যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা ‘এসোসিয়েশন অফ কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটি’র অর্থায়নে সম্প্রতি পরিচালিত এক আন্তর্জাতিক গবেষনায় সারকথা হিসাবে বলা হয়েছে, ‘সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাই বৃহদাকারে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনেছে, আর বিশ্ববিদ্যালয়ই প্রতিটি পরিবর্তনের জন্য প্রধান নিয়ামকের ভূমিকায় ছিলো।’ উন্নত বিশ্ব এমন কি উন্নয়নশীল বিশ্বের উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা তাই অনস্বীকার্য।
ইতিহাস বলে, তেরশো শতকের দিকে যুক্তরাজ্যর শাসকেরা যখন কেমব্রিজের মত বিশ্ববিদ্যালয় নির্মান করেছিলো মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার শাসকেরা তখন নির্মান করতো উপাসনালয়। সময়ের পরিক্রমায় এখন সেই কেমব্রিজ হয়েছে আধুনিক মানুষের তীর্থস্থান।
দেশ হিসাবে বাংলাদেশ অপেক্ষাকৃত নবীন তাই বিভিন্ন অসুবিধার পাশাপাশি সুবিধাও কিন্তু অনেক, আমরা চাইলে অন্যের অভিজ্ঞতার আলোকে কাজ করতে পারি যেটা সবসময় নবীনদের জন্য একটা এডভান্টেজ। কিন্তু দুর্ভাগা এই দেশ বলতেই হয়, তা না হলে এই সুযোগ কাজে না লাগিয়ে যে বোকামিটা আমরা করছি তার জন্য পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমাদের দায়ী থাকতে হবে নিঃসন্দেহে।
দেশ হিসাবে বাংলাদেশ অপেক্ষাকৃত নবীন তাই বিভিন্ন অসুবিধার পাশাপাশি সুবিধাও কিন্তু অনেক, আমরা চাইলে অন্যের অভিজ্ঞতার আলোকে কাজ করতে পারি যেটা সবসময় নবীনদের জন্য একটা এডভান্টেজ। কিন্তু দুর্ভাগা এই দেশ বলতেই হয়, তা না হলে এই সুযোগ কাজে না লাগিয়ে যে বোকামিটা আমরা করছি তার জন্য পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমাদের দায়ী থাকতে হবে নিঃসন্দেহে।
উন্নত বিশ্বের প্রতিটি দেশ তাদের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কেন্দ্র করেই ঘটনার আবর্ত তৈরি করে। এই যেমন, বিভিন্ন দেশের রেওয়াজ আছে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হয়ে প্রথম বক্তৃতা তিনি দেন কোন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিংবা কোন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান অন্য দেশে পরিদর্শনে গেলে সেই দেশের কোন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করেন। এমনই ঘটনার ধারাবাহিকতায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করেছে, ( যদিও এই বক্তৃতার ব্যবস্থা শুধুমাত্র জনাব নরেন্দ্র মোদীর অভিপ্রায়ে হয়েছে তা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে প্রশাসনের উদাসীনতা দেখে সহজে অনুমেয়।) কিন্তু বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সেভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না, বরং সাম্প্রতিক বিভিন্ন সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রের ক্ষতিকর উদাসীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই হতে পারতো আমাদের স্বপ্ন গড়ার কারখানা। কেননা এটাই সত্য, এই বাংলাদেশের জন্মই হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে, ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গন অভ্যুথান, ৭১-এর স্বাধীনতা, ৯০ এর স্বৈরাচার পতন কিংবা হালের ২০০৮ এর অগণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সবই কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু এবং এর ঘটনা প্রবাহ ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রীক। যুদ্ধ বিগ্রহ শেষে স্বাধীনতা উত্তর সত্যিকারের দেশ গড়ায় তাই বিশ্ববিদ্যালয়ই পারে প্রধান ভূমিকা রাখতে। আমাদের শুরুটাও কিন্তু ঠিক তেমনটাই ছিলো। কিন্তু ধীরে ধীর সব কিছু বুর্জয়াদের অধিগ্রহনে চলে যাচ্ছে, যা ভয়াবহ কিছুর নির্দেশক।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে শুরুর ঘটনা বলতে গেলে বলতে হয়, জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক স্বাধীনতা তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্বশাষনের আইন জাতীয় সংসদের পাশ করান যেটা ৭৩-এর অধ্যাদেশ নামে বহুল পরিচিত। কথিত আছে ড. কামাল হোসেন তখন বিরোধীতা করেছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুকে বোঝাতে চেয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জবাবদিহিতার ভিতরে আনতে হবে। প্রতিউত্তরে বঙ্গবন্ধু তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় ধমকে বলেছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তাদের বিবেকের কাছে জবাব দিবে, তাদের আর কোন দায়বদ্ধতার প্রয়োজন নেই’।
যদিও উপরিউক্ত বিষয়টি আমার শোনা কথা, আমি চাক্ষুষ ঘটনাপ্রবাহ দেখি নি। তবে আমি যেটা দেখেছি তা থেকে ঘটনার সত্যতা নিরুপন করতেও কিন্তু বেগ পেতে হয় না।
