৮ম পে-স্কেলে সচিব কমিটির সুপারিশ অর্থমন্ত্রীর কাছে জমা প্রদানের পর থেকেই বাংলাদেশের প্রায় সব পাবলিক ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক উপযুক্ত বেতন ও যথাযথ মর্যাদা প্রদানের দাবিতে আন্দোলন করছেন। সচিব কমিটির সুপারিশে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিল করায় প্রধানত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এ আন্দোলনে নামতে হয়েছে। বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকদের সচিব পদমর্যাদায় অর্থাৎ গ্রেড-১ বা ৪০ হাজার টাকা স্কেলে বেতন পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়োজ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের এক-চতুর্থাংশ অধ্যাপক এই বেতন স্কেল পেয়ে থাকেন।
কিন্তু প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোয় সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিল করায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সেই সুযোগ আর থাকছে না। ফলে বর্তমানে বেতন কাঠামোয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা সচিব পদমর্যাদা বা গ্রেড-১ বেতন পেলেও প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো বাস্তবায়িত হলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সর্বশেষ বেতনের ধাপ হবে যুগ্ম সচিব সমমর্যাদার গ্রেড-৩ স্কেল। তাই প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো বাস্তবায়িত হলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা দুই-ই দুই ধাপ কমে যাবে বলেই তারা আন্দোলন করছেন।
কিন্তু প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোয় সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিল করায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সেই সুযোগ আর থাকছে না। ফলে বর্তমানে বেতন কাঠামোয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা সচিব পদমর্যাদা বা গ্রেড-১ বেতন পেলেও প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো বাস্তবায়িত হলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সর্বশেষ বেতনের ধাপ হবে যুগ্ম সচিব সমমর্যাদার গ্রেড-৩ স্কেল। তাই প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো বাস্তবায়িত হলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা দুই-ই দুই ধাপ কমে যাবে বলেই তারা আন্দোলন করছেন।
সাদা চোখে প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোয় সচিব কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে গ্রেডের হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পদমর্যাদা ও বেতন দুই ধাপ নিচে নামবে এ কথা সত্য। তবে পে-স্কেলে সচিব কমিটির সুপারিশের দিকে গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে, প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা সূক্ষ্ম কারচুপির মাধ্যমে দুই ধাপ নয়, তিন ধাপ নিচে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ সপ্তম জাতীয় পে-স্কেলে সিনিয়র সচিব বলে আলাদা কোনো পদ ও বেতন স্কেল ছিল না। তখন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পরেই ছিল সচিবদের বেতন (গ্রেড-১)। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা এই সচিবের সমমানের পে-স্কেল অর্থাৎ গ্রেড-১ স্কেলে বেতন পাওয়ায় তাদের বেতন ও মর্যাদা উভয়ই মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পরে ছিল। কিন্তু প্রস্তাবিত পে-স্কেলে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পরে সিনিয়র সচিব পদ এবং তাদের বেতন সচিবদের উপরে থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদায় আরও একধাপ অবনমন ঘটবে। অর্থাৎ বর্তমান বেতন কাঠামোয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পরেই বেতন পান। কিন্তু প্রস্তাবিত পে-স্কেলে সচিব কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে তারা মন্ত্রিপরিষদ সচিবের পরে সিনিয়র সচিব, সচিব, অতিরিক্ত সচিব অর্থাৎ তিন ধাপ পরের স্কেলে বেতন পাবেন। যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদারও অবনমন হবে। তবে এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, প্রচলিত বেতন কাঠামোয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য উপযুক্ত বেতন নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু প্রচলিত বেতন কাঠামো যথেষ্ট না হলেও এই বেতন কাঠামোয় টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড থাকায় একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর সুযোগ ছিল। কিন্তু ৮ম পে-স্কেলে সেই সুযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এখন আন্দোলনে নামতে হচ্ছে। প্রচলিত বেতন কাঠামো অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চাকরি জীবনের শেষ পর্যায়ে হলেও সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল প্রাপ্তির মাধ্যমে সচিব পদমর্যাদায় বেতন পেতেন। কিন্তু ৮ম পে-কমিশনের সুপারিশ কার্যকরী হলে সেই সুযোগ আর থাকবে না। ফলে তাদের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদা ও গ্রেড-৩ বেতন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
