সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য থেকে আমরা জানতে পারলাম, অষ্টম জাতীয় পে-কমিশনের বেতন কাঠামোতে সরকার কিছুটা পরিবর্তন আনছে। এর ফলে আশা করা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি বৈষম্যমূলক ও অসম্মানজনক যে বেতন প্রস্তাব করা হয়েছিল, তা দূর হবে। আমরা সরকারের এ সঠিক উপলব্ধিকে স্বাগত জানাই। পাশাপাশি ড. ফরাস উদ্দিনের নেতৃত্বে অষ্টম বেতন কমিশন এবং পরবর্তীকালে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কিছু আমলা কর্তৃক যাচাই-বাছাই পূর্বক প্রণীত নীতিমালায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতি যে অবজ্ঞা প্রদর্শন করা হয়েছিল, সে ব্যাপারে আমরা ক্ষোভ প্রকাশ করছি। এটাও উল্লেখ করতে হয়, বেতন কাঠামোতে সরকার এখন যে পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে, সেটা আপনা আপনি আসছে না। সে জন্য শিক্ষক সমাজকে রোদ-বৃষ্টি সহ্য করতে হয়েছে। ন্যায্য অধিকার ও সম্মান রক্ষার দাবিতে শিক্ষক সমাজকে রাজপথে নামতে হয়েছে।
আমরা এ কথা অস্বীকার করি না, সরকার পরিচালিত হয় আমলাদের ওপর ভর করে। আরও পরিষ্কার করে বলা যায়, সরকারকে তার সিদ্ধান্ত বা নীতি আমলাদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হয়। সে জন্য সরকার আমলাদের ওপর নির্ভরশীল। শিক্ষক সমাজও তাই মনে করে। আমরা আরও বলতে চাই, শিক্ষক সমাজ আমলাদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে না এবং আমলারা শিক্ষক সমাজের প্রতিদ্বন্দ্বীও নন। এখানে উভয়ের পেশাগত কাজের ধরন ভিন্ন। বহুকাল আগে থেকেই উচ্চারিত হয়ে আসছে যে, শিক্ষক হচ্ছেন মানুষ গড়ার কারিগর। শিক্ষক সমাজ এই মানুষ গড়ার কারিগরি করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ উন্নয়নের দিকে ধাবমান একটি রাষ্ট্র। উন্নত রাষ্ট্রগুলোতে শিক্ষক সমাজ বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। উন্নত দেশগুলোর প্রসঙ্গ এখানে অযৌক্তিক মনে হলে আমরা অর্থনৈতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের কাছাকাছি প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের দিকে দৃষ্টি দিতে পারি। ভারত-পাকিস্তানেও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের মর্যাদা বাংলাদেশের তুলনায় বেশ উপরে। আবার এটাও ঠিক, সম্মান ও মর্যাদা স্থান-কাল-পাত্রভেদে পরিবর্তন হয়। এটা অনেকটা আপেক্ষিক বিষয়ও বটে। বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বেতন স্কেল একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীর সমান এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীদের স্কেল পেয়ে থাকেন। সরকারি চাকরি বিধিতে তারা চতুর্থ ও তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীর মর্যাদার অধিকারী। এ বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন স্কেল শীর্ষ পদের আমলাদের নিচে রাখলে শিক্ষকের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয় কোথায়? এ মতের যারা সমর্থক, তাদের কাছে প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোতে আমলাদের তুলনায় শিক্ষকদের স্কেলের অবনমন নিশ্চয় খারাপ বা অস্বাভাবিক কিছু নয় বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক বিষয় বিবেচিত হয়েছে।
সমাজে শিক্ষকদের অবদানের কথা কেউ কি অস্বীকার করতে পারেন? শিক্ষকরা প্রতিদানের আশায় কিছুই করেন না; কিন্তু তাদের ন্যূনতম প্রাপ্যটা নিশ্চয়ই প্রতিদান নয়। একজন শিক্ষক হিসেবে আমরা এ কারণে গর্ববোধ করি যে, যারা দেশ পরিচালনা করছেন, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা সবাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কোনো না কোনো শিক্ষকের ছাত্র। এ কথা অনেকেই বলে থাকেন যে, শিক্ষকরা ছাত্রের পিতৃতুল্য। এখন পিতৃতুল্যের সঙ্গে মাতৃতুল্য যুক্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ পুরুষের পাশাপাশি শিক্ষকতা পেশায় এখন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী যুক্ত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি, সে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদে একজন নারী অধিষ্ঠিত। এটি আমাদের জন্য অবশ্যই গর্বের বিষয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম মাতৃতান্ত্রিক পরিবার চালু হয়েছে। সেই গর্বে আমরা গর্বিত।
