আমি সচেতনভাবেই মূল্য শব্দটি ব্যবহার করেছি মর্যাদার পরিবর্তে। যার মূল্য নেই তার আবার কিসের মর্যাদা? প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক পর্যন্ত সবাই মূল্যহীন। তাদের প্রয়োজনটাই বা কী? আমাদের প্রতিবেশী মিয়ানমারে সামরিক জান্তা শাসনামলে বছরের পর বছর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল। তাতে কী এমন ক্ষতি হয়েছিল দেশটির! মার্শালতন্ত্র
তো দেশ চালিয়ে নিয়েছে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে শিক্ষাবিহীন কিংবা গণতন্ত্রবিহীন ভালো অথবা মন্দ চালানোর বিষয়টি নিয়ে। আবার বিপরীত উদাহরণও রয়েছে, পাকিস্তানের দীর্ঘ স্বৈ^রশাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন স্কেল একটি অন্য উচ্চতায় তুলে দিয়ে গেছেন, যা অনেক সফল রাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনীয়। কয়েক দশকের যুদ্ধ-ক্ষতিগ্রস্ত দেশ শ্রীলংকার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন স্কেল সার্ক দেশগুলোর সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ তো মিয়ানমার কিংবা পাকিস্তান নয়- একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। পৃথিবীর অনেক দেশে সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে, দেখেছি আমাদের প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের শিক্ষকরা ইউজিসি কিংবা হায়ার এডুকেশন কমিশন থেকে এয়ার ফেয়ারসহ সব ধরনের সুবিধা পেয়ে বিপুল সংখ্যায় অংশগ্রহণ করে নিজের দেশের গবেষণার অর্জনগুলো বিশ্ব দরবারে তুলে ধরছে। আর আমাদের দেশের ইউজিসি ফান্ড দুর্বলতায় কাতর আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা উল্লেখ করা বাহুল্যমাত্র। ফলে আমন্ত্রণকারী দেশের ফেলোশিপ ছিল আমার একমাত্র ভরসা।
শিক্ষার শুরুতেই গুরুত্ব দেয়া উচিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের, কারণ ওখান থেকেই শিক্ষার ভিতটি পোক্ত হয়ে বেড়ে উঠবে। যদি ভালো ছাত্ররা প্রাথমিক শিক্ষকতার পেশায় না আসে, তাহলে ছাত্রদের শক্ত ভিতটি কে তৈরি করে দেবে। তৃতীয় শ্রেণীর পদে কোনো আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন ভালো ছাত্র পা মাড়ানোর কথাও ভাবে না। প্রাথমিক শিক্ষকদের অপাঙক্তেয় হিসেবে গণ্য করা হয়। কালেভদ্রে হয়তো দু-একজন এলিট ব্যুরোক্র্যাট আলোচনা প্রসঙ্গে অজপাড়াগাঁয়ের কোনো এক স্কুলের মাস্টার মশাইয়ের অবদান উল্লেখ করেন লেখায় কিংবা সাক্ষাৎকারে- তাকে ধন্য করেন অথবা নিজের মাহাত্ম্য প্রকাশ করে ধন্য হয়ে থাকেন। এ পর্যন্তই প্রাপ্তি, হয়তো দেখা যাবে সেই মাস্টার মশাই পেনশনের টাকা তুলতে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কিংবা শেষ পর্যন্ত কোনোরকমে তুলতে পেরে অতি দীনতায় কায়ক্লেশে নিজের অহংবোধ নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছেন। সরকার সব সময় শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন; কিন্তু কেন শিক্ষকের বেতন যথাযথভাবে বাড়িয়ে মেধাবীদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় আকর্ষণ করা হচ্ছে না, সেটি কেউ ভেবে দেখে না। ন্যূনতম সম্মান নিয়ে বাঁচার অধিকারটুকুও তাদের দেয়া হয় না। তাহলে বাজেট বৃদ্ধিতে শিক্ষা খাতে কারা লাভবান হন, কিভাবে হন? ট্যাব দেয়া হবে ছাত্রদের, যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত- অবশ্যই সরকার ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু যারা মাল্টিমিডিয়া দিয়ে শিক্ষা দেবেন, তাদের দীনহীন অবস্থার কথা সেই সরকারি স্কুল-কলেজ এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আজকের নীতিনির্ধারক বনে যাওয়া ব্যুরোক্র্যাট মহাশয়দের ভেবে দেখা কর্তব্য। আর গণতান্ত্রিক সরকারকেই তো সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেক অপ্রিয় কিন্তু ভালো বিষয়ে যেভাবে দৃঢ়তার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার কাছ থেকে জাতি শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি বিষয়ে সে ধরনের পদক্ষেপ প্রত্যাশা করে।
এবার গিয়েছিলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক কনফারেন্সে, ছিলাম নিউইয়র্কের টাইম স্কয়ারের শেরাটনে, পাশের রুমে ছিলেন উগান্ডার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বন্ধু এনজেলো কাকান্দে। রাতে আড্ডার ফাঁকে আমার কাছে বেতন স্কেল জানতে চাইলে উত্তর দিয়ে মনে মনে ভাবলাম, ওদের লেকচারের স্কেল আর কত হবে। ওর স্কেল জেনে লজ্জা পেয়ে মেইল চেক করার ভনিতায় নিজ রুমে গিয়ে লজ্জা এড়ানোর চেষ্টা করেছি। উগান্ডা, ইথিওপিয়া কিংবা পাকিস্তান পারলেও পারব না আমরা। সব জায়গায় ফেল কড়ি, মাখ ঘি, কিন্তু শিক্ষকদের বেতন বাড়িও না। পরামর্শ দাও ওখানে টাকা ফেলে আর কাজ কী, কই যাবে আর ব্যাটারা- করে তো খেতে হবে। ব্যুরোক্র্যাসি, পুলিশ, সামরিক বাহিনী সবাই সরকারের উপকারে লাগে, লাগে না কেবল শিক্ষকরা। কিন্তু ভুললে তো চলবে না শিক্ষকরা লাগে জাতির কাজে এবং অবশ্যই লাগে সরকারের শিক্ষা কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নে। এবং অনেক জাতীয় শিক্ষক ব্যক্তিত্ব সরকারের পরামর্শকের ভূমিকায় থাকেন। একটি ঐতিহ্যবাহী দল রাষ্ট্রক্ষমতায়, তারা যদি এই ট্যাবু ভাঙতে না পারেন তাহলে পারবেন কারা?
