যেকোনো বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ ‘জ্ঞানই শক্তি’এ নীতিবোধ দ্বারা পরিচালিত। উন্নত দেশগুলোতে জ্ঞানের ধারক-বাহক এবং পালকদের সর্বোচ্চ মর্যদা দেওয়া হয়। সেখানে মেধা-মনন, জ্ঞান-গরিমা উৎকৃষ্ট সম্পদ বলে বিবেচিত। আমাদের দেশগুলোতে জ্ঞান ক্ষমতার উৎস না হলেও জ্ঞান মর্যাদায় অভিসিক্ত। আমাদের শাসকদের পক্ষ থেকে কখনো কখনো তার প্রকাশ ঘটে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একুশে বইমেলা উদ্বোধন করতে গিয়ে একবার জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। অনেক বৈপরিত্যের মাঝে এ কথা অনেকের ভালো লেগেছিল। বিশেষ করে যারা নিরন্তর জ্ঞান সাধনায় লিপ্ত তাদের উৎসাহিত করেছিল। কথা ও কাজের মাঝে যে বেজায় ফাঁক তা এবার বেতন কাঠামো ঘোষণায় প্রমাণিত হয়েছে।
সম্প্রতি সরকার নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণা করেছেন। ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত বেতন কমিশন প্রকাশিত হলে দেখা যায় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কাঠামোতে অবিশ্বাস্য রকম অবমূল্যায়ন হয়েছে। ইতিমধ্যে সচিব কমিটি কাঠামোটি পর্যালোচনা করেছে। মন্ত্রিপরিষদ বেতন কাঠামো অনুমোদন করেছে বলে সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে। প্রকাশিত নতুন বেতন কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সর্বোচ্চ বেতনকে চতুর্থ গ্রেডে নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে রয়েছেন সামরিক বাহিনীর জেনারেল, লেফটেন্যান্ট জেনারেল, মেজর জেনারেল ইত্যাদি সামরিক কর্মকর্তা। এরই সাথে সমান্তরালভবে রয়েছে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, সংস্থাপন সচিব, সিনিয়র সচিব এবং অন্য সচিবরা। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে যে এখানে ক্ষমতা বনাম অক্ষমতার দ্বন্দ্ব রয়েছে।
সক্ষমতার মানদণ্ড যখন ‘সম্মতি নয় শক্তি’তখন অক্ষম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তো কোনো কাজে আসবে না! বিভিন্ন পর্যায়ের বিশ্লেষকরা খোলামেলাই বলেছেন: বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মহাজোট সরকার যেহেতু জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করে ক্ষমতাসীন হয়নি, তাই সামরিক বাহিনী, সিভিল আমলাতন্ত্র ও পুলিশ-র্যাব-বিজিবিকে খুশি করে তারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়।
আজকের অবহেলিত শিক্ষকরা একসময় আওয়ামী লীগের প্রধান শক্তি ছিল। মূলত বাংলাদেশের উদ্ভব, বিকাশ ও প্রতিষ্ঠায় আওয়ামী লীগের সাথে সাথে বুদ্ধিজীবীদের সমান্তরাল ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তাঁদের ভুমিকা ছিল অনন্য। অন্যদিকে, এখন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বুদ্ধিজীবীদের সেই মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান আর নেই। অন্যদিকে দলীয় রাজনীতির বাহক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাঁদের অবমূল্যায়ন ঘটিয়েছেন। সাম্প্রতিক নির্বাচনে শতনাগরিক বনাম সহস্রনাগরিকের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থেকেছেন তাঁরা। সবচেয়ে দুঃখজনক একটি বিতর্কিত নির্বাচনকে দলীয় শিক্ষকরা সুষ্ঠু সার্টিফিকেট দিতেও দ্বিধা করেননি তাঁরা। এমনকি বেতন কাঠামো ঘোষিত হওয়ার পর অনুষ্ঠিত পর্যালোচনা সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি কঠোর পদক্ষেপ তো দূরের কথা কঠিন শব্দাবলি উচ্চারণেও অপারগ থেকেছে। তার কারণ সেখানে আওয়ামী লীগ সমর্থিত নীল দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা রয়েছে। একটি রাজনৈতিক সরকারের সিদ্ধান্তকে তাঁরা আমলাতন্ত্রের ঘাড়ে চাপিয়েছেন।
তবে এটা অস্বীকার করে লাভ নেই যে, আমলাতন্ত্র এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সম্প্রদাযের মধ্যে একটি অদৃশ্য ঠান্ডাযুদ্ধ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মনে করেন,তারাই শ্রেষ্ঠ। আর আমলারা মনে করেন তারাই শ্রেষ্ঠ। দুই শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই ভিত্তিহীন নয়। পাকিস্তান আমলের সিএসপি বা বাংলাদেশ আমলের বিসিএস এর অর্ন্তভুক্ত যারা হচ্ছেন তাঁরা সবাই নিজ নিজ বিভাগে শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থীর স্বীকৃতি পেয়েছেন। বিভাগের প্রথম ছেলেটি হয়তো শিক্ষক হয়েছে, দ্বিতীয়টি আমলা হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে উষ্ণ সম্পর্ক থাকলেও পেশাগত প্রতিযোগিতা অদৃশ্য বিভেদ সৃষ্টি করেছে। রাষ্ট্রের সম্পদ বণ্টনের বৈধ কর্তৃত্বের অধিকারী সিভিল সার্ভিসের কাছে কারণে-অকারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মুখোমুখি হতে হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সর্বাংশে সরকারি অনুদান-নির্ভর হওয়ায় এই দায়বদ্ধতা শিক্ষকদের মর্যাদা হানি ঘটায়।
