দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন সর্বনিম্ন। অর্থনীতির সূচকে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোতেও শিক্ষকদের বেতন বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশ পাকিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সবচেয়ে বেশি বেতন দেয়। বর্তমান (সপ্তম পে স্কেল) বেতন স্কেলে বাংলাদেশে একজন প্রভাষকের মূল বেতন মাত্র ১১ হাজার টাকা, অধ্যাপকের ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা
। প্রস্তাবিত অষ্টম বেতন স্কেলে তা দ্বিগুণ বাড়ানো হয়েছে। এতে প্রভাষকের মূল বেতন ধরা হয়েছে ২২ হাজার টাকা এবং অধ্যাপকের মূল বেতন ধরা হয়েছে ৬৪ হাজার ৬০০ টাকা। এর পরও সবার চেয়ে পিছিয়েই থাকছে বাংলাদেশ। অথচ নেপালে বর্তমানে প্রভাষকের মূল বেতন ২৮ হাজার ১৯২ টাকা আর অধ্যাপকের ৬৫ হাজার ১৮৪ টাকা।অষ্টম বেতন স্কেলে মর্যাদার দিক দিয়েও আগের চেয়ে কয়েক ধাপ পিছিয়ে যাচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। দেশের বিশিষ্ট কয়েকজন অধ্যাপক বলেছেন, শিক্ষকরা যদি মানসিকভাবে পিছিয়ে পড়েন তাহলে তাঁরা কিভাবে ক্লাসে পড়ালেখায় মন দেবেন? আর মানের উন্নয়নই বা কিভাবে হবে?
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সূত্র জানায়, দেশে এখন ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। এর মধ্যে অধ্যাপক আছেন প্রায় পাঁচ হাজার। এর মধ্যে এক-চতুর্থাংশ অধ্যাপক সিলেকশন গ্রেড পেয়েছেন পদোন্নতির ১২ থেকে ১৪ বছর পর, তাঁদের সংখ্যা প্রায় এক হাজার ২৫০ জন। সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত শিক্ষকরা এত দিন সর্বোচ্চ বেতন পেয়েছেন। অর্থাৎ তাঁদের বেতন সচিবদের বেতনের সমান। সপ্তম বেতন স্কেলে সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও সচিব উভয়েই ৪০ হাজার টাকা মূল বেতন স্কেল পান। কিন্তু নতুন বেতন স্কেলে (অষ্টম পে স্কেল) গ্রেড-১ এর আগেও তিনটি ধাপ রাখা হয়েছে। প্রথম ধাপে ৯০ হাজার টাকা বেতন পাবেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও মুখ্য সচিবরা। দ্বিতীয় ধাপে ৮৪ হাজার টাকা পাবেন সিনিয়র সচিবরা। আর তৃতীয় ধাপে পদায়িত সচিবরা পাবেন ৮০ হাজার টাকা। এরপর থেকেই শুরু হয়েছে গ্রেড-১। এখানে রয়েছে সচিব (ওএসডি) ও অধ্যাপকরা (সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত)। বেতন কমিশন অবশ্য সিলেকশন গ্রেড তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। তা করলে অধ্যাপকদের নেমে আসতে হবে গ্রেড-২ তে। যেখানে বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৪ হাজার ৬০০ টাকা। অন্য পদের শিক্ষকদেরও এভাবে নিচের ধাপে নামতে হবে। সপ্তম বেতন স্কেলে গ্রেড-৪ এ থাকা সহযোগী অধ্যাপকরা মূল বেতন পান ২৫ হাজার ৭৫০ টাকা। নতুন স্কেলে তাঁরা পাবেন ৫০ হাজার টাকা। তাঁদের গ্রেড ঠিক থাকলেও আগের একই মর্যাদার প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপরে উঠে যাচ্ছেন। আর সহকারী অধ্যাপকরা ১৮ হাজার ৫০০ টাকার মূল বেতনের বদলে পাবেন ৩৫ হাজার ৫০০। তাঁদের ক্ষেত্রেও সহযোগীদের মতো একই ঘটনা ঘটছে। শিক্ষকরা বলছেন, 'এত দিন আমরা সর্বোচ্চ গ্রেডে বেতন ও সম্মান পেলেও নতুন বেতন কাঠামোতে আমাদের দুই ধাপ নিচে নেমে আসতে হবে, যা আমাদের জন্য মোটেই সম্মানজনক নয়।'
