Thursday, June 4, 2015

আমি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক…


ড. মোঃ মীর মোশাররফ হোসেন:

teacher
আমার এই লেখা কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, রাজনিতিক দল বা সরকারের বিরুদ্ধে নহে, এটা একান্তই আমার মনের দর্শন থেকে অনুভব এবং উপলব্ধির প্রয়াসমাত্র।
এই দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কারা, যারা স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রথম ১-৫% ছাত্র/ছাত্রীদের মধ্যে একজন। যারা সারাজীবন স্বপ্ন দেখে এবং বড় বড় স্বপ্ন দেখায় ছাত্র/ছাত্রীদের। যারা পৃথিবীর উন্নত দেশ থেকে শিক্ষা অর্জন করে ফিরে আসে দেশে দক্ষ জনশক্তি তৈরির নেশায়। যারা সমাজের মানুষের কাছে আদর্শ। যারা আজ এইদেশে দক্ষ জনশক্তি ও শিক্ষিত জাতি তৈরির কারিগর।
যে দেশে একজন অটোরিকশা, সিএনজি এবং বাসচালক মাসে গড় আয় করে ৩০,০০০ টাকা। একজন খুদ্র ব্যবসায়ী মাসে আয় করে কমপক্ষে ৫০,০০০ টাকা। সেই দেশে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এর মাসে বেতন শুরু ১১,০০০ টাকা দিয়ে। উল্লেখ্য যে, ২০০২ সালে আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে একটি এনজিও তে ২৬,২০০ টাকা বেতন এবং অন্যান্য সুবিধাদিসহ মোট ৩৬,৫০০ টাকা বেতন পাই। আমিও স্বপ্ন দেখেছিলাম  উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হব; ২০০৩ সালে থাইল্যান্ড থেকে ট্রেনিং, ২০০৪-২০০৯ সালে জাপান থেকে মাস্টার্স ও পি এইচ ডি এবং ২০০৯-২০১০ সালে কানাডা থেকে পোস্ট ডক্টোরেট করে ২০১০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করি ১৮,৫০০ টাকা বেতনে। কেন এই দেশের মেধাবি সন্তানেরা বিদেশ থেকে উচ্চ ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরে আসবে? এই দেশকি দিতে পারছে তাদের মেধার প্রকৃত মূল্যায়ন? শুনিতে খারাপ লাগিলেও এটাই বাস্তবতা, আসলে আবেগ দিয়ে জীবন চলেনা।
একজন উচ্চ ডিগ্রীধারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ১১,০০০ টাকা স্কেলে থেকে শুরু করে ১০-১২ বছরে প্রফেসর হয় তখন তার বেতন স্কেল হয় ৩৩,৫০০ টাকা, যা কিনা একজন খুদ্র ব্যবসায়ী, অটোরিকশা, সিএনজি এবং বাস/চালকের মাসিক গড় আয়ের সমান। এতেই আমাদের সন্তুষ্টি, কারন আমাদের অনেক সন্মান, টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কি দরকার? উল্লেখ্য ১-২% শিক্ষকের দুর্নিতির দায়ভার তো বাকী ৯৮% শিক্ষক নিতে পারেনা।
beton_teacher
একবার প্রশ্ন ওঠে ছাত্রছাত্রীদের পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কেন এসি মিনিবাস ব্যবহার করে? ৩০ লাখ টাকা দামের এই একটি এসি মিনিবাসে প্রায় ৩০-৩২ জন শিক্ষকগাদাগাদি করে বসে। অথচ আমার কিছু বন্ধু আছে যারা প্রতেকে সরকারী ও অন্য বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে ২৫ থেকে ৬৫ লাখ টাকা দামের এসি গাড়ি নিয়ে মাঠ গবেষণায় যায়, ব্যক্তিগত ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার করে। অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, আসলে আমরা এবং যাদের আমরা শিক্ষা দিচ্ছি, কেউ আমরা আমাদের অধিকার কি? তা জানিনা।