একটু লক্ষ করে দেখুন, বঙ্গবন্ধু তার দুই কন্যাকে বিবাহ দিয়েছেন কাদের সাথে (আমাদের সমাজে তখন বিবাহ দেওয়ার রীতি যেমন ছিলো বিশেষত মেয়ের ক্ষেত্রে)। তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তুলে দিয়েছিলেন একজন পরমানু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার হাতে । আর তার ছোট মেয়ে শেখ রেহানাকে তিনি বিবাহ দিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শফিক আহমেদ সিদ্দিকীর সাথে। গাড়িতে ফ্লাগ উড়িয়ে চলা মন্ত্রী, আমলা কিংবা বড় ব্যবসায়ীরা যে তখন ছিলো না, ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। ব্যাপারটা হচ্ছে ভিশন বা দর্শন। তিনি ছিলেন তার জন্ম দেওয়া দেশের ভিশিয়নারী, স্বপ্নদ্রষ্টা। তিনিই তার মেয়ে জামাই পছন্দের মধ্য দিয়ে নিঃসন্দেহে দেশকে নিয়ে তার ভিশন ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
অথচ সময়ের কি নির্মম পরিহাস, এখন আমরা হরহামেশাই দেখতে পাই ইচ্ছামতো এটা সেটাকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বেশ কিছুদিন আগে অনলাইন পত্রিকায় দেখেছিলাম কোন এক মন্ত্রী নাকি বাংলাদেশে সেলুলার ফোনের তৃতীয় প্রজন্মের ব্যবহারকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিলো বলে আখ্যায়িত করেছে। তথ্যের সত্যতা জানি না, তবে আশেপাশের পরিস্থিতি দেখে মিথ্যা বলে একবাক্যে উড়িয়েও দিতে পারি না। এখানে উল্লেখ্য যে, সেলুলার ফোনের প্রথম প্রজন্মেরই সৃষ্টি হয় বঙ্গবন্ধু প্রয়াত হওয়ারও ৪ বছর পর (১৯৭৯-এ)। একইভাবে রাস্তাঘাটে বিভিন্ন পোস্টার ফেস্টুন দেখতে পাই, পাড়ার বখাটে ছেলেটার ছবি সেই সাথে তার মনগড়া কোন কথা হিসাবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। সম্প্রতি একটি ভিডিওতে দেখেছিলাম, জনাব ওবায়দুল কাদের বলছেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর ছবির পাশে চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারীর ছবি দেখে বিব্রতবোধ করেন। যা আমার উপরোক্ত অবজারভেশনকেই নির্দেশিত করে। এভাবে সব সুযোগ সন্ধানীরা দেশটাকে বিপথগামী করেছে, এখনও করে যাচ্ছে যা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বাধীনভাবে কিছু লোক সত্য সন্ধান করুক, সত্য কথা বলুক তা সুযোগ সন্ধানীরা কখনোই চায় নি। সেই পরিক্রমায় আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর আঘাত করে কন্ঠ রোধ করতে চাইছে তারা।
কথিত আছে, আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি মাহাথির মহাম্মদ তার দেশ সেবায় আসার পর পর-ই নিজে নিজের ব্যক্তিগত ফোন দিয়ে বিভিন্ন দেশে গবেষনারত মেধাবী মালয়শিয়ানদের দেশে ফিরে আসার জন্য অনুরোধ করতো। এরকম একজন মালয়শিয়ানের একটি কলাম পড়েছিলাম, তিনি লিখেছিলেন, গভীর রাতে তিনি একটা ফোন পান, ফোনের ওপাশ থেকে পরিচয় আসে তিনি তার দেশের প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মহাম্মাদ, এরপর প্রধানমন্ত্রী তাকে দেশে ফিরে যাবার অনুরোধ করেন। তিনি লিখেছিলেন, মাহাথির এই কাজটি এতটাই আবেগ দিয়ে করতো যে তিনি ভুলে যেতেন যাকে ফোন দিচ্ছেন সেখানে এখন রাত না দিন। সেই মালয় লোকটি ফোন পাবার এক মাসের ভিতর সব গুছিয়ে নিজের দেশে ফিরে যান। আর এমন অসংখ্য ফোন আর মেধাবীদের ফিরে যাওয়াই আজ আধুনিক মালয়শিয়া সৃষ্টির রহস্য যা বোঝার জন্য বেগ পেতে হয় না। মাহাথিরের ছিলো ভিশন বা স্বপ্ন, আর তার বাস্তবায়নের কারিগর ছিলো মেধাবীরা।
দুর্ভাগা এই জাতি, স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরেও মনে হচ্ছে একজন স্বপ্নদৃষ্টা অভিভাবকের অভাবে আমরা পথ হারা, তাই নিজের দেশ ছেড়ে উত্তাল সমুদ্রে ডিঙ্গি নৌকা করে সেই মাহাথিরের দেশে যেতে প্রান দেই, কিন্তু আমাদের জীবন এমন না হলেও পারতো, এক শেখ মুজিব কিন্তু ৪৪ বছর আগে সেই স্বপ্নই দেখেছিলেন যা মাহাথির তার দেশে করেছিলেন বাস্তবায়ন। বাংলাদেশ বড়ই অভাগা, যখনই একজন সপ্নচারী এসেছে আমরা তাকে সরিয়ে দিয়েছি। কাউকেই হাল ধরতে দেইনি।
অষ্টম বেতন স্কেল এক সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনার ফল, শুধুমাত্র এক শ্রেনীর লোক তাদের হীনমানসিকতা চরিতার্থ করতে এই পরিকল্পনার আশ্রয় নিয়েছে যা নিঃসন্দেহে জাতির জন্য অন্ধকার কিছু। এটা পরিবর্তন না করে এভাবে রেখে দিলে মেধাবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আসবে না, সেই সাথে স্বাধীন মানুষ তৈরি হবে না যারা জাতি্কে সংকটে পথ দেখাবে। এটা হবে ১৪ই ডিসেম্বরের মত আরো একবার বুদ্ধিজীবি হত্যা, এবং সৃষ্টির জরায়ুকে চিরতরে নষ্ট করে দেওয়া। যা কাম্য নয়, কোনভাবেই নয়।
-ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া থেকে
লেখক: সহকারি অধ্যাপক, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
Source: http://goo.gl/BrCH8r
0 comments:
Post a Comment