বিদেশে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমলারা প্রায়ই সেই উদাহরণ টেনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বউপার্জনের উপদেশ দেন। কিন্তু বিদেশ আর এ দেশ যে এক নয় তারা তা হয়তো এড়িয়ে যান। নীতিগতভাবেই দুটো ভিন্ন জিনিস। বিদেশে প্রথমত জ্ঞান এবং অবশেষে শিক্ষা পণ্য রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর বাংলাদেশে সরকার কাঙ্ক্ষিত জনশক্তি সৃষ্টির জন্য শিক্ষায় বিনিয়োগ করছে। এই বিনিয়োগ যত বেশি হবে ততই জাতীয় উন্নয়ন তরান্বিত হবে। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষাকে বিদেশের মতো পণ্য হিসেবে গণ্য করায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। একই দেশে একজন শিক্ষক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ বেতন পাচ্ছেন অন্যদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতনমান অনেক নিম্ন। অন্যদিকে বাংলাদেশের অদ্ভুত জনসংস্কৃতি অনুযায়ী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অবিশ্বাস্য রকম কম বেতন দিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে যে, একই পিতা-মাতার যে সন্তানটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যলয়ে পড়ছে তার উচ্চহারে বেতন দিতে দ্বিধা নেই। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন বাড়ালেই দোষ। অভিভাবক টাকা দেয় না। আর ছাত্র করে আন্দোলন। সরকার বেতন বৃদ্ধির তাগিদ দিয়েই খালাস। আদায় করার কার্যকর পদক্ষেপ এবং কৌশল দুটোই সেখানে অনুপস্থিত।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠমোর দাবি একটি মৌলিক এবং যৌক্তিক দাবি। ১৯৮৬ সালে শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন দীর্ঘ আন্দোলন করেও সফলতা অর্জন করতে পারেনি। বর্তমান সরকারের শিক্ষামন্ত্রী পৃথক বেতন কাঠামোর আশ্বাস দিলেও তা কার্যকর করার কোনো উদ্যোগ শিক্ষা মন্ত্রণালয় নেয়নি। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো তো বটেই এমনকি পার্শ্ববর্তী সার্কভুক্ত দেশগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পৃথক পে-স্কেল রয়েছে। শ্রীলংকা যে শিক্ষায় অগ্রসর তার কারণ সেখানে শিক্ষকদের উচ্চহারে বেতন প্রদান। এমনকি পাকিস্তানের মতো পরোক্ষ সামরিক কর্তৃত্বের দেশেও উচ্চহারে বেতন-ভাতা দেওয়া হচ্ছে। ভারতে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতন অনেক উচু হারের। সুতরাং বাংলাদেশে সরকারের উচিত অবিলম্বে শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো ঘোষণা করা। শিক্ষকদের উচিত কাঙ্ক্ষিত বেতন কাঠামোর জন্য অনতিবিলম্বে আন্দোলনের সূচনা করা। কেবল আন্দোলনের মাধ্যমে শিক্ষকরা তাঁদের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে পারেন। যদি জাতীয় বেতন কাঠামো বিন্নাসে সকল ক্যাডারের ঐকমত্য অর্জন অসম্ভব হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য উচ্চহারে শিক্ষাভাতা, গবেষণা ভাতা, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ভাতা এবং বই ক্রয় ভাতা প্রবর্তন করা যায়। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আমলাদের অনুরূপ যানবাহন সুবিধা প্রদান করা যায়। উল্লেখ্য যে, প্রেসিডেন্ট এরশাদ কাঠামোগতভাবে সেনাবাহিনীর বেতন না বাড়াতে পেরে বিভিন্ন ভাতার নামে তাদের বেতন অনেকগুণ বাড়িয়ে নিয়েছিলেন।
সত্যি সত্যিই যদি দেশকে মধ্যম আয়ের অথবা উন্নত আয়ের পর্যায়ে উন্নীত করার চেষ্টা থাকে তাহলে সকল পর্যায়ে উত্তম মেধাকে ব্যবহারের জন্য উত্তম বেতন কাঠামো দিতে হবে। বাজেটে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া সকল পর্যায়ের সকল শিক্ষককে পদ ও মর্যদায় সকল ক্যাডারের উর্ধে স্থান দিতে হবে। কেবল তখনই কাম্য জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন সম্ভব হবে।
Published in: http://www.ntvbd.com/opinion/12293/
0 comments:
Post a Comment