এই দেশে প্রথম শ্রেনীর মেধাবি ছাত্র/ছাত্রী এবং উচ্চ ডিগ্রীধারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যারা সারাজীবনই ভাড়া বাড়িতে থাকিতে বাধ্য অথচ সেই বাড়ির মালিক হলেন একজন অর্ধশিক্ষিত খুদ্র ব্যবসায়ী, ঠিকাদার অথবা লোকাল রাজনীতিবিদ। যেই দেশে ঔষধ কোম্পানী, ফিড কোম্পানী, দেশী ও বিদেশী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে একজন চার থেকে পাঁচ গুন বেশী বেতন পায় এবং ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যাবহার করে, সেই দেশে এই উচ্চ ডিগ্রীধারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যারা সারাজীবনই পাবলিক বাস, রিক্সা, অটো অথবা এক বাসে গাদাগাদি করে কখনো বসে বা কখনো দাঁড়িয়ে এক হাতে একটি ল্যাপটপ ব্যাগ আর অন্য হাতে পরীক্ষার খাতা নিয়ে ক্যাম্পাসে পৌছাঁর জন্য প্রতিনিয়ত মরণপাণ লড়াই করছে। কেন এ দেশে গাড়ি, এসি, ট্যাব, নোট এবং স্মার্ট ফোন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হাতের নাগালের বাহিরে? কেন এই উচ্চ ডিগ্রীধারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাদের বাবা, মা ও তার পরিবারের জন্য এক টুকরা বাসস্থানের ব্যবস্থা ও করিতে পারবেন না? বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকই জীবনের সঙ্ঘে সংগ্রাম করে করে কোনোমতে বেঁচে আছেন।
প্রতিবাদহীন, মেরুদণ্ডবিহী্ন, সমাজের ক্ষমতাহীন ও অবহেলিত, পরিবারের কাছে জীবন যুদ্ধে পরাজিত এই উচ্চ ডিগ্রীধারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এখন আর সন্মান ও নাই। কারন অর্থ ও প্রতিষ্ঠা তাদেরকে এমন অবস্তাই নিয়ে গেছে, তারা এখন শঙ্কিত ও লজ্জিত স্বপ্ন দেখাতে সেই কোমলমতি মেধাবি ছাত্র/ছাত্রীদেরকে এবং পরিবারকে। আমরা আর কতদিন আমাদের এই  মেধাবি কোমলমতি সন্তানদের মিথ্যা স্বপ্ন দেখাব যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা অত্যান্ত সন্মানজনক ও মর্যাদার পেশা? অথচ পাসপোর্ট করিতে গেলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বাসায় পুলিশ আসে তার বিরুদ্ধে কোন দুর্নিতির অভিযোগ আছে কিনা?
সুস্থ ও উন্নত দেশ তৈরিতে শিক্ষকদের প্রতি প্রকৃত মর্যাদার বিকল্প নেই। উন্নতবিশ্বে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পরিবার এবং নিজের সকল চাহিদা (গাড়ি, বাড়ি, ও উন্নত চিকিৎসা মিটিয়ে, গবেষণায় মেধা ও শ্রম দিয়ে সমাজ ও দেশের সেবা করে যান। এছাড়া উন্নত বিশ্ব ও মধ্যম আয়ের দেশে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজের উচ্চশ্রেণীর মানুষ। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের দেশে শিক্ষকদের অর্জিত মেধা ও জ্ঞান, সমাজ ও দেশের সেবায় কাজে লাগাতে এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের স্বতন্ত্র পে-স্কেল প্রদানের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট জোর দাবি জানাচ্ছি। যেখানে নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের জিডিপির পার্থক্য আকাশচুম্বী না হলেও শিক্ষকদের বেতন কাঠামোর পার্থক্য এভারেস্ট সমান।
আমরা যাদের শোষন ও নির্বিচার থেকে বাঁচার জন্য লাখ লাখ মানুষের প্রানের বিনিময়ে এই সোনার বাংলাদেশ উপহার পেয়েছি, সেই পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চেয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতন প্রায় ৬ গুন কম। আমাদের বিশ্বাস এবং আক্ষেপ, স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরে এ দেশের ঊর্ধ্বমুখী সামগ্রিক উন্নয়নের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন পাকিস্তানের শিক্ষকদের বেতনের চেয়েবেশি পাওয়ার অধিকার ও সামর্থ্য রাখে।
লেখক, ড. মোঃ মীর মোশাররফ হোসেন
অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ও ছাত্র উপদেষ্টা,
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
Source: http://www.campuslive24.com/campus.127989.live24/

0 comments:

Post a Comment