Wednesday, June 17, 2015

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দাবি কি অযৌক্তিক


সিনথিয়া পারভীন কাকলী

১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় এ্যাক্ট অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জ্যেষ্ঠ শিক্ষকরা সচিব সমমর্যাদার। ৭ম জাতীয় বেতন কাঠামোতেও তারা ১ ও ২ গ্রেডে বেতন পেতেন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়েরই একসময়ের ছাত্ররা শিক্ষকদের তাদের নিজেদের থেকে দুই ধাপ নিম্নমর্যাদা দিয়ে ৩ ও ৪ গ্রেডভুক্ত করতে চান। প্রস্তাবিত ৮ম জাতীয় বেতন কাঠামোতে এভাবেই সুপারিশ করেছেন সচিব কমিটির সদস্যরা যা মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেলেই জুলাই মাস থেকে কার্যকর হবে। এটা ১৯৭৩ সালের এ্যাক্টের সাথে সাংঘর্ষিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য চরম অবমাননাকর হবে

মানুষ গড়েন যিনি, শিক্ষক তিনি। একটি শিশুকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষকদের রয়েছে অগ্রণী ভুমিকা, সীমাহীন ত্যাগ। প্রাথমিক অবস্থায় শিশু থাকে কাঁদা-মাটির ন্যায় আকৃতিহীন। প্রাথমিক, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজের শিক্ষকরা সেটিকে ধীরে ধীরে একটা আকৃতি দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আকৃতিটাকে পোড়া দেয়া ও রং করার কাজে নিয়োজিত শিল্পী। এত কষ্টে তৈরি সমগ্র আকৃতিটির শিল্প মর্যাদার সার্থকতা নির্ভর করে এই শিল্পীদের তুলির অনুপম কারুকার্যের ওপর। আগুয়ান সভ্যতায় তার অবস্থান কোথায় থাকবে সেটা এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ঠিক হয়ে যায়। সামান্য ভুল হলে চলে যাবে বাতিলের খাতায়। শিল্পী বেখেয়াল হলেই শিল্পটির অর্থ হয়ে যাবে ভিন্ন। তাই এই শিল্পীদের মনোযোগ ও আন্তরিকতার ওপর নির্ভর করে সমগ্র জাতির ভবিষ্যৎ। তারাও যে বৈষম্যের শিকারে পরিণত হবেন, আর সেটা ঠেকাতে মানববন্ধন ও কর্মবিরতির মত কর্মসূচি পালন করতে হবে ভাবিনি। 

প্রাথমিক, মাধ্যমিক, কলেজ ও মাদ্রাসা শিক্ষকদের আন্দোলনের কথা অনেকবার শুনেছি। তাদের গায়ে “পিপার স্প্রে” গরম পানি ঢালা ও লাঠিচার্জের দৃশ্যও দেখেছি। এই প্রথম দেখলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বাঁচার তাগিদে, সম্মান বাঁচাতে ভিন্ন আঙ্গিকে মাঠে নেমেছেন। ছোট বেলায় স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের কাছে শুনতাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন। আর তাদের লাইফ “So Luxirious” । কথাটি জীবনে এতবার শুনেছি যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি আমার এক ধরনের হিংসা জন্মায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এ হিংসা থেকে বাদ পড়েনি। সে হিংসা আজ আর হিংসা নেই। চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে পরিনত হয়েছে ক্রোধে। তবে এ ক্রোধ শিক্ষকদের প্রতি নয়, যারা উঁচু স্থানে থেকে সমপদমর্যাদার মানুষগুলোকে পদদলিত করতে চেষ্টা চালাচ্ছে তাদের প্রতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আজ সব সংকোচ দূর করে, দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যেন জানাচ্ছেন সমাজে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার মানুষ আরো আছে। 

