Friday, June 19, 2015

বেতন কাঠামোতে সম্মানী নয়, সম্মান চাই

রাহিদুল ইসলাম রাহি

অষ্টম জাতীয় পে কমিশনের বেতন কাঠামোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি বৈষম্যমূলক ও অপমানজনক প্রস্তাবনায় বিস্মিত শিক্ষক সমাজ। সভ্যতার উষালগ্ন থেকেই শিক্ষকতা পেশাকে সমাজে ও ব্যক্তিজীবনে সর্বোচ শ্রদ্ধা ও মর্যাদার চোখে দেখা হয়। এখনও বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই শিক্ষকদের সর্বোচ্চ সম্মান ও সম্মানী দুটিই দেওয়া হয়। 
সমাজে শিক্ষকদের অবদানের কথা বলাই বাহুল্য। যদিও শিক্ষকরা প্রতিদানের আশায় কিছুই করেন না; কিন্তু তাদের নূ্যনতম প্রাপ্যতা চাওয়াটা নিশ্চয়ই প্রতিদান নয়। আমরা গর্ববোধ করি, যারা দেশ পরিচালনা করছেন, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা সবাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদেরই ছাত্র। বাবা-মা যেমন সন্তানদের বড় করেন কিছু পাওয়ার আশায় নয়, তাদের সন্তানরা ভালো মানুষ হবে, ভালো থাকবে_ এটাই তাদের প্রত্যাশা, পরম পাওয়া। আমরা শিক্ষকরাও ছাত্রদের পড়াই তাদের কাছ থেকে কোনো সুবিধা পাওয়ার আশায় নয়, ছাত্ররা মানুষের মতো মানুষ হবে, ভালো কিছু করবে_ এটাই আমাদের প্রত্যাশা। অবশ্য আমাদের দেশের অনেক আমলা ব্রিটিশ সিভিলিয়ানের উত্তরসূরি হিসেবে দাম্ভিকতা, অহমিকা আর ক্ষমতার দাপট দেখাতে পছন্দ করেন। তাই হয়তো আমাদের শিষ্যরা মধুর প্রতিশোধ হিসেবে বেছে নিলেন আমাদের সম্মান ও সম্মানীকে! স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন আর সেই স্বপ্নের পালে হাওয়া লেগেছিল অষ্টম জাতীয় পে অ্যান্ড সার্ভিসেস কমিশন গঠনের কথা শোনে। কিন্তু এ রিপোর্ট যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্বপ্নভঙ্গের নতুন উপাখ্যান আর বঞ্চনার শেষ ধাপ। বেতন কমিশনের রিপোর্টে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো না দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, যা পুঁজিবাদী শিক্ষাব্যবস্থার আরেক রূপ। রিপোর্টটি পড়ে মনে হয়েছে, যারা বলেন_ 'পড়াশোনা করে কী হবে, সার্টিফিকেট কিনব টাকা দিয়ে, চাকরি নেব টাকা দিয়ে, টাকাই ইনকাম করব।' যেন তাদের কথাই ঠিক!