বেতন বৈষম্যের কারণে গত সোমবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আন্দোলনেও নামেন। সেদিন সব বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই ঘণ্টার কর্মবিরতি ও অবস্থান ধর্মঘট পালিত হয়। সরকার থেকে শিগগির সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেওয়া না হলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন শিক্ষক নেতারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা সরকারি কর্মকর্তাদের মতো সুযোগ-সুবিধা আশা করি না। কিন্তু আমাদের কেন নিচে নামিয়ে দেওয়া হবে? মন্ত্রিপরিষদ ও মুখ্য পরিষদ সচিবরা আমাদের ওপরে থাকতে পারেন। কিন্তু এর পরের অবস্থানে তো আমাদের থাকা উচিত। আর আমাদের মূল দাবি স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো। সেটা না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আগের মর্যাদার অবস্থানে রাখতে হবে। নইলে আমরা কঠোর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হব। সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি আমাদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে।'
কর্মসূচির বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমরা ১৯ জুনের মধ্যে শিক্ষামন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, শিক্ষাবিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি ও ইউজিসি চেয়ারম্যানকে স্মারকলিপি দেব। ২০ জুন সংবাদ সম্মেলন করে কর্মসূচি ঘোষণা করব। অনশনসহ আরো কঠোর কর্মসূচি আসতে পারে।'
জানা যায়, শিক্ষকরা সরকারের কাছে প্রস্তাব দেওয়ার জন্য একটি স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর ব্যাপারেও আলোচনা করছেন। সেই কাঠামোতে প্রভাষকের বেতন হতে হবে অষ্টম বেতন স্কেলের গ্রেড-৬-এর সমান, ৩৫ হাজার ৫০০ টাকা। আনুপাতিক হারে সহকারী, সহযোগী ও অধ্যাপকদের বেতন বাড়বে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি সূত্র জানায়, কয়েকটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন স্কেল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাংলাদেশের শিক্ষকরা বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধায় যথেষ্ট পিছিয়ে আছেন। অধিকাংশ দেশেই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রভাষকের পদ নেই। তাদের শুরু সহকারী অধ্যাপক দিয়ে। আশপাশের দেশগুলোতে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল রয়েছে। ভারতে সহকারী অধ্যাপকের মূল বেতন ৫৫ হাজার, সহযোগী অধ্যাপকের ৯০ হাজার এবং অধ্যাপকের এক লাখ ১০ থেকে এক লাখ ৩৫ হাজার টাকা। পাকিস্তানে সহকারী অধ্যাপকের মূল বেতন এক লাখ চার হাজার, সহযোগী অধ্যাপকের এক লাখ ৫৬ হাজার ও অধ্যাপকের দুই লাখ ৩৪ হাজার টাকা। শ্রীলঙ্কায় সহকারী অধ্যাপকের বেতন স্কেল এক লাখ পাঁচ হাজার ৬৮০, সহযোগী অধ্যাপকের এক লাখ ৪০ হাজার ও অধ্যাপকের এক লাখ ৮৬ হাজার ৩৪৫ টাকা।
চীনে সহকারী অধ্যাপকের মূল বেতন ৯৬ হাজার ৩০৯, অধ্যাপকরা পান এক লাখ ৫০ হাজার ৩৩১ টাকা। মালয়েশিয়ায় সহকারী অধ্যাপকের মূল বেতন দুই লাখ ৫৩ হাজার ১৫৮, অধ্যাপকরা পান তিন লাখ ৬০ হাজার ৩০৫ টাকা। জাপানে সহকারী অধ্যাপকদের মূল বেতন দুই লাখ ৪২ হাজার ৭২৯, অধ্যাপকরা পান চার লাখ ৫১ হাজার ৮৮৮ টাকা। এর বাইরে আবাসন, যাতায়াতের জন্য গাড়িসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
বাংলাদেশে অষ্টম পে স্কেলে যুগ্ম সচিব ও তদোর্ধ্ব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের গাড়ি ক্রয়ে ২৫ লাখ টাকা ঋণ সুবিধা ও মাসিক ব্যয় নির্বাহের জন্য ৪৫ হাজার টাকা বহাল রাখা হয়েছে। কিন্তু সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য এ সুবিধা দিতে হলে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থ সংস্থানের কথা বলা হয়েছে। শিক্ষকরা বলছেন, 'এক দেশে তো দুই নিয়ম হতে পারে না। জনগণের করের টাকায় যুগ্ম সচিবরা যদি এ সুবিধা পেতে পারেন তাহলে আমরা পাব না কেন?'