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কি জাতির প্রয়োজনে ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৯০ কিংবা ২০০৭ সালে জেল-জরিমানা, হত্যা-নির্যাতনের শিকার হননি। শিক্ষা-গবেষণার পাশাপাশি আর কী ভূমিকা পালন করতে হবে তাদের? আমরা প্রত্যেক শিক্ষকের জন্য দূরে থাকুক, প্রফেসরদের জন্য তো গাড়ি-বাড়ি এবং গাড়ি মেইনটেনেন্সের জন্য অর্থ চাইনি। আমরা তো ছাত্রজীবনে যে বাসে চড়েছি, শিক্ষক অবস্থায়ও সেই একই বাসে চড়ে জীবনীশক্তি ব্যয় করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করছি, পড়াচ্ছি, গবেষণা করছি, পরীক্ষা নিচ্ছি, অফিসিয়াল দায়িত্ব পালন করছি। শিক্ষকদের জন্য ব্যক্তিগত গাড়ি চাই না, কিন্তু সব শিক্ষকের ব্যবহারের জন্য তো এসি বাস বরাদ্দ দেয়ার অবস্থায় এসেছে আজকের বাংলাদেশ। মানসম্মত জীবনযাপনের অধিকার রয়েছে জাতির ভিত গঠনের কারিগর প্রাইমারি শিক্ষক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। বেশি বেতনের কারণে অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয় বিদেশ চলে গেছেন অথবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নিয়েছেন কিংবা কেউ খণ্ডকালীন শিক্ষকতা করছেন। শ্রীলংকা, ভারত কিংবা পাকিস্তানের মতো মানসম্মত বেতন পেলে নিশ্চয়ই কোনো শিক্ষক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাবেন না।
দু-চারটি ব্যতিক্রম ছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ক্লাসের সেরা ছাত্র ছিলেন। আর আমাদের মতো কোনো কোনো বোকা(?) এলিট ব্যুরোক্র্যাসিতে চান্স পেয়েও যায়নি অথবা কেউ আবার ছেড়েও এসেছে শিক্ষা-গবেষণা-মত প্রকাশের স্বাধীনতার মোহে। আমি অবশ্যই বলব না, ভুল করেছি, ভুল করছেন বেতন-ভাতা বিষয়ক বৈষম্যের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা। পেশা হিসেবে বিবেকের স্বাধীনতা, চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাটি এখনও আমাদের রয়েছে। কিন্তু লেজুড়বৃত্তির কারণে হয়তো একদিন সেটিও হারিয়ে যেতে পারে। আমরা বেসামরিক ব্যুরোক্র্যাট কিংবা সামরিক ব্যুরোক্র্যাট কিংবা পুলিশ কারোই প্রতিদ্বন্দ্বী নই। যে যার মতো অবস্থানে থেকে সরকারি কাজ, দেশ রক্ষা কিংবা আইন-শৃংখলা রক্ষায় ভূমিক রাখব। আমাদের কাজ জাতি গঠনে ভূমিকা পালন করা, সেটি আমরা করার চেষ্টা করছি। তবে আমাদের ন্যূনতম আত্মমর্যাদাটুকু দিতে হবে। ব্যুরোক্র্যাটদের মধ্যে অনেক ভালো, মেধাবী ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব রয়েছেন। তারা প্রশাসন যন্ত্র সচল রাখার কাজে ব্রত রয়েছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সম্মানিত অধ্যাপক কিছুদিন আগে লিখেছিলেন, পাকিস্তান আমলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বাগে আনতে না পেরে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ছত্রছায়ায় এলিট বেসামরিক-সামরিক ব্যুরোক্র্যাসি তৈরির চেষ্টা করা হয়েছিল। তাদের তখন শেখানো হতো, তোমরা শাসক সম্প্রদায় আর বাকিরা শাসিত। তোমরা এলিট তারা প্রলেতারিয়েত। দেশ স্বাধীন হলেও আমাদের ব্যুরোক্র্যাসি সেই বৃত্ত থেকে বের হতে পারেনি বলে তিনি আক্ষেপ করেছেন। এমনটি হলে সেটি হবে দুঃখজনক। সেই পাকিস্তানের সামরিক জান্তা পারভেজ মোশাররফরা পারলেও আমাদের গণতান্ত্রিক সরকারগুলো কেন পারছে না? কোথায় তাদের ভয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩র অধ্যাদেশ করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আÍমর্যাদাবোধ তৈরি করতে সাহায্য করেছিলেন। তাহলে তার কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে তো আশা করতেই পারি শিক্ষকদের জন্য পাকিস্তানের ওপরে না হোক, অন্তত সমপর্যায়ের বেতন কাঠামো তৈরির নির্দেশ তিনি দেবেন।
ড. মোকাম্মেল এইচ ভূঁইয়া : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়tutulmh@gmail.com
Source:http://www.jugantor.com/sub-editorial/2015/06/12/277544
0 comments:
Post a Comment