কথা হলো, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোার স্বাবলম্বী হওয়ার উপায় কী? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিল্পকারখানা স্থাপন করে ছাত্র-শিক্ষকরা সেখানে কাজ করে আয় করতে হবে অথবা ছাত্রদের কাছ থেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো টাকা নিতে হবে! পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও যদি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো টাকা নেয়, তবে দেশের গরিব ও মেধাবী ছাত্রদের উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি উচ্চ হারে টাকা দিয়ে পড়তে হতো, তাহলে আমি লেখাপড়া করতেই পারতাম না। শুধু আমি নয় এই দলে হয়তো দেশের অনেক প্রথিতযশা ব্যক্তিরাও পড়তেন। 
অষ্টম বেতন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী স্বতন্ত্র বেতন স্কেল তো দুঃস্বপ্ন। এখন দেখি আগের গ্রেডটাই ধরে রাখার জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে। একজন যুগ্ম সচিব যে বেতন পান তা একজন অধ্যাপকের বেতনের সমান; কিন্তু যুগ্ম সচিব শুল্কমুক্ত গাড়ি কেনার সুবিধার পাশাপাশি সেই গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসিক ৪৫ হাজার টাকা পান। গাড়ির পেছনের মাসিক খরচটা একজন অধ্যাপকের বেতনের সমান, যা পণ্ডিত মশাইয়ের তিন পা-ওয়ালা কুকুরের অঙ্কের মতোই। সপ্তম বেতন কাঠামোতে সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও সচিবদের বেতন স্কেল সমান ছিল; কিন্তু বর্তমান কাঠামোতে সিলেকশন গ্রেড আর টাইম স্কেল বাদ দেওয়া এবং সিনিয়র সচিব ও পদায়িত সচিব গ্রেড সৃষ্টি করে শিক্ষকদের বেতন গ্রেড দুই ধাপ নিচে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা এত সম্মানী চাই না, আমাদের আগের সম্মানটুকুই ফেরত চাই। পৃথিবীর কোথায়ও, কোনো সময়ে, কখনও কোনো বেতন কমিশন বেতন স্কেলের গ্রেডকে এভাবে অবনমন করেছে কি?
 
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই_ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক নৈতিকতা, ব্যক্তিত্ব, সৃজনশীলতা আগের মতো আর নেই। তাদের অনেকে আজ রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি, নৈতিক স্খলন, লবিং-গ্রুপিং, সান্ধ্যকালীন কোর্স, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো, কনসালট্যান্সিসহ নানাবিধ কাজে ব্যস্ত। নিয়মিত ক্লাস, ল্যাব ও গবেষণার চেয়ে বাইরের কাজেই বেশি উৎসাহী ও মনোযোগী। তবে এর সংখ্যা শতকরা হিসাবে খুব বেশি নয়। যদিও তা শিক্ষক সমাজের সম্মানহানির জন্য যথেষ্ট। মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় না আসা বা আসতে না দেওয়া, গবেষণা সুবিধার অপর্যাপ্ততা, পেশাগত উৎকর্ষতা বাড়ানোর সুযোগ-সুবিধার অভাব সর্বোপরি তুলনামূলক নিম্ন বেতন কাঠামোসহ নানাবিধ বিষয় পেশা হিসেবে শিক্ষকতার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। যে সমস্যাগুলো শিক্ষকতা পেশাকে কলুষিত করছে সেগুলো সমাধানে যথার্থ পদক্ষেপ না নিয়ে উল্টো শিক্ষকদের বেতন গ্রেড অবনমন করা জাতি হিসেবে আমাদের দৈন্যতারই পরিচায়ক। 
দেশের মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমাদের বিশ্বাস ও প্রত্যাশা, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি বৈষম্যমূলক বেতন কাঠামো সম্পর্কে অবগত এবং যথার্থ পদক্ষেপও নেবেন। তার বাবা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষকদের জন্য অনেক কিছু করেছেন। বঙ্গবন্ধুই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গঠন করেছিলেন। তিনি স্বাধীনতার পর শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছিলেন একজন শিক্ষককে, বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন, বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শও নিতেন। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে হয়তো ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে উপস্থিত থাকতেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে 'জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়' ঘোষণা দিতেন। প্রধানমন্ত্রীও নিশ্চয় আমাদের বিষয়টি দেখবেন। যেখানে তিনিই প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণীর মর্যাদাসহ শিক্ষকদের বিভিন্ন সুযোগ দিয়েছেন। আমাদের দাবি মূলত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র পে-স্কেল। যে দাবির কথা সম্প্রতি সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের নেতারা জানিয়েছেন। আমরা চাই, সরকার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সম্মানের জায়গাটা রাখবে এবং খুব দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি বৈষম্যমূলক বেতন কাঠামো পরিবর্তন করে আমাদের আস্থার প্রতিদান দেবে।

সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল, পরিবেশ ও নগর পরিকল্পনা বিভাগ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

published in: http://www.samakal.net/2015/06/20/144292

0 comments:

Post a Comment