দীর্ঘদিন পর সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ছে। এই বেতন বাড়ার তালিকায় প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্র্যায়ের শিক্ষকরাও রয়েছেন। অন্যদের মতো শিক্ষকদেরও বেতন বাড়ার সংবাদে খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু সচিব কমিটির সুপারিশ অর্থমন্ত্রীর কাছে পেশ করার পর ঢাকা, জগন্নাথ, রাজশাহীসহ একের পর এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে বেতন স্কেল প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি প্রদান ও প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী
শিক্ষক সমিতির মানববন্ধন কর্মসূচি থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে, শিক্ষকসমাজ এই পে স্কেল গ্রহণ করেনি। কারণ টাকার অঙ্কে প্রতিটি স্তরের শিক্ষকদের বেতন বাড়লেও সচিব কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে প্রতিটি স্তরের শিক্ষকদের মর্যাদা ও বেতন স্কেল তুলনামূলকভাবে দুই-ই কমে যাবে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। সচিব কমিটির যে সুপারিশ অর্থমন্ত্রীর কাছে রয়েছে, তা যদি হুবহু বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন স্কেল বর্তমানের চেয়ে তিন ধাপ কমে যাবে। আর এই বেতন কমার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের সামাজিক মর্যাদাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকদের সচিব পদমর্যাদায় অর্থাৎ গ্রেড-১ বা ৪০ হাজার টাকা স্কেলে বেতন পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়োজ্যেষ্ঠ অধ্যাপকদের এক-চতুর্থাংশ অধ্যাপক এই বেতন স্কেল পেয়ে থাকেন। কিন্তু প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোয় সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিল করায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সেই সুযোগ আর থাকছে না। ফলে প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো বাস্তবায়িত হলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সর্বশেষ বেতনের ধাপ হবে যুগ্ম সচিব সমমর্যাদার গ্রেড-৩ বা ২৯ হাজার ৫০০ টাকার স্কেল।
সাদা চোখে প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোয় সচিব কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে গ্রেডের হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পদমর্যাদা ও বেতন দুই ধাপ নিচে নামবে। কিন্তু পে স্কেলে সচিব কমিটির সুপারিশের দিকে গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে যে প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা সূক্ষ্ম কারচুপির মাধ্যমে দুই ধাপ নয়, তিন ধাপ নিচে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণ সপ্তম জাতীয় পে স্কেলে সিনিয়র সচিব বলে আলাদা কোনো পদ ও বেতন স্কেল ছিল না। তখন মন্ত্রিপরিষদসচিবের পরেই ছিল সচিবদের বেতন (গ্রেড-১)। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা এই সচিবের সমমানের পে স্কেল অর্থাৎ গ্রেড-১ স্কেলে বেতন পাওয়ায় তাঁদের বেতন ও মর্যাদা উভয়ই মন্ত্রিপরিষদসচিবের পরে ছিল। কিন্তু প্রস্তাবিত পে স্কেলে মন্ত্রিপরিষদসচিবের পরে সিনিয়র সচিব পদ এবং তাঁদের বেতন সচিবদের ওপরে থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদায় আরো এক ধাপ অবনমন ঘটেছে। অর্থাৎ বর্তমান বেতন কাঠামোয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা মন্ত্রিপরিষদসচিবের পরেই বেতন পান। কিন্তু প্রস্তাবিত পে স্কেলে সচিব কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে তাঁরা মন্ত্রিপরিষদসচিবের পরে সিনিয়র সচিব, সচিব, অতিরিক্ত সচিব অর্থাৎ তিন ধাপ পরের স্কেলে বেতন পাবেন, যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদারও অবনমন হবে।
এভাবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অবনমনের ধারাবাহিকতায় সরকারি কলেজের শিক্ষক, এমপিওভুক্ত কলেজের শিক্ষক, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকদেরও আর্থিক অবনমন ঘটবে। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের নিয়োজিত সরকারি কলেজের শিক্ষকদের নানা জটিলতা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত পদোন্নতির সুযোগ থাকলেও সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এমপিওভুক্ত কলেজ, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। তবে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না, এমন নয়। কারণ প্রতিবছর যে পরিমাণ শিক্ষকের পদোন্নতি পাওয়ার কথা, পদ না থাকায় তা সম্ভব হয় না। ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষকদের কথা যদি বিবেচনা করা হয় তাহলে দেখা যাবে যে বর্তমানে দুই শতাধিক শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতির যোগ্য। কিন্তু এই বিভাগের অধ্যাপক পদের সংখ্যা সারা দেশে মাত্র ১৩টি। ফলে এই বিভাগের বেশির ভাগ সহযোগী অধ্যাপককে অধ্যাপক না হয়েই অবসরে যেতে হবে। পদোন্নতি না পেলেও বর্তমান বেতন কাঠামোয় তাঁরা অধ্যাপকদের স্কেলেই বেতন পান। কিন্তু প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোয় টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিল করায় তাঁরা সেই সুবিধাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবেন। বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের অন্য বিভাগগুলোর শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
