ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,আমাদের গর্বের বিশ্ববিদ্যালয় কারণ আমরা গর্ব করে বলি এটা প্রাচ্যের অক্সফোর্ড। কেউ এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করলে আমরা তার তুলোধুনো করে ছেড়ে দেই। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা আয়নায় দেখতে ভয় পাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমাদের ভালোবাসা অনেকটা পুরোনো জমিদাররের উত্তরসুরিদের মত। সেই জমিদারী নেই, সেই জৌলুস নেই কিন্তু একখানা বাস্তবতা বিবর্জিত ভাব ঠিকই থাকে। যে কোন কর্ম দিবসে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টার মধ্যে যে কোন বিভাগে গেলে ২০-৩০% শিক্ষককে বিভাগে পাওয়া যায়। যদিও ৩টার পর তাও পাওয়া যায় না। এরকম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে ছাড়া পৃথিবীর আর কোথায় আছে? অনেক শিক্ষকের অফিস রুম মাসেও একদিন খোলা হয় না। ওই ধরনের শিক্ষক যদিও মাঝে মাঝে বিভাগে আসেন কিন্তু অফিস রুম, লাউঞ্জ ঘুরে এবং ক্লাস যদি থাকে ক্লাস খানা নিয়ে চম্পট। প্রশ্ন হলো এরকম কেন হচ্ছে? এরকম হবে না কেন? আমরা যে ৭৩-এর অধ্যাদেশের মাধ্যমে স্বাধীন। আমাদের কারো কাছে কোন জবাবদিহি করতে হয় না। অনেক শিক্ষকই আছেন বিভাগে একটু ঢু মেরে সোজা প্রশাসনিক ভবন। এরা জানে প্রশাসনের কাছাকাছি থাকলে লাভ। এরা শুধুই লাভ খোজে এবং এভাবেই চলছে।
তারা ছাড়া প্রত্যেকটা শিক্ষককে একটু ভালো জীবিকার নির্বাহের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বাহিরে এক বা একাধিক কাজে নিয়োজিত। একজন শিক্ষককে যদি একবার পার্ট-টাইম ক্লাস নেওয়ার জন্য উত্তরা বা বসুন্ধরাতে যেতে হয় তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেওয়ার জন্য সময় বা এনার্জি তার কোনটি অবশিষ্ট থাকে? তিনি নিশ্চই খুব exhausted তাই যদিও এখানে ক্লাস নেন সেই ক্লাসের মান খুব একটা ভালো হবে নাএটা প্রায় নিশ্চিত। অর্থাত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মান এমিনিতেই পৃথিবীর পার্সপেক্টিভ থেকে বিবেচনা করলে অনেক poor কিন্তু আমাদের ability যতটুকু আছে তার পুরোটুকু কি এই বিশ্ববিদ্যালয়কে দিতে পারছি? আমি নিশ্চিত এর উত্তর আমরা সবাই জানি। এই পরিস্থিতিতে সরকার শিক্ষকদের সম্মান এবং সম্মানী দুটোই কমাতে উদ্যত হয়েছেন। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান কি আরো অবনতি হবে না? বর্তমান শিক্ষকদের দিয়ে শিক্ষক সমাজকে বিবেচনা করে তার প্রেক্ষিতে সরকার যদি শিক্ষকদের অবমাননা করে তাতে এই মান আরো নিম্নগামী হবে।
এই বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান কোথায় তা জানার জন্য কি কোন গবেষণা বা সার্ভে করার কোন প্রয়োজন আছে? আমাদের খোলা চোখেই চারিদিকে তাকালেই এটা জল বৎ তরলং হয়ে যায়। এখানে গবেষণা বলতে কি কিছু আছে? যাও কিছু গবেষণা হয় তলিয়ে দেখলে এদেরকে গবেষণা বলা যায় কিনা সন্দেহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নের মান দেখলেও বোঝা যায়। বোঝা যায় আমাদের ক্লাসরুমগুলোর দিকে তাকালে। বোঝা যায় আমাদের ছাত্রছাত্রীদের হাঁটা চলার মধ্যে। তাদের চালচলনের মধ্যে আমি কোন এনার্জি দেখতে পাইনা কেমন যেন সব লেথার্জিক, নির্জীব। দিন আসে দিন যায়। ক্লাস ইচ্ছে হলে করে আবার মনটা চায়নি তাই করলাম না গোছের মানসিকতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ছাত্র বা ছাত্রীর মধ্যে ক্লাস, এসাইনমেন্ট, exam ইত্যাদি নিয়ে যে পরিমান ব্যাস্ততা থাকার কথা তার বিন্দু মাত্রও দেখা যায় না। দুটো পরীক্ষার মধ্যে মিনিমাম gap এক সপ্তাহ চাই। কেন? কারণ সারা বছর পরে না তাই ওই গেপটুকুর মধ্যেই অধিকাংশ পড়াশুনা হয়। তাই দ্রুত পড়ে আর দ্রুত ভুলে যায়। এর মাধ্যমে আর যাই হউক জ্ঞান অর্জন হয় না।
আমাদের লাইব্রেরিগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের ভির লেগেই থাকে কিন্তু সেটা হলো BCS বা সমমানের চাকুরী প্রত্যাশীদের গাইড বই পড়াশুনা। ওই লাইব্রেরিতে সত্যিকারের একাডেমিক বই আজকাল আর কেউ পড়ে বলে মনে হয় না। ক্লাসে প্রক্সি নামক একটি ব্যাধি দ্বারা এই বিশ্ববিদ্যালয় আক্রান্ত। একজনের attendance অন্যজন নির্দিধায় অন্যজন দিয়ে দেয়। ছাত্রছাত্রীরা অসৎ হওয়ার ট্রেনিং-টা ওখান থেকেই শুরু। পৃথিবীর কোথাও বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলে ক্লাসে উপস্থিত থাকার জন্য নম্বরের ব্যাবস্থা সম্ভবত বাংলাদেশেই এবং তাও আবার খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই আছে। আমরা আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের শিশুদের চেয়েও অধম হিসাবে treat করি।
সব বিষয়ে আমাদের মধ্যে কেন জানি এক ধরনের complacence কাজ করে। এটা অত্যন্ত ক্ষতিকারক। এই complacence আরো ভালো করার ইচ্ছাটাকে নস্ট করে দেয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে আমাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার একটা হীন প্রয়াস বলে আমি মনে করি। এই ব্যাধি থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে।
কামরুল হাসান
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
0 comments:
Post a Comment