যা হোক, পিতা-মাতা বা বাবা-মা সন্তানকে বড় করে তোলেন কিছু পাওয়ার আশায় নয়, সন্তান ভালো মানুষ হলে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলে সে গর্ববোধ করবে, এটিই বাবা-মার প্রত্যাশা। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কও তাই। একজন শিক্ষক উচ্চশিক্ষায় কিংবা কোনো সেমিনার বা অন্য কোনো কারণে বিদেশে গেলে যখন কোনো ব্যক্তি এসে পায়ে সালাম করে ছাত্র বলে পরিচয় দেন, সেই শিক্ষকের পক্ষে এর চেয়ে পরম পাওয়ার আর কিছু নেই। এটা আমাদের কোনো কোনো আমলার কাছে ভালো নাও লাগতে পারে। ব্রিটিশ সিভিলিয়ানের উত্তরসূরি হিসেবে তাদের দম্ভ ও অহমিকায় আঘাত লাগতে পারে। আর এ কারণে সে ক্ষমতার দাপট দেখাতে পছন্দ করে। অনেকেই মনে করেন, হয়তো এটা ভেবেই আমরা যারা শিক্ষকতা পেশায় আছি, তাদের প্রতি মধুর প্রতিশোধ হিসেবে কোনো কোনো আমলা আমাদের সম্মান ও সম্মানীকে খাটো করার লক্ষ্য স্থির করেছেন। অন্যথায় শিক্ষকদের কপালে এমন লাঞ্ছনা জুটত না। স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ও দাবি। স্বপ্নের এই পালে হাওয়া লেগেছিল অষ্টম জাতীয় পে অ্যান্ড সার্ভিসেস কমিশন গঠনের কথা শুনে। কিন্তু এ রিপোর্ট যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্বপ্নভঙ্গের নতুন উপাখ্যান আর বঞ্চনার শেষ ধাপ। বেতন কমিশনের রিপোর্টে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো না দেয়ার কথা বলা হয়েছে, যা পুঁজিবাদী শিক্ষাব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার স্পষ্ট আভাস। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার উপায় কী? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কি কোনো সম্পদ আছে? ভৌত অবকাঠামো কি সম্পদ? তাহলে কি এগুলো বেসরকারি পর্যায়ে কোচিং সেন্টার, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্য কোনো কর্পোরেট অফিসের জন্য ভাড়া দিয়ে আয় বাড়ানো হবে? নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান স্টেক হোল্ডার শিক্ষার্থীদের বেতন বাড়ানো হবে? বাড়ানো হলেই বা কী পরিমাণে? শিক্ষার্থীদের বেতন বাড়ানো হলে ছাত্র আন্দোলন শুরু হবে। তখন এর দায় কে বহন করবে? যারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বাবলম্বী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে আয় বাড়াতে বলেন, উল্লিখিত প্রশ্নগুলোর উত্তর তাদেরই দেয়া উচিত। প্রেসক্রিপশন দেয়াই শেষ নয়, পরবর্তী অবস্থার দায়ও নিতে হয়।
অষ্টম বেতন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী স্বতন্ত্র বেতন স্কেল দূরের কথা, আমাদের বর্তমান অবস্থাটাই অক্ষুণ্ণ রাখা হয়নি। নিজে উপরে উঠতে গিয়ে আমাদের নিচে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন দেখি আমাদের আগের গ্রেডটাই ধরে রাখার জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে। একজন যুগ্ম সচিব যে বেতন পান তা একজন অধ্যাপকের বেতনের সমান; কিন্তু যুগ্ম সচিব শুল্কমুক্ত গাড়ি কেনার সুবিধার পাশাপাশি সেই গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসিক ৪৫ হাজার টাকা পান। গাড়ির পেছনের মাসিক খরচটা একজন অধ্যাপকের বেতনের সমান। সপ্তম বেতন কাঠামোতে সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও সচিবদের বেতন স্কেল সমান ছিল; কিন্তু বর্তমান কাঠামোতে সিলেকশন গ্রেড আর টাইম স্কেল বাদ দেয়া এবং সিনিয়র সচিব ও পদায়িত সচিব গ্রেড সৃষ্টি করে শিক্ষকদের বেতন গ্রেড দুই ধাপ নিচে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। পৃথিবীর কোথাও কখনও কোনো বেতন কমিশন বেতন স্কেলের গ্রেডকে এভাবে অবনমন করেছে বলে আমাদের জানা নেই।
বেতন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের পাশাপাশি ছাত্রদের বেতন, পরীক্ষা ও ভর্তি ফি বাড়ানোর স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এটা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সচিবদের বা ধনীদের ছেলেরা খুব কমই পড়ে, সবচেয়ে বেশি পড়ে মধ্যবিত্তের সন্তানরা। নিু আয়, ক্ষেত্র বিশেষে দিনমজুর পরিবারের ছেলে-মেয়েরাও আজকাল উঠে আসছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাষ্ট্র প্রদত্ত প্রায় বিনা টাকায় পড়ার সুযোগ রয়েছে বলেই এ সব পরিবারের ছেলে-মেয়েরা এ পর্যায়ে লেখাপড়ার সুযোগ ভোগ করছে।
একজন শিক্ষক হিসেবে আমরা শিক্ষাকে জাতীয়করণের কথাই বলতে চাই। আমরা কথা বলতে চাই পুরো শিক্ষক সমাজ নিয়ে। অষ্টম পে-কমিশনের রিপোর্টে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অসম্মানিত করা হয়নি; দেশের এমপিওভুক্ত বেসরকারি স্কুল ও কলেজের শিক্ষকদেরও অসম্মানিত করা হয়েছে। মর্যাদার দিক থেকে বেসরকারি শিক্ষকদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়েছে। পে-কমিশনে তাদের বিষয়ে স্পষ্ট কিছু না থাকায় দেশের এমপিওভুক্ত পাঁচ লাখ শিক্ষক এ নিয়ে দুর্ভাবনায় রয়েছেন। আমরা লাখ লাখ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর বিষয়টি আন্তরিকতার সঙ্গে বিবেচনার দাবি জানাই।
সব শেষে বলতে চাই, বর্তমান সরকার বেশি করে দেশের উন্নয়নের কথা প্রচার করতে চাইছে। এ উন্নয়নের সঙ্গে শিক্ষক সমাজেরও সংযোগ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে শিক্ষক সমাজের দাবি ও ন্যায্যতা উপেক্ষিত হলে দেশের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব হবে না। তাই প্রশ্ন জাগে, শিক্ষক সমাজ কি উন্নয়নের পরিমাপ সূচকের বাইরে? শিক্ষকরা সরকারের কাছে ন্যায্যতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা করে।
ড. মো. শামছুল আলম : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
0 comments:
Post a Comment