এমপিওভুক্ত কলেজের শিক্ষকদের বেশির ভাগই যে প্রভাষক পদে চাকরিজীবন শুরু করেন, শেষ পর্যন্ত দেখা যায় যে ওই পদে থেকেই তিনি অবসর নিচ্ছেন। খুব কম ক্ষেত্রে তাঁদের পদোন্নতির সুযোগ থাকলেও তা সহকারী অধ্যাপক পদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। মাধ্যমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদোন্নতির কোনো সুযোগ না থাকায় তাঁদের বেতন বৃদ্ধিও টাইম স্কেলের ওপর নির্ভর করে। বর্তমান বেতন কাঠামোয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষক গ্রেড-১১ বা ৬ হাজার ৪০০ টাকা স্কেলে নিযুক্ত হন। তিনি বিএড শিক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়ার পর গ্রেড-১০ বা ৮ হাজার টাকার স্কেলে উন্নীত হন। অতঃপর আরো আট বছর চাকরি করলে টাইম স্কেলের মাধ্যমে সম্মানিত শিক্ষক গ্রেড-৯ বা ১১ হাজার টাকা স্কেলে বেতন পান।
মাধ্যমিকের মতো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবস্থাও প্রায় একই। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও তিন লাখ সহকারী শিক্ষকও টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিলের ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতির শিকার হবেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন সহকারী অধ্যাপক গ্রেড-১৫ বা ৪ হাজার ৯০০ টাকা স্কেলে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হন। পিটিআইয়ে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর তাঁর বেতন স্কেল পাঁচ হাজার ২০০ টাকা বা গ্রেড-১৪তে উন্নীত হয়। মাধ্যমিকের মতো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদগুলোয় পদোন্নতির কোনো সুযোগ না থাকায় তাঁদেরও বেতন বৃদ্ধির জন্য টাইম স্কেলের ওপর নির্ভর করতে হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষক টাইম স্কেলের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে আট বছর পর পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা স্কেলে বা গ্রেড- ১৩, ১২ বছর পর পাঁচ হাজার ৯০০ টাকা স্কেলে বা গ্রেড-১২, ১৫ বছর পর ছয় হাজার ৪০০ টাকা স্কেলে বা গ্রেড-১১তে বেতন পান। কিন্তু সচিব কমিটির সুপারিশকৃত বেতন কাঠামোয় টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাতিল করায় তাঁদের এই আর্থিক সুবিধাপ্রাপ্তির ধাপগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে তাঁরা স্থায়ীভাবে আর্থিক ক্ষতির সম্মুুখীন হবেন।
এ ছাড়া সুপারিশকৃত বেতন কাঠামো বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে এই বেতন কাঠামোয় নিম্নতর পদ থেকে উচ্চতর পদে আনুপাতিক হারে বেতন বেড়েছে বেশি, যা নিম্নপদের সঙ্গে উচ্চপদে নিযুক্তদের বেতন বৈষম্য বাড়াবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সুপারিশকৃত বেতন কাঠামো বাস্তবায়িত হলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের বেতন বাড়বে ৫৮.২৩ শতাংশ। কিন্তু প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন সহকারী শিক্ষকের বেতন বাড়বে ৫২.২৪ শতাংশ।
পরিশেষে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষকদের সচিব কমিটির সুপারিশ প্রত্যাখ্যান করার ফলে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শিক্ষকরা যদি বেতন কাঠামো পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রামে নামেন, তাহলে শিক্ষাব্যবস্থা অস্থির হয়ে পড়বে। তাই অর্থমন্ত্রীর কাছে দাবি থাকবে, সচিব কমিটির সুপারিশকে চূড়ান্ত না ধরে সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি কমিটি গঠন করা হোক। আমরা আশা করব, প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কয়েক লাখ শিক্ষকের যৌক্তিক ক্ষোভের বিষয়টি আমলে নিয়ে ওই পর্যালোচনা কমিটি টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বহাল রেখে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চূড়ান্ত সুপারিশ উপস্থাপন করবে। আর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা সিনিয়র অধ্যাপকদের বেতন সিনিয়র সচিব ও পদায়িত সচিবের অনুরূপ ও প্রভাষক থেকে অধ্যাপক পর্যন্ত বেতন কাঠামোর যৌক্তিক পুনর্বিন্যাসের যে দাবি উত্থাপন করেছেন, তা-ও তারা আমলে নেবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
Source: http://www.kalerkantho.com/print-edition/sub-editorial/2015/06/10/231755
0 comments:
Post a Comment