দুই. ২০০৯ সালের বেতন কাঠামোও যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য যথেষ্ট ছিল তা নয়, বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন অনেক কম। কারণ বাংলাদেশের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক প্রভাষক পদে ১৩৫ ডলার বেতনে চাকরিতে নিযুক্ত হন। একজন অধ্যাপক সর্বোচ্চ বেতন পান ৪১৩ ডলার। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ৪০৭৭ ডলারে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হলেও একজন অধ্যাপকের সর্বোচ্চ বেতন ৮৩৬৯ ডলার। যুক্তরাজ্যের কথা না হয় বাদ দিলাম কিন্তু প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের জিডিপির পার্থক্য আকাশচুম্বী নয়। তাই ভারতের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক যে বেতন পান এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের তার কাছাকাছি বেতন দাবি করাটা কি অযৌক্তিক? কিন্তু দুর্ভাগ্য এদেশের শিক্ষকসমাজের। ভারতে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক প্রতি মাসে ৬০ হাজার রুপি; আর একজন অধ্যাপক ১ লাখ ৫ পঞ্চাশ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত বেতন পেলেও এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের ১৩৫ ডলার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। (টাকার অঙ্কে বেতন বলতে লজ্জা লাগছে তাই ডলারে বলে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর চেষ্টা করছি!) আমরা যে পাকিস্তানকে ব্যর্থ রাষ্ট্র বলে প্রতিদিন একশবার গালমন্দ করি, সেই পাকিস্তানও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সম্মানী প্রদানের ক্ষেত্রে আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে। পাকিস্তানের একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মাসে ২ লাখ ৩ হাজার থেকে ৪ লাখ টাকা পর্যন্ত সম্মানী পান। বাংলাদেশের কাছাকাছি যেসব দেশের জিডিপি সেই মধ্য এশিয়ার দেশ কাজাখিস্তান, ইথিওপিয়া, আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়া এবং সুদূর আমেরিকা মহাদেশের ব্রাজিলের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন আমাদের থেকে কয়েকগুণ বেশি। ওই সব দেশসমূহে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক বেতন পান যথাক্রমে - ১০৩৭, ৮৬৪, ২৭৫৮ এবং ১৮৫৮ ডলার। আর অধ্যাপকের সর্বোচ্চ বেতন যথাক্রমে- ২৩০৪, ১৫৮০, ৬২২৯ এবং ৪৫৫০ ডলার।
তিন. ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়নের জন্য স্থায়ী পে-কমিশন, শিক্ষক নিয়োগের জন্য স্বতন্ত্র কমিশন ও সম্মানজনক সম্মানী প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষানীতিতেও শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর কথা বলা হয়েছে। নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ৬৯তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব নেতাদের 'অস্ত্র নয় শিক্ষায় বিনিয়োগ করার' আহ্বান জানিয়েছেন। বিশ্বনেতাদের মতো আমরাও প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে সমর্থন করেছি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ওই ঘোষণা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। বরং এবার বাজেটে শিক্ষার চেয়ে সামরিক খাতেই বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা আন্দোলনের মাধ্যমে জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা, জাতীয় শিক্ষানীতি ও শিক্ষা আইনের বাস্তবায়ন দাবি করছে। আর যতক্ষণ পর্যন্ত শিক্ষকদের দাবি বাস্তবায়িত না হচ্ছে অর্থাৎ শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর ঘোষণা বাস্তবায়িত না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত ঘোষিত ৮ম পে-স্কেলের যৌক্তিক পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও মর্যাদা প্রদানের দাবি জানাচ্ছে।
পরিশেষে, দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে সামরিক খাতের ব্যয় আরও বৃদ্ধি করলেও আমাদের আপত্তি করার কিছু নেই; কিন্তু পাশাপাশি শিক্ষা খাতেও উপযুক্ত বরাদ্দ প্রদান ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের উপযুক্ত সম্মানী প্রদানের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর জাতিসংঘের ঘোষণার বাস্তবায়ন হতে পারে। টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের মাধ্যমে নয়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন স্কেল উন্নীত করে যথাক্রমে- বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের মন্ত্রিপরিষদ সচিব পদমর্যাদা ও গ্রেড, সিনিয়র অধ্যাপকদের সিনিয়র সচিব পদমর্যাদা ও গ্রেড এবং অধ্যাপকদের সচিব পদমর্যাদা ও গ্রেড প্রদানের মাধ্যমে এই সংকটের সমাধান হতে পারে। আর এ ধারাক্রম অনুসরণ করে প্রভাষক থেকে সহযোগী অধ্যাপক পর্যন্ত নতুন বেতন কাঠামো ও পদমর্যাদা প্রদানের যে দাবি বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশন সমিতির পক্ষ থেকে করা হয়েছে সেই দাবি বাস্তবায়নেরও জোর দাবি জানাচ্ছি।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
salah.sakender@gmail.com
Source: http://www.bd-pratidin.com/editorial/2015/06/17/87802
Source: http://www.bd-pratidin.com/editorial/2015/06/17/87802
0 comments:
Post a Comment