১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় এ্যাক্ট অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জ্যেষ্ঠ শিক্ষকরা সচিব সমমর্যাদার। ৭ম জাতীয় বেতন কাঠামোতেও তারা ১ ও ২ গ্রেডে বেতন পেতেন। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়েরই একসময়ের ছাত্ররা শিক্ষকদের তাদের নিজেদের থেকে দুই ধাপ নিম্নমর্যাদা দিয়ে ৩ ও ৪ গ্রেডভুক্ত করতে চান। প্রস্তাবিত ৮ম জাতীয় বেতন কাঠামোতে এভাবেই সুপারিশ করেছেন সচিব কমিটির সদস্যরা। যা মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পেলেই জুলাই মাস থেকে কার্যকর হবে। যেটা ১৯৭৩ সালের এ্যাক্টের সাথে সাংঘর্ষিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য চরম অবমাননাকর হবে। ১৯৭৩ সালের বিশেষ এ্যাক্টের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জাতির বিবেক হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়, পাশাপাশি তাদের বিশেষ কিছু অধিকারও দেয়া হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই সচিবরা নিচের দিকের দু’একটি গ্রেড ছাড়া অন্যান্য স্তরের বেতন ১০০ শতাংশ বৃদ্ধির ব্যাপারে অমত হলেও নিজেদের বেতন ঠিকই ১০০ শতাংশ বৃদ্ধির সুপারিশ করেছেন। যা অবশ্যই নিন্দনীয় ও পরিত্যাজ্য। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠতম শিক্ষকরা সচিব পদমর্যাদার অধিকারী হলেও সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে উভয়ের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য বিদ্যমান। সচিবদের জন্য আছে গাড়ি-বাড়িসহ আরো কত কি? আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গাড়ি-বাড়ি তো দূরের কথা বসার জন্য একটি নিজস্ব অফিস কক্ষ পর্যন্ত নেই। একটা কক্ষের মধ্যে ঠিক করা হয় ৩/৪ জন শিক্ষকের বসার জায়গা। ৮ম জাতীয় বেতন কাঠামোতে তাদের বঞ্চিত করে দুই ধাপ নিচে নামিয়ে দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এটা কেন করা হয়েছে আমাদের সবার প্রশ্ন। একই সাথে রাষ্ট্রে সর্বোচ্চ নির্বাহীর কাছে দাবি যেন বিষয়টির সমতা বিধান করা হয়। প্রতিবছর এই শিক্ষকদের হাত দিয়ে অসংখ্য নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটসহ হাজার হাজার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তৈরি হয়। তারাই একসময় হন বড় আমলা। মাত্র ক’দিনের ব্যবধানে কেমন করে পিতৃতুল্য শিক্ষকদের ভুলে যান বুঝে আসে না। 

৮ জুন সারাদেশের ৩৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রস্তাবিত অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামো বাতিল করে পুনঃনির্ধারণ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল ঘোষণার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের ডাকে নিজ নিজ কর্মস্থলে কর্মবিরতি ও অবস্থান ধর্মঘট পালন করেছেন। ধর্মঘট থেকে তারা বলেছেন চলতি মাসের মধ্যে এ বিষয়ে ঘোষণা না এলে কঠোর কর্মসূচি দেবেন। তাদের এই আন্দোলনে নামতে বাধ্য করা জাতির ইতিহাসে কলঙ্কজনক হিসেবেই লেখা থাকবে। বিশ্বের কোথাও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে বলে আমার জানা নেই। যারা সমাজের বৈষম্য দূর করতে ব্যস্ত, তাদেরকেই আজ নিজেদের বৈষম্যের সে াতে না ভাসানোর জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে। এটা কারো কাম্য নয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিটা দিন গুরুত্তপূর্ণ। প্রতিনিয়ত এখানে ছন্দের তালে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। এজন্য ক্লাস ও পরীক্ষা দুটিই তাদের কাছে অধিক গুরুত্ব বহন করে। শিক্ষকদের কঠোর কর্মসূচির হুমকিতে শিক্ষার্থীরা আতংকিত না হয়ে পারে না। ক্লাস বা পরীক্ষা বন্ধ করে শিক্ষকদের যেন আর মানববন্ধন-অবস্থান ধর্মঘট বা অন্য কোনো কর্মসূচি পালন করতে না হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া তাদের দাবি তো অযৌক্তিক নয়। বৈষম্য দূর করে তাদের সুনিশ্চিত জীবন-যাপনের ব্যবস্থা করলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্ক্ষিকরা আর বাড়তি উপার্জনের জন্য প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়মুখী হবেন না। জাতিকে উন্নত প্রজন্ম উপহার দিতেও নিশ্চিন্ত বোধ করবেন।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

Published in: http://www.bangladeshshomoy.com/news.php?id=12387

0 comments:

Post a Comment