায় জটিল কাজ। অনুমোদন ও সময়ান্তরে নবায়নও হয়। ডিগ্রি নিয়ে বের হন শিক্ষার্থীরা। আর এ দোষ তো তাঁদের নয়। যাদের এ অব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা, তাদের। সেই অক্ষমতার মাশুল দেবেন ছাত্রছাত্রীরা, এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না।
১৯৯২ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের মাধ্যমে এসব বিশ্ববিদ্যালয় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। ঠিক তেমনি বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোও। এখানে ব্যয়ের অতিরিক্ত আয় উদ্যোক্তা, ট্রাস্টি বা বোর্ড সদস্যরা কেউ ভাগাভাগি করে নিতে পারেন না। তা ব্যয় করতে হয় ভবন নির্মাণ, গবেষণাগার ও পাঠাগার সম্প্রসারণ, শিক্ষকদের বর্ধিত বেতন-ভাতা, শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়া ইত্যাদি কাজে। কেউ তা না করে বাঁকা পথে নিতে চাইলে তা ঠেকানোর দায়িত্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থার। সেই নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা জোরদার করা হলে এমনটা হবে না। তবে প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি সরকারের সময়ে কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে তাদের সমর্থিত ব্যক্তিদেরই এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে দেওয়া হয়। সরকার পরিবর্তনের পর পরিচালনা পর্ষদের হয় কিছু চেহারা বদল। এমনকি বদলে যায় প্রতিষ্ঠানটির নাম। এই সুবিধার বিষয় মাথায় রেখে এমন নাম বদল বারবার হচ্ছে, এমনটাই দেখা যায়। তাদের কার্যক্রমের ওপর কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ওপর কর বসিয়ে কিছু টাকা আয় হলেও এগুলোর মানে ইতিবাচক প্রভাব পড়ার কোনো কারণ নেই। এমনিতেই আমাদের দেশে শিক্ষায় বিনিয়োগ কম বলে অভিযোগ রয়েছে। তার মধ্যেও যেটুকু বেসরকারি বিনিয়োগ আসছে, তার ওপর কর বসানোয় তা–ও নিরুৎসাহিত হবে।
কোনো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর কর আরোপ অযৌক্তিক। এটা সংবিধান প্রদত্ত আমাদের শিক্ষা লাভের অধিকারের পরিপন্থী। তা সত্ত্বেও সরকার তা করে চলেছে। কিছুকাল আগে থেকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর ছাত্রছাত্রীরা সাড়ে ৭ শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন কর দিয়ে যাচ্ছে সরকারকে। তবে ২০১০ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর সাড়ে ৪ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব, প্রতিবাদের মুখে সরকার তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিল। এ বছর বর্ধিত হারেই কর আরোগিত হলো। যুক্তরাষ্ট্রের মতো পুঁজিবাদী দেশে প্রায় সব ক্ষেত্রেই করের ছড়াছড়ি। সেখানেও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অলাভজনক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রয়ে গেছে করের আওতার বাইরে।
বরং তারা সেবামূলক সংস্থাগুলো থেকে কিছু ছাড় পায়। দিতে হয় না পৌর কর। এটা বিবেচনায় নেওয়া দরকার যে সরকারের এসব শিক্ষার্থীর জন্য যে অর্থ ব্যয় করার কথা ছিল, তা করতে হচ্ছে না। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ সেই দায়িত্ব পালন করছে। সেখানে তো তাঁরা আশা করতেই পারেন সরকারি সহায়তা। করের বোঝা নয়। পড়ালেখা করতেও যদি কর দিতে হয়, তা সমাজে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় সাংবিধানিক অঙ্গীকারের পরিপন্থীই হবে।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment