Friday, June 26, 2015

সংস্কারের বিকল্প নেই

মো. আবদুল লতিফ মণ্ডল

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময় পাকিস্তানের অংশ হিসেবে আমরা ব্রিটিশ শাসনামলে প্রবর্তিত প্রশাসন ব্যবস্থা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করি। এ শাসন ব্যবস্থা ছিল মূলত ঔপনিবেশিক ধাঁচের। পাকিস্তান সরকার এ ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক প্রশাসন ব্যবস্থা জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হবে না, এ উপলব্ধি থেকেই শুরু হয় প্রশাসনিক সংস্কারের উদ্যোগ।

কীভাবে বেসামরিক প্রশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং একটি প্রাদেশিক প্রশাসনকে কেন্দ্রীয় সরকারে পরিণত করা যায় সে ব্যাপারে সুপারিশ প্রদানের জন্য স্বাধীনতার পর পরই গঠিত অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রেস্টোরেশন কমিটির সুপারিশক্রমে প্রাদেশিক সচিবালয়কে জাতীয় সচিবালয়ে রূপান্তর করা হয়। এছাড়া গঠন করা হয় প্রশাসন ও চাকরি পুনর্গঠন কমিটি। এ কমিটিকে স্থানীয় সরকারসহ কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্রের পুনর্গঠন সম্পর্কে প্রস্তাব পেশ করার দায়িত্ব দেয়া হয়। কমিটির সুপারিশগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল প্রশাসনের সব পর্যায়ে গণতন্ত্রায়ণ; নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের এখতিয়ারে ক্ষমতা প্রত্যপর্ণ; জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে সুস্পষ্ট সীমারেখা টানা; থানাকে প্রশাসনের মূল ইউনিটে পরিণত এবং মহাকুমাগুলোকে জেলায় রূপান্তর করা। তত্কালীন আওয়ামী লীগ সরকার এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তন এবং আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৬ সালে গঠিত হয় পে অ্যান্ড সার্ভিসেস কমিশন। সার্ভিস কাঠামোর ব্যাপারে এ কমিশনের সুপারিশগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দুটি সুপারিশ ছিল (ক) সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে ২৯টি ক্যাডার সার্ভিস প্রবর্তন; এবং (খ) সরকারি নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে সব ক্যাডারের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সিনিয়র সার্ভিস পুল (এসএসপি) গঠন। কমিশনের সুপারিশ গ্রহণ করে সরকার ১৯৮০ সালের ১ সেপ্টেম্বর মূল ১৪টি ক্যাডারসহ ২৯টি সার্ভিস ক্যাডার সৃষ্টির আদেশ জারি করে। তার আগে সরকার ১৯৭৯ সালের ২৩ আগস্টের এক আদেশে এসএসপি গঠন করে। পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক গৃহীত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন ক্যাডার সার্ভিস হতে এসএসপিতে সদস্য অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ থাকলেও এর বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি ছিল তা হলো, জনপ্রশাসনে এলিটিজম সৃষ্টি করা। এসএসপি ১০ বছর কার্যকর ছিল। এরশাদের জাতীয় পার্টি সরকারের আমলে ১৯৮৯ সালের ১৭ জুলাইয়ের এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এসএসপি বাতিল করা হয়।

১৯৮২ সালের মার্চে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের পর পরই জেনারেল এরশাদ প্রশাসনিক সংস্কারে দুটি কমিটি গঠন করেন। এর একটি হলো মার্শাল ’ল কমিটি এবং অন্যটি প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্গঠন কমিটি। কার্যপরিধির আলোকে মার্শাল ’ল কমিটি যেসব সুপারিশ পেশ করে সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, মন্ত্রণালয়/বিভাগের সংখ্যা এবং বেসামরিক কর্মচারী বিশেষ করে নিম্নপর্যায়ের কর্মচারীর সংখ্যা হ্রাস করা; প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ সচিবালয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধাপগুলো কমানো; সচিবালয় ও অন্যান্য নির্বাহী সংস্থাগুলোর কাজ ঢেলে সাজানো; নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং আর্থিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা হস্তান্তর বিধিবিধানুগ ও নিয়মিতকরণ। সচিবালয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ধাপগুলো কমানো ব্যতীত কমিটির অন্যান্য সুপারিশ সরকার গ্রহণ করে।

প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্গঠন কমিটির সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত একজন প্রধান নির্বাহী চেয়ারম্যান এবং প্রতিনিধি পরিষদ থাকবে। পরিষদের ওপর ন্যস্ত থাকবে সংশ্লিষ্ট স্তরের সব কার্যক্রমের নিয়ন্ত্রণ ও কর্মচারীদের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব; জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসনিক, বিচার বিভাগীয় ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত ক্ষমতা ন্যস্ত করা হবে; প্রশাসনিক স্তর হিসেবে মহাকুমা ও বিভাগকে বাতিল করা হবে। এসব সুপারিশ বাস্তবায়নের উপায় নির্ধারণের জন্য গঠিত হয় ন্যাশনাল ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটি ফর অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রিফর্ম/ রি-অর্গানাইজেশন (নিকার)। তাদের সুপারিশে স্থানীয় পর্যায়ে সৃষ্টি হয় উপজেলা প্রশাসন। ১৯৮৮ সালে স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ) আইনের মাধ্যমে জেলা পরিষদ পুনর্গঠিত হলেও নির্বাচিত চেয়ারম্যানের স্থলে সরকার কর্তৃক চেয়ারম্যান নিয়োগের বিধান করা হয়, যা ছিল কমিটির সুপারিশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি সরকারের পতন হয়। ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর উপজেলা পদ্ধতি বাতিল করে। সংসদে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এবং অন্য দুটি বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টির দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি (নবম সংসদ মেয়াদে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিলকৃত) প্রবর্তন করে। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির শাসনামলে (১৯৯১-৯৬ এবং ২০০১-২০০৬) কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় সরকার প্রশাসন ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য আর কোনো সংস্কার আনা হয়নি।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় এসে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে উপজেলা পরিষদ পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে উপজেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮ পাস করে। তাছাড়া এরশাদ সরকারের আমলে ১৯৮৮ সালে প্রণীত স্থানীয় সরকার (জেলা পরিষদ ) আইন বাতিল করে জেলা পরিষদ আইন ২০০০ পাস করে। তবে ওই মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার আইন দুটি বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়নি। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ৩০ জুন উপজেলা পরিষদ সংক্রান্ত সব আইন বাতিল করে স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) অধ্যাদেশ জারি করা হয় এবং তা তাত্ক্ষণিকভাবে কার্যকর হয়। এ অধ্যাদেশের অধীনে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে তৃতীয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ স্থানীয় সরকার (উপজেলা পরিষদ) অধ্যাদেশ ২০০৮ রহিত করে উপজেলা পরিষদ (রহিত আইন পুনঃপ্রচলন ও সংশোধন) আইন ২০০৯ পাস করে। অধ্যাদেশটির অধীনে তৃতীয় উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় আইনগত শূন্যতা এড়াতে ২০০৯ সালের আইনটিকে ৩০ জুন ২০০৮ তারিখ থেকে কার্যকারিতা দেয়া হয়। আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক ১৯৯৮/২০০৯ সালে প্রণীত উপজেলা পরিষদ আইনে স্থানীয় সংসদ সদস্যকে উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা এবং তার পরামর্শ গ্রহণ পরিষদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে পরিষদের ওপর সংসদ সদস্যের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাছাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও চেয়ারম্যানের মধ্যে দ্বন্দ্বের খবর গণমাধ্যমে প্রায়ই প্রকাশ হয়। অন্যদিকে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মধ্যে সখ্য গড়ে ওঠার খবর পত্রপত্রিকা ও অন্যান্য সূত্রে প্রায়ই পাওয়া যায়। এসবের ফলে অনেক উপজেলায় প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায় শৃঙ্খলা ব্যাহত হচ্ছে।

২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে জেলা পরিষদ আইন ২০০০ মোতাবেক জেলা পরিষদ নির্বাচনের জন্য বিধি প্রণয়নসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালের ডিসেম্বরে তিনটি পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি বাদে অন্য ৬১টি জেলা পরিষদে দলীয় ব্যক্তিদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়। ফলে জেলা পরিষদ প্রত্যাশিত ভূমিকা পালনে সক্ষম হচ্ছে না।

কেন্দ্রীয় প্রশাসনে পদোন্নতি ও পদায়নে অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার খবর প্রায়ই প্রকাশিত হচ্ছে। তবে এ ধরনের অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা নতুন নয়। স্বাধীনতার পর থেকে আশির দশকের শেষ পর্যন্ত প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ সচিবালয়ের উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদগুলোয় নিয়োগ ও পদোন্নতির ব্যাপারে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হলেও বিএনপির শাসনামলে ১৯৯২ সালে এসব পদে পদোন্নতিতে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। অনেকের মতে, প্রশাসনকে দলীয়করণেরও এটি ছিল প্রথম সুপরিকল্পিত বড় পদক্ষেপ। তবে কেউ কেউ মনে করেন, স্বাধীনতার পর পরই তত্কালীন আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) প্রতিষ্ঠিত পদ্ধতির ব্যত্যয় ঘটিয়ে বিপুলসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে ম্যাজিস্ট্রেট ও অন্যান্য পদে চাকরি প্রদান ছিল প্রশাসনকে দলীয়করণের প্রথম পদক্ষেপ।

১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি এইচএম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। সরকার গঠনের এক বছর পার না হতেই প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে বিএনপির প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি করতে এবং পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের সময় তা কাজে লাগাতে ১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিএনপি সরকার বাংলাদেশ সচিবালয়ের উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে সাতশর বেশি কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়। একসঙ্গে সচিবালয়ে উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে এত বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তাকে এর আগে পদোন্নতি প্রদানের নজির ছিল না। দলীয়করণের অভিযোগ ছাড়াও পত্রপত্রিকায় এ পদোন্নতিকে ‘গণপদোন্নতি’ বলে অভিহিত করা হয়। শূন্যপদ ব্যতীত পদোন্নতি দেয়া যায় না, প্রশাসনিক অঙ্গনে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠিত এ নিয়মটির ব্যত্যয় ঘটানো হয়।

১৯৯২ সালে বিএনপি প্রয়োজনীয় শূন্যপদ ছাড়াই অনেকটা ‘গণপদোন্নতির’ যে নজির সৃষ্টি করে, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ তা যত্নসহকারে অনুসরণ করে। পরবর্তীতে বিএনপি বা আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় এসেছে, তখন তারা উভয়ে শূন্যপদ ছাড়া দলীয় স্বার্থে পদোন্নতি প্রদান ও প্রশাসনে দলীয়করণের গতি আরো জোরদার করেছে।

আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনী মেনিফেস্টোয় প্রশাসনকে নির্দলীয় ও গণমুখী করার অঙ্গীকার করে। মেনিফেস্টোয় বলা হয়, চাকরিতে নিয়োগ ও পদোন্নতির মাপকাঠি হবে মেধা, দক্ষতা ও জ্যেষ্ঠতা। প্রশাসন ব্যবস্থায় সংস্কার আনা হবে। প্রশাসনে গতিশীলতা আনয়ন এবং জনসেবার মানোন্নয়নে একটি কার্যকর সিভিল সার্ভিসের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার সিভিল সার্ভিস আইন প্রণয়নের কথা বলতে শুরু করে। দেশের শাসন ব্যবস্থার উন্নয়নে একটি কার্যকর সিভিল সার্ভিসের গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে একটি শক্তিশালী সিভিল সার্ভিস গঠনের ওপর ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক (২০১১-১৫) পরিকল্পনায় জোর দেয়া হয়। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১০-১১ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘জনপ্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা সংস্কারমূলক কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। সিভিল সার্ভিস আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। আলোচনা, ওয়ার্কশপ এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে এটি চূড়ান্ত করা হবে।’ পরবর্তী তিন অর্থবছরের অর্থাত্ ২০১১-১২, ২০১২-১৩ এবং ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায়ও তিনি জানান, সিভিল সার্ভিস আইনের খসড়া চৃড়ান্ত পর্যায়ে আছে এবং সরকার এটিকে আইন হিসেবে প্রণয়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আইনের খসড়া একাধিকবার প্রস্তুত করা হলেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের মেয়াদে (২০০৯-২০১৩) সেটি শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।