জানতে চাইলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিষয়টি নিয়ে আমরা আলাপ-আলোচনা করছি। আমি এ ব্যাপারে শিক্ষকদের সঙ্গেও বসব। তাঁদের সমস্যা ও মনের কষ্ট সরকারকে জানাব। আশা করি অবশ্যই সমাধান বের হয়ে আসবে। তবে আমার অনুরোধ, শিক্ষকরা যেন এই বিষয়টি নিয়ে পড়ালেখায় কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি না করেন।'
বেতন ও চাকরি কমিশন-২০১৩ গঠনের পর একাধিকবার দেখা করেন শিক্ষক নেতারা। বেতন কমিশন থেকে শিক্ষকদের প্রস্তাব দিতে বললে গত বছরের ১৯ নভেম্বর একটি প্রস্তাব দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। তাতে ছয়টি বিষয় উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে (সপ্তম পে স্কেল অনুযায়ী) প্রভাষকদের সর্বনিম্ন বেতন স্কেল ষষ্ঠ গ্রেড থেকে উন্নীত করে নবমে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী সহকারী, সহযোগী ও অধ্যাপকদের বেতন স্কেল আনুপাতিক হারে উন্নীত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। গবেষণা ভাতা মূল বেতনের ৪০ শতাংশ করতে বলা হয়।
দুর্বল বেতন কাঠামোর কারণে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী শিক্ষকতায় আসতে চাইছেন না। ইউজিসির সর্বশেষ (৪০তম) বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালে ৩২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০.০৫ শতাংশ শিক্ষকই নানা কারণে শিক্ষা ছুটিতে ছিলেন। জানা যায়, ছুটিতে থাকা শিক্ষকদের অধিকাংশই বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি শেষে আর দেশে ফেরেন না।
ইউজিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক শিক্ষক একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সময় বেশি দেন।
এ ব্যাপারে শিক্ষক নেতারা বলছেন, বেতন কম হওয়াতেই শিক্ষকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে যান। ঢাকার বাইরের শিক্ষকদের সে সুযোগও নেই।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'অধ্যাপকদের দুই ধাপ অবনমন হচ্ছে। আমার যে অবস্থান সেখান থেকে নামিয়ে দেওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। সরকার যদি শিক্ষকদের ইচ্ছা করে এই অবনমন করে তাহলে মুক্ত মন নিয়ে পাঠদান করা কষ্টকর হয়ে পড়বে। বেতন কমানোর সঙ্গে অপমান করলে শিক্ষকরা চাকরি কেন করবেন? তাঁরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বা বিদেশে চলে যাবেন। এমনিতেই উচ্চশিক্ষায় দৈন্যদশা। এরপর এই অবস্থা চলতে থাকলে মান আরো পড়ে যাবে।'
ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বেতন কাঠামো নিয়ে ইউজিসির করার কিছুই নেই। এটা সরকারের সিদ্ধান্তের ব্যাপার।'
Source: http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2015/06/10/231737
0 comments:
Post a Comment