প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট বর্জিত ৫ জানুয়ারির একতরফা সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভের পর গঠিত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার জনপ্রশাসনে শৃঙ্খলা ও গতিশীলতা আনতে সংস্কারমূলক কার্যক্রম বা সিভিল সার্ভিস আইন প্রণয়ন সম্পর্কে বক্তব্য প্রদানে বিরত রয়েছে। গত ৫ জুন ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনকালে অর্থমন্ত্রী জনপ্রশাসনে সংস্কার আনয়ন বা সিভিল সার্ভিস আইন প্রণয়ন সম্পর্কে কোনো বক্তব্য দেননি। বাজেট বক্তৃতায় সচরাচর ‘জনপ্রশাসন’ শিরোনামে একটি অনুচ্ছেদ থাকে। এবারের বাজেট বক্তৃতায় সেটিও নেই। 

সংবিধানে সংসদ আইন দ্বারা প্রজাতন্ত্রের কর্মে কর্মচারীদের নিয়োগ ও কর্মের শর্তাবলি নিয়ন্ত্রণের নির্দেশনা (অনুচ্ছেদ ১৩৩) থাকলেও স্বাধীনতার ৪৩ বছরে সে আইন প্রণীত হয়নি। গত চার দশকে ক্ষমতাসীন কোনো রাজনৈতিক দল আইনটি প্রণয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। ১৯৯১-২০১৩ সময়কালে পালাক্রমে ক্ষমতায় আসীন বিএনপি ও আওয়ামী লীগ আইনটি প্রণয়নে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। আসলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেউ চায় না মেধা ও দক্ষতার ভিত্তিতে একটি নিরপেক্ষ ও কার্যকর জনপ্রশাসন গড়ে উঠুক। কারণ আইনটি প্রণীত হলে তারা ক্ষমতায় আসীন হলে ইচ্ছামতো জনপ্রশাসনে নিয়োগ, পদোন্নতি, পদায়ন ইত্যাদি কার্যক্রম চালাতে পারবে না। তাদের উভয়ের উদ্দেশ্য হলো, দলীয়করণের মাধ্যমে প্রশাসনকে ব্যবহার করে ক্ষমতার ভিত শক্তিশালী করা। এটিই প্রশাসনে অদক্ষতা, দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা ইত্যাদির মূল কারণ।

প্রশাসনকে যুগোপযোগী করতে সংস্কারের বিকল্প নেই। স্বাধীনতার পর পরই তত্কালীন সরকার প্রশাসনিক সংস্কারের উদ্যোগ নেয় এবং পরবর্তী সরকারগুলো কমবেশি সে ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। ক্ষমতাসীন সরকার তাদের আগের মেয়াদে (২০০৯-২০১৩) প্রশাসনিক সংস্কারের যে পরিকল্পনা গ্রহণ করে তার বাস্তবায়ন শুধু প্রশাসনিক সংস্কারের ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে না, বরং এর মাধ্যমে প্রশাসনকে বহুলাংশে গতিশীল ও গণমুখী করা সম্ভব হবে।

লেখক: সাবেক সচিব ও কলাম লেখক

Published in: http://www.bonikbarta.com/2015-06-25/news/details/5876.html

আরো পড়ুন:

ঔপনিবেশিক জনপ্রশাসন এবং ক্যাডার সার্ভিস সংস্কার

ক্যাডারের রাজা "প্রশাসন ক্যাডার"

প্রশাসন ক্যাডার দুর্নীতির শীর্ষে!

শিক্ষার ঋণে আনন্দভ্রমণ!



0 comments